শিশুতোষ গল্প // কলা ভুত ঘোড়া ভুত // বিশ্বজিৎ বসু
বিকাল থেকে ছিল গুমোট ভাব। উত্তর পশ্চিম কোণে জমে উঠেছে সিঁদুরে মেঘ। একটু আগে শুরু হয়েছে পুবোন বাতাস। ছুটে চলেছে পুব হতে পশ্চিমে। এই বাতাস বন্ধ হলেই পশ্চিম থেকে উঠে আসবে কাল বৈশাখী ঝড়। উত্তর থেকে দক্ষিণে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক। ল্যাংড়া আম তলায় খেলা করছে এক ঝাঁক সাত বয়রা পাখি! বাড়িতে বেজে উঠেছে সন্ধ্যার শাঁখ ।
খেলা ফেলে বিস্ময় ফিরে আসে বাড়িতে। কলতলা থেকে হাত পা ধুয়ে সোজা গিয়ে বসে পড়তে।
আজ অনেক বাড়ীর কাজ। বাংলা হাতের লেখা লিখতে হবে, ইংরেজি হাতের লেখা লিখতে হবে, বাবলু স্যারের অংক করতে হবে। এছাড়া আছে সিদ্দিক স্যারের ইংরেজি আর মিত্তির স্যারের বাংলা। মিত্তির স্যারকে কাল জসিমউদ্দিনের মামার বাড়ি কবিতা মুখস্থ বলতে হবে। পড়া না পারলে স্যার বেত দিয়ে পিটায়।
বড় ঘরের মেঝোতে মাদুর পাতা, মাঝখেনে একটা হারিকেন। হারিকেনের আলোয় চারপাশে পড়তে বসেছে বিস্ময়, ছোট পিসি আর মুগ্ধ।
হাতের লেখা শেষ করে বিস্ময় মুখস্থ করতে থাকে মিত্তির স্যারের পড়া।
“আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।
ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।”
প্রতিদিন বাড়ির কাজ শেষ করার পর বিস্ময় কান খাড়া করে থাকে। রান্নাঘর থেকে যখন ঝাড়ুর খস খস আর পিড়ি পাতার খট খট শব্দ হয় তখন সে বই গুছিয়ে ফেলে। অপেক্ষা শুধু কখন মায়ের ডাক আসবে। খেতে আয়।
আজকে বাড়ির কাজ শেষ না হতেই মায়ের ডাক। বিস্ময়, তোমরা খেতে আসো। ঝড় উঠে আসছে।
রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় যেতে না যেতে শুরু হয় ঝড়। বিস্ময় মনে মনে মুখস্থ করতে থাকে
“ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ”।
বিস্ময়ের মন চলে যায় আম কুড়ানোর দিকে। বৈশাখি ঝড়ে আম কুড়ানোর মজাই আলাদা। সে নিজেদের বাড়ি হোক আর মামা বাড়িতেই হোক। কিন্তু রাতের ঝড়ে গাছ তলায় যাবার অনুমতি নাই, যেতে হবে ভোরে। সবার আগে। সবার আগে না যেতে পারলে আম পাওয়া যাবে না। অন্যরা এসে কুডিয়ে নিয়ে যাবে।
বাইরে তখন শন শন ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝিলিক। ভোরে উঠতে হলে তাড়াতাড়ি ঘুমাতো হবে। কোল বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে বিস্ময় গুনতে থাকে একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই ছিয়ানব্বই…।
মনের মধ্যে তাড়া। ভোরে আম কুড়াতে যেতে হবে। কোন এক সময়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় বিস্ময়ের। ধরাস করে উঠে বসে। ভোর হয়ে গেল নাকি।
ঘরের মধ্যে হারিকেনের টিম টিমে আলো। ছাদের উপরে মনে হচ্ছে একটি ইঁদুর হাটাহাটি করছে। টিম টিমে আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে ঘরের আসবাবপত্র। গভীর ঘুমে মা। মার গলা জড়িয়ে গভীর ঘুমে মুগ্ধ। বাবার হালকা নাক ডাকার শব্দ।
খুব সাবধানে জানালা খুলে বাইরে তাকায় সে। ঝড় থেমে গেছে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। আকাশে কালো মেঘ। মাঝে মাঝে হালকা মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি। না এখনও ভোর হয় নাই। বিস্ময় জানালা বন্ধ করে আবারও শুয়ে পরে।
সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঘুম আর আসছে না। মাথার ভিতর ঘুর ঘুর করছে আম কুড়ানো। কখন ভোর হবে। কখন ফুটকলইদের মোরগটা বাগ দিবে।
নির্ঘুম বিস্ময়ের মন ভীষণ খুশি। আজ সবার আগে সে বের হবে। কেউ তার আগে আম তলার যেতে পারবে না। প্রথমে যাবে নারকেলী তলা। নারকেলী গাছের আমগুলো এক একটা ছোট নারকেলের মত। তারপর সাঙারে তলা।
সাঙারে তলায় এক সাঙারে অনেকগুলো গাছ । চ্যাপ্টা, চিনিটুরা, কাচা মিঠে, নাক অলা, লম্বা এবং গোল। সেখান থেকে চারা তলা, তারপর সেনের ভিটায় বর্ণচোরা গাছের তলা ঘুরে মালির ভিটে। আজ সে ব্যাগ ভরে আম কুড়াবে।
না! কতক্ষণ আর শুয়ে থাকা যায়। আর এখন ঘুমিয়ে পরলে সূর্য ওঠার আগে আর ঘুম ভাঙবে না। তখন গেলে আম তলায় আমও পাওয়া যাবে না। সে আবারও জানালা খুলে বাইরেটা দেখে। মনে হয় যেন একটু ফরসা হয়েছে। না আর দেরি না। এখনই বের হতে হবে। না হলে আম পাওয়া যাবে না। অন্য কেউ এসে কুড়িয়ে নিয়ে যাবে।
বিস্ময় জানালা বন্ধ করে দেয়। তারপর নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে একটা ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি। বিস্ময় একটু দাড়ায় উঠোনে। লক্ষ্য করে মাটিতে পরে থাকা আম দেখা যাবে কি না। ঝলকানিতে দেখা যাচ্ছে পরিস্কার উঠোন। দেখা যাচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছের পাতা। বিস্ময় ভাবে গাছ তলায় পরে থাকা আমও তাহলে দেখা যাবে।
নারকেলী তলায় কিছু পাওয়া গেল না। বিস্ময় সাঙারে তলায় গিয়ে আম খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুজতে চোখ যায় চ্যাপ্টা গাছে। থমকে দাঁড়ায় বিস্ময়। ওটা কি ! জ্বল জ্বল করছে।
বিদ্যুতের ঝলকানি গাছের নিচে আসছে না। নিকষ কালো অন্ধকার। ওটা কি কোন প্রাণী,? বন বিড়াল? না শেয়াল? না শেয়াল বন বিড়াল তো গাছে উঠতে পারে না। তাহলে কি নেইল। নেইল গাছে গাছে ঘুরে। গাছের পাকা ফল খেয়ে বেড়ায়।
না এটাতো কোন প্রাণী না। প্রাণীর তো দুটি চোখ থাকে! আর আলো না পড়লে সে চোখতো জ্বল জ্বল করে না। এতো একটি আলো। তাহলে কি ওটা। ভুত! ব্রহ্মদৈত্য! ব্রহ্মদৈত্যর কপালে নাকি চোখ থাকে। বাস করে গাছে।
না ভুত হয় কিভাবে। মনিকাকা যে বলে ভুত বলে কিছু নাই। তাহলে ওটা কি? ওটা কি সাপের মনি। দিদিমা গল্প করেছে সাপ বুড়ো হয়ে গেলে মাথায় মনি হয়। সেই মনি এরকম জ্বল জ্বল করে। সাপের যখন ক্ষুদা লাগে তখন মনি কোন গাছের কোঠরে রেখে আশে পাশে খাবার খুজতে বের হয়। তারপর সূর্য ওঠার আগে মনিটাকে মাথায় তুলে নিয়ে বাসায় চলে যায়।
ভাবতে ভাবতে গা ছম ছম করা শুরু করে। বিস্ময় আর সামনে এগোনার সাহস পায় না। যদি আশে পাশে কোথাও সাপটা থেকে থাকে। না এখানে আর নয়। পিছন ফিরে
রওনা দেয় চারা তলার দিকে।
চারা গাছ। এটা এ বাডির সবচেয়ে বড় আম গাছ। সবাই বলে চারা তলা ভয় আছে। এখানে পাশাপাশি কয়েকটা আম গাছ। সিঁদুরে, হালটে, জনে, আষাঢ়ে, আঁশে। হালটে গাছের নিচ দিয়ে চলে গেছে বড় রাস্তা। অন্য গাছের নিচে বুনো গাছের ঝোপ। ঝোপের ভিতর আস্টেল, ডেমকোল, কাওয়ার টুটি কিম্বা বেত গাছ। তার উপর দিয়ে জার্মানি লতার ছাউনি। দিনের বেলা শেয়াল আর বন বিড়াল লুকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে দেখা যায় দুই একটা লাফারু।
সারা বছর এখানে কেউ ঢোকে না। শুধু মাত্র আম কুড়ানোর সময় মানুষের যাতায়াত হয়। আম পাকা শুরু হলে পাড়ার ছেলে মেয়েরা সারাদিন ঘুর ঘুর করে এর তলায়। তখন তৈরি হয় আলপথ। কমে যায় ঝোপ।
যে ডালের নিচে আম বেশী পাওয়া যায় বিস্ময় গিয়ে দাড়ায় সেই ডালের নিচে। বুকের মধ্যে দুরু দুরু। মনের মধ্যে চ্যাপ্টা গাছের সেই আলো। হঠাৎ কি যেন সামনে লাফ দিয়ে ওঠে। থমকে দাড়ায় বিস্ময় । দুপা পিছিয়ে আসে। তারপর একটু অপেক্ষা করে আরেকটা বিদ্যুত ঝলকানি পর্যন্ত। না কিছু নেই। সে আবার পা বেড়ায়। আবার কিছু লাফ দিয়ে উঠে। কিন্তু কোন শব্দ নেই। বিস্ময় আবারও দুপা পিছিয়ে আসে। আবার কিছুক্ষণ অপেক্ষা ক’রে বিদ্যুত ঝলকানির সময় পা বাড়ায়। না আবারও কিছু লাফ দিচ্ছে।
বিস্ময় পিছিয়ে আসে। ওটা কি ভুত! তাহলে তো সত্যি, চারা তলায় ভয় আছে। বিস্ময়ের গা ছম ছম আরো বের যায়। বুকে থুতু দিয়ে ভাবে , না, ভুত বলে তো কিছু নেই। কিন্তু সামনে এগোতে সাহস হয় না। উল্টো ঘুরে হাটা দেয় সেনের ভিটার দিকে।
উল্টো হাটার সময় চোখ যায় সিঁদুরে গাছে। ওকি! মানুষ বসে আছে সিঁদুরে গাছের ডালে। পরিস্কার দেখা যাচ্ছে বিদ্যুতের ঝলকানিতে। না এখানে আর নয়। হাঁটা শুরু করে সেনের ভিটার দিকে।
সেনের ভিটায় যেতে মনে পরে গর্তটার কথা। বর্ণচোরা গাছের গোড়ায় বড় গর্ত। গইজদ্দি রাজাকারকে কবর দেবার জন্য এ গর্ত খুড়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। মনে ভয় আরও বেড়ে যায়। মনে হয় কে যেন পিছে পিছে আসছে। বিস্ময় একবার ভাবে দৌড়ে বাড়ি চলে যায়। আবার ভাবে মাত্র দুতিনটা আম পেয়েছে। পিছনে ফিরে দেখে কেউ পিছনে হাটছে কিনা। না কেউ নেই। তাহলে মালির ভিটে ঘুরে যায়। বিস্ময় বাড়ি না গিয়ে রওনা দেয় মালির ভিটার দিকে। সেখানে দুটো আম গাছ। বাঘা আর টুরা। মালির ভিটায় পৌছার সাথে সাথে ঘোড়ার ডাক হিহিহিহিহিহিহি। বিস্ময়ের বুকের ভিতর থর থর করে কাঁপা শুরু হয়েছে। নিশ্চয় ভুত। এখন যে কি করবে। কেন যে এখানে এলো। বাড়ি চলে গেলে এমন বিপদে পড়তে হতে না। পা থর থর করে কাঁপছে, কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ মেয়ে মানুষের চিন চিনে কন্ঠে আওয়াজ
- কিডারে ওখানে!
নিশ্চয় ভুত না হলে চিন চিন গলায় কথা বলবে কেন। বিস্ময় থর থর করে কাঁপছে। সামনে পিছনে সরতে পারছে না।
আবারএ সেই কন্ঠ আওয়াজ কিডারে ওখানে
বিস্ময় এবার থর থর কন্ঠ উত্তর দেয়
আ-আ-আমি বি-বি- বিস্ময়! - কি করিস ওখানে
-আ আ আম কুড়ায় - এখন তো রাতে দুপুর, এখন আইছিস ক্যা, ভোরের সময় আসিস। এখন বাড়ি যা।
- তা-তাহলে হলে বা-বা-বা ড়ি যাই।
- হ, বাড়ি যা। সাবধানে যাস। অন্ধকার।
বিস্ময় পা টিপে টিপে হাটা দেয় বাড়ির দিকে । একটু পর পর পিছনে তাকায়। শাড়ী পড়া কে যেন হেটে আসছে পিছন পিছন। বিস্ময় একভার ভাবে দৌড় দেই, আবার ভাবে অন্ধকারে দৌড় দিলে যদি মাটিতে পরে যায় ভুত এসে ঘারের উপর বসবে। বিস্ময় জোড়ে হাঁটা শুরু করে। কদমতলা ভিটে পার হবার চোখে পরে সাঙারে তলায় একটা আলো। বিস্ময় আবার দাঁড়িয়ে পরে। এখন কোন দিকে যাবে। পিছনে ভুত সামনে ভুত।
কে যেন পুরুষ কন্ঠে ডাকছে। বিস্ময়, বিস্ময়। তুই কোন জায়গা। বিস্মযের গলাটা চেনা, বাবার গলা। বাবা ডাকছে! আলো হাতে ওটা ভুত না ওটা বাবা। বিস্ময় দম ফিরে পায়।
বিস্ময় উত্তর দেয় আমি রসগোল্লা আম তলায়।
বিস্ময় এবার ছুটে দৌড় দেয় বাবার কাছে। পিছন তাকিয়ে দেখে শাড়ী পড়া একজন পিছে পিছে আসছে। বিস্ময় বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে “বাবা ভূ-ভূ-ভূত”।
- কই ভুত!
- আমার পিছন পিছন আসছে।
বাবা হারিকেন উপরে তুলে ধরে বলে, কে? - পিছন থেকে চিন চিন কন্ঠে উত্তর দেয় আমি রানী। – ও রানীদি।
- হ, এত রাতে কি কেউ আম কুড়াতে বের হয়। ভোর হতে অনেক দেরি। বিস্ময়ের কি ভয় ডর নাই।
বিস্ময় এতক্ষণে মনে হয় হ তাইতো এতো চন্দ বাড়ীর পিসিমার গলা।
চার
সকালে বিস্ময়ের যখন ঘুম ভাঙে তখন বেলা হয়ে গেছে অনেক। ঘুমানোর সময় মাকে বলেছিল ভোর হলে আবার ডেকে দিতে। কিন্তু মা আর ডাকে নাই।
বিস্ময় বিছানা ছেড়ে সোজা হাটা দেয় সাঙারে তলায়। রাতে যেখান থেকে আলোটা আসছিল সেখানে। না কোন আলো নেই। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সেই দিকে। অনেকক্ষণ চোখ ঘোরাঘুরির পর শুধু চোখে পরে বিছা টাইপের একটা পোকা। গাছের কান্ডের সাথে লেপ্টে আছে।
সেখান থেকে চারা তলায়। যেখানে কিছু লাফিয়ে উঠছিল। সেখানে একটি আম পারা কোটা মাটিতে । এক মাথায় একটা ভাঙা কচুর ডগা। কোটার গোডার দিকটায় পাারা লাগলে ঢেঁকির মত অন্যপাশ উপরে উঠে আসছে। সেই সাথে কচুর ডগাটি লাফ দিয়ে উঠছে।
সিঁদুরে গাছের যেখানে মানুষ বসে ছিল সেখানে ঝুলে আছে একটি কলার পাতা। ঝরে উড়ে এসেছে কোথা থেকে।
মালির ভিটায় গিয়ে দেখে সুনিলদার ঘোরাটা তখনও সেখানে বাধা ।