ছোটগল্প// কুণ্ডুলি// আসাদ জোবায়ের

আশ্বিন মাসের শিরশিরে হাওয়ায় কেঁপে ওঠে শিউলির বাড়ন্ত শরীর। কাঁটা দিয়ে ওঠে লোম। কাঁথা টেনে ওম নেওয়ার চেষ্টা করে। পাশে শুয়ে থাকা ছোট বোন সেফালি ও সেলিমার গায়েও কাঁথা উঠিয়ে দেয়। ঐ দূরের ফাঁপোর বিল থেকে কোনো এক নিশাচর পাখির একটানা ‘কোয়াক, কোয়াক’ ডাক ভেসে আসছে। এপাশ ওপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় শিউলি। হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে দৌড়ে জানালার কাছে যায়। দক্ষিণের জানালা খুলে দেখে নেয় বাইরেরটা। চাঁদ হেলে পড়েছে পশ্চিমে। পূবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে মোরগের ডাক। না, আর দেরি করা ঠিক হবে না। ঝট করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে শিউলি। বাইরে তখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চাচাদের ঘরের পেছনের জানালায় গিয়ে আতাউলকে ডাক দেয় সে। আতাউল তার চাচাতো ভাই, বছর দুয়েকের ছোট। দুইবার ডাকতেই কাঁইকুঁই করে সে জবাব দেয়।

এরপর মুরগির ঘরার উপর থেকে টেনে একটা ঠেলা জাল, বড় দুটো থালা ও বদনা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিউলি। আতাউলও বেরিয়ে আসে একটা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরে। ঠেলা জালটা সে কাঁধে নেয়। হাঁটতে থাকে শিউলির পিছু পিছু। শিউলির গায়ে একটা ফ্রোক। বারো কি তেরো বছর বয়স হবে তার।
গ্রামের মেঠো পথ ধরে মাঠের দিকে এগিয়ে যায় ওরা। শরতের ঠাণ্ডা বাতাসে শিউলির চুল পেছনে উড়তে থাকে। ঠাণ্ডায় গায়ের লোম কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে যায়।
উউ… বুবু, জাড় লাগিচ্চে তো।
হ.. জাড়ের দিন আসিচ্চে না..। অ্যাকন অ্যানা জাড় লাগবিই। কামত হাত দিলেই গাও গরম হয়্যা যাবি।
হ ঠিক কচা বুবু। পানিও তো কম ঠাণ্ডা হবিনে! বরপের লাকান। উউউ…।
চুপ কর তো আতাউল। অতো কতা কসনে। অ্যাকনো সকাল হয়নি। মানষে কবি কি?
আচ্চা।

নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে শিউলি ও আতাউল। ওরা যাচ্ছে জমি সেঁচে মাছ ধরার জন্য। নিচু ধানের জমিতে এখন প্রচুর মাছ। গতকাল বিকেলে ওরা একটা জমি নির্বাচন করেছে। জমির মালিককে ওরা চেনে না। গাঢ় সবুজ ধানের গাছ লকলক করছে। নিচের পানিতে মাছ খলবল করছে। আশপাশের জমিতেও মাছ আছে। সেগুলোকেও এই জমিতে আনতে হবে। এজন্য নির্বাচিত জমিতে খাবার দিতে হবে।

মাছের খাবার শিউলি নিজেই বানাতে পারে। বিকেলে বাড়ির আঙিনায় সে মাছের খাবার বানানোর আয়োজন করে ওরা। আতাউল কোদালে কওে গরুর গোবর নিয়ে আসে। শিউলি ঘর থেকে এক গামলা ধানের কুড়া নিয়ে আসে। পালা থেকে নিয়ে আসে কিছু খড়। প্রথমে কিছুটা কুড়া মাটিতে বিছিয়ে দেয়। তারপর কাঁচা গোবর ভেঙে ছিটিয়ে দেয়। তার ওপর আরেক স্তর কুড়া বিছিয়ে দেয়। এরপর আবার গোবর, তার ওপর কুড়া দিয়ে ঢেকে দেয়। এবার খড় দিয়ে পুরোটা মুড়িয়ে দেয়। খড়ে ম্যাচ ঠুকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় শিউলি। খড়ের আগুনে চকচক করে ওঠে শিউলিদের মুখ। চোখের মধ্যেও আগুনের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। এক সময় সব খড় পুড়ে আগুন নিস্তেজ হয়ে যায়। ওপর থেকে সাবধানে ছাই সরিয়ে দেয় শিউলি। তারপর আধা-পোড়া কুড়া ও গোবর মিশিয়ে ফেলে। মো মো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশ। গন্ধ শুকে বড় পেট নিয়ে বেরিয়ে আসে শিউলির মা।
ওই ছুড়ি, আজগে হামার শরীলডা ভালো লাগিচ্চে না। তুই কুন্টিও যাসনে। মাছ ধরা তোর লাগবিনে আজ।
কিন্তু মা, ঘরত্ যে চাউল নাই। কাল খামো কি?
চাউল নাই সেই চিন্তা তুরই করা লাগবি? তোর বাপ আছে না? কুঁড়ে এক মান্ষেক লিয়ে হামার হচে যত জ্বালা।
শিউলি আর কথা বাড়ায় না। বাবা তার কাজ-কাম কিছু করে না। চার বোনসহ ছয় জনের সংসার কীভাবে চলে তা কেউ বোঝে না। মা সুস্থ-সবল থাকতে এর বাড়ি ওর বাড়ি কাজ করে চালিয়েছে। এখন সেও কাজ করতে পারছে না। শিউলি বড় মেয়ে। দায়িত্বটা আপনাআপনি তার কাঁধে চলে এসেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন জমি সেঁচে মাছ ধরে বিক্রি করেই আপাতত চলছে। এছাড়া ধান কাটার সময়ে ধানের শীষ কুড়িয়ে, আলুর সময়ে আলু তুলে দিয়ে মায়ের সংসারে সে সহযোগিতা করে। তাছাড়া গাছ থেকে ডাল ভেঙ্গে শুকিয়ে চুলার খড়ি বানানো, বাড়ির পেছনে ছোট্ট এক টুকরো জমিতে বেগুন, পোটলের চাষ, দুটো গরুর দেখাশোনা- মায়ের সাথে সব কাজই করে শিউলি। সে যে মেয়ে, মনেই থাকে না তার। ক্লাস ফাইভ পাস করে হাইস্কুলে আর ভর্তি হওয়া হয়নি। কিন্তু ছোট তিন বোনের লেখাপড়া সে চালিয়ে নিতে চায়। ওদের ভাই নেই, ছোট বোনদের সে দুঃখ বুঝতে দেয় না শিউলি। সে নিজেই বড় ভাইয়ের ভূমিকায় নেমে পড়েছে।
দুই হাতে ভালো করে মাছের খাবার মিশিয়ে নেয় শিউলি ও আতাউল। তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার হয়ে এলে তারা চলে যায় সেই জমিতে। টর্চের আলোয় জমির চারপাশের আল ভালো করে দেখে নেয়। চারপাশে চারটা ছেঁড়া রেখে বাকিটা কাদা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এরপর গামলা থেকে খাবার নিয়ে ছিটিয়ে দেয় পুরো জমিতে।

শরৎ শেষ হতে না হতেই যেন শীতের মহড়া শুরু হয়েছে। শিশিরে ভিজে গেছে ঘাস, ধানের গাছ। ভোর রাতে সরু আল ধরে হাঁটছে শিউলি ও আতাউল। দুই হাতে থাকা বদনা ও ঠেলা জাল দিয়ে ধানের গাছ সরিয়ে দিচ্ছে তারা। তবু গায়ের সাথে লেগে ভিজে যাচ্ছে শিউলির ফ্রক, আতাউলের প্যান্ট, শার্ট। বরফের মতো ঠান্ডা। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে ওরা। ভোর রাতের এই পুবাকাশ খুব চেনা ওদের। স্তরে স্তরে মেঘের দলা। সূর্যের উপস্থিতিতে লাল রক্তিম হয়ে উঠেছে। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সূর্য্যরে আলোর রেখা। যেন ঐ দূরের কোনো জায়গা থেকে আকাশে অসংখ্য রঙিন তীর ছুড়ে মারা হয়েছে। তীরগুলো মেঘের স্তর ভেদ করে অনেক উপরে চলে গেছে। আর তীরের আঘাতে জর্জরিত মেঘগুলো রক্তিম বর্ণ হয়ে গেছে। শিউলি আকাশের দিকে তাকায়। মেঘেরা সূর্য্যরে দেখা পেয়েছে। এই মাটি, এই ধানের জমি সূর্য্যরে দেখা পাওয়ার আগেই তাদের কাজ সারতে হবে। তাই দ্রুত পা চালায় শিউলি। পেছনে পেছনে আতাউল। সে কয়েক বার আল থেকে পা পিছলে পড়ে গেছে। আবার উঠে দৌড়ে শিউলি বুবুর কাছে চলে এসেছে।
নির্ধারিত জমির আলে বিড়ালের মতো চুপিচুপি পা রাখে ওরা। লকলকে ধান গাছের নিচে পানি খলবল করছে। শিউলির বুকের ভেতরটাও খলবল করে উঠলো। হাতের সরঞ্জাম এক পাশে রেখে চারপাশের আলের ছেঁড়া অংশ দুইজনে মিলে আটকে দেয়। এরপর জমির সবচেয়ে নিচু অংশে গিয়ে টান মেরে কয়েক গোছা ধানগাছ মাটিসহ তুলে ফেলে। এক পাশে যত্নে করে রেখে দেয় সেগুলো। মাছধরা শেষ হলে সেগুলো আবার আগের জায়গায় রোপন করে যেতে হবে। এভাবে গোল একটা জায়গা ফাঁকা করে ফেললো ওরা। নিচ থেকে মাটি সরিয়ে দিল। এটাকে বলা হয় ভাতি। আলের বিপরিতে একটা কলমিতলা ভেঙ্গে এনে তার সাহায্যে ঠেলাজাল সেট করলো ওরা। এরপর হাতে থালা নিয়ে নেমে পড়লো ভাতিতে। পানি সেঁচে ঠেলাজালে ছুড়ে দিল। কখনো কখনো সামনে থেকে কখনো উপুড় হয়ে পেছন দিক হয়ে দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে পানি সেঁচতে থাকে তারা। ঠেলাজালে জমা হতে থাকে বড় বড় পুঁটি, টেংরা মাছ। কখনো লাফিয়ে উঠে আলের ওপর ছটফট করতে থাকে। শিউলি তা ধরে ঠেলাজালের পানিতে ছেড়ে দেয়।
সূর্য্য উঁকি দিচ্ছে পুব আকাশে। ধানগাছের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নেয় শিউলিও। আজ বড় দেরি করে এসেছে ওরা। সকাল হয়ে গেলে জমির মালিক চলে আসতে পারে। বিপদে পড়ার ভয় আছে। কেড়ে নিতে পারে সব মাছ। তাই জোরে জোরে হাত চালায় শিউলি। পা ঠাণ্ডায় যেন জমে যাচ্ছে। তবু কিচ্ছু করার নেই। পানি যতো কমে আসছে ততো মাছের আনাগোনা বাড়ছে। পায়ের নিচে এসে ঢুকে যাচ্ছে বাইম কিংবা টাকি মাছ। ধরে ধরে তা ঠেলা জালের মধ্যে ছুড়ে মারে ওরা। পানি আরো কমে এলে ভাতি থেকে জমির মাঝ বরাবর কাদা সরিয়ে একটা নালা করে দেয় শিউলি। এবার নালা দিয়ে সুড়সুড় করে পুঁটি, টাকি, টেংরা, শিং মাছ চলে আসতে থাকে। ওরা থালা দিয়ে পানির সাথে ওগুলো ঠেলাজালের মধ্যে ছুড়ে মারতে থাকে।
ইশ বুবু! চিৎকার করে ওঠে আতাউল।
কী হচে রে?
আতাউল হাত বাড়িয়ে দেয়। ডান হাতের মধ্যমা আঙুল থেকে রক্ত বের হচ্ছে। শিং মাছ কাঁটা ফুটিয়ে দিয়েছে। শিউলি হাতটা নিয়ে আঙুলে চাপ দিয়ে রক্তের সাথে বিষ বের করে দেয়। ব্যাথায় ছটফট করতে থাকে আতাউল।
আচ্চা তুই আলত্ উটে বসে থাক। হামি একলাই পারমো অ্যাকন। পানি কমে গ্যাছে।

শিউলির কথায় আতাউল আলে উঠে বসে থাকে। শিউলি আবার পানি সেঁচে। আজ অনেক মাছ। এই মাছ ধরে সে বাড়ি যাবে। গোসল করে, জামা পরিবর্তন করে মাছ নিয়ে বাজারে যাবে। বিক্রি করে চাল কিনে বাসায় ফিরবে। ওদিকে মায়ের অসুখ। পেটটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। বাবা একটা ছেলে চায়। শিউলিকে দিয়ে তার হচ্ছে না। ছেলে দরকার। বংশের মুখ রাখতে হবে তো। বাবার অসহায় মুখ ভেসে ওঠে শিউলির চোখে। অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছেন উনি। দোকান দিয়েছেন, হাটে হাটে ধান কেনা-বেঁচার ব্যবসা করেছেন, গঞ্জে গিয়ে বুট মাখা বিক্রি করেছেন, পিঠে করে আইসক্রিমের বাক্স নিয়ে এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন, আঁচার বিক্রি করেছেন- কিন্তু কোনো কিছুতেই বাবার মন টেকে না। দুইএক মাস পরেই নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। এই করতে গিয়ে জমিও বিক্রি করেছেন। শেষ পর্যন্ত খালি হাতে এখন ঘরে বসে থাকেন আর মায়ের বকুনি খান। এখন একটা ছেলে দরকার। একটা ছেলে হলেই এ সংসারে সুখ ফিরে আসবে এটা বাবার বিশ্বাস। ছেলে একটু বড় হলেই লেদ মেশিনের কাজে পাঠিয়ে দেবে বাবা। এভাবেই দিন ফিরে আসবে। সেই আশায় দিন গুনছেন তিনি। বাবার ছেলের অভাব পুরণ করতে পারছে না বলে শিউলির খারাপ লাগে। বুক ভেঙ্গে যায়।

চোখের জলে ভাবনার সাগরে ভাসতে ভাসতে কখন পানি শুকিয়ে গেছে টেরই পায় না শিউলি। খরখর করে আঁকিরযুক্ত কাদা উঠতে থাকে থালার সাথে। একটা বড় তেলাপিয়া মাছ ভাতির মধ্যে চলে আসা দেখে চিৎকার করে ওঠে আতাউল। তার চিৎকারে বাস্তবে ফিরে আসে শিউলি। মাছটা ধরে ঠেলাজালের মধ্যে ছেড়ে দেয়। একবার দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখে নেয়। সকাল হয়ে গেছে। কুয়াশা ভেদ করে হালকা রোদ এসে পড়েছে ওদের গায়ে। একটু ভয় পেয়ে যায় শিউলি। কেউ এসে গেলেই বিপদ। তাড়াতাড়ি মাছ খুটে নিয়ে সটকে পড়তে হবে এখান থেকে। হাতে বদনা নিয়ে ধানগাছ ফাঁক করে করে ভেতরে ঢুকে যায় সে।
শিউলি বু, হামার হাত ফুলে গ্যাছে। বেদ্না হচ্চে।
শিউলি কোনো কথা না বলে মাছ খুটতে থাকে। এখন কথা বলার সময় না। টপাটপ মাছ ধরে বদনায় রাখে। একটু পরপর বদনার মাছ ঠেলাজালের পানিতে ছেড়ে দিয়ে যায়। মাছগুলো জালে আবদ্ধ পানিতে খলবল করে সাঁতার কাটতে থাকে। আতাউলের খুব ভালো লাগে। বসে বসে মাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক্ষণ বসে থাকতে থাকতে তার হাঁটু লেগে যায়। একটু উঠে দাঁড়ায় সে। অমনি কেউ একজন দেখে ফেলে তাকে। বুঝতে পেরে সাথে সাথে বসে পড়ে আতাউল। ফিসফিস করে বলে-
বুবু, একটা মানুষ এদিক আসিচ্চে। হামাক দেকিচে মনে হচ্চে।
হিস…। লোক করে বসে থাক। এনাও লড়বুনো।
শিউলিও চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে থাকে। নিঃশ্বাস তার বড় হতে থাকে। আজ ধরা পড়লে সব শেষ। ঘরে চাল নেই। এই মাছ বিক্রি করে তবেই না খাবার জুটবে বাড়ির সবার। শিউলি বুঝতে পরে কেউ একজন আসছে এদিকে। ঝুপঝুপ পানির শব্দ হচ্ছে। শব্দটা আরো কাছে চলে আসে। একটু পরেই ঠাস ঠাস করে দুটো শব্দ হয়। আর ভ্যা করে কেঁদে ওঠে আতাউল। শিউলি কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।
এই ছোড়া, তুরকেরে সাহস তো কম না। হামার ভিউওত মাছ ধরিচ্চু। ধানগুলো শ্যাষ করে ফেলিচ্চু। তোর সাথে আর কে আছে ক? বলেই লোকটা আতাউলের কান ধরে দাঁড় করায়।
শিউলি বু… বলে চিৎকার করে ওঠে আতাউল। আর স্থির থাকতে পারে না শিউলি। সে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না।
ওই ছুড়ি, এদিক আয়। তোক্ তো চেনা চেনা মনে হচ্চে। উত্তর পাড়াত বাড়ি, না?
শিউলি এগিয়ে আসে। চোখে-মুখে ভয়। আতঙ্ক। লোকটা দক্ষিণ পাড়ার হবে হয়তো। চেনা চেনা হচ্ছে, রাস্তাঘাটে দেখেছে। কেমন খাটাসের মতো তাকিয়ে আছে শিউলির দিকে। গায়ে একটা পুরাতন শার্ট, লুঙ্গি। কোমরে গামছা বান্ধা। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুকড়ে যায় শিউলি। তবু ভয়ে ভয়ে আলের দিকে যায় সে।
লোকটা আতাউলের কান ছেড়ে দিয়ে কোমরের গামছা খুলে আলের ওপর বিছিয়ে দেয়। এরপর বলে-
সব মাছ এই গামছার ওপর ঢাল। সাহস দেখে বাচিনে। হামার ভিঁউওত মাছ ধরবের আচ্চে! হামাক চিনিস তোরা? মাইরে তক্তা বাইনে দিলেও কেউ বাঁচাবের আসপিনে এটি, হুম…।
শিউলি ভয়ে ভয়ে বদনার মাছ গামছাতে ঢালে। মাছগুলো লাফাতে থাকলে লোকটা গামছার চারপাশ ধরে থলের মতো করে।
ঠেলাজালের মাছগুলোও দে এটি। এই ছোড়া তুই বসে আছু ক্যা? ঠেলাজাল আলগ করে ধর।
আতাউল পাশের জমির মধ্যে নেমে ঠেলা জাল আলগা করে ধরে। মাছ ছটফট করে লাফাতে থাকে। শিউলি সেই মাছ ধরে ধরে লোকটার গামছার থলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। তার কেবলই মনে হতে থাকে- অসুস্থ মা, ছোট তিন বোন, বাবা- সবাইকে আজ না খেয়ে থাকতে হবে। নিরুপায় হয়ে মাছগুলো লোকটার গামছায় ভরে দেয় শিউলি। সব মাছ খুঁটে খুঁটে দেওয়া শেষ হলে লোকটা বলে-
অ্যাকন ধানের থোপগুলো ঠিকমতো বসে দে। হায় হায় রে, কতগুলোর থোপ তুলে ফেলচে।
শিউলি ভাতির ফাঁকা জায়গায় ধানের গোছাগুলো লাইন করে বসিয়ে দিয়ে আল কেটে দেয়। পানি ঢুকে ভরে যেতে থাকে জমি। শিউলির বুকেও নদীর স্রোত বয়ে যায়। মনে মনে নিজেকেই দোষ দেয় সে। কেন আরেকটু আগে আসতে পারেনি তারা?

শূন্য ঠেলাজাল, বদনা আর থালা নিয়ে হাঁটতে শুরু করে ওরা। পা সামনে আগাতে চায় না। তবু যেতে হবে। মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে ওরা। একটু পরেই পেছন থেকে ডাক দেয় লোকটা। শিউলি চমকে ওঠে। একটু আশান্বিত হয়। লোকটা মনে হয় মাছগুলো ফেরত দেবে। ভাবতেই চোখমুখ উজ্জল হয়ে ওঠে। পেছনে ঘুরে এগিয়ে যায় শিউলি। আতাউল তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।
শিউলি লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। এই হাসির মানে বুঝতে পারে না শিউলি। হঠাৎ লোকটা শিউলির বুকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। সারা গা কেঁপে ওঠে শিউলির। কুঁকড়ে যায়। এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দেয়। তারপর হনহন করে হাঁটতে থাকে। একটু দুরে দাঁড়িয়ে থাকায় আতাউল কিছুই বুঝতে পারে না। তাকে পাশ কাটিয়ে শিউলি জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। পেছনে পেছনে ‘বুবু কী হচে, এঙ্কা করে জোরে হাটেচ্চা ক্যা?’ বলতে বলতে দৌড়াতে থাকে আতাউল।
আতাউলের কথা কানে ঢোকে না শিউলির। তার আশপাশে কেউ আছে সেটাই সে বুঝতে পারে না। দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতে থাকে। এমন অনুভূতি কখনোই হয়নি তার। এভাবে লোকটা তার বুকে হাত দিল কেন? কেনোই বা তার এতো খারাপ লাগছে? কেন নিজের শরীরকেই ঘেন্না হচ্ছে তার? নিজের বুকের দিকে তাকায়। বুকটা কেমন ফোলা ফোলা হয়েছে। এজন্যই কি মা ওড়না পড়তে বলে সবসময়? দোকান থেকে লেস কিনে এনে ফ্রোকের বুকে লেগে দিয়েছে কি এজন্যই? কিন্তু সেই লেসওয়ালা ফ্রোকই তো সে আজ পরে এসেছে। তবু লোকটা হাত দিল কেন? নাহ..! আর ভাবতে পারে না সে। কাঁদতেও পারছে না আর। গলা শুকিয়ে গেছে। শুধু চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। কাঁধে ঠেলাজাল নিয়ে হনহন করে সে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। পেছনে থালা ও বদনা নিয়ে পড়িমড়ি করে হাঁটছে আতাউল।

বাড়ির সামনে এসে ওরা কিছুটা অবাক হয়ে যায়। অনেক লোকজন শিউলিদের ঘরে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। বিশেষ করে মহিলারা। বুকের মধ্যে ধক করে শিউলির। মায়ের কিছু হয়নি তো?
কী সোন্দর মিয়ে ছোল হচে। চান্দের লাকান। এই ছোলের কাছে শিউলিরা ফেল।
দূর থেকে একথা কানে আসে শিউলির। আবারো মেয়ে হয়েছে মায়ের। বাবার আশা পুরণ হলো না। বাবা কোথায়? আশপাশে চোখ বোলায় শিউলি। ওদের উঠোন পেরিয়েই একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে বসে আছে বাবা। সেদিকে এগিয়ে যায় শিউলি। একটা চাদরমুড়ি দিয়ে বসে আছে। কুঁজো হয়ে যাওয়া পিঠ আর উশকো চুল দেখে খুব কষ্ট হয় শিউলির। বাবা একটা বিড়ি খাচ্ছে। বিড়ির ধোঁয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে ওপরে উঠছে। সেদিকে চোখ যায় শিউলির। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধোঁয়ার রেখা একেকটা কুণ্ডুলি তৈরি করছে। তারপর বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কুণ্ডুলির মতো জীবনটাও বড় দুর্বোধ্য মনে হয় শিউলির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *