শিশুতোষ গল্প।। মৌরাজ্যে মনু।। জহির টিয়া

  • আমার গুলুগুলু, লক্ষ্মীসোনা। এবার তুমি ঘুমাও।
    মা, কপালে একটা চুমু দিলো। বাড়ির আঙিনায় জাম গাছের নিচে একটা বাঁশের তৈরি মাচান। সেখানেই মা শুয়ে রেখে হেঁসেল ঘরে গেলেন। দুপুরের রান্নাবান্না করতে। মনুর ঘুমে চোখ ভারি হয়ে এলো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সে। ধীরেধীরে ঘুমরাজ্যে হারিয়ে গেলো।
    মনুর ডান গালে কে যেন চুমু এঁকে দিলো। কিছুটা টের পেল মনু। ভাবলো, মা বুঝি আবার এসেছে। তাই সে চুপচাপ শুয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে, আবার চুমু খেলো। এবার ঠোঁটে। তবুও চোখ খুলছে না মনু। কিন্তু অনুভব করে তার ঠোঁটটা ভেজা ভেজা লাগছে। সে মনে করল, মা হয়তো বেশি করে চুমু খেতে গিয়ে একটু লালা লেগে গেছে। ভাবতেই ঠোঁটটা একটু নড়ে ওঠে। তাতেই এক ফোঁটা লালা জিভে গিয়ে লাগল। মনু মিষ্টিযুক্ত স্বাদ অনুভব করল। তবুও চোখ খুললো না। মায়ের চুমু খাওয়া লালা তো মিষ্টিই লাগে ! কিন্তু আজ ভিন্ন রকম স্বাদ কেন? কেন ভিন্ন স্বাদ? মনের ভেতর প্রশ্ন জাগে মনুর। পরক্ষণে, সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে গেল মনুর কানে। ‘এই মনু, মনু ওঠো না। চলো, আমার সাথে খেলবে না?’
    এবার মনু চোখ খোলে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ তো নেই। তবে কে এভাবে ডাকল? মনুর ভেতর একটু ভয় কাজ করতে লাগল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, গতরাতে মা ভূতের গল্প বলেছিলেন। সেই রকম কিছু হবে না তো!
    মনু ভাবছে, মাকে ডাকবে নাকি! অমনি মনু শুনতে পায় আদুরে ডাক,
  • কি ভয় পাচ্ছো? ভয় পেয়েও না। আর মাকেও ডাকার প্রয়োজন নেই। এই যে আমি এখানে।
  • কে? কে? কই কাউকে তো দেখছি না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মনু।
  • তোমার ডান দিকে তাকাও। মাচানের কোণে বসে আছি।
    এবার মনু মাচানের ডান দিকে ভ্যাকাচ্যাকা হয়ে তাকায়। কিন্তু কেউ তো নেই।
  • কি, এখনো দেখতে পাও নি? ভরাট কণ্ঠে জানতে চাইল মৌমাছিটা।
    এবার মনু ভালোভাবে লক্ষ্য করে। একটা মৌমাছি সেখানে বসে আছে। আর মৌমাছিটা তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে মিটমিট করে হাসছে।
  • হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু মৌমাছিরা কি কথা বলতে পারে
  • কেন পারে না? এই যে আমি কথা বলছি, বিশ্বাস হচ্ছে না? যাদেরকে আমাদের পছন্দ হয় তাদেরকে আমরা বন্ধু বানাই। আর ওদের সাথে কথা বলি, ওদের মাতৃভাষায়। যেমন তোমার মাতৃভাষা বাংলা, তাই সেই ভাষাতে কথা বলছি।
  • এবার বুঝেছি? তাহলে তুমি কি আমায় বন্ধু করতে চাও?
  • চাই বলেই, তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তুমি আমার বন্ধু হবে না?
  • অবশ্যই হবো। কিন্তু….. গাল চুলকাইতে চুলকাইতে মনু বলল।
  • কোনো কিন্তু নয়….. চলো আমার সাথে।
  • কোথাই?
  • আমাদের রাজ্যে। মৌরাজ্যে।
  • তোমরা তো অনেক ভয়ানক। সুযোগ পেলে যাকে তাকে কামড়ে ধরো। আর তোমরা কামড়ালে জ্বর হয়, প্রচণ্ড ব্যথা পায়। গতমাসে, আমার চাচাত ভাই সনিকে কামড়ে দিলে তোমরা। তার কি কান্না! আর ব্যথায় ছটফট করছিল। ডাক্তার ডেকে তাকে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল।
  • কিন্তু আমরা কি কোনো কারণ ছাড়া কামড়াই? আমাদের রাজ্যে যখন কেউ আঘাত করে তখন বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে আমরা আক্রমণ করি। তোমার চাচাত ভাই সেদিন কত জোরেই না ইটটা ছুঁড়ল! আর তাতে আমাদের কয়েকজন প্রচণ্ড আঘাত পেল। এমন কি একজনের একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। তাহলে সেক্ষেত্রে কি করতাম তুমি বলো? আক্রমণ না করলে আরও কত ইটপাটকেল ছুঁড়তো। কিন্তু তুমি বড্ড ভালো ছেলে, সবার চেয়ে আলাদা। তাই তোমাকে আমরা বন্ধু বানিয়েছি। তুমি কি যাবে?
  • বুঝেছি। কিন্তু কিভাবে যাবো? আমি তো ওড়তে পারি না।
  • আমার পিঠের ওপর চড়ে বসো।
  • তুমি তো একেবারে ছোট্ট প্রাণি? আমার ভার বহন করবে কিভাবে?
  • ও সব চিন্তা, তুমি করো না। চড়ে বসো। দেখতে পাবে। তুুুমি স্পর্শ করলে তোমার ভার যতখানি, ঠিক ততখানিই বড় হয়ে যাবো।
    মনু মৌমাছিটাকে স্পর্শ করতেই একটা সাইকেলের সমান হয়ে গেল। যেন লাল টুকটুকে সাইকেল। আশ্চর্য ব্যাপার তো! আনন্দে বলে উঠলো মনুর মন। মৌমাছির পিঠের ওপর চড়ে বসতেই ভন্ ভন্ করে ওড়ে চলল। কি আরাম! আর তুলতুলে! প্রথমে মনুর ভয় করলেও কিছু দূর যাওয়ার পর তার ভালোই লাগছে। মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম, নদী-নালা পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। কত অপরুপ দৃশ্য উড়তে উড়তে দেখতে পায়। মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে গেলো মৌমাছি ওদের মৌরাজ্যে। মনুকে পিঠ হতে নামিয়ে দিলো বন্ধু মৌমাছি মৌটুকি। মনুর বন্ধু মৌমাছিটার নাম মৌটুকি।
    মনু লক্ষ্য করে, তাকে বরণ করার জন্য কতকগুলো মৌমাছি দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ফুলের তোড়া আর প্রত্যেকের কাছে এক গ্লাস করে মধু। এর আগে এতো রকমের ফুল আর মধুও কখখনো দেখেনি মনু। তারপর মৌটুকি মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
  • চলো বন্ধু, আমাদের রাণীর কাছে।
    ডিমের মতো চোখ বড় বড় করে মনু জানতে চাইল,
  • তোমাদের রাণী থাকে বুঝি?
  • কেন থাকবে না? তোমাদের যেমন মানব সমাজে রাজা-রাণী থাকে আমাদেরও রাণী থাকে। চলো, গেলেই দেখতে পাবে।
    হেলতে-দুলতে, হেলতে-দুলতে পৌঁছে গেল রাণীর দরবারে। রাজসিংহাসন কী অপূর্ব ! এর আগে কখনো মনু রাজসিংহাসন দেখেনি। মায়ের মুখে রাজা-রাণীর অনেক গল্প শুনেছে সে। সেখানে রাজসিংহাসন এর কথা বলতো তার মা। সেই থেকে মনুর রাজসিংহাসন দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল রাজসিংহাসনের দিকে। মনু দেখতে পায়, রাণী রাজসিংহাসনের স্বর্ণখচিত চেয়ারে বসে আছেন। তার পাশের চেয়ারটা ফাঁকা। মনু বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই কি তাই? কতকিছু ভাবনা ঘিরে ধরে তাকে। মৌটুকি, মনুকে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
  • এই মনু, দাঁড়ালে কেন? মহারাণী ডাকছে তো তোমাকে। রাণীর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসো। রাণী মা তোমার সাথে কথা বলতে চায়।
    মৌটুকির কথায় মনু টের পেয়ে হকচকিয়ে ওঠে।
  • হ্যাঁ, তাই তো! যাচ্ছি বন্ধু।
    রাণী ডাক দিলেন। ভারী মিষ্টি সুরে।
  • এই মনু, এদিকে এসো। এই চেয়ারে বসো।
    মনু ধীরে ধীরে গিয়ে সেই চেয়ারে বসে। চেয়ারটা দুহাত দিয়ে নাড়ানাড়ি করতে থাকে। রাজসিংহাসনের চেয়ার। যেমন তেমন সাধারণ চেয়ার না। মনু এর আগে কখখনো এমন স্বর্ণ খচিত চেয়ার দেখেনি। তার নিজের বাড়িতে দুইটা কাঠের চেয়ার আছে। তাও আবার জোড়াতালি লাগা।
  • মনু, কেমন আছো? আমাদের এই মৌরাজ্য তোমার কেমন লাগছে ?
    রাণীর প্রশ্নে মনু যেন প্রাণ ফিরে পায়। মনু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
  • আপনি, আমার নাম জানলেন কেমন করে?
    মৌরাণী অট্টহাসি হেসে বললেন,
    যাকে আমরা বন্ধু ভাবি, শুধু তার নাম নয়। তাদের পরিবারের সবকিছুর খবর রাখি। তারা কে, কোথায়, কি করে সবই জানি? যেমন তোমার মা, এখন রান্না করছে। ঠিক না?
  • হ্যাঁ তা ঠিক। আপনি জানলেন কিভাবে?
  • বললাম না, যাকে বন্ধু ভাবি তাদের পরিবারের সবকিছুর খবর রাখি। এখন তোমার মা সজনে শাক রাঁধছে। ভাত রান্না হয়ে গেছে। বিশ্বাস হয় না? দেখবে?
  • হ্যাঁ, কিন্তু কিভাবে সম্ভব!
    রাণী সিংহাসনের পাশে হতে একটা ছোট সোনালি রঙের গ্লাসের মতন কি যেন বের করলেন। ঠিক যেন পানি পান করা কাঁচের গ্লাস।
  • বিশ্বাস না হলে এই যে দেখো। এইখানে চোখ রাখো।
    মনুর হাতে সোনালি গ্লাসটি দিলেন রাণী। হাতে নিয়ে প্রথমে একটু নাড়াচাড়া করল মনু। তারপর গ্লাসের ভেতরে চোখ রাখতেই, মনু তাদের পুরো বাড়িটা দেখতে পেল। তা দেখে, আরো অবাক হয়ে যায় মনু। সত্যিই তো মা রান্না করছে। চুলার ওপর সজনে শাকের পাতিল। আর চুলার পাশেই ভাতের হাঁড়ি। মনু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে,
  • এটা কি করে সম্ভব? আচ্ছা তাইলে আমার বাবাকে দেখাতে পারবেন?
  • অবশ্যই। কেন পারবো না?
    রাণী হাতে সোনালি গ্লাসটি নিয়ে, একটু পেছনের দিকে কি যেন ঘুরালেন। মনুর দিকে হাত বাড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
  • এই নাও মনু। দেখো, তোমার বাবা এখন কি করছে?
    মনু সোনালি গ্লাসটি হাতে নিয়ে আবার দেখতে লাগল। গ্লাসের ভেতরে চোখ রাখতেই সত্যি, সত্যিই তার বাবাকে দেখতে পেল। তার বাবা অন্যের জমিতে কামলা দিচ্ছে। কোদাল হাতে মাটি কাটছে। মনুর ইচ্ছে করছে বাবা বলে ডাকতে। মনু বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল তার বাবাকে।
  • কি মনু, দেখতে পেলে?
    রাণীর কথাতে সেখান হতে চোখ সরালো মনু। তারপর এক গাল হাসি হেসে বলল,
  • হ্যাঁ, পেয়েছি। বাবা মাঠে মাটি কাটছে।
  • তখন তুমি বললে না, এটা কি করে সম্ভব? বলছি শোনো তাহলে, তোমাদের মানব সমাজেও এমন যন্ত্র আছে। বহুদূরের জিনিসকে কাছে টেনে বড় করে দেখতে পাওয়া যায়। তোমাদের ওটার নাম কি তুমি জানো? মনে হয় তুমি জানো না। তোমাদের ওটার নাম “টেলিস্কোপ”। দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যায় এই যন্ত্রের সাহায্যে। তেমনি আমাদের এটার নাম “মৌলিস্কোপ”। যা তুমি দেখলে কিছুক্ষণ আগে এর কি কাজ। তুমি বড় হয়ে লেখাপড়া করলেই তোমাদের টেলিস্কোপ দেখতে পাবে। যারা লেখাপড়া করে তারই দেখতে পায়। স্কুল-কলেজ এইগুলো থাকে। এবার শোনো, খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে। আগামী শিক্ষাবর্ষে স্কুলে ভর্তি হবে, বুঝেছো?
  • হ্যাঁ বুঝেছি। কিন্তু আমরা তো অনেক গরীব।
  • গরীব হলে তো কি? গরীব যারা, তারাই দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে লেখাপড়া করে সফলতা অর্জন করেছে। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী ঘাঁটলে জানতে পারবে। তাই লেখাপড়া করতে হবে। জ্ঞানী হতে হবে। শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তবেই যশ-খ্যাতি পাবে। যা ইচ্ছে করলে তুমিও পারবে। তোমাকে পারতেই হবে। আর তোমাকে তো সাহায্য করার জন্য আমরা আছি। সুখেদুঃখে আমরা তোমাদের পাশে থাকবো। আশা করি, বুঝতে পেরেছ?
    মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো মনু।
    মনু ও মৌরাণী আরো অনেক অনেক গল্প করল। মৌরাণী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
  • তোমার যাবার সময় হয়ে এলো মনু। কারণ তোমার মা’র রান্না শেষের দিকে। রান্না শেষ হলেই তোমাকে খুঁজবে খাওয়ার জন্য। ওদের সাথে গিয়ে আমাদের রাজ্যের কিছুটা ঘুরে ঘুরে দেখে নাও। আবার পরবর্তীতে আসবে তখন, আরো কথা হবে। অনেক কিছু দেখতে পাবে। এই বলে রাণী, মনুকে বিদায় দিলেন।
    মনুর বন্ধু মৌটুকির সাথে আরও কয়েকজন এসে, মনুকে নিয়ে গেল। মনুকে মৌরাণীর রাজপ্রাসাদটা ঘুরে ঘুরে দেখাল। বন্ধু মৌমাছিটি মনুকে বলল,
  • বন্ধু,পিঠের ওপর চড়ে বসো, সময় বেশি নেই। অল্প সময়ের মধ্যে তোমাকে কিছু দেখিয়ে রেখে আসব। উৎসুক চোখেমুখে মৌটুকির পিঠের ওপর বসে মনু বলল,
  • তোমাদের রাণী তো খুব ভালো। প্রাণ জুড়িয়ে গেছে তার ব্যবহারে। আসলে তোমরা সবাই অনেক ভালো।
  • হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছো। আমাদের রাজ্যে, অন্য রাজ্যের কেউ এলে তারা কেউ কোনদিন দূর্নাম করতে পারে না। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাদের সাথে ভালো ব্যবহারের পাশাপাশি ভালো অ্যাপায়নের। খুব খুশি হলাম তোমার কথা শুনে বন্ধু।
    তৃপ্তি ভরা মনে মনু জানতে চাইল,
  • বন্ধু, এখন আমাকে আর কোথাও নিয়ে যাবে নাকি
  • হ্যাঁ, আমাদের রাজ্যের কয়েকটা দর্শনীয় স্থান দেখিয়ে নিয়ে আসি।
  • কিন্তু, দেরি হয়ে যাবে তো? মা খুঁজবে।
  • সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমার মা, তোমাকে খোঁজার আগেই পৌঁছে দিবো।
  • আচ্ছা, ঠিক আছে।
    মৌমাছিরা উড়তে উড়তে এক লাল পাহাড়ের চূঁড়ার ওপর দাঁড়ালো। পাহাড়ের নাম “লাল পাহাড়”। লাল পাহাড় মানে সবকিছুই এখানে লাল। কোনটা টুকটুকে লাল, কোনটা গাঢ় লাল, কোনটা ফ্যাকাশে লাল। যতদূর চোখ যায়, তত দূর-ই শুধু লাল আর লাল। লালের সমারোহ। গাছপালা, গুল্মলতা, পশুপাখি সবকিছুই লাল।
    পাহাড় হতে ঝর্না হয়ে অবিরামভাবে পড়ছে লালচে জল। সেই জলে সাঁতার কাটছে দলে দলে সুশ্রী লাল মৌপরীরা। কি অপূর্ব ! কি অপূর্ব! সুন্দর দৃশ্য! একে তো মনুর প্রিয় রঙও লাল। তা দেখে বিমোহিত হয়ে যায় আরও। মনু চাঁদের মতো উজ্জ্বল, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখে টেনে বলল,
  • কি দারুণ! এর আগে কখখনো কল্পনা করিনি। মনঃপ্রাণ ভরে গেল বন্ধু।
  • চলো, আরও সামনে। আরও অনেক কিছু দেখতে পাবে
  • আরো কিছুক্ষণ থাকি। অনেক ভাল লাগছে।
  • না বন্ধু। হাতে সময় বেশি নাই। পরে আবার আসবে যখন, বেশি করে দেখবে।
    এরপর মৌটুকি পিঠের ওপর মনুকে বসিয়ে উড়াল দিলো অন্যখানে। উড়তে উড়তে পৌঁছে গেল এক সাগর কিনারে। বিশাল জলরাশি। টগবগে হলুদ জল। যেদিকে তাকায় সেদিকেই হলুদ। এ যেন হলুদের রাজ্য। মনু কি বলবে? কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। বিস্ময় ভরা, অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে। মনুকে একেবারে সাগর কিনারে জলের পাশে দাঁড় করিয়ে দিলো মৌটুকি। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে সুমিষ্ট জলের ঘ্রাণ। মনু কিছুটা এগিয়ে জলের ওপর দাঁড়ালো। হাঁটুজলে নেমে দুই হাত দিয়ে অবিরত নাড়তে থাকে হলুদ জল। কয়েক ফোঁটা ছিটকে ঠোঁটে লাগতেই মিষ্টিযুক্ত স্বাদ আঁচ করলো মনু। তখন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
  • বন্ধু, এই জলগুলো মধুর মতো মিষ্টি যে খুব!
  • হ্যাঁ, মিষ্টি। কারণ এগুলো জলের মতো মনে হলেও কিন্তু জল নয়। এইগুলো মধু।
  • মধু–! এত্তো গুলো মধু।
  • আমরা লাখ লাখ মৌমাছি প্রতিদিন যতো মধু সংগ্রহ করি সবগুলোই এখানে জমা হয়।
    মনুর ইচ্ছে করছে মায়ের জন্য কিছু মধু নিয়ে যায়। কিন্তু কিভাবে বলবে বন্ধু মৌমাছিকে। লজ্জা লাগে ওর। আবার যদি লোভী বালক ভাবে। তাই কিছু বললো না। কিন্তু বন্ধু মৌমাছি মৌটুকি মনুর মনের কথা বুঝতে পারে। তখন সে হেসে বলল,
  • মনু, তুমি যতো মধু চাইবে নিতে পারবে কিন্তু আজ না। কারণ হাতে আর মোটেও সময় নেই। আমি আরেক দিন গিয়ে তোমাকে দিয়ে আসবো।
  • তুমি কিভাবে জানলে যে, আমার মধু লাগবে?
  • তোমার মনে খবর আমি সবই জানি। যেমন, এখন, এখান হতে যেতে ইচ্ছে করছে না তোমার, ঠিক না?
  • হ্যাঁ, আর কিছুক্ষণ থাকি।
  • না বন্ধু, আর হাফ মিনিটও থাকা যাবে না। এখনি আমার পিঠে চড়ে বসো। তোমার মা, তোমাকে এখনি ডাকবে।
    মনু কিছুতেই বন্ধু মৌটুকির পিঠে উঠতে চাচ্ছিল না। খুব জোড়াজোড়ি করে পিঠে উঠিয়ে উড়াল দিলো মৌটুকি। মনু, না না…. বলে চিৎকার দিতে লাগল।
    মা রান্নাঘর হতে দৌঁড়ে আসেন মনুর কাছে।
  • কি হয়েছে, বাবা? এভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলি ক্যান? কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখলি বাবা?
  • না মা, খুব মজার স্বপ্ন দেখছিনু।
    বলেই হি হি হি …. সুরে হাসতে লাগলো মনু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *