জয় বাংলা শিশুসাহিত্য উৎসব।। একাত্তরের অশােক।। খালেক বিন জয়েন উদ্দীন

ছেলেটি সরাসরি আমাদের ক্যাম্পে ঢুকে পড়ল। আমরা ভাবতেই পারি নি, রাত দুপুরে

অত্তটুকুন একটি ছেলে আমাদের তিনজন সান্ত্রীকে ডিঙিয়ে কমান্ডারের মুখােমুখি হবে।

ছেলেটির হাতে একটি চিঠি। আমাদের কমান্ডার হেমায়েত উদ্দীন তখন হ্যারিকেনের মৃদু

আলােয় বই পড়ছিলেন। ছেলেটি চিঠিখানি তার হাতে দেওয়ার আগেই হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলে। আমরা তাকে সান্ত্বনা দিই। তার কান্না থামে না। সে কেঁদেই বলে, আমার

নাম অশােক। আমাদের গ্রামের নাম উনশিয়া। গতকাল ওরা আমাদের গ্রামে এসেছিল।

সারা গ্রাম ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার বড় ভাইকে গুলি করেছে। আমার দিদিকে ধরে

নিয়ে গেছে। স্যার, আপনি আমাদের বাচান। ওদের ক্যাম্পে আক্রমণ করুন। আমাকেও

আপনাদের দলে ভর্তি করে নিন। আমি মুক্তিযুদ্ধ করব।

অশােক আমাদের মুক্তিবাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। ইতােমধ্যে আমাদের দল ভারির হয়েছে।

আমরা নিজেরাই বিল-বাওড় এলাকা কোটালিপাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করেছি। প্রতিদিন এখানে অনেক ছাত্র-যুবা দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আমরাও শ্রাবণ-ভাদ্রে পাকবাহিনীর দখলকৃত থানায় পাল্টা হামলা চালিয়েছি। রাধাগঞ্জের আক্রমণে আমরা তিনজন রাজাকার ও একজন পাঞ্জাবি সেনা খতম করেছি। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে সংবাদ বুলেটিনে এই সংবাদ প্রচার করেছে। আশ্বিনের প্রথম দিকে এক গভীর রাতে আমাদের ক্যাম্পে এলেন একজন দাড়িওয়ালা মানুষ। আমরা কেউই তার কাছে যেতে পারি নি। শুধু আমাদের কমান্ডার সেই গভীর রাতে তাকে সেলুট দিয়ে নৌকা থেকে ক্যাম্পের ভেতরে নিয়ে এসেছিলেন। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা। সেই নিজঝুম রাতে দাড়িওয়ালা মানুষটি কমান্ডারকে কী বলেছিলেন, তা আমরা জানি নে। বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম অশােকের ছােটোছুটি। শেষ রাতের দিকে জেনেছিলাম ইনি মেজর জলীল। ৯ নম্বর সেকটরের কমান্ডিং অফিসার।

আশ্বিনের শেষনাগাদ আমরা পাকসেনাদের আশ্রয়স্থল কোটালিপাড়া খাদ্য গুদামে আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। কিন্তু এ খবর কীভাবে যেন জানাজানি হয়ে যায়। ওরা তখন খুলনা, যশাের ও গােপালগঞ্জ থেকে আরাে সেপাই এনে আমাদের সমগ্র জলাভূমিতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। জহরকান্দির যুদ্ধে বাবুল, অসিত, সােলেমান ও আব্বাসসহ আমাদের কমান্ডার হেমায়েত ভাই গুরুতরভাবে আহত হন। তার গালের ডান পাশ দিয়ে একটি গুলি অপর পাশ ভেদ করে চলে যায়। দাঁতের চোয়াল ও মাড়ি ভেঙে যায়। সেই মরণপণ যুদ্ধে আমরা আহত হলেও ওদের গ্রামে ঢােকার প্রতিরােধে জয়ী হই। ওরা পয়সা হাটের কয়েকটি দোকান লুট করে এবং পাশের একটি বাড়িতে ঢুকে হাঁস-মুরগি, খাশি ও একটি গরু নিয়ে যায়।

যুদ্ধ চলছে। সমগ্র বাংলাদেশে শত্রুহননের পালা। এখন আর গেরিলা আক্রমণ নয়, সরাসরি সম্মুখযুদ্ধ। জলাভূমির যুদ্ধ। ওরা আসে নদী বেয়ে, খাল বেয়ে। আমরা কখনো। নৌকায়, কখনাে ডাঙায়। এত দিন অশােক আমাদের মূল ক্যাম্পে থাকত। কিন্তু ওর মা মুজিবনগরে চলে যাবার পর সে শপথ করেছে মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দেবে।ইতােমধ্যে সে অস্ত্র চালনা শিখেছে। জহরকান্দির যুদ্ধে সে অংশ নিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। অশােক এখন আমাদের দলের একজন মুক্তিযােদ্ধা। সকলের আদর ও ভালবাসায় সে ভুলে গেছে ভ্রাতৃশােক। তবুও মাঝে-মধ্যে অশােককে দেখতাম আনমনা। মা ও দিদিকে দূরে রেখে এক বুক দুঃখ নিয়ে দাড়িয়ে থাকত আমাদের ক্যাম্পের পেছনের বড় পুকুরটার পাড়ে। আবার কখনাে অপারেশনে গেলে দেখতাম নৌকোয় গলুইয়ে চিৎ হয়ে আকাশ দেখছে। তবে অশােক যখন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র শুনত, তখন তাকে পায় কে? চরমপত্র শুনে উল্লাস করত, পাকসেনা খতমের সংবাদ শুনে ‘জয়বাংলা’ বলে চিৎকার করত। আমার তখন অশােককে সমান বয়সী মনে হত। গ্রাম গঞ্জে মুক্তিসেনার মারে কার্তিকের শেষনাগাদ খবর পেলাম খান সেনারা বিল-বাওড় ছেড়ে সদরে আস্তানা গাড়বে। যাবার আগে বাজারের গম ও আটার গুদাম লুট করবে। অশােক মাছ বিক্রি করতে গিয়ে এ সংবাদ সংগ্রহ করেছিল। কাল ভােরেই নাকি ওরা বাজারে আসবে। আমরা ওদের প্রতিরােধ করার প্রস্তুতি নিলাম। অশােক ও দু’জন মুক্তিসেনাকে পাঠিয়ে দিলাম। বাজারের পেছনে ঝােপ-জঙ্গলের মধ্যে। আমরা পরিকল্পনা মােতাবেক যে যার অবস্থানে চলে গেলাম। ওরাও খুব ভােরে লঞ্চ নিয়ে এল। বাজারে গুদাম ও দোকান থেকে আটার বস্তা বের করার সাথে-সাথে চারদিক থেকে গর্জে উঠল আমাদের সঙ্গীন। কিন্তু ১ ঘন্টার মধ্যেই আমরা অবস্থান থেকে পেছপা হতে বাধ্য হলাম। ওদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মুখে আমরা টিকতে না পেরে দূর গ্রামের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। ওরা সারা দিন বাজার থেকে গুলির বৃষ্টি ঝরাল এবং সন্ধ্যার আগেই নদীপথে মহকুমা শহরের দিকে চলে গেল। রাত ২ টার দিকে আমরা প্রধান ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি। সকলেই ফিরে এসেছে। কিন্তু অশােক ফিরে নাই। বাকি রাত উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটালাম। পর দিন সকালে ছুটে গেলাম বাজারে।

জন-মনিষ্যির গন্ধ নেই। পাকসেনার ভয়ে বাজারের আশে-পাশের বাড়িগুলাের লােক পর্যন্ত সরে গেছে। বাজারের উত্তর-পশ্চিমে যে ঝােপ-ঝাড় ছিল, তার একটু দূরে প্রধান সড়কের পাশে ছিল একটি বুড়াে বটগাছ। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। আমরা নৌকা থেকে নামতেই দেখি অশােক বটের ঝুরির সাথে ঝুলছে। তার কোমল কিশাের বুকটা চেরা। বেয়নেটের ঘায়ে দু উরু খােচা-খােচা বুকের তলাটা লালে লাল হয়ে গেছে। রক্তের একটি ধারা মিলে গেছে খালের পানির সাথে। অশােককে আমরা নিয়ে এলাম প্রধান ক্যাম্পে। ওকে আর পােড়ানাে হল না। মাটি দেয়া হল। এরপরে আমরা আরাে দুটো অপারেশন করেছি। অশােকের মারা যাওয়ার খবর বােধকরি তার মা ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বেই জেনেছিলেন। আমরা বিজয় দিবসের দিনই বাজারের সেই বট গাছটিকে কেটে ফেলি। এটা ছিল শােক নিবারণের একটি সহজ উপায়। জানুয়ারি মাসে ভারত থেকে ফিরে এসেছিলেন অশােকের মা ভাগ্যলক্ষ্মী দেবী। তিনি কাটা বট গাছটি দেখতে এসে শােকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।

সাতদিন ধরে বটের গােড়ায় বসে অঝােরে কেঁদেছিলেন। আমরা তাকে সান্ত্বনা দিতে সাহস পাই নি। একদিন শুনলাম— অশােকের মা ভারতে চলে গেছেন। যাবার আগে ঐ জায়গায় একটি অশােকের চারা লাগিয়ে গেছেন। একাত্তরের সেই অশােকের চারাটি মরে যায় নি। আজ তার বয়স একুশ বছর। অনেক ডালপালা তার। প্রতি বসন্তে অজস্র অশােক ফোটে আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প শােনায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *