শিশুতোষ গল্প।। ফুলবাড়ির যুদ্ধ।। ইমরুল ইউসুফ

গুলির শব্দে হোসেনের ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে শুনতে চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারে না। আবার গুলির শব্দ। লাফিয়ে ওঠে হোসেন। জানালাটা একটু ফাঁক করে। এক চোখ দিয়ে তাকায়। বাইরে অন্ধকার। ঘরের পাশে কলাগাছ ছাড়া হোসেন আর কিছুই দেখতে পায় না।

            আবারও গুলির শব্দ ভেসে এলো। পর পর চারটি গুলি ফুটল। হোসেন এবার সত্যিই ভয় পেলো। সে তার মাকে ডাকল। মা হোসেনকে জড়িয়ে ধরল।

বলল, ‘খোকা একদম চুপ। কোনো কথা বলবি না। মনে হয় খানসেনারা আমাদের গ্রামে ঢুকেছে। আমাদের এখন আরও সাবধানে থাকতে হবে। তোর আব্বা যুদ্ধে গেছে। খানসেনারা এ কথা জানলে আমাদের বাঁচতে দেবে না।’

            মনু মারা গেছে। ভোরবেলা খবর আসে। খবরটা শুনে হোসেনের মা কাঁদতে থাকে। মায়ের কান্না দেখে হোসেনও কাঁদে। হোসেনের বড় মামা মনু। তালতলী গ্রামের সবাই মনুকে চিনত। একটু পাগলাটে মনুকে সাবাই ভালোবাসত। অথচ তাকে প্রথম বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। তারপর গুলি করে মারা হয়েছে। মনুর অপরাধ সে তালতলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বলেনি। শুধু মনু নয়- গ্রামের রতন, হারুন মাঝি, সবুর মোল্লাকেও তারা এভাবে মেরেছে। কারণ তারা সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিল। চেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

            স্বাধীনতা, কী সুন্দর কথা। সুন্দর এই কথাটি হোসেন আজ প্রথম শুনল।

মাকে বলল, ‘মা স্বাধীনতা কী?’

মা বলল, ‘স্বাধীনতা মানে কারও বাধা ছাড়াই চলাচল করা। কথা বলা। কাজ করা। অথচ পাকিস্তানিরা আমাদের তা করতে দিচ্ছে না। এ জন্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। তোর আব্বা, চাচারা যুদ্ধ করছে।’

            যুদ্ধ কথাটি শুনেই হোসেনের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। নিশ্বাস ঘন হয়। গরম হয়ে ওঠে কান। মনে পড়ে যায় গত রাতের কথা। ঠা ঠা গুলির শব্দের কথা। ওরা আমার মামাকে গুলি করে মেরেছে। সবুর চাচাকে মেরেছে। আমিও ওদের গুলি করে মারব। মনে মনে বলে হোসেন।

            হোসেনের মাথায় এখন একটাই চিন্তা। তাড়াতে হবে। পাকসেনাদের এ দেশ থেকে তাড়াতে হবে। কারণ ওরা আমাদের মারছে। আর এ কাজে খান সেনাদের সহযোগিতা করছে গ্রামের কিছু খারাপ মানুষ। এরা রাজাকার। এদেরও শাস্তি দিতে হবে। এরা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা চায় না। বাংলাদেশ নামে স্বাধীন কোনো দেশের জন্ম হোক তা চায় না।

            ‘আমাদের জন্ম হয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। আমরা সবাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেব। যুদ্ধ করব।’ জোর গলায় এই কথাটি বলল সিরাজ।

হোসেন সিরাজের এই কথা শুনে দৌঁড়ে তালতলী ক্লাবে ঢুকল।

বলল, ‘সিরাজ ভাই আমিও যুদ্ধ করব।’

সিরাজ বলল, ‘না, হোসেন তুই এখনো ছোটো। তোকে যুদ্ধ করতে হবে না। তোর আব্বা যুদ্ধে গেছে। এখন তুইও যদি যাস, আর তোর খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলে খালাম্মা বাঁচবে না।’

            ‘কিচ্ছু হবে না সিরাজ ভাই, আমি যুদ্ধে যাবো। আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও।’ বলল হোসেন।

‘তাহলে আজ সন্ধ্যার পর পরই খেয়াঘাটে চলে আসবি।’ সিরাজ বলল।

            হোসেন দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম এলো না। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগল। অপেক্ষা করতে লাগল কখন সন্ধ্যা হবে।

            সন্ধ্যায় হোসেনের মা ঘরে কুপি জ্বালল। কুপি নিয়ে গেল রান্নাঘরে। এই সুযোগে মাকে না বলেই হোসেন বেরিয়ে পড়ল। বাড়ির উঠোন রাস্তা পেরিয়ে খেয়াঘাটের দিকে ছুটল।

            নৌকা ঘাটে বাঁধা ছিল। অনেকের সঙ্গে হোসেনও নৌকায় উঠল। সবশেষে নৌকায় উঠল সিরাজ ভাই। এক ঘণ্টার মধ্যে হোসেনদের নৌকা একটি চরে পৌঁছালো। নাম পাখির চর। পাখির চরের পরেই মিষ্টিপুর গ্রাম। এই গ্রামের ছেলে সুরুজ আলী। সুরুজ আলী সেখানে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলেছে। শত শত যোদ্ধাকে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বন্দুক, স্টেনগান কীভাবে চালাতে হয়, কীভাবে এতে গুলি ভরতে হয় তা শিখিয়ে দিচ্ছে। শিখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে শত্রুর মুখোমুখি যুদ্ধ করতে হবে। শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে।

            টানা সাত দিন প্রশিক্ষণ চলে। হোসেন-সহ সবাই অস্ত্র চালাতে শিখে যায়। সবার চোখে এখন একটাই স্বপ্ন। একটাই আশা। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। দেশের স্বাধীনতা আনতে হবে।

            স্বাধীনতা আনার কাজটি মোটেও সহজ নয়। বিষয়টি এই কদিনে হোসেন-সহ দলের সবাই বুঝে গেছে। এ জন্য তারা পরিকল্পনা করে। প্রথম অপারেশনটা কোথায় কীভাবে করবে তা ঠিক করে। ঠিক হয় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত দলের নেতৃত্ব দেবে সিরাজ।

            পরিকল্পনামতো সিরাজের দল ফুলবাড়ি গ্রামে পৌঁছায়। পাকিস্তানি সেনাক্যাম্প ঘিরে ফেলে। মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হয়। সবার মতো হোসেনও শক্ত হাতে স্টেনগান ধরে। শত্রুক্যাম্পে গুলি চালাতে থাকে। হোসেনের ছোঁড়া গুলিতে এক সেনাসদস্য মারা যায়। হোসেন আনন্দ করতে থাকে। তার দলের সবাই খুশি। দিন গড়িয়ে যায়। যুদ্ধ চলতে থাকে।

            তিন দিনের দিন পাকিস্তানিরা বিমান হামলা শুরু করে। তারা বিমান থেকে বোমা ফেলতে থাকে। বিমান হামলায় হোসেনদের দল পিছনের দিকে সরে যেতে থাকে। কিন্তু দলের কেউ ক্যাম্পের দিকে গুলি ছোঁড়া বন্ধ করে না। হঠাৎ একটি বোমা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে পড়ে। সাথে সাথে সালাম, লালু ও করিম শহিদ হয়। সবুজ ঘাস রক্তে লাল হয়ে যায়। রক্ত দেখে মাথা ঘুরে যায় হোসেনের। রাগে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। হোসেনদের দলের সবাই আবার শক্ত হাতে স্টেনগান ধরে। ঠা ঠা গুলি চালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা একসময় সেনা ক্যাম্প ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।

            ফুলবাড়ির যুদ্ধে হোসেনদের দল জিতে যায়। স্টেনগান উঁচু করে তারা আনন্দ করতে থাকে। প্রথম যুদ্ধে জিতে কিশোর হোসেনের মনোবল আরও বেড়ে যায়। পণ করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। তবে তার আগে যুদ্ধ জয়ের খবরটি মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে। হোসেনদের গ্রাম তালতলী শত্রুমুক্ত হয়েছে। এ খবর তারা জেনেছে নৌকা ঘাটে আসার আগেই। খবরটা শুনে তারা এক অপরকে জড়িয়ে ধরে। আনন্দে হোসেন কেঁদে ফেলে। তার মনু মামার কথা মনে পড়ে। আব্বা আম্মার কথা মনে পড়ে। হোসেন জানে না তার আব্বা বেঁচে আছে, নাকি মনু মামার মতো শহিদ হয়েছে? খবরটি জানার জন্য হোসেনের মন ছটফট করতে থাকে। এ কথা ভাবতে ভাবতে হোসেন দৌড়ে নৌকায় ওঠে। তাদের নৌকা তালতলী গ্রামের দিকে চলতে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *