অনাবাসী- সময়ের ঘূর্ণনে এই উপন্যাস টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে।। নিতু ইসলাম

আমি যখন ‘অনাবাসী‘ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। তখন প্রায় মধ্যরাত। এক সুতীব্র বেদনা নিয়ে নিস্তব্ধ আকাশের দিকে তাকালাম ‘আসমান জমিনের মালিকের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললাম‘ পৃথিবীর মানুষের পৈশাচিক নির্মমতার, বিচ্ছেদ বেদনার শেষ কোথায় হে আমার প্রতিপালক!

এখন তবে প্রকাশ করা যাক, প্রতিভাবান সু ঔপন্যাসিক রেজাউল করিম রচিত উপন্যাস ‘অনাবাসী’ ভেতর, বাহির ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি…

বই থেকে– ১৯৭৮ সাল। নিউ আরাকান রেস্তরার পাচক ইয়াকুব মিঞা এক বিকেলে জানতে পারলো বুথিডং শহরের পরিস্থিতি ভালো না, যে কোন সময়ে হামলা হতে পারে। আর কে না জানে দুর্বলের উপরে সবলদের চিরকালের ক্ষোভ। এই দেশে রোহিঙ্গা জনগণের তো কোন জীবনের মূল্য নেই।

ইয়াকুব মিঞা দ্রুত ঘরে ফিরে সিদ্ধান্ত নেয় পরের দিনই যে কোন প্রকারে বুথিডং ছাড়বে। বিধি বাম। সেই রাতেই বর্মী মিলিটারিদের হাতে নিহত হয় ইয়াকুব মিঞা, তার স্ত্রী ও দুই বছরের শিশুকন্যা ‘ফাতিমা।‘
শুধুমাত্র প্রাণে বেঁচে যায় শিশুপুত্র ‘হালিম।‘

মাদ্রাসার তরুণ হুজুর ‘আবুল হাশিমের‘ সাথে পরদিন অটোতে করে চলে যায় মঙডু শহিরে। সেখানে আছে আবদেল করিম। অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী সে। কিন্তু আজ তারাও অসহায়। সবাই চলে আসতে চায় বাংলাদেশে। এখানে আর কিছু না হোক বেঘোরে প্রাণ তো হারাবে না। বুথিডং বা মঙডুতে থাকলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শুণ্যের কোঠায়।

বহু কষ্টে জিপ চালক উথানের সহযোগিতা ও আব্দেল করিমের সহায়তায় বাংলাদেশে চলে আসে তারা। শুরু হয় অন্য এক জীবন। হাসতে বা কাঁদতে ভুলে যাওয়া ‘হালিম’ থেকে যায় এই দুটো পরিবারের সাথে। এই পরিবারের সবাই যেন এক আত্মা এক প্রাণ। ঠিক এক বছর পরে বার্মা সরকার আবার ফিরিয়ে নিতে চায় সব রোহিঙ্গাদের। মনে কষ্ট থাকলেও দেশের মাটির টানে ফিরে আসে তারা।

এ কেমন ফিরে আসা? এখানে জীবন আরো যন্ত্রণাকর। প্রতিটি মানুষ হয় নির্যাতনের স্বীকার। মঙডুতে ফিরে তাদের প্রথমে নেয়া হয় পুলিশ বেষ্টিত ফুটবল মাঠে। বদলে যায় পরিচয় পত্র। তারা এখন দেশের সবচেয়ে নিম্নবর্ণ অধিবাসী।

এতিম হালিম এতোদিন সবার আদরেই বেড়ে উঠছিল, কিন্তু সরকারের নতুন নিয়মে হাশিমকে বুথিডং ফিরে যেতে হবে। হালিমকেও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কেউ নিজ এলাকা ত্যাগ করতে পারবে না। গ্রামের বাইরে যাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কোথাও ফোন কল করা যাবে না। রোহিঙ্গা শিশুদের আর স্কুলে ভর্তি করা হবে না। জমিজমা বিক্রি নিষিদ্ধ।

সুখের দিনে মানুষ মানুষকে যতটুকু অনুভব করে দুঃখে অনুভব করে তারচেয়ে অনেক বেশি।

এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছু বছর। হালিম বড় হয় তার এক মামার বাড়িতে। এতো আদর স্নেহ দিয়েও আইনের কারণে ‘হাশিম বা আব্দেল করিম‘ কারো পরিবারই তাকে ধরে রাখতে পারে না।

আব্দেল করিমের পুত্র কন্যা রুখসানা ও শাফায়েতকে আর স্কুল কলেজে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। একসময় ‘থুরামন’ নামে বামার ( মায়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি) যুবকতাদের গৃহশিক্ষক হয়ে আসে। ভালোবাসার টানে থুরামনের সাথে ইয়াঙ্গুনে পালিয়ে আসে রুকসানা। থুরামন ধর্ম বদলে মুসলিম হয়।

এরপরে কেটে যায় বহু বছর। সবাই যখন মোটামুটি এই মানবেতর জীবন মেনে নিয়েছে। তখনই আসে আরেক বিপদ। কানাঘুষায় শোনা যায়, নাসাকা বাহিনী আবার তৎপর হচ্ছে। আব্দেল করিমের পুত্র শাফায়েতকে তারা ধরে নিয়ে যায়। বিনা অপরাধে। ১৫ দিন পর্যন্ত চলে অমানুষিক নির্যাতন। আব্দেল করিম ছেলের কোন হদিসই করতে পারেন না। দুঃখের সাথি হাশিমকে যে খবর দিয়ে আনবেন তারও উপায় নেই।

একসময় শাফায়েতের খবর মেলে। সে হাসপাতালে।
এবার আর দেরি করেন না তিনি। নিজ সন্তানকে অসুস্থ অবস্থায়ই মোটা অংকের চিয়াটের (বার্মিজ মুদ্রা) বিনিময়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন। হালিম এখন বড় হয়েছে। এখন তার মনে শুধু বাবা মা ও একমাত্র বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ। বিপদ আর মৃত্যুর বিভীষিকা পার হয়ে আবার বাংলা দেশে আসে হাশিম ও তার পরিবার। এবারের রাখাইন সেনা অপারেশন কেড়ে নেয় সুশীল ধর্মভীরু আব্দেল করিম ও তার স্ত্রীকে।

বাংলাদেশে আবার অনাবাসী হয় রোহিঙ্গা জাতির বেঁচে থাকা প্রায় সকল মানুষেরা । প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গাকে ঠাঁই দিয়েছে বাংলাদেশ সরাকার। এখানে ক্যাম্প করা হয়েছে। প্রতিটি ক্যাম্পের তত্বাবধায়কের উপাধি হচ্ছে ‘মাঝি।‘

কেটে যায় আরো কিছুদিন। হালিম বিয়ে করে তার মামাতো বোনকে। হাশিম স্বপ্ন দেখে তার দুই ছেলেকে অবৈধ পথে জেলে নৌকায় মালয়েশিয়া পাঠাবে। শাফায়েতের স্বপ্ন একবার তার বোন রুখসানাকে দেখবে। হালিমের স্বপ্ন অন্তত তিনজন নাসাকাকে খুন করে সে তার পরিবারের হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
থুরামনের স্বপ্ন তার প্রিয় স্ত্রীকে তার পরিবারের সাথে মিলিত করবে।

এই সব স্বপ্ন পূরণ বা স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প নিয়ে শেষ হয় একটি অসাধারণ উপন্যাস। নাম তার অনাবাসী।

চিত্রকল্প–
‘জীব হত্যা মহাপাপ‘ –এই বাণীতে দীক্ষিত মানব সন্তানগুলো। জন্মাবধি এরা এই শিক্ষা নিয়ে বড় হয়েছে। আজ সকাল হতে এরা কত না নির্জীব জীবকে বিনা কারণে হত্যা করেছে তার হিসাব কারো কাছেই নেই।

(১৪ পৃষ্ঠায় এই চিত্রকল্পের মাধ্যমে যে কষ্টের আবহের সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সত্যিই অকল্পনীয় । কখনো কখনো একটি সুন্দর উপস্থাপন পুরো দৃশ্যটি চোখের সামনে এনে দেয়)

রূপক উপমা দর্শন সম্পর্কিত আলাপঃ

রূপক, উপমা, দর্শন, ও টুইস্ট একজন লেখকের ভাবনার গভীরতা ও উপন্যাসের আভিজাত্য প্রকাশ করে। ‘অনাবাসী’ এই সব দিক বিবেচনায় কতটা সমৃদ্ধ, সেটুকু দেখা যাক।

বাবা মায়ের চিন্তায় শাফায়েতও উদ্বেগাকুল। ঘরে জ্বলছে হেরিকেন। হেরিকেনের টিমটিমে আলোতে দুজন যুবক বসে আছে নির্বাক– নিঃশব্দ। রাতের নিস্তব্ধতায় ছেদ পড়েছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার বিরামহীন শব্দ ঝিঁ…..

(এইখানে লেখক যখন একটি অসহনীয় দম বন্ধ করা পরিবেশের সৃষ্টি করলেন। তখন যেন আমি নিজেও কল্পনায় সেই ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম।)

অতীতের দুঃসহ স্মৃতি, বর্তমানের বিপদ সঙ্কুল জীবন, আগামীর অনিশ্চয়তা। ‘এই লাইনটি পড়লে একই সাথে দু’টি বিষয় ভেসে উঠে- রূপক, উপমার মাধ্যমে এখানে যে দ্বৈততার সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অনুপম।

নব্বই–একশ বছরের চলৎশক্তি রহিত পীড়িত মানুষটিও বেঁচে থাকতে চায়। এই আকাঙ্ক্ষার পেছনে কোন প্রেরণা কাজ করে কে জানে। অদেখা জগতে যাওয়ার ভয়, নাকি জীবন যে জগতে অতিবাহিত হয়েছে সেই জগতের প্রতি মায়া। ‘এখানে লেখক বাঁচার আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে যে দূরবর্তী সময়ের ইঙ্গিত করেছেন, তাতে একই সাথে দূরদৃষ্টিতা ও দর্শন প্রকাশিত হয়েছে।

জাতিসত্তা বিষয়ক সমস্যা অতীতে ছিল ভবিষ্যতেও থাকবে। আবার সমাধানও হয়েছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে, কখনও বা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এইখানে জাতিগত সমস্যাকে সমাধানের মানদণ্ডে ফেলার ভেতর দিয়ে এক নিখাদ দর্শনের রূপ উন্মোচিত হয়েছে।

অল্প কিছু সম্পাদকীয় ত্রুটি

-প্রতিবার বলা হয়েছে থুরামনের প্রিয়তি স্ত্রী। শব্দটি প্রিয় বা প্রিয়তম স্ত্রী হলে আরো বেশি ভালো লাগতো।

-এক জায়গায় ১৯৭২ থেকে ১৯৯২ কে ত্রিশ বৎসর বলে উল্লেখ করা হয়েছে । এখানে ২০ বৎসর হবে ।

মূলত অনাবাসী উপন্যাস কেবলই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আখ্যান নয়। অনাবাসী উপন্যাসে লেখক বিভিন্ন চরিত্রে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ইতিহাস স্বল্প পরিসরে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।

ফ্ল্যাপ নামকরণ প্রচ্ছদ নিয়ে কিছু কথা-

প্রথম ফ্ল্যাপটি ঔপন্যাসিক যেভাবে সাজিয়েছেন, তা উপন্যাসের সাথে যথাযথ ঐকতান প্রকাশ করেছে।

-এই উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর নামকরণ। ‘অনা’ অর্থা ‘না’ বা ‘নেই’ এর সাথে আবাসী শব্দটি জুড়ে দেয়ায় এক করুণ আবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

উপন্যাসটি মূলত সীমান্ত কেন্দ্রিক সে বিবেচনায় বলা যায় প্রচ্ছদ একদম উপযুক্ত হয়েছে। প্রচ্ছদের কাঁটাতার ও লাল সবুজের নক্সা দেখে দেখে একটি দেশের। মানচিত্র ব্যবচ্ছেদের প্রতিচ্ছবি চোখে ভেসে উঠে। এটি প্রচ্ছদের শৈল্পিক বিস্তারের প্রমাণ।

অনাবাসী গ্রন্থের মধ্য দিয়ে লেখক বলতে চেয়েছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সাধারণ মানুষ থেকে উদ্ভুত হয় না। রাষ্ট্র যদি এই কদর্য কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করে, সাধারণ মানুষ এমনকি শান্তির বার্তাবাহক ধর্মীয় নেতৃবৃন্দও তাতে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যেও কিছু মানুষ মানবতার বাণী বুকে ধারণ করে নিজের জীবনেও ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে না।

ড্রাইভার ‘উথান’ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একটি পরিবারকে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা থেকে বাঁচিয়েছে। বর্মী নাগরিক ‘থুরামন‘ রোহিঙ্গা কন্যা রুকসানার প্রেমে পড়ে। রাখাইনে রুকসানাকে বিয়ে করা সম্ভব না। বর্মী সমাজ তা মেনে নিবে না। রুকসানার জন্য সে রাখাইন ত্যাগ করে চিরতরে- চলে যায় ইয়াঙ্গুনে । এমন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন ঘৃন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাঝেও কিছু মানুষ মানবতার ঝাণ্ডা বয়ে নিয়ে চলে।

উপন্যাসটি পড়াকালীন অনেক সময় মনে হয়েছে লেখক তার লেখার মাধ্যমে একটু অতিরিক্ত আবেগ মিশ্রিত করেছেন। আবার এমনও হতে পারে পাঠক হিসেবে আমিই হয়তো কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েছি। শেষ দৃশ্যে খানিকটা নাটকীয়তা সংযোজন হয়েছে। আমার মনে হয়, লেখক পরবর্তী সংস্করণে সেটুকু পরিমার্জন করে নিবেন ।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে উর্দু ও হিন্দিতে সমৃদ্ধ সাহিত্য-সম্ভার থাকলেও বাংলাদেশে সাহিত্যে খুব বেশি একটা চোখে পড়েনি। অনাবাসী বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে এক চ্যালেঞ্জিং প্রচেষ্টা।

পরিশেষে বলা যায়, বইটির সর্বাঙ্গীণ বিন্যাস যথাযথ মনে হয়েছে। লেখক তার সু’লেখনীর মাধ্যমে মূল ঘটনার বাইরে রাখাইন এলাকার ভৌগলিক বিবরণ, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সামাজিক অবস্থা, রাষ্ট্র কর্তৃক নির্যাতন, এথনিক ক্লিনজিং প্রচেষ্টা এবং মানবিক ইস্যুগুলো মুন্সিয়ানার সাথে বিবৃত করেছেন।

তবে বইটি পরবর্তী সংস্করণে সম্পাদনায় লেখক অধিক সময় নিয়ে ভাষাশৈলী উন্নয়নের প্রচেষ্টা করতে পারেন। তা যদি হয় তাহলে ‘অনাবাসী‘ উপন্যাসটি সাড়া জাগানো ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেতে পারে।

পরবর্তী সংস্করণে উপন্যাসটির প্রুফ রিডিং-এও আরও দক্ষতার প্রয়োজন । আশা করছি সময়ের ঘূর্ণনে এই উপন্যাস টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে- কারণ, এর প্রেক্ষাপট সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী।

গ্রন্থ–অনাবাসী
মো. রেজাউল করিম
প্রকাশনী সংস্থাঃ গতিধারা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৪৩
প্রচ্ছদঃ সিকদার আবুল বাশার
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি – ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *