রহস্য উপন্যাস

রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। পর্ব দশ

দশ

ঝড়ের আঁচর যেনো শহরেও লাগছে। জামাল সাহেবের বাসার পাশে যে গাছটি ছিল সেই গাছটি বুঝতে পারছে ঝড়ের তান্ডবের কী মজা! কত শক্তি আছে এই ঝড়ের। গাছ ঝড়ের শক্তি পরীক্ষা করবে? না ঝড় থেকে বাঁচার লড়াই করবে। ঝড়ের শক্তির কাছে বারবার নুইয়ে পড়ছে গাছ। লড়াই করছে তার ডালপালা বাঁচাতে। যখন একটি ডাল মড়মড় করে আলাদা হয়ে গেল, তখন গাছ কি করবে! তার পাজড় ভেঙে যাচ্ছে। কি করবে! হাল ছেড়ে দিলে তো আর চলবে না।
ঝড়ের সঙ্গে মোকাবেলা করেই টিকতে হবে। না হয় হারাতে হবে, এক এক করে সকল ডালপালা। লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে এখনো যারা টিকে আছে তাদের জন্য লড়াই। নিজে বাঁচার জন্য লড়াই। এ লড়াইয়ে তবুও হার মানছে না গাছ।

গাছের নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার মতো শক্তি নাই। গাছদের নিজ সীমানায় লড়াই করতে হয়। এ লড়াইয়ে নয় জয়, নয় পরাজয়। গাছদের সীমানা ত্যাগের কোনো সুযোগ নেই। জামাল সাহেব দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। ঝড়ের তিব্রতা বাড়তে থাকে। সকালের খবরে দেখেতে পেল। ফুলপুর গ্রামের গাছপালা ডালপালা হীন হয়ে পড়ে আছে। ভাবতে লাগলো এই ঝড়ে তার বাড়ির গাছপালা যেনো লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।

এই খবর শুনে বাড়ির সকলেই বিচলতি হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে সকালেই ঝন্টুকে গ্রামে পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে লাইলিও যাবার জন্য বায়না ধরলো। জামাল সাহেবের আফিস আছে তাই যেতে পারবে না। ভোর না হতেই ভাই-বোন ছুটলো গ্রামের দিকে। গ্রামে ঢুকেই দেখতে পেলো গাছের ডালপালা পরে আছে। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করবে এমন পরিবেশ নেই। তাই হাশেমদের বাড়ি চলে গেল। দেখতে পেল কোনো খয়ক্ষতি হয়নি হাশেমদের বাড়ি। এমন আজব কান্ড দেখে লাইলি অবাক। অবাক ঝন্টুও। এত বেলা হয়েছে একনো হাশেম জাগেনি। দরজার কাছে গিয়ে দরজা লক করলো। অনেক বার লক করার পরে হাশেম বলে ডাক দিতেই হাশেম দরজা খুলে দিল। খুব সুন্দর একটি ঘুম হয়েছে হাশেম ও গোলাম আলীর। চোখমুখ মুচতে মুচতেই দেখতে পেল ঝন্টু ও লাইলির মুখ। ওদের দুজনকে দেখে ওরা চমকে গেল দু‘জন। এত সকালে ওরা কীকরে এলো!

ঘুম ঘুম ভাব নিয়েই হাশেম বলে, কেমন আছো ঝন্টু? কেমন আছো লাইলি? সহজ উত্তর ভালো আছি। ওদেরকে বারান্দায় বসতে দিল।
এত সকালে তোমরা?
হ্যা, ঢাকা থেকে এলাম। রাতে ঝড় হয়েছে। খবরে দেখলাম ফুলপুর গ্রাম ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে। তাই চলে এলাম। আমাদের বাড়ি গেলাম। বাড়ির ভেতরে প্রবেশের কোনো পথ পেলাম না। তাই তোমার কাছে এলাম।

তোমরা এসেছো বেশ ভালো হয়েছে। আগে কিছু খাওয়াদাওয়া করো তারপর তোমাদের বাড়ি যাই। এদিকে বেশ ক্ষিদে লেগেছে লাইলির। ঝড়ের ভয়ে রাতে কিছু খায়নি। লাইলিকে দেখে হাশেমের মন ভালো হয়ে গেল। কল্পনায় লাইলিকে দেখছে। সেদিন যে লাইলিকে দেখেছিল আজ মনে হতে লাগছে আরও বেশি সুন্দর। কলাপাতা রঙের স্যালোয়ার পরে বেশ ভালোই লাগছে। হাশেম কখনো ভাবেনি আজ লাইলির সঙ্গে দেখা হবে। ঝড় যেনো হাশেমের জন্য আর্শিবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে। ঝড়ভাঙা সকাল যে এতো সুন্দর হতে পারে! তা ভাবতেই পারেনি হাশেম।

গোলাম আলী ব্যস্ত হয়ে পরে নাস্তা আয়োজনে। হাশেম আর গোলাম আলী ছাড়া এই বাড়িতে কেউ থাকে না। লাইলি ঘরে ভেতর চলে গেল। এলোমেলো ঘর দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মেয়েরা এলোমেলো ঘর পছন্দ করে না। ঘর গোছাতে শুরু করে দিল। ঝন্টু আর হাশেম কথা বলছে। এত বড়ো বাড়িতে তোমরা কেউ থাকো না। কেউ বাড়িতে না থাকলে বাড়িটি যেনো ভুতুড়েবাড়িতে পরিণত হয়। বাড়ির ভেতরে থাকে না প্রাণের ছোঁয়া। তোমরা এই বাড়িতে থাকতে তোমাদের ছোঁয়ার প্রাণ ফিরে পাবে বলে মনে করেছিলাম তোমাদের বাড়িটি। তোমাদের সঙ্গে সুখ দুখ ভাগাভাগি করবো বলে মনে করেছিলাম। তা আর হলো না। তবুও ভালো, এই ঝড় উপলক্ষে তোমারা দুজন এলে। চাচা আর চাচিকে তো দেখিই না।

তুমিও তো যাও না ঢাকা। ঢাকা গেলে তো দেখা হয়।
ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছে হয় না। এই গ্রাম যেনো আমার কাছে আত্মা।
স্বর্গভূমি। কেউকি স্বর্গ ছাড়তে চায়?
না, স্বর্গ ছাড়বে কেনো?
তাই, আমি এই গ্রাম নামক স্বর্গ মোটেও ছাড়তে চাই না। ধসগ্রামের
পাখিরা আমার সঙ্গে কথা বলে।
তাই?
হ্যা।
গ্রাম আমারও ভালো লাগে। তোমার সঙ্গে এই গ্রামে কত আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছি সে কথা খুব মনে পড়ে।
আমারও মনে পড়ে ঝন্টু।
মনে পড়লেতো আর হবে না, গ্রামে আসতে হবে, গ্রামে। দেখতে হবে গ্রামের মানুষ। এদিকে লাইলির ঘর গোছানো শেষ। গোলম আলী নাস্তা নিয়ে এলো।
টেবিলে সাজানো হলো নাস্তা। তিনটি প্লেটে খাবার দিয়ে গোলাম আলী দাঁড়িয়ে রইলো। হাশেম ও ঝন্টু এসে বসলো। লাইলিও আসলো। প্লেট তিনটি দেখে লাইলি বললো। প্লেট তিনটি কেনো?
গোলাম আলী আমি পরে খাবো।
লাইলি, পরে কেনো?
এমনি।

এমনি কি? খাবার নিয়ে আসো আমার সবাই এক টেবিলে বসে খাবো। তারপর আমাদের বাড়ি যাবো। হাশেম ও ঝন্টু এই কথায় সায় দিল। গোলাম আলী একটি চেয়ার এনে খাবার খেতে বসে পড়ে। এক সঙ্গে খাবার খাওয়ার মজাই আলাদা। খাবার টেবিলে হাশেম ও লাইলি চোখে চোখ পড়তেই দুজন অন্যরকম হয়ে গেল। মুহুর্তেই চোখ সরিয়ে নিল দু‘জন। মনে পড়ে গেল সেই পুতুল খেলার কথা। হৈচৈয়ের দিনগুলো। আজ লাইলি কত বড় হয়েছে। ঘর গুছিয়ে দিয়েছে আমার।

ঝন্টু উঠে দাঁড়ালো। কুড়াল আর দাও বের করতে বললো হাশেমকে। হাশেম গোলাম আলীকে বলল, যা বাড়ির প্রবেশদারে যে ডালাপালা পড়ে আছে সেইগুলো পরিস্কার করে দে।
যে কথা সেই কাজ। গোলাম আলী কাজ শুরু করে দিল। কাজের সঙ্গি হলো সবাই। বাড়ির প্রবেশদার পরিস্কার করা এতো সহজ নয়। ঘাম ঝরতে থাকে। এই প্রবেশদারে এত ডালাপালা কেনো পড়ে আছে। সব ঝড় কি এই বাড়িতেই এসে পড়েছে?
আমাদের বাড়ির ডালপালা কেনো ভাঙলো না?
কাল তো ঝড়ের ভয়ে ঘরে আমরাও গেলাম।
তবে আর বলতে পারবো না, রাতে কি হয়েছে। এতো ঝড় হয়েছে আর আমরা কিছুই বলতে পারলাম না! এই বাড়ির জন্য কত খুন হয়েছে!

খুন!

কত খুন! এই খুনের জন্য বাবুমিয়ার জমিদারি হারিয়ে। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই আন্দোলনের মুখে বাবুমিয়া তার হারিয়েছে জমি। জমি হীন হয়ে দিশে হারা বাবুমিয়া। কি করবে! চারিদিকে রক্তের হোলিখেলা। এই রক্তের দাগ এসে আঁচর লাগে বাড়ির সীমানায়। রক্তের ভয়ে বাড়ি রেখে পালিয়ে যায় বাবুমিয়া। রক্তের খেলা থেকে বাঁচতে কোথায় যাবে? ভাবতে থাকে। ভাবনা একটি রক্ত যেনো চোখের সামনে না আসে। তাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

এই বাড়ির শিকদার ছিল কাশেমের দাদা। তারই কুটকৌসলে ঝরেছে রক্ত।
হয়েছে এই দেশের উল্টপালট খেলা। কোথায় ঠাঁই নিয়েছে সেই বাবুমিয়া? ভারত, পাকিস্তান, নাকি অন্য কোনো দেশে। কাশেমের দাদা আসিন হয়ে দখল করে নেয় এই বাবুমিয়ার বাড়ি। এ কথা ভাবতেই হাশেম চমকে ওঠে। গোলাম আলী কাটতে থাকে ডালাপালা। ঝন্টু ও লাইলি সরিয়ে ফেলে।

তারা জানতেও পারে না হাশেম এত সময় কি ভাবছে। কি তুফান বয়ে গেছে তার মনের ভেতর। কর্মমুখর সময় চলতে থাকে। বাড়ির ভেতরে যাওয়াই যেনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে দুপুর হয়ে আসছে। লাইলি বলছে, রান্না না করলে আমরা খাবো কি?

হাশেম বলছে হ, রান্না করতে হবে।
চাল ডাল দাও আমি রান্না করি?
লাইলি তুই শহরের মেয়ে এই মাটির চুলায় রান্না করতে পারবি?
হ্যা, পারুম।
তা হলে চল, আমি চাল, ডাল বের করে দেই।
ঝন্টু বলল, না এই ডালপালা কেটেছেটে বাড়ির ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই আজ ঢাকা ফিরে যাই।
না, আজ থাকো ,দেখি চেষ্টা করে।
লাইলিও এই কথায় সায় দিল। কাজ চলতে লাগলো গোলাম আলী, ঝন্টু আর, হাশেম কাজে মন দিল। লাইলি চলে গেল রান্নার আয়জোনে।

Series Navigation<< রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। পর্ব নয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *