শিশুতোষ গল্প।। অন্তরার গ্রাম দেখা।। বাসুদেব খাস্তগীর
অন্তরা ঢাকার এক নামীদামি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ঢাকা শহরেই তার জম্ম এবং বেড়ে ওঠা। কখনও সে গ্রাম দেখেনি। গ্রামের মেঠোপথ, সবুজ মাঠ, খাল-নদী, গাছপালার সাথে সে মোটেও পরিচিত নয়। বাবাকে সে মাঝে মাঝে বলে গ্রামে নিয়ে যেতে। বাবা সবসময় আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘নিয়ে যাবো মা।’ এইতো গত কয়েকদিন আগেও অন্তরা বাবাকে বলেছে, ‘বাবা স্কুলে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই নিজের গ্রাম নিয়ে গল্প করে, আমি অবাক হয়ে শুনি; আমি আমার নিজের গ্রাম নিয়ে কোনো গল্প করতে পারি না। আমাদের কি গ্রাম আছে বাবা?’
- ‘আছে মানে? অবশ্যই আছে। নিয়ে যাবো একদিন।’ বলে আবার সান্ত্বনা দেন বাবা। আরিফ সাহেবের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার অদূরে প্রত্যন্ত এক গ্রামে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তিনি। ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় গ্রামে তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। অন্তরার জম্মের পর দু-একবার গিয়েছেন নিজের বাড়িতে। বাড়িতে তেমন কেউ নেই। থাকেন এক চাচা। সবাই কর্মজীবনের টানে শহরমুখী। নিজের যে বাড়ি আছে, তা ঐ চাচাই দেখাশুনা করেন।
অন্তরা রোজই স্কুলে যায় আর প্রতিদিনই বন্ধুদের করা গ্রামের গল্প নিয়ে মনেমনে অনেককিছুই ভাবে। অন্তরা গান শিখে। দেশের গান অন্তরার বরাবরই প্রিয়। দেশের গানের কথায় গাঁয়ের যে ছবি ফুটে উঠে তা ভাবতেই অন্তরার ভীষণ ভালো লাগে। অন্তরা আজও স্কুলে গেছে। সবার সাথে হৈ হুল্লুড়ে মেতে উঠেছে। শ্রেণি শিক্ষক ক্লাসে রোল কল করলেন। পিওন এসে একটি নোটিশ দিয়ে গেলো। নোটিশের বিষয়- ‘একটি গ্রামের বর্ণনা ’ রচনা লিখন প্রতিযোগিতা। পাঁচশ শব্দের মধ্যে লিখে পনের দিনের মধ্যে জমা দিতে বলেছে। এ মাসের শেষেই স্কুলের রজত জয়ন্তী। যারা প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করবে, তাদেরকে রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করবে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বাসায় গিয়ে অন্তরা বাবাকে বলে, ‘এবার আমাকে কিন্তু গ্রামে নিয়ে যেতেই হবে।’ বাবা বলেন, ‘সামনের ছুটিতে গ্রামে যাবো।’ বাবাকে স্কুলে প্রতিযোগিতার কথা কিছু বলে না অন্তরা। অন্তরার বাবা সামনের শুক্রবারে অন্তরাকে নিয়ে গ্রামে যাবেন মনস্থির করলেন। শুক্রবার স্কুল ছুটি; তার সাথে শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় স্কুল বন্ধ থাকবে। তাই এ দুটো দিনকে গ্রামে যাওয়ার জন্য বেছে নিলেন অন্তরার বাবা। যাওয়ার ব্যাপারটা বাড়ির চাচাকে ফোন করে জানালেন। অবশেষে সেদিন অন্তরা ও তার বাবা ট্রেনে চড়ে গ্রামের বাড়ি উদ্দেশে রওনা হলেন। ঝকঝকাঝক শব্দে দূরের গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু। শহর-নগর পেরিয়ে ট্রেন ছুটেছে গ্রামের দিকে। জানলার পাশে বসে অন্তরা গ্রামের দারুণ সব দৃশ্য দেখে। ট্রেনের দুরন্ত গতি। অন্তরা দেখছে নদী, সাগর, পাহাড়সহ আরো কতো কী! শহরে কত জায়গায় বেড়ানো হয়েছে, কিন্তু এভাবে শহর ছেড়ে কখনও বাইরে যাওয়া হয়নি অন্তরার। নগর জীবনের কোলাহল ছেড়ে এ যেনো এক স্বর্গ সুখের অনুপম যাত্রা। এরকম সুন্দর দৃশ্য অন্তরার এ বয়সে আর দেখা হয়নি। প্রায় ছয়ঘন্টা ট্রেন চলার পর চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে থামলো। গ্রামের সেই চাচা অন্তরাদের নিয়ে যাবার জন্য আগে থেকেই সিএনজি নিয়ে হাজির। স্টেশন থেকে সিএনজি যোগে গ্রামের বাড়ি প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। পথে পথে যানজট পেরিয়ে যখন তারা বাড়িতে পৌঁছে, তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বাড়িতে নতুন অতিথিকে পেয়ে সবাই ভীষণ খুশি। বাড়িতে অন্তরার বাবার চাচার একটি নাতনী আছে। ওর নাম ফুলি। সে স্থানীয় স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ফুলি বেশ দুষ্টু ও চঞ্চল মেয়ে। ও অন্তরাকে বলল, ‘কালকে আমিই তোমাকে আমাদের স্কুল ও গ্রাম দেখাবো।’ ফুলিদেরও কাল স্কুল বন্ধ। কথা বলতে বলতে রাত অনেক হয়ে গেলো। ক্লান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়তেই সবার চোখে ঘুম। সকালে ঘুম থেকে থেকে উঠেই অন্তরা বাড়ির উঠোনে দাঁড়ায়। কী এক অনাবিল শান্তি! স্নিগ্ধ ভোরের ঝিরঝিরে বাতাসে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে অন্তরার। সকালের খাওয়া শেষে ফুলির হাত ধরে অন্তরা বের হয় গ্রামের পথে। ফুলির দাদু নিষেধ করে পুকুরে না নামার জন্য। গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছে অন্তরা আর ফুলি। চারপাশে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতে সোনারঙের হাতছানি, হলুদ সর্ষে-ক্ষেত, টিন ও ছনের বাড়িঘর, মাঠে সবুজ দুর্বাঘাস। অন্তরার মন দোলে ওঠে। মনেমনে শহরের সাথে গ্রামের পার্থক্য খোঁজে অন্তরা। হাঁটতে হাঁটতে অন্তরার মনে কোনো প্রশ্ন জাগলে সে ফুলিকে জিজ্ঞেস করে এবং ফুলি নিমিষেই তার উত্তর দিয়ে দেয়। কতদূর গিয়ে অন্তরা দেখে একটি বড় বটগাছ। এত বড় গাছ অন্তরা ছবিতে দেখেছে, বাস্তবে দেখেনি। প্রশ্ন করতেই ফুলি বলে, ‘এটা বট গাছ। এগাছের নিচে প্রতি বছর বৈশাখের প্রথম দিনে মেলা বসে। দাদু বলেন, গাছটার বয়স নাকি একশো বছরেরও বেশি।’
অন্তরা বলে ‘এতবড় গাছ তো আর দেখি নি!’ অন্তরা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় গাছের নিচে। পাশে দিয়েই বয়ে চলেছে নদী। ওরা নদীর কূলে ওঠে। নদীর দুপাড়ের চরে বেগুন, শশা, ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয় অন্তরা। সবজি তার বরাবরই প্রিয়, কিন্তু সে এগুলোর চাষাবাদ কখনোই দেখেনি। নৌকায় নদী পারাপার, গাঁয়ের মেয়েদের নদীতে থালাবাসন ধোয়া, দূরে আখ ক্ষেতের দৃশ্য- এ যেনো স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। অন্তরা নদীর পাড়ে হাঁটছে। সাবলীলভাবে সব দৃশ্যের বর্ণনা করে যাচ্ছে ফুলি। কাঁদামাটি আর জমির আল ধরে হাঁটার অভ্যাস না থাকলেও ভালোই লাগছে অন্তরার। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছেলেরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে। অন্তরা বলে, ‘ঘুড়ি তো আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে ফুলি।’ ফুলি হাসে। অন্তরা বলে,‘ গ্রাম সত্যিই সুন্দর রে! এখানে নেই কোনো বেশি মানুষের কোলাহল, নেই মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি আর যানজট।’ ফুলি বলে, ‘যানজট কী, আপু?’
-‘রাস্তায় বেশি গাড়ি হলে গাড়ি চলতে পারে না, অনেকক্ষণ গাড়িতেই বসে থাকতে হয়- এটাই যানজট। এর জন্য শহরে সময়মতো স্কুলে পৌঁছাতে পারি না।’ ফুলি শুনে অবাক হয়। সে বলে, ‘গাঁয়ে তো এসব কিছু নেই! আমি এক দৌড়ে স্কুলে পৌঁছে যাই।’
অন্তরার বাবা ও ফুলির দাদু ওদের খুঁজতে বেরিয়েছেন। ফুলি আর অন্তরা বাড়ির পাশেই স্কুলের বারান্দায় বসে গল্প করছে। অন্তরা আর ফুলিকে তাঁরা বাড়িতে নিয়ে এলেন। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে বিকেলে ফুলিদের থেকে বিদায় নিয়ে শহরের দিকে পা বাড়ায় অন্তরা ও তার বাবা।
রাত দশটায় ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। রাতের আঁধারে গ্রামের দৃশ্যগুলো আর তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। চোখে ঘুম এসে ভর করেছে অন্তরার। ট্রেন চলছে। অন্তরা কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর সে ক্ষণিকের স্বপ্নে গ্রামের দেখা দৃশ্যগুলোর রাজ্যে হারিয়ে যায়। একটু পরই আবার ঘুম থেকে জেগে ওঠে অন্তরা। তার মনের সেতারে বেজে ওঠে প্রিয় গান, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবো নাকো তুমি…’
ট্রেন চলছে। ফুলির জন্য তার মন পোড়ে। বেশ মিষ্টি মেয়েটা, কতো কিছুই না তাকে দেখালো। অন্তরা তার বাবাকে বলে ‘বাবা ফুলিকে একদিন ঢাকা দেখাতে নিয়ে এসো না। সে এখনো শহর দেখেনি।’ বাবা ঘুম ঘুম চোখে বলে ‘হ্যাঁ, আনবো রে মা।’ অন্তরা বাসায় পৌঁছে ভাবে, সে স্কুলের বন্ধুদের সাথে এখন গ্রামের গল্প করতে পারবে। সে মনেমনে আরো ভাবে সত্যি সত্যিই ‘তোমার দেখা গ্রাম’ নিয়ে রচনা লিখবে। বাস্তবে দেখা গ্রামকে সে কল্পনার ছবিতে রূপায়িত করার চেষ্টা করে। হাতে কাগজ-কলম নিয়ে চলছে তার নিরন্তর চেষ্টা।