সংলাপ-নির্ভর উপন্যাসের জয়জয়কারের হাটে ‘মৃত্যুগন্ধী’ এক অন্য নাম : রেজাউল করিম

বাংলা উপন্যাস শুরু থেকেই কাহিনি-প্রধান সাহিত্য হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। বাংলা ভাষাভাষী লেখক ও পাঠকবৃন্দের মন ও মননে উপন্যাস বলতে একটি কাহিনি, সেই কাহিনিতে এক দল মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার বয়ান বিবৃত হয়। সেই কাহিনিতে লেখক এক বা একাধিক পরিবার ও পরিবার-সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের জীবন-বর্ণনা তুলে ধরেন নিজস্ব ভাষারীতিতে। লেখক তাঁর কাহিনি বর্ণনায় কখনও-বা সরল বয়ানরীতি অনুসরণ করেন। কিছুটা বর্ণনা ও সংলাপের মধ্যেই কাহিনি আবর্তিত হয়। কাহিনি বয়ানে কখনও লেখক বর্ণনাশ্রয়ী হয়েও ওঠেন। কখনও-বা দেখা যায় লেখক সংলাপ-নির্ভর হয়ে পড়েছেন।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় সামাজিক উপন্যাসের ধারায় সংলাপ-নির্ভর সামাজিক উপন্যাস শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে, নির্দ্বিধায় তা বলা যেতে পারে। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, সংলাপ-নির্ভর উপন্যাসে জীবন ও সমাজ সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকতর প্রভাব বিস্তার করছে না, সমাজের অভ্যন্তরীন মিথস্ক্রীয়া, কাহিনির পাত্র-পাত্রীর মনোজাগতিক বিশ্লেষণ সেথায় অনুপস্থিত। লেখক ইয়াসির আজিজ উপন্যাসের মনস্তত্ত্বের রূপায়ন প্রসঙ্গে বলেন, “উপন্যাসের কাহিনির পরই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় এর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়-আশয়। একটি স্বার্থক উপন্যাস হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে লেখকের সুপরিকল্পিত ও দক্ষ হাতের গাঁথুনি সর্বাগ্রে প্রয়োজন হয় এবং তারই মধ্যে ফুটে ওঠে মনোজগতের নানা ধরনের খেলা (ইয়াসির আজিজ, “উপন্যাসের মনস্তত্ত্বের রূপায়ন”, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ মে, ২০১৩)।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় “আদর্শ হিন্দু হোটেল” উপন্যাসে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ নিয়ে আখ্যানচিত্র তৈরি করেছেন। আখ্যানবয়ানে লেখক বর্ণনায় প্রাকৃতিক পরিবেশ, সমাজচিত্র ও ব্যক্তিচরিত্রের মনোস্তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। সংলাপের মধ্য দিয়ে আখ্যান বয়ানের যৌক্তিকতা কাহিনিকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেছেন। সে অর্থে বাংলা ভাষায় রাচিত উপন্যাসের আঙ্গিকে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস।
সংলাপ-নির্ভর উপন্যাসের জয়জয়কারের হাটে জাকির তালুকদার লিখেছেন মৃত্যুগন্ধী উপন্যাস, যা বোদ্ধা পাঠকদের সেই আক্ষেপ পূরণ করতে পারে বলে মনে হয়। উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একজন লেখককে নিয়ে। অবিখ্যাত অথচ শিল্প ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধ একজন লেখকের কাহিনি এই মৃত্যুগন্ধী। রুচি ও আত্মসম্মানের কারণে সাহিত্যের প্রচার-প্রচারণায় নিজেকে উৎসর্গ করতে তিনি নারাজ। সম্পাদকের কাছে তাঁর পা-লিপির চাহিদা নেই, নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠীও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি নিজের লেখার শিল্পমান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। লেখক নিজ পরিবারে সময় দিতে পারেন না। আর্থিক দৈন্যের কারণে স্ত্রীর কাছেও তিনি উপেক্ষিত। একমাত্র সন্তানের সাথেও তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়, কেননা লেখক লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকায় সন্তানের সাথে সেই সখ্য গড়ে ওঠেনি।


মূলত পারিবারিক অশান্তি থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও মুক্তিলাভের জন্য লেখক আত্মগোপনে যান। আশ্রয় নেন এক পীরের মাজারে। মাজার বলতে গতানুগতিক যে বাস্তবতা তেমনটি এই মাজারে দেখা যায় না। মাজারে বিভিন্ন স্থান থেকে পুন্যার্থীরা আসেন, মাজার জেয়ারত করে চলে যান, কেউ কেউ বেশি সময়ও থাকেন, এর মাঝে দু’একজন সন্ত্রাসী যে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য আসে না- তাও নয়। মাজারে হিন্দু পুন্যার্থীরাও আসেন। তাঁদের জন্য রয়েছে পৃথক হোস্টেল, সেখানে রান্নাবান্নাও করেন হিন্দু পাচক। তবে মাজারে কোনো সন্ত্রাসী আশ্রয় নিল কিনা কর্তৃপক্ষ গোপনে নজর রাখেন। লেখকও তাঁদের নজরে পড়ে যান। লেখকের নিরিহদর্শন অবয়ব, স্বাভাবিক চলাফেরার কারণে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব দেয়া হয় মাজার কমপ্লেক্সের গ্রন্থাগারিককে। লেখক গ্রন্থাগারিককে নিজ পরিচয় দেন না, বরং কথোপকথনে দ্বিধাহীনভাবে বলেন, তিনি নিজের জীবন থেকে পালিয়ে থাকার জন্য এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রন্থাগারিক এতটুকু নিশ্চিত হন যে, মানুষটি সন্ত্রাসী নন, তিনি লেখকের থাকার জন্য ছোট্ট একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেন।

লেখক মোবাইল ফোন অফ করে দেন। গভীর রাতে অন করে দেখেন বাসা থেকে কোনো এসএমএস এসেছে কিনা? বাসা থেকে এসএমএস না আসায় তাঁর হতাশা আরও বাড়ে। অনেক দিন পর একদিন, এসএমএস আসে- সে এক ভিন্ন কাহিনি।


এর পরেই শুরু হয় উপন্যাসের নির্যাস বর্ননা- লেখকের আত্মঅনুসন্ধান। লেখকের আত্মঅনুসন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসা পর্বে উপন্যাসের লেখক দেশের লেখালেখি, প্রকাশনা ব্যবসায়, ফেসবুকে সাহিত্যের ভালো-মন্দ থেকে শুরু করে একজন লেখক চলমান বাস্তাবতায় যে সব ইতোবাচক ও নেতিবাচক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন, তা স্বভাবসুলভ সাবলীলতায় তুলে ধরেছেন, কিঞ্চিৎ জীবন-দর্শনও তুলে ধরেছেন। আখ্যান বয়ানে দেখা যায়, লেখকের চিন্তা মনোজগতের প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, আবার উত্তরও বিবৃত করেছেন। মানবজীবনে অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন উত্তর হতে হয়, যার উত্তর যুক্তিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই প্রশ্ন তুলে ধরে লেখকের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন এভাবে, “ মাঝেমধ্যে মনে হয়, পুরোপুরি ধর্মনিবিষ্ট হয়ে পড়লে বোধ হয় খারাপ হতো না। অন্তত বিনা প্রশ্নে কিছু কিছু বিষয় মেনে নিতে পারলে মনের কষ্ট অনেক কমে যায়।” প্রসঙ্গক্রমে দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট গ্রন্থ লেখার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। মানবজীবনের দুঃখ-দারিদ্র-অপমান-অশান্তি অনুসন্ধানে দস্তয়ভস্কিও উত্তর খুঁজেছেন ধর্মবোধের কাছে। এখানেও দস্তয়ভস্কির চিন্তার আরও ব্যাপকতা পরিস্ফুট হয়েছে এভাবে, “যুক্তিবাদ এখনো সবকিছুর উত্তর দিতে পারেনি, সবকিছুর অবলম্বন হয়ে উঠতে পারেনি।” বর্ণনা পর্বে লিও তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি সম্পর্কেও বলেছেন, যা প্রাসঙ্গিকতার দাবীদার। তলস্তয় কিংবা দস্তয়ভস্কি সম্পর্কেও যখন বলেছেন, তখন মনে হয় যেন পাঠক তাঁদের জীবন-কাহিনিই পড়ছে। ক্ষণকাল পরেই মনে হয়, মৃত্যুগন্ধীতে আছি কিনা সেটি মনে করে দেখতে হয়। লেখকের এ এক প্রচন্ড সম্মোহনী বিবরণী, অপূর্ব মুনশিয়ানা।


আখ্যানের শুরু ও শেষ হয়েছে মৃত্যু দিয়ে। প্রথম পর্বে এক বৃদ্ধার মৃত্যুকালীন অবস্থা বর্ণনার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের লেখক মানুষের জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। মৃত্যুর স্বরূপ সন্ধানে সিগমন্ড ফ্রয়েড, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর ব্যাখ্যা এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। দীর্ঘ জীবন অধিকারী একজন মানুষ সম্ভবত মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয় এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতও থাকে। তাই দেখা যায় বৃদ্ধার জীবনের শেষ লগ্নের তার অনুভূতি এভাবে তুলে ধরেছেন, “এ কথা সত্য যে ভীতি রয়েছে। রোদের মতোই স্পষ্ট সে ভীতি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভীত যাঁর হওয়ার কথা, কেবল তার মুখেই ভীতির চিহ্নমাত্র নেই”। উপন্যাসের আখ্যান শেষ হয়েছে জীবনানন্দের সাথে উপন্যাসের নায়কের স্বপ্নের মধ্যে আলাপনের মধ্য দিয়ে। তখন খুব ভোর- উপন্যাসের লেখক ও জীবনানন্দ কথা বলছেন, “কবি স্বয়ং বলছেন তাকে ছাদে নিয়ে যেতে, সে কেমন করে তা অবজ্ঞা করে। সি কবির পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কবির হাতটা ধরতে যায়। কবি তার দিকে চোখ মেলে তাকান। … বলেন, আজ হবে মৃত্যুযাত্রা কবিতার পাঠ। ওরা কেউ বোধ হয যাবে না। বোধ হয় ভয় পাচ্ছে যেতে। চলো তুমি আর আমি দুজনে মিলে চলে যাই। তুমি কী ভয় পাচ্ছ?… কবি এমন অনায়াসে হাসপাতালের বেড ছেড়ে উঠে দাঁড়ান যে মানেই হয় না মাত্র কয়েক দিন আগে নিজের দেহটাকে থেঁতলে নিয়েছেন ট্রামের সঙ্গে। কবির এই অনায়াস দেহছন্দ তার পায়েও সঞ্চারিত হয়।” জীবদ্দশায় জনপ্রিয়তা পাননি বাংলার এক দুঃখী কবি ও লেখক জীবনানন্দ দাশ; স্বপ্নে তাঁর সাথে অখ্যাত লেখকের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে উপন্যাস শেষ হয়েছে। শেষ বাক্যটি পাঠের পরেও পাঠককে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে থাকতে হয়। উপন্যাসের চমৎকার এক সমাপ্তি টেনেছেন লেখক।


মৃত্যুগন্ধী উপন্যাসে স্বল্পসংখ্যক চরিত্রের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। প্রধান চরিত্রে রয়েছে একজন অখ্যাত লেখক। এছাড়া লেখকের স্ত্রী, পুত্র ও মাজারের গ্রন্থাগারিকের চরিত্র অগৌণ। বলা যায় অখ্যাত লেখকই উপন্যাসের চৌদ্দ আনা অংশ দখল করে রয়েছেন। জাকির তালুকদার মূলত লেখকের অজ্ঞাতবাস জীবনে তার মস্তিষ্কে উত্থিত মানুষের জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কীত প্রশ্ন, একই সাথে উত্তর উপস্থাপন করে হয়ত নিজেরই জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কীত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে চেয়েছেন; অন্য অর্থে নিজ দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকের মননেও সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।


উপন্যাসের প্রথম পর্বে দেখা যায় জনৈকা দাদী, তাঁর কন্যা ও নাতিকে। দাদীর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তাঁর অনুভূতি ও অবস্থা বর্ণনা করে ঔপন্যাসিক মৃত্যু সম্পর্কীত দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন যা আগে কিছুটা বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্ব থেকে শুরু হয়েছে অখ্যাত লেখকের অজ্ঞাতবাস যাত্রা দিয়ে। এর পরে আর কোনো পর্বেই দাদী, তাঁর কন্যা ও নাতি প্রসঙ্গ আসেনি। লেখক তার গল্পের প্লট কিভাবে সাজাবেন, এটা তাঁর স্বাধীনতা। তবে প্রথম পর্বেও পরে মনে হয় যেন ভিন্ন একটি আখ্যান। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, প্রথম পর্ব থেকে উপন্যাসের পরবর্তী অংশে একটা উল্লম্ফন দৃশ্যমান, যা নবীন পাঠকদের কাছে একটা ধন্দ হয়ে থাকতে পারে। বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার অনেক সমৃদ্ধ মনে করি। উপন্যাসের এখানে সেখানে চলতি ভাষায় আমরা ব্যবহার করি- ইউনিভার্সিটি গ্ল্যামার, প্লিজ এমন কিছু ইংরেজি শব্দ ইচ্ছে করলেই পরিহার করা যেত। উত্তম বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে, এমন ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের ব্যাপকতর ব্যবহার ভবিষ্যতে বাংলা শব্দসম্ভারকে অবলুপ্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। মৃত্যুগন্ধী শেষ হয়েছে গতানুগতিক সমাপ্তির পরিবর্তে ভিন্ন এক ধারায়। আখ্যান বয়ানে জাকির তালুকদারের সাবলীল গদ্যে কোথাও ছন্দপতন নেই। ঝকঝকে কাগজে উন্নত মুদ্রণ, বানানবিভ্রাটমুক্ত বইটি পড়ে পাঠক তৃপ্ত না হওয়ার কারণ নেই।

লেখক : জাকির তালুকদার
প্রকাশক : প্রথমা
মূল্য : ২০০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *