শিশুতোষ।। মুক্তিফৌজ।। তোফায়েল হোসেন

শুধু বন্দুকে গুলি লোড করা শিখেছে মাত্র। পাশে দাড়িয়ে দেখছেন কর্ণেল নওফেল। আন্তরিকতার সাথে কোচ হিসেবে টার্গেট মিলানো শেখাচ্ছেন রক্তচোখের হাবিলদার জমির উদ্দিন। যার চোখে তাকালে দেখা যায় চোখ দিয়ে যেন এখনি ঠিকরে বেরোবে আগুনের লেলিহান শিখা, পুড়িয়ে দিবে পাকিস্তানি ইয়াহিয়ার শয়তানী সমর্থনকারী দুষ্কৃতিকারী চেলাচামুণ্ডাদেরকে। তিনি বলে উঠলেন- এবার সবাই ডান কাঁধের নিচে বুকের একটু উপরে বন্দুকের বাটের শেষাংশ লাগান, আস্তে করে ট্রিগার গ্রুপে হাত দিন, ট্রিগারে আঙুল ঠেকান, বাটে চোঁয়াল ঠেকিয়ে টার্গেট ডিসটেন্স কন্ট্রোল সাইটের ব্যাক সাইট ইউ ফ্রন্ট সাইট টি এর মাঝামাঝি পিনের উপর দিয়ে টার্গেট এর বুক বরাবর লক্ষ্য করুন, এবার লম্বাশ্বাস নিয়ে বুক ভরে ফেলুন, তারপর শ্বাস কন্ট্রোল করুন। টার্গেট মিলান। আত্মবিশ্বাসের সাথে ট্রিগার টানুন। হাবিলদার জমির ট্রিগারে টান দেয়ার কথা বলার সাথেসাথেই সবাই ট্রিগার টানে। ভিতরে চাঁপা উত্তেজনা। জীবনে প্রথম নিজেদের হাতের বন্দুকের গুলির শব্দে কিছুটা ভয় পেলেও চোখেমুখে ফুটে উঠেছে আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছায়া। টগবগে তারুণ্য ও পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে ক্রোধে ফুঁসে উঠছে সবাই। ট্রিগার টানার সাথেসাথেই ট্যাঁট্যাঁ… শব্দে শাঁশাঁ শিষ তুলে একেকটি গুলি ছোটে গিয়ে লাগলো প্রত্যেকের একশ মিটার সামনে টার্গেটের মাঝখানের বুলের কেন্দ্রবিন্দুতে। কর্ণেল এসে প্রত্যেকেরই পিঠ চাপড়ে দিলেন। সামনে এগিয়ে গেলেন এবং বললেন ভয় পেয়োনা, এভাবেই প্রত্যেক পাকিস্তানি হানাদারদের বুক ঝাঁঝরা করে দিতে হবে আমাদেরকে। কর্ণেল এর কথা শোনে সবাই বলে উঠে আমরা দেশকে মুক্ত করতে জীবন দিতেও রাজী আছি কর্ণেল। সারাদেশে মা-বোন, শিশু, বৃদ্ধদেরকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর করা নির্মম অমানবিক নির্যাতনের কথা সহ নানা অসংগতির কথা বললেন। কর্ণেল সবার মুখে তাকিয়ে দেখলেন যুদ্ধ করার জন্য সবাই যেন উন্মুখ হয়ে আছে, মৃত্যুভয় নেই কারো মুখে। একেকজন মুক্তি যেন একেকটা পারমানবিক বোমা। সত্যিই পারমানবিক বোমা হয়ে দেখা দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়। কেউ পিছু হটেনি, কেউ আপোষ করেনি, ক্ষুধার্ত থেকেও যুদ্ধ করেছে অকাতরে। সম্মুখে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বুকে মাইন নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে ট্যাংক এর নিচে। কেউকেউ গ্রেনেড হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শত্রুর স্থায়ী ব্যাংকারে। এই মুক্তি সেনার দলে আছে ছাত্র, দিনমজুর, ঢাকার বুকে রাতদিন এক করে চালানো রিক্সাওয়ালা, মুড়িচানাচুর বিক্রেতা সহ অনেকেই। মনোযোগ সহকারে কর্ণেল এর সমস্ত কথা শুনলো তরুণ মুক্তি সেনার দল এবং তারপর তাদেরকে শপথ বাক্য পাঠ করানো হল। শপথ বাক্য পাঠ শেষে সবার প্রতি ধন্যবাদ শুভ কামনা জানালেন কর্ণেল এবং পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে বলে অপস্ অফিসার মেজর মিনহাজকে সাথে নিয়ে কমান্ডপোস্ট এর দিকে এগিয়ে গেলেন। মুক্তি সেনারা সমস্বরে বন্দুক উঁচিয়ে শ্লোগান দিলেন – জয় বাংলা…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *