রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। পর্ব নয়

নয়

হাশেম যখন বারিন্দায় বসে রাতের স্বপ্নে দেখা কথাগুলো ভাবছিল, ঠিক তখনি বাবুমিয়ারবাড়ির কথা সামনে চলে আসে। সামনে এসে দাঁড়ায় সিজান সুজন ও কাশেম। সিজান ও সুজনের কথা ভুলতে পারলেও ভুলতে পারেনি কাশেমের কথা। খুন। খুনের কথা। যা ময়না পাখির কন্ঠে ভেসে ওঠে।কাশেমের কথা ভাবতেই, ডালিম গাছের ডালে একটি ঝাঁকিতে নড়েচড়ে ওঠে। ঠিক তখনি ময়না পাখি এসে ডালিম গাছের ডালে এসে বসে। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটতে থাকে। ময়নাপাখি যেনো হাশেমের অতি আপন কেউ। খুব বেশি কথা বলে ময়না পাখি, তা কিন্ত নয়। দুই একটি কথা বলেই উড়াল দিয়ে চলে যায়। ময়না পাখি কোথা থাকে তা জানে না হাশেম। কিন্তু কেনো কাশেমের কথা ভাবতেই ময়না পাখি উড়ে আসে। নতুন কোনো কথা থাকে তার কথার ভেতর।

যা হাশেমের মনকে নতুন কিছু জানার ইচ্ছে জাগায়। সেই কথাগুলোর সুত্র ধরে ভাবনার জগৎ সৃষ্টি হয়। ঠিক তখনি হাশেমের মন উতালপাতাল হয়ে যায়।
হাশেমের মনে একটি প্রশ্ন খেলা করে, এই বাড়ি যদি বাবুমিয়ারবাড়ি হয়,
তা হলে কাশেম কে?
বাবুমিয়াই বা কে?
বাড়ির মালিকানায় ঘাপলা আছে কি?

আবার ভাবে, বাড়ি নিয়ে যদি ঘাপলাই থাকবে, তা হলে কাশেমের বাবা ও কাশেম কীকরে এই বাড়িতে এতদিন থাকলো! কেউ তো দাবি করলো না, বাড়ির মালিকানা নিয়ে। তাদের নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্নও করেনি।
ময়না পাখি বলে, হাশেম, হাশেম।
জি, ময়না পাখি। কিছু বলবে?
কাশেম কে নিয়ে তোমার ভাবনার শেষ নেই, তাই না?
না, কাশেমকে নিয়ে কি ভাববো? কাশেম তো আর এই দেশে নেই। খুন নিয়ে ভাবছি।
এই খুনের কারনে বাবুমিয়ারবাড়ি মালিক হয়েছিল কাশেমের বাবা।

কি বল ময়নাপাখি?
আমি ঠিকই বলেছি।
তা হলে এই বাড়ির প্রকৃত মালিক কাশেমরা নয়?

ময়না পাখি উড়াল দিয়ে চলে গেল। হাশেমের মনের ভেতর এক অজানা রহস্য এসে বাসা করলো। এদিকে গ্রামের মানুষ জানে এই বাড়ি ঝন্টুদের। হাশেমও তাই জানে। সময় দৌড়াতে থাকে। হাশেম ভাবতে থাকে আমার দেখা এই আম গাছটি। ছোট ছিল। বড় হলো। আমের মুকুল এলো। কড়াআম দেখলাম। কাচাআম দেখলাম। পাকা আম দেখলাম। আমহীন গাছ দেখলাম। আবার মুকুল আসে। আম ধরে। আম পড়ে। গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। আম গাছের ডালে পাখি বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে। ছানা ফোটায়। উড়াল দিয়ে চলে যায়। গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো পাখি কি দাবি করে আমি এই গাছের মালিক?

পাখি দাবি না করলেও কোনো মানুষ দাবি ঠিকই করে। আমি এই গাছের মালিক। এই গাছের ফল আমার। ভূমি যার মালিক সে। এই ভূমির মালিক কে?
তা হলে কি এই বাড়িতে বসে বাবুমিয়া জমিদারি পরিচালনা করতো?
এই প্রশ্ন হাশেমের মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
এমন সময় গোলাম আলী এসে হাজির।
কিরে কোথা গেছিলি?
সারা ফুলপুর ঘুরে এলাম।
কি দেখলি?
একটি বুনোহাঁস?
বুনেহাঁস সে আবার কি? বুনোহাঁস নামে কোনো হাঁসতো
দেখিনি। রাজহাঁস দেখেছি।
তুই দেখেছিস বুনোহাঁস?

হ্যাঁ দেখেছি, ঝন্ধসটুদের বাড়ি থেকে একটি বনোহাঁস এসে ঝিলে নামলো। যে দেখে সেই বলে এরকম হাঁসতো আমরা আর কখনো দেখিনি। সোনা রঙের পাখা। হাঁস জলে ভাসছে। মাছ ধরে গিলছে। গুলগুলি গিলছে। গ্রামের মানুষ যখন এই হাঁসটি ধরার চেষ্টা করলো ঠিক তখনি হাঁসটি উড়াল দিয়ে বনে চলে গেল। তাই সকলে বলতে লাগলো এটি বনোহাঁস। আমিও না চিনে বললাম বনোহাঁস। তুমি যেমন কাশেমের কথা ভাবো। কাশেমের বাড়ির কথা ভাবো, আমিও ঐ বাড়ির বিড়ালের কথা ভাবি। বিড়ালের কথা ভাবতেই ঘটেগেল এমন ঘটনা। কিরে গোলাম আলী তোরও কি আমার মতো ভাবনার রোগ ধরেছে নাকি?

যে যার সঙ্গে থাকে সে তার মতোই হয় কিছুটা।
আমি কার মতো হয়েছি?
তাতো জানি না।
তুই যে আমার মতো হতে চাস কেনো?
বাবুমিয়ারবাড়ির রহস্য জানতে?
হা হা করে একগাল হাসি দিল হাশেম। তা হলে আমার সঙ্গে তুমিও আছো।
তোমার সঙ্গে আছি কি না জানি না। তবে, বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে।
আমরা যে বাড়িতে বসে আছি এই বাড়িও নাকি ঐ বাড়ির অংশ ছিল।
আবারও একগাল হাসি দিল হশেম।
হতেই পারে।
কী বলছো?
হ্যা আমি ঠিকই বলছি।
যে বাড়ি নিয়ে কথা বলছি ঐ বাড়িটি যদি জমদিার আমলের হয়। তা হলে
বাবুমিয়া জমিদার ছিল। এবং মুসলিম ছিল।
এটা তুমি কি করে অনুমান করলে?
বাবুমিয়াবাড়ির নাম ফলক দেখে।

এর আগে তো এমন করে কেউ ভাবেনি। পলাশি যুদ্ধের পর এই দেশ ব্রিটিশ শাসন করেছে জমিদারদের মাধ্যমে। হিন্দু মুসলিম সব ধরণের জমিদারই ছিল। এই এলাকা ছিল মুসলিম জমিদারের খাজনার আওতায়। তাই এলাকা বাবুমিয়ারবাড়ি নাম হওয়া সাভাবিক।

তাই?
হ্যা।

তা, হলে এই বাড়ি কাশেমদের হলো কীকরে? ঝন্টুদের হলো কীকরে?

আমরা মানুষ বারবার ভাগ হয়ে যাই। জাত জাতে ভাগ হই। ধর্মে ধর্মে ভাগ হই। ভাষায় ভাষায় ভাগ হই। দেশ দেশ ভাগ হই। আমারা লড়াই করি। আমরা দখল করি। মাটি ভাগ করে ফেলি, মাটি ভাগ হয় না। নদী ভাগ করে ফেলি, নদী ভাগ হয় না। পানি ভাগ করে ফেলি, পানি ভাগ হয় না। এই ভাগে খেলায় আটকা পরে আছে বাবুমিয়ারবাড়ি। ভাগাভাগির খেলায় মেতে আছে মানুষ। রক্ত আর খুন। যে খুনের দায় ভার বহন করছে মাটি, ঘর-বাড়ি।

তারা তো কথাই বলতে পারে না। লড়াই করতে পারে না। তাদের আবার দায় কী?
তারাতো ফলদান বৃক্ষের মতো। যখন ফল পাকে তখন অধিকার জন্মে পাখির।

পথিকের। যে এই ভূমির মালিক। তখন আগ্রাসিন প্রতিবেশির চোখ পরে ঐ গাছের দিকে। প্রথমে ফল, পরে গাছ ও জমির ওপর। এই চাওয়া পাওয়া ভেতরেই রক্ত, খুন। শক্তির ভেতরেই চলে দখল দারির খেলা। সময়রের কাটা ঘুরতে থাকে। গল্পও চলতে থাকে। হঠাৎ ঝড় চলে এলে। গাছপালা নড়েচড়ে ওঠে। হাশেম ও গোলাম আলীর আলাপচারিতা বন্ধ হয়ে যায়। বারান্দার পরিবেশ পাল্টে যায়। ঘরের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

Series Navigation<< রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। পর্ব একরহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। পর্ব দশ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *