কানিজ পারিজাত এর গল্প ‘সাপলুডু’

কানিজ পারিজাত

হুট করেই ঘটল। মুমুর মনে হলো তার বুকের মাঝ বরাবর কে যেন হাতুড়ি দিয়ে বড়ো একটি পেরেক ঠুকে দিল।
দমবন্ধ লাগতে শুরু করল তার। মুঠোফোন হাত থেকে নামিয়ে রেখে বিছানায় বসা মুমু জানালা দিয়ে বাইরে
তাকায়। তিনতলার জানালার অদূরেই একটি বেলগাছ।
ঝিরঝির বাতাসে সবুজ সবুজ কচি পাতা অনায়াসে দুুলে দুলে যাচ্ছে। ডালের খাঁজে একটি পাখির বাসা।
কী সুন্দর কিছু খড়কুটো এনে বাসা বানিয়েছে পাখিটা।
মুমু হঠাৎ খেয়াল করলো সুন্দর এই দৃশ্যটা কিছুতেই তাকে আর আন্দোলিত করতে পারছে না।
অথচ কিছুদিন আগেও দু’চোখে প্রগাঢ় ভালো লাগা নিয়ে সে এই দৃশ্যটা দেখেছে।

সন্ধ্যা হয় হয়। খুট করে শব্দ হয় দরজায়। বন্দনাদি এসে ঢুকলো রুমে,
-দীনদার ক্যান্টিনে আজ চটপটি আছেরে মুমু, তাড়াতাড়ি যা শেষ হবার আগেই, খুব টেস্ট,
মুমু কোনো উত্তর দেয় না। কেমন শূন্য ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে থাকে। মুমুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থেকে বন্দনাদি বলে ওঠে
–আবার? আবার তোকে সাপে খেয়েছে?
-মানে? অস্ফুটে আস্তে আস্তে বলে মুমু–
মানে বুঝলি না?
অদ্ভুত এক হাসি দিয়ে বন্দনাদি বলে-সাপলুডু খেলেছিস কখনো? খুবই আনপ্রেডিক্টেবল খেলা।
একবার মইয়ের উপরে উঠলি কি পরমুহূর্তেই সাপে খেলো, আর অমনি নিচে নেমে গেলি!
মুমুর শূন্য নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকিয়ে বন্দনাদি ফের বলে– ধর, তুই সাপলুডুর কোর্টে চারের ঘরে আছিস।
গুটিতে দুুই-চার-ছয় পড়েছে। তুই তরতরিয়ে ঘর গুনে নয়ত মই বেয়ে উপরে উঠছিস। ছিয়ানব্বইতে পৌঁছে
গেছিস, চার পড়লে ঘরে উঠবি। সাতানব্বইয়ে বড়ো অজগর হা করে আছে।
এমন সময় তোর পড়লো পুট, মানে–এক, অমনি তুই অজগরের পেটে গেলি।
সোজা নিচে নেমে আসলি আবার চারের ঘরে। আবার তরতরিয়ে উঠলি, আবার সাপে খেল, নিচে নেমে গেলি।
কখন উপরে উঠবি আর কখন নিচে নামবি সবই আনপ্রেডিক্টেবল।
মুমু কোনো কথা না বলে চুপ করে তাকিয়ে থাকে বাইরে। ঘর অন্ধকার। বন্দনাদি বাতিটা জ্বেলে দেয়।
বন্দনাদি মুমুর রুমমেট।
ছয়মাস হলো এই রুমে এসেছে। জীবনে একাকী বন্দনাদি একটি কলেজে দর্শন পড়ায়। বয়স চল্লিশের
কোঠায় হলেও সুশ্রী বন্দনাদির মনের বয়স সবসময়ই একুশ।
ছয়মাসেই কেমন আপন করে নিয়েছে মুমুকে। কিছু কিছু মানুষ অদ্ভুত এক আবেশ নিয়ে আসে
পৃথিবীতে, চৌম্বকীয় আবেশ। নিজেরা কেন্দ্রে থেকে, চারপাশে তৈরি করে বলয়, আবেশের বলয়। বন্দনাদি
নিজের অজান্তেই এমন বলয় তৈরি করেছে।
কিন্তু যারা ভিন্ন কারণে তৈরি করে বলয়, বলয় গ্রাসের মতোই করে অধিগ্রহণ!
মুমুর হঠাৎ দমবন্ধ লাগতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে খুব কঠিনভাবে পেরেকটা বুকের ভিতর বসে আছে।
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার, ভারি কষ্ট। বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মুমু।

প্রধান সড়কের পাশেই তাদের এই হোস্টেল। কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল। একটা সি এ ফার্মে চাকরি করে মুমু।
চাকরির সুবাদে চার বছর ধরে আছে এই হোস্টেলে। বন্দনাদি নিচে যাচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে মুমুকে ডাকদেয়
–চল নিচে যাই।
টিভি রুমে, টিভি দ্যাখ, মনটা ডাইভার্ট করার চেষ্টা কর। মুমু পেছনে না ফিরেই বলে
–তুমি যাও।
দরজা থেকে ফিরে আসে বন্দনাদি। কাছে এসে দাঁড়ায়, শান্ত গলায় বলে
–দ্যাখ, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, এই ব্যাপারটা খুবই বায়বীয়। শুধু শুধু বায়বীয় বিষয়ের জন্য নিজেকে কষ্ট
দেওয়ার কোনো মানে হয়?
অন্ধকারেই চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলে মুমু
–উনি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন বন্দনাদি। একটু আগে দেখলাম, আমার নাম্বার
ব্লক করে দিয়েছেন- হঠাৎ করেই।
-তোর ঐ লোকটা? কি যেন নাম ওনার? -রেজোয়ান চৌধুরী। নামটা বলার সময় গলাটা আটকে আসে মুমুর।
মমতার একটি হাত পিঠে রাখে বন্দনাদি। ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
তারপর বলে– আমি নিচে গিয়ে তোর জন্য চা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে মুমু। রাস্তা
দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি। সারি সারি গাড়ি। হঠাৎ একটা ব্ল কালার এলিয়নের দিকে নজর যায় মুমুর। হোস্টেলের
গেইট ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে মুমুর।

দুই

হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে মুমু। ভিড়ের মধ্যে মানুষটা একটু পরপরই চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে।
মুমু পলকহীন চোখে ছুটছে। কোনোভাবেই আড়ালে যেতে দিতে চায় না মানুষটাকে। ভিড় এত বেশি যে ঠেলেঠুলে,
ছুটে ছুটেও মুমু কোনোভাবেই মানুষটার কাছে পৌঁছাতে পারছে না।
উহ! মানুষটা যদি একবার পেছনে ফিরে তাকাতো! ভিড় আর মানুষের ধাক্কা স্রােতের মতো ভাসাতে ভাসাতে মুমুকে
নিয়ে এলো নদীর পাড়ে। জাহাজের মতো দেখতে বড়ো বড়ো লঞ্চ দাঁড়ানো।
পাড় থেকে লঞ্চে ওঠার জন্য কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে মানুষেরা উঠে যাচ্ছে লঞ্চের ডেকে।
মানুষটাও উঠে যাচ্ছে একটা লঞ্চে। মুমু অনেকটা পেছনে।
চেষ্টা চালায় ভিড় ঠেলে যেকোনোভাবেই হোক লঞ্চে ওঠার, মানুষটার কাছে পৌঁছার।
কাঠের সিঁড়ির প্রায় কাছাকাছি মুমু এমন সময় সাইরেন বেজে উঠল, লঞ্চ ছেড়ে যাবার সাইরেন!
লঞ্চের ডেক থেকে কাঠের সিঁড়ি তুলে নেয়া হচ্ছে; মুমু চিৎকার দিয়ে ওঠে, কাকে যেন থামাতে চায়।
গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চায় না। চিৎকার দিয়ে মানুষটাকে ডাকার চেষ্টা করে মুমু।
কোনো আওয়াজই পৌঁছায় না যেন। একটু একটু করে লঞ্চটা সরে যাচ্ছে দূরে, মানুষটাও।

বন্দনাদির ধাক্কায় ঘুম ভেঙে যায় মুমুর। স্বপ্ন দেখছিল সে। কষ্টের একটা স্বপ্ন।
বন্দনাদি বলে ওঠে– ঘুমের মধ্যে কেমন গুমড়িয়ে গুমড়িয়ে কাঁদছিলি; স্বপ্ন দেখছিলি মনে হয়।
উত্তর না দিয়ে চুপ থাকে মুমু। বিছানার পাশে রাখা মুঠোফোনে একটা নাম্বার টিপে কানে ধরে।
তারপর হতাশ মুখে মুঠোফোন নামিয়ে রাখে বিছানায়।
বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে।
খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, অথচ ভেতরটা বরফের চাঁইয়ের মতো শক্ত, শীতল।
ঐ প্রান্তের বিছানায় গিয়ে শুয়ে মুমুকে খেয়াল করছিল বন্দনাদি। মুমুর উদ্দেশে বলে–
বাড়ি যাস না দেখি বেশ কিছুদিন। কয়েক দিন বাড়ি
থেকে ঘুরে আয়, ভালো লাগবে।
-কাথাও যেতে ইচ্ছে করছে না বন্দনাদি। কিছু ভালো লাগে না। কোনো কাজে মন বসে না।
মানুষটা কেমন বদলে গেল, হঠাৎ কেমন অচেনা হয়ে গেল। খুব বিষন্ন মুখে কথাগুলো বলে মুমু।
-হুম !
বেশ বড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বন্দনাদি, তারপর বলে–
এর মানে হলো, তুই অবজেক্ট হয়ে গেছিস।
মুমুর বিষন্ন মুখটার দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে–
এটাকে বলে ট্রান্সফরমেশন ফ্রম সাবজেক্ট টু অবজেক্ট। এই কাজটা ব্রিটিশরা করেছিল আমাদের সাথে।
প্রথম দিকে আমাদের গরীব মানুষগুলোকে বিনে পয়সায় খাওয়াতো চা।
তারপর যখন চা খাওয়াটা ওদের নিত্য অভ্যাসে পরিণত হলো, তখন ফ্রি খাওয়া দিলো
বন্ধ করে। নিয়ম করলো, চা খেতে গেলে পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হবে। মানে, বেনিয়ারা ঐ মানুষগুলোর
উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো। মানুষগুলোকে অবজেক্ট বানিয়ে ফেললো। তোর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিছুদিন
আগেও তুই সাবজেক্ট ছিলি। স্বাধীন, প্রাণবন্ত, উদ্যমী। কেউ একজন তোকে একটা নিয়মে অভ্যস্ত করলো,
তারপর হঠাৎ তোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো। তুই এখন অবজেক্ট, নিষ্প্রাণ, জড়বস্তুর মতো। বিছানা থেকে নেমে
জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মুমু। ভোর হয় হয়। আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে। অথচ মুমুর মনের
আকাশ কেমন মেঘে ঢাকা, অন্ধকার। -অন্তুর খবর নিয়েছিলি? পেছন থেকে প্রশ্ন করে বন্দনাদি। -রোজ-ই
তো কথা হয়।নির্লিপ্ত মুখে উত্তর দেয় মুমু। হঠাৎ ধমকে ওঠে বন্দনাদি– অন্তু যদি তোকে এমন দেখে, ওর
কেমন লাগবে বল তো? -ওর জন্যই তো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি। না হলে কবেই তো-ধীরে ধীরে গভীর থেকে
কথাগুলো বলছিল মুমু।
-এসব সস্তা সংলাপ বন্ধ কর। যেকোনো ঘন অন্ধকারের পরেই একটা ঝকঝকে সকাল আসে।

লাইফ ইজ বিউটিফুল। জীবন সুন্দর। বেঁচে থাকা তারচেয়েও সুন্দর।ধমকে উঠে বলে বন্দনাদি। জানালা দিয়ে
একটু একটু আসছে ভোরের আলো। বন্দনাদির মুখে সেই আলো পড়ে কেমন একটা আভা তৈরি করেছে।
বিষণ্ন মুমু সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে– মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে বন্দনাদি। গায়ে
মাথায় একটু জল ঢেলে আসি।
রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার করিডোর ধরে হেঁটে বাথরুমের দিকে এগোয় মুমু।
হঠাৎ নজর যায় উল্টোদিকের দোতালার করিডোরে। রুমি। মুঠোফোন কানে ধরে কথা বলছে হেঁটে হেঁটে।
রুমিকে দেখলে এখনও অবাক লাগে মুমুর। কেমন বদলে গেল মেয়েটা। বন্দনাদি আসার আগে সে-ই ছিলো
মুমুর রুমমেট। পিঠের ব্যথায় সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয় বলে তিনতলা ছেড়ে দোতালায় চলে গেছে। প্রথম দিকে
দেখা হলে হেসে কথা বলত, এখন কেমন অচেনা! সত্যি মানুষ কী বিচিত্র! বিচিত্র মানুষ বিচিত্রভাবে বদলায়,
ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মুমুর।

তিন

অফিসের ডেস্কে বসে কাজ করছে মুমু। বহুতল ভবনের আটতলায় বেশ পরিপাটি প্রাইভেট ফার্ম।
কিউবিক্যাল সিস্টেমে বসার ব্যবস্থা। আই সি এম এ কমপ্লিট করে আবেদন করেছিল মুমু।
চাকরিটা হয়ে যায়। সকালের টি-টাইমে সহকর্মী পিংকি এসে বসে মুমুর সামনে। -এ্যাই মুমু আপি, এমন
দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
মনে হচ্ছে ঠিকমতো সাজ করে আসোনি। মাঝারি গড়নের ত্রিশোর্ধ্ব মুমু বেশ মায়াবী মিষ্টি চেহারার।
পরিপাটি সাজ সবসময়ই তাকে একটি ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। গত কয়েকদিনে কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে
সব। মুমু যেন হারিয়ে ফেলেছে তার রঙ, তার সাজ, তার সত্তা। টুং করে আওয়াজ হলো ফোনে। মেসেঞ্জারে
বার্তা এসেছে।
আশান্বিত মুমু চমকে উঠে নিজের মুঠোফোন হাতে নেয়। নাহ! তার নয়, পিংকির। পিংকির ফোনে বার্তা
এসেছে। বুকের ভেতর আবার পেরেক বিঁধে থাকার অনুভূতি হতে থাকে মুমুর। মুঠোফোনে কিছু একটা
লিখতে থাকে পিংকি। তারপর গলা একটু নামিয়ে ফিসফিস করে বলে–
মুমু আপি, একটা ব্যাপার আছে জানো। এই ফ্রাইডেতে যাবো।
-কোথায়?
-ঐ যে সেই রিসোর্টে। দিনে গিয়ে দিনেই আসা যাবে। ওর পরিচিত এক বন্ধু ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
ও আর আমি, সারাদিন একসাথে রিসোর্টে, উহ! ভাবতেই কেমন যেন লাগছে আমার ! মুমুর থেকে বয়সে
খানিক ছোটো পিংকি তার বয়ফ্রেন্ড রঞ্জনের সাথে সারাদিন রিসোর্টে থাকার পরিকল্পনা করছে।
মুমু হঠাৎ প্রশ্ন করে, -শেষ পর্যন্ত তোমাদের বিয়েটা যদি না হয়?
-ধ্যাৎ, কী যে সব ব্যাকডেটেড কথা বলো না তুমি মুমু আপি! বিয়ে হবে কি হবে না, সেটা ভেবে এখনকার
আনন্দটা কি মাটি করব নাকি ? তুমি এখনও ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট যুগে আছ মুমু আপি। শোনো লাইফ ইজ
নট কালারলেস, ইট ইজ এনজয়েবল, রিলেশান ইজ এনজয়েবল। একটু অ্যাডভেঞ্চার না থাকলে রিলেশান
তো পানসে হয়ে যায়!
মুমুর সাথে রেজোয়ান চৌধুরীর রিলেশানটা পানসে হয়ে গিয়েছিল কি না তা জানে না মুমু। তবে এই অফিসেই
পরিচয় হয়েছিল তার, রেজোয়ান চৌধুরীর সাথে, বছর দুয়েক আগে। দুই বছর আগে এক ঝকঝকে সকালে
পরিপাটি রেজোয়ান চৌধুরী এসেছিল তার ডেস্কে। ক্লায়েন্ট হিসেবে, ট্যাক্স ফাইল নিয়ে। বস বাইরে। সম্ভ্রান্ত
সম্পন্ন ক্লায়েন্ট। মুমু কাফী ভাইয়ের রুমে নিয়ে বসাতে চায়। ব্যক্তিত্ববান মানুষটি আশ্বস্ত করেন; স্বাচ্ছন্দে
কাজ করতে পারে মুমু। উনি এখানেই বসবেন।

সেদিনের মতো কাজ শেষ হলে উঠে যাবার সময় মানুষটি হঠাৎ বলে ওঠেন–আপনার গানের রুচি ভালো।
অবাক হয় মুমু। পরে খেয়াল করে, ভদ্রলোক হঠাৎ আসায় বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল সে। খুব লো ভলিউমে
ডেস্ক কম্পিউটারে বেজে চলেছে গান। মুমুর পছন্দের গান। একটার পর একটা। আরো দুইদিন এসে কাজ
শেষ করেন ভদ্রলোক। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুই একটি কথা হয়। মুমুর সম্পর্কে জানতে চান। স্বল্প কথায়
উত্তর দেয় মুমু।
শেষের দিন উঠে যাবার সময় ফোন নাম্বার নিয়ে বলেন– আপনার কাজ খুব গোছানো। রিয়েলি ইউ আর
ইনটেলিজেন্ট অ্যান্ড সিম্পলি স্ট্যানিং। ভদ্রলোক চলে যান। মুমুও ভুলে যায়। তবে ভদ্রলোক ভোলেননি।
সাতদিন পরে হঠাৎ ফোন আসে। ভদ্রলোক ধন্যবাদ দিতে চায়– আপনি এত সুন্দরভাবে আমার ফাইলের
কাজ করেছেন, গ্রেট ফুল টু ইউ! মনে হলো আপনাকে ভালো করে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার।
‘ধন্যবাদ পর্ব’ দীর্ঘায়িত হয়।
ফোন রাখার আগে রেজোয়ান চৌধুরী ভরাট গলাটা একটু নামিয়ে বলেন– আপনার কণ্ঠটা খুব মিষ্টি।মুমু যেন
একটু নাড়া খায়। স্বামীহীন একাকী মুমুকে প্রতিনিয়ত বিপরীত মেরুর প্রশংসাবাণীতে ভাসতে হয়। তবু
রেজোয়ান চৌধুরীর প্রশংসা যেন একটু ভিন্ন, একটু আলাদা। সত্যিই সবার থেকে আলাদা ভিন্ন এক মানুষ
রেজোয়ান চৌধুরী।
পঞ্চাশোর্ধ বয়সেও মেদহীন পেটানো শরীর আর মার্জিত কথা তাকে যেন ভিন্ন এক মাত্রা এনে দিয়েছে। পরের
ফোনটা আসে তিন দিন বাদে। এরপর একদিন বাদে। তারপর প্রতিদিন। কথা বলে রেজোয়ান চৌধুরী। কথা
বলে মুমু। গান নিয়ে, দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, সংস্কার নিয়ে। কথা হয় সকালে, কথা হয় বিকালে, কথা হয় রাতে।
কথা হয় রেজোয়ান চৌধুরীর শূন্যতা নিয়ে, কথা হয় মুমুর জীবনের দুঃখ নিয়ে।
হঠাৎ একদিন রেজোয়ান চৌধুরী বলেন– ডু ইউ ফিল সামথিং?
-কী ফিল করব?
অবাক হয়ে জানতে চায় মুমু। রেজোয়ান চৌধুরীর ভরাট গলাটা নেমে আসে, খুব ধীরে ধীরে আবেশী এক গলায়
বলেন– উই আর ফ্লাইং লাইক বার্ডস, উই আর ফ্লাইং ইন দ্য সেইম স্কাই! আবেশ আসে মুমুর।
অদ্ভুত এক আবেশ।

বাতাসে ভেসে যাবার আবেশ। ডানা মেলে উড়ে চলার আবেশ। অমৃত জলে ডুবে যাবার আবেশ। আকণ্ঠ অমৃত
পানের আবেশ। আবেশ। আবেশ। আবেশ। সে রাতে ঘুমের মধ্যে একটি ভরাট কণ্ঠ মুমুর কানের কাছে বারবার
বলে ওঠে– উই আর ফ্লাইং ইন দ্য সেইম স্কাই। তিনদিন আর কোনও ফোন আসে না মুমুর। অধীর, অস্থির মুমু
অপেক্ষা করে প্রতিটা মুহূর্তে, প্রতিটা সেকেন্ডে। অপেক্ষা করে তার ফোনটা বেজে ওঠার, অপেক্ষা করে একটি
পরিচিত কণ্ঠ শোনার। তিনদিন পরে ফোন আসে। অফিস ফেরত মুমু পড়ন্ত বিকালে হেঁটে হেঁটে ফিরছিল।
হোস্টেলের পথের কাছে কামরাঙ্গা গাছের নিচে পৌঁছাতেই ফোনটা বেজে উঠলো, অস্থির মুমু একশ্বাসে বলে
ওঠে– কী হয়েছিল আপনার? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আপনি?
ভরাট গলাটা আবার নেমে আসে, মুমুকে থামিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বলে,
-রিল্যাক্স। তারপর আবার প্রশ্ন করে, -ডু ইউ ফিল সামথিং? কাঁপা গলায় উদভ্রান্তের মতো মুমু জানতে চায়–কী?
ধীর শান্ত গলায় ভরাট কণ্ঠ বলে ওঠে– আস্ক ইয়োরসেল্ফ।

চার

ডেস্ক ফোনটা বেজে ওঠে। চিন্তায় ছেদ পড়ে মুমুর। কাফী ভাই ডেকেছেন। অফিসের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড কাফী
ভাই। কাজকর্মে খুঁতখুঁতে ধর্মকর্ম করা ভালোমানুষ কাফী ভাই, বস বাইরে গেলে একটু বেশিই ডাকাডাকি করেন
মুমুকে। আড়চোখে তাকান। বাড়তি কথা বলেন। মুমু ঢুকতেই কাফী ভাই বলেন–
সব ঠিক আছে মুমু?
-কেন ?
-আপনাকে কেমন অ্যাবসেন্ট মাইন্ড মনে হচ্ছে। একটা ফাইল এগিয়ে দেন মুমুর দিকে– এখানে একটু ভুল
করেছেন, আপনি এত সিনসিয়ার, সাধারণত এমন ভুল হয় না আপনার। মুমু দেখে খুব সূক্ষ্ণ একটা ভুল। একটা
শব্দ- ধরার মতো নয়। এতে ফাইলের হিসেবেও কোনো প্রভাব পড়েনি। কাফী ভাই বলেন– অসুবিধা নাই, আমি
ঠিক করে দিয়েছি। তারপর কেমন আঠালো দৃষ্টিতে তাকান মুমুর দিকে।
-আপনার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে মুমু।
-কেন?
-এই যে একাকী জীবন আপনার। ভাবতে গেলেই খুব কষ্ট লাগে। একা থাকা খুব কষ্টের।
-একা কোথায়? আমার ছেলে অন্তু আছে আমার সাথে।
-হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে অন্তুও তো একদিন বড়ো হবে। ওর বয়স যেন কত? কোনো ক্লাসে পড়ে এখন?
-এগারো বছর। ক্লাস সিক্স।
-সেটাই, ও আস্তে আস্তে বড়ো হবে, ব্যস্ত হবে। আপনি আরো একা হয়ে যাবেন। ওর জন্য এখন লাইফ স্যাক্রিফাইস
করছেন, অথচ এমন একটা সময় আসতে পারে, যখন জীবনের রূপ-রস-গন্ধ উপভোগের সময় শেষ! মুমু কোনো
কথা বলে না, চুপ থাকে। কাফী ভাই আবার আঠালো চোখে তাকান। তারপর ভেজা ভেজা গলায় বলেন– আপনি
চাইলে কিন্তু নিজেকে ভালো রাখতে পারেন মুমু। মাঝে মাঝে ঘুরতে যেতে পারেন সুন্দর জায়গায়। চলেন,
আপনাকে একদিন বেড়িয়ে নিয়ে আসি। শিমুল ঘাট। খুব সুন্দর জায়গা, কাছেই একটা গোলাপ বাগান আছে। লঞ্চে
করে যেতে হবে। আড়াই ঘণ্টা লাগে। অসুবিধা নাই। কেবিন নিয়ে যাব। ভি. আইপি কেবিন। দিনে যাওয়া, দিনে আসা।

কিছুক্ষণ চুপ থাকে মুমু। তারপর বলে– আমি লঞ্চে উঠতে ভয় পাই। তারচেয়ে বরং একদিন আপনার বাসায় যাই। ভাবি
নাকি খুব সুন্দর রান্না করে। ভাবির হাতের রান্না খাবো। সারাদিন বেড়াবো। অনেক মজা হবে।উঠে আসার সময় মুমু
দেখতে পায় মুখটা গম্ভীর হয়ে গেছে কাফী ভাইয়ের।

পাঁচ

পড়ন্ত বিকেলে হেঁটে হেঁটে ফিরছে মুমু। হোস্টেলের পথের কাছের কামরাঙা গাছটার নিচে এসে থমকে দাঁড়ায়। গাছের
নিচে ফুল, বেগুনি রঙের ছোটো ছোটো ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেদিন এখানেই ফোনটা বেজে উঠেছিল; ভরাট কণ্ঠ
ধীরে ধীরে বলেছিল, ‘আস্ক ইউরসেলফ’। ফোনটা কেটে যায়, মুমু দাঁড়িয়ে থাকে অবশ-বিমূঢ়। মাথার ওপর ঝরে পড়ছিল
একটা-দুটো ফুল, ছোটো ছোটো ফুল, বেগুনি রঙের ফুল। মাথার উপর ঝরছে ফুল,মুমুর মনে ফুটছে ফুল ! সেই ফুল
ফোটার আবেশে বুঁদ হয়ে যায় মুমু। আনমনে বলে ওঠে, কে তুমি ফুল ফোটাও? কে তুমি সুবাস ছড়াও? কে তুমি? কে
তুমি? কে? রেজোয়ান চৌধুরী আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ববান, সফল, কিন্তু মানসিকভাবে শূন্য এক মানুষ। মুমুর মনের শূন্য
আঙিনায় তিনি ফুল ফুটিয়ে দেন। একটার পর একটা ফুটতে থাকে ফুল, রঙিন রঙিন ফুল। মুমু ঘুমোতে যায়। কে যেন
বলে ওঠে, ‘আস্ক ইয়োরসেল্ফ’। মুমু হেঁটে যায়- কে যেন বলে ওঠে ‘আস্ক ইয়োরসেল্ফ’। মুমু কামরাঙা গাছটার নিচে এসে
দাঁড়ায়- কে যেন বলে ওঠে ‘আস্ক ইয়োরসেল্ফ’। দুইদিন নীরব থেকে আবার বেজে ওঠে ফোন। দুর্বল, দ্রবীভূত মুমু
অস্ফুটে বলে– আমি…ওপাশের ভরাট কণ্ঠ বলে,
-জানি, উয়ি হ্যাভ সেইল্ড আওয়ার বোট!কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুমু ভাঙা গলায় বলেছিল– কিন্তু আমার অন্তু ?…
আমি তো কোনোদিন কারো সাথে জড়াতে পারব না। আমার অন্তুকে নিয়ে জীবন পাড়ি দিতে হবে।
-জানি, আপনি নিশ্চিন্তে অন্তুর হাত ধরে জীবনের পথ চলুন। আমি বন্ধু হয়ে থাকবো পেছনে, কোথাও অন্ধকার দেখলে
আলো জ্বেলে দেব। সত্যিই রেজোয়ান চৌধুরী বন্ধু হয়েই ছিল। মুমুর বন্ধু, খুব আপন বন্ধু। নাহ্ ! কাফী ভাইদের মতো
লঞ্চে করে বেড়াতে নিয়ে যেতে চাননি, রঞ্জনের মতো রিসোর্টে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করেননি। তিনি শুধু আলো জ্বেলে
গেছেন। মুমুর জীবনের আলো। লাল-নীল আলো। রঙিন রঙিন আলো। তারপর হঠাৎ করেই সব কেমন বদলে যেতে
লাগল। একটু একটু করে আলো নিভে যেতে লাগলো। চারপাশে নেমে এলো অন্ধকার। সে অন্ধকারে মুমু দাঁড়িয়ে- একা।
ভীষণ একা- এক প্রশ্নচিহ্ন হয়ে।

ছয়

-উনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে? -কার কথা বলছো? বন্দনাদির প্রশ্নের উত্তরে জানতে চায় মুমু। সন্ধে হয়ে গেছে। মনমরা মুমু
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। বন্দনাদি আচারের তেল দিয়ে বিছানায় বসে মুড়ি মাখছেন। মুড়ি মাখতে মাখতে বলেন
–তোর ওই লোকটার কথা বলছি।
-উনার স্ত্রীর সাথে সেপারেশান চলছে। ছেলেমেয়েরা উনার কাছে থাকে, আবার স্ত্রীর কাছেও। বাইরে থেকে কত সফল
একজন মানুষ অথচ ভেতরে ভেতরে কত শূন্য ছিল! কত একা! মানুষটা হঠাৎ বদলে গেল কেন বন্দনাদি? ভেতর থেকে
গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুমু ধীরে ধীরে বলে– গত কয়েক মাসে কেমন অচেনা হয়ে গেল ! ফোন দিলে বিরক্ত হতো।
অল্প কথায় ফোন রেখে দিত। কেমন যেন এড়িয়ে যেত। আমার সাথে আগে যে সময়ে কথা বলতো, সেই সময়ে
কয়েকবার আমি তার ফোন ব্যস্ত পেয়েছি, জিজ্ঞেস করলে রেগে যেত। আমার সাথে রাগ করে দু’বার আমার ফোন
-নম্বর ব্লক করে দিয়েছিল। সেদিন দেখি কোনো কারণ ছাড়াই ব্লক করেছে। মানুষটা আমার সাথে আর নেই !
আমি এখন বন্ধুহীন!
এমন কেন হলো বন্দনাদি?

একমুঠো মুড়ি মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বন্দনাদি বলে– দারুণ স্বাদ হয়েছেরে মুমু ! আয় , খেয়ে দ্যাখ। তারপর
বলে–শোন, রোজ রোজ ক্যান্টিনের ওই দীনদা’র চা-পুরি কি খেতে ভালো লাগে? তাই তো মাঝে মাঝে মুখের স্বাদ
পরিবর্তন করতে হয়। এই যেমন মুড়ি মাখা মুখে ভিন্ন স্বাদ এনে দিল ! সম্পর্কও তেমনই। সম্পর্কেও মাঝে মাঝে স্বাদ
বদলাতে হয়।
-মানে?
কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চায় মুমু। মুড়ির বাটিটা মুমুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বন্দনাদি বলেন–একই মানুষের সাথে
একই সম্পর্ক- রোজ রোজ যদি মুরগি আর ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খাস তাও একঘেঁয়ে লাগবে। তাই তো মানুষ মাঝে
মাঝে চাপিলা মাছের ঝোল, একটু আমড়ার খাট্টা খোঁজে; স্বাদ পরিবর্তন করতে চায়।
-উনি অমন নয় বন্দনাদি। জীবনে বহু সময় বহু রাত উনি একা পাড়ি দিয়েছেন, নিদ্রাহীন থেকেছেন, রাতের পর রাত।
-হুম, বুঝেছি, তুই হয়ে উঠেছিলি তার নিদ্রাকুসুম। নিদ্রাহীন মানুষের নিদ্রাকুসুম তেল !
বন্দনাদির কথার উত্তরে কথা বলতে গিয়ে মুমুর চোখ হঠাৎ প্রধান সড়কের ওপর আটকে যায়। একটা ব্লু রঙের
এলিয়ন হোস্টেলের গেইটের কাছে এসে থামল; রেজোয়ান চৌধুরীর গাড়ি! এত চেনা! ভুল হবার কথা নয় মুমুর!
বহুদিন মুমুকে অফিস থেকে এই গাড়িতেই হোস্টেলের গেইটে নামিয়ে দিয়ে গেছেন রেজোয়ান চৌধুরী। তারপরের
দৃশ্যটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না মুমু। একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নামছে; সুসজ্জিত পোশাকে ঢাকা মেয়েটি মুমুর
খুব চেনা- রুমি!

সাত

ভেঙে পড়েছে মুমু। ভীষণ ভেঙে পড়েছে। আগে কোনোদিন এতটা ভেঙে পড়েনি সে। জীবনে একটি ভুল বিয়ে হয়েছিল
তার, ভুল মানুষের সাথে। মাত্র একুশ বছর বয়সে বিয়ের একবছর পরে অন্তুর জন্ম। দিনের পর দিন সেই ভুলের মাশুল
টানতে টানতে ক্লান্ত নিপীড়িত মুমু ঘুরে দাঁড়ায়। ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে আসে। জীবনে এগোতে চায়। অন্তুকে মানুষ
করতে চায়। মা বাবার কাছে ছেলেকে রেখে চাকরিতে ঢুকেছিল সে। অন্তুর জন্যই লড়াই। জীবনের পথে চলার লড়াই।
কখনও এতটা ভেঙে পড়েনি সে। রেজোয়ান চৌধুরী মানুষটাকে খুব আপন ভেবেছিল! আর রুমি? মুমুর রুমমেট ছিলো।
কত স্নেহ করতো মুমু মেয়েটাকে! কত বিশ্বাস করতো! সব কথা বলতো। নিজের কথা, রেজোয়ান চৌধুরীর কথা। সেই রুমি!
এই জন্যেই রুমি রুম বদল করে তাড়াতাড়ি চলে গেল! এই জন্যেই মুমুকে দেখলে এড়িয়ে যেত, চিনতে চাইতো না!
মুমু রঙহীন হচ্ছিলো আর রুমি হয়ে উঠছিল একটু একটু করে রঙিন!

সন্ধ্যার পর হোস্টেলের তিনতলায় শাহনাজ আপার রুমে অনেকেই জড়ো হয়েছে। দোতলায় রুমিকে ডেকে আনতে পাঠানো
হয়েছে। শাহনাজ আপা বন্দনাদির মতোই একটি কলেজে পড়ান। হোস্টেলের নিয়ম শৃঙ্খলার বিষয়ে মতামত দেন, সবাই
তাকে খুব মানে। সোহেলী নামের একজন বলে ওঠে, কীভাবে পারলো? কি চিজ্-রে বাবা। অপরাজিতা বলে,
-খুব চাল্লু মেয়ে! প্রথম দিকে কেমন ছিলো, মনে আছে? ক্ষ্যাত, কেমন সব জামা পরতো! ওদের দুইজনকে থামিয়ে দিয়ে ইরা
বলে,-শোনো, এসব মেয়ে হচ্ছে লোভী। ওরা যা করে, উদ্দেশ্যেই করে। আমি খবর নিয়েছি, ঐ লোককে ধরেই ও নাকি নতুন
চাকরিটা পেয়েছে! ভালো বেতনের চাকরি। সাধে সাধে কি আর অত ডাঁট আসে! সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বন্দনাদি বলে–
তোমরা এত কিছু দেখছো, লোকটার দোষ দেখছো না? রুমি কি একাই? লোকটাও তো বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে! রুমি এসে ঢুকল।
সবাই থেমে যায়। শাহনাজ আপা বলেন, রুমি, তুমি মুমুর সাথে রুমে ছিলা একবছর। তাই না?
-জ্বি, রুমি মাথা নিচু করে উত্তর দেয়।
-রেজোয়ান চৌধুরীর সাথে মুমুর বন্ধুত্বের কথা তো তুমি জানতে?-
জ্বি।
-তুমি কীভাবে এই কাজটা করতে পারলে? তুমি তার সাথেই বন্ধুত্ব করে ফেললে! মাথা নিচু করেই,
রুমি বলে– উনি মুমু আপুর বন্ধু বলে যে আমার বন্ধু হতে পারবে না এমন তো কোনো কথা নেই। সকলে হৈ হৈ করে ওঠে,
-এই মেয়ে, ফাজিল মেয়ে, নির্লজ্জ মেয়ে, তোমার জন্যেই তাদের বন্ধুত্ব ভেঙে গেছে, মুমু মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছে।
তুমি মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়ের সর্বনাশ করো! কয়েকজন রুমির দিকে ধেয়ে যায়। শাহনাজ আপা সবাইকে থামিয়ে দেন,
কঠিন মুখে বলেন– সব কিছুর একটা নিয়ম আছে, এই হোস্টেলে আমরা কিছু নিয়ম মেনে চলি। শোনো রুমি, তুমি দেখলে সে
মুমুর বন্ধু, সেটা জেনেও তুমি তোমার রুমমেট, তোমার সিনিয়র আপুর বন্ধুর সাথে গোপনে গোপনে যোগাযোগ করলে। বন্ধুত্ব
করলে। একজনের ক্ষতি করে লাভবান হতে চাইলে! বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুমি মাথা নিচু করে বলে–
আপু এইটা মুমু আপুর ব্যর্থতা যে, উনি ওনাকে ধরে রাখতে পারে নাই, আর এইটা আমার সাফল্য যে আমি ওনাকে জয় করেছি!
উত্তরটা শুনে রুমে উপস্থিত সকলেই কেমন স্তম্ভিত হয়ে যায়!

আট

হুট করেই ঘটল। মুমু চুপচাপ বসেছিলো টিভি রুমে। সন্ধ্যাটা
টিভি রুমে এসে বসে থাকে একা একা। বন্দনাদি দীনদা’র ক্যান্টিন থেকে চা হাতে এগিয়ে আসে।
-অন্তু এখন কোন ক্লাসেরে?
-ক্লাস সেভেনে উঠেছে, এই বছর শেষে ওকে ক্যাডেটে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াবো ভাবছি।
-ভালো। টুং করে একটা আওয়াজ হয় ফোনে। মেসেঞ্জারে বার্তা এসেছে। আলগোছে ফোনটা তুলে হাতে নেয় মুমু।
-মিসিং ইউ! রেজোয়ান চৌধুরীর মেসেজ ! বেশ অবাক হয় মুমু। কিছু না বলে ফোনটা নামিয়ে রাখে। টিভি রুমে অল্প গুটিকতক
মেয়ে। হঠাৎ কোণায় নজর যেতেই চমকে উঠে মুমু। রুমি ! এককোণায় বসা। থমথমে, ফ্যাকাসে, রঙহীন। মনে হচ্ছে জীবনের
সব রঙ যেন হারিয়ে ফেলেছে। মুমুর মনে হলো, রুমির বুকের ভেতরেও কেউ মনে হয় পেরেক ঠুকে দিয়েছে!
পাশ থেকে ফিসফিস করে ওঠে বন্দনাদি,
-সাপে খেয়েছে! এইবার ওকে সাপে খেয়েছেরে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *