আলমগীর রেজা চৌধুরী ও মগ্নমধ্যাহ্ন র দলিলপত্রাদি মোস্তফা হায়দার

একজন আলমগীর রেজা চৌধুরি ভূগোল মাপা সীমানার মানুষ নয়। স্বচ্চজলের সীমানায় বসবাস করা কতগুলো উদার প্রাণীর একজন। প্রকৃতির কোলে বসবাস করা শব্দের দরি বেঁধে বেধেঁ বাক্যের গায়ে যখন পড়িয়ে দেন নিজস্বতা তখন পাঠকমাত্রই বুঝতে অবকাশ থাকে না যে, তিনি আলমগীর রেজা চৌধুরি। মগ্ন মধ্যাহ্ন ‘ বইটি নির্মোহ পাঠক যখন খচখচ করে ভেতরের জমিনে হাত রাখবে তখন পরিধির আতিথেয়তায় পাঠকের ভেতরশক্তি নিয়ে যাবে শিল্পের অমোঘ অর্ঘ্যের কিনারায়। অবাক হয়ে কতগুলো পরিচ্ছেদ পাঠে বিমোহিত না হয়ে পারিনি। চেহারা বেশী দিনের চেনাজানা না হলেও শব্দের সীমানায় তিনি বিশালতার হাত ধরে কিছুকাল ধরে গল্পের কথামালায় আমার ভেতর দখল করে আছে।
এতো স্মৃতিকাতরতাময় মানুষ মনে হয় না তাঁকে দেখলে। মাথার ব্রাশ করা দেখে প্রথমদিনই বুঝে নিয়েছি সীমানা মেনে চলা কোন পুরুষ তিনি না হলেও রোমান্টিসিজমে চরমভাবে আক্রান্ত। ধারণ করার শক্তি এতই প্রবল যে, ইতিহাসের পাতাগুলো খচখচ করে ইমাজেনারেশনের সামনে তুলে ধরলেন তাঁর ও তাঁদের সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি।অবাক হতে হয়। আশির দশকের ভেতরের কান্ডকীর্তিগুলো সুন্দরের ডালায় তুলে স্মরণ করিয়ে দিলেন সে সময়কার সাহিত্যের ইতিহাস। তাঁর ‘মগ্নমধ্যাহ্ণ ” বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের এক চরম স্বাক্ষ রেখেছেন সচেতনভাবে। নিজের যুদ্ধ অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটের চেয়ে ফেরারি বা হুলিয়া নিয়ে প্রশাসনের চোখে ধরা পড়ার পর শিক্ষক বাবাই বেশী সচেতনভাবে তাঁকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব তুলে দিলেন লেখকের রাজনৈতিক গুরুদের হাতে।
লেখকের পরিবারের দুজন ইতিহাস বহন করা মুক্তিযোদ্ধা এবং লেখক ঘর করে আলোকিত করে গেছেন রেখে যাওয়া ভবিষ্যৎ লেখক রেখে। তিনি আলমগীর রেচা চৌধুরি।
লেখক হিসেবে বেড়ে উঠা সময়কে এতো সুন্দরের আয়নায় এনে পাঠককে বসিয়ে দিলেন মন্ত্রের দরোজা খোলে। লেখক হওয়ার ক্লাসগুলো সময়কে ধাবিত যেমন করে তেমনি কালের স্বাক্ষ্যও বহন করে চলেছে। একজন লেখক সময়ের কাছে নিশ্চিত জবাবদিহিতা রাখে। সেটি এ লেখক করতে সক্ষম হয়েছে সচেতনভাবে। লেখকের এ বইটিতে অনেক স্বপ্নের মৃত্যু যেমন দেখেছি তেমনি অগোচরে পড়ে থাকা অনেক স্বপ্নের নামও দেখার সুযোগ হয়েছে। লেখক দিনক্ষণ যে সুচারুভাবে রেখেছেন তাতে মেধার পরিস্ফুটনও ঘটছে। মেধাবীরাই পারে নিয়ত সময়ের স্মরণ রাখতে। জাতির পিতার আত্বজীবনিতে যেমন আমরা অনেক যাপিত সময়ের তথ্য পাই তেমনি অনেক বামরাজনীতির বোঝা বহন কারীর কাছে তা পাইনি।
একজন লেখক কিন্তু স্বপ্নদ্রষ্টা। আবার সময়ের আয়নাও বটে। সেটা হতে গিয়ে লেখকের চোখ পড়ে অনাচার অথবা অসময়ের অযাচিত বিষয়ে। যেমন সদ্য সময়ে একজন মেধাবী তরুণের প্রস্থান এ কবিকে ছুঁয়ে গেছে। তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকান্ড ছিল ‘পৃথিবীর ক্ষত’ নামে আখ্যায়িত হওয়া বিষয়টিও কবির চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি। সময়ের আলোচিত এ হত্যাকান্ডের পূর্বে ত্বকী লিখেছিল- ওরা রমিজকে হত্যা করে / পেশিশক্তি দিয়ে/ ওরা রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে নেয় জামা/রক্তাক্ত,কলঙ্কিত,কাদামাখা/অথচ কাদা নয়/এ এক মসৃণ যন্ত্রণা। অত্যন্ত প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন এ কিশোরের উপলব্দি প্রতিপক্ষ খুব ভালোভাবে আত্বস্থ করতে পেরেছে বলে ওকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ছাড়ল। এটা জাতির জন্য বড় হতাশাজনকও বটে।
কবি ও কথাশিল্পী আলমগীর রেজা চৌধুরী’ লেখক তৈরির কারিগর’ অনুচ্ছেদে বলতে গিয়ে সত্যের পরকাষ্টা উত্থাপন যেমন করেছেন তেমনি বর্তমান সময়ের দিকেও ঈঙ্গিত করেছেন। তাঁর ভাষাং-” যখন প্রচলিত ধারার বাইরে নতুন কোনো বিষয়,বক্তব্য উত্থাপিত হয় তা রাস্ট্রীয় কাঠামোতে গ্রহণযোগ্য হয় না। এ প্রতিকুলতার শিকার হয়েছে ভিন্নধর্মী এ কাগজগুলো। কবি রফিক আজাদের বেশ্যা বিড়াল,আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্প সত্যের মতো বদমাশ,নির্মলেন্দু গুণে হুলিয়া অসমাপ্ত কবিতাদ্বয় অনিবার্যভাবে রাস্ট্রীয় কোপানলে পড়ে। ” উল্লেখ্য বিষয়গুলোর দিকে তাকালে এখকনকার সময় ভাবতে কষ্ট হবে। এখন কোপানলের পরিবর্তে গৌরনলে পতিত হবে জেনে লেখকগণ সত্য বলতে পিছপা হচ্ছেন অনায়াসে। লেখক কিন্তু পরোক্ষভাবে সত্য বলার সাহস সঞ্চার সৃষ্টিতে অনুপ্রাণনের যোগানও দিয়েছেন। তবে এ বইটিতে তিনি কথার পিঠে অনেক সত্য বলেই গেছেন। যদিও অনেক সত্য ছিল তিক্ততায় ভরা।
অথচ এ লেখক সারাজীবন একটি দুঃখ বয়ে বেড়াবেন নিশ্চিত। তাঁকে যুদ্ধে যেতে দেয়নি বলে। আজ এটি যদিও অন্যদের ক্ষেত্রে একধরণের ব্যাধির রুপ নিয়েছে বলে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ও দিতে চায় না। কবি তার সতীর্থ বন্ধু আবুল হাসানকে ‘মর্মাহত রাজা’ বলে স্মৃতির মিনার গড়েছেন। বেঁধেছেন বাংলাসাহিত্যের এক শক্তসীমানায়। এ জায়গায় লেখক লেখককে সম্মান দিতে গিয়ে কোন কার্পন্যতার আশ্রয় নেননি। অনেক হারিয়ে যাওয়া লেখককে তিনি যেমন স্মরণ করেছেন তেমনি সময়ের কিছু মেধাবিকেও স্মরণে আনতে ভূল করেন নি। একজন কবি বা লেখক যেমন নিয়ত সময়ের সাক্ষী তেমনি অনেক হারিয়ে যাওয়া তত্বের নিরব দর্শকও বটে। এ জায়গায় কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী মগ্নমধ্যাহ্ন কে একাত্তরের ডায়রীর মতো অনেক ঘটনার দললিপত্রও বানিয়ে ছেড়েছেন।
বটগাছের মতো আগলে রাখা শক্তিদিয়ে বন্ধুত্বের জায়গা থেকে শুরু করে স্নেহাশীষদের দিয়ে যাচ্ছেন সুন্দরের সবটুকু। দেখলে মনে হয় মাত্র সাইত্রিশ পার করা এক তরুণ। চঞ্চলতা আর প্রীততায় একেবারে বন্ধু কাল দেখা হওয়া নতুন মানুষটির সাথে।
আপনার বোঁচে থাকা শক্তিতে শব্দরা যেমন কথা বলে বলে বাঁচিয়ে রাখবে তেমনি ভালোবাসার রোপন করা চারাগুলো অাগলে রাখবে একজন আলমগীর রেজা চৌধুরী কে।
সুস্থতার সহিত আপনার জীবন হোক হায়াতময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *