সমাজমঙ্গলের কবি মজিদ মাহমুদের জন্মদিনে কাব্যশীলনের শুভেচ্ছা।
মননশীল পাঠকের কাছে মজিদ মাহমুদ একটি সুপরিচিত নাম। তাঁর গদ্য এবং পদ্য উভয় বাংলার সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর প্রথম বই ‘বৌটুবানী ফুলের দেশে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। পরের বছর প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘মাকড়সা ও রজনীগন্ধা’ (১৯৮৬)। ১৯৮৯ সালে প্রথম কবিতার বই ‘মাহফুজামঙ্গল’ প্রকাশের পর তিনি পাঠকের দৃষ্টি কাড়েন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ছাড়াও মননশীল প্রবন্ধ ও গবেষণাকর্মে খ্যাতি রয়েছে মজিদ মাহমুদের। নজরুল ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে কাজ করেছেন তিনি।
প্রতিবছরের পহেলা বৈশাখে অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল হতে পাবনার ঈশ্বরদীতে কবির জন্মস্থানে অনুষ্ঠিত হয় চারদিনব্যপী ‘চরনিকেতন বৈশাখী উৎসব’। ওসাকা ও পাবনা সাংস্কৃতিক পরিষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয় বাংলা সাহিত্য সম্মেলন। চরনিকেতন কাব্যমঞ্চে কবি মজিদ মাহমুদের ৫৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানটি বৈশাখী উৎসবের উন্মাদনা নিয়ে পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহর থেকেই বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে খই-মুড়ি-মুড়কি, মিঠাই-সন্দেশ সহযোগে নাচে-গানে, ঢোলের বাদ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। এই ব্যতিক্রমী আয়োজনে থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা এবং জমজমাট দেশজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য বাসনা থেকেই প্রতি বছরই এই আয়োজন হয়ে থাকে। এবার এপ্রিল মাসের ১৪, ১৫ এবং ১৬ তারিখ ‘চরনিকেতন বৈশাখী উৎসব ও বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’- হচ্ছে না। কারণটি সবারই জানা। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।
মজিদ মাহমুদের জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে পাবনা জেলায়। পিতা কেরামত আলী বিশ্বাস। মা সানোয়ারা বেগম। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর। লেখালেখির হাতেখড়ি শিশুবেলা থেকেই। কবিতা তাঁর নিজস্ব ভুবন হলেও মননশীল গবেষণাকর্মে খ্যাতি রয়েছে। নজরুল ইনসটিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে তিনি কাজ করেছেন। সাংবাদিকতা তাঁর মূল পেশা হলেও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ৩০। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো, কাব্যগ্রন্থ : মাহফুজামঙ্গল (১৯৮৯), গোষ্ঠের দিকে (১৯৯৭), বল উপাখ্যান (২০০১); আপেল কাহিনী (২০০২) মাহফুজামঙ্গল উত্তরখ- (২০০৪), ধাত্রী-ক্লিনিকের জন্ম (২০০৮), দেওয়ান-ই-মজিদ (২০১১), সিংহ ও গর্দভের কবিতা (২০১৩), কাঁটাচামচ নির্বাচিত কবিতা (২০০৯)। গবেষণা ও প্রবন্ধগ্রন্থ : নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র (১৯৯৭); কেন কবি কেন কবি নয় (২০০৩); নজরুলের মানুষধর্ম (২০০৩); ভাষার আধিপত্য ও বিবিধ প্রবন্ধ (২০০৩), উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্য ও অন্যান্য (২০০৮); রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণসাহিত্য (২০০৯); সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা (২০১১); রবীন্দ্রনাথ ও ভারতবর্ষ (২০১২), ক্ষণচিন্তা (২০১৬),
সম্পাদনা : বৃক্ষ ভালোবাসার কবিতা (২০০০); জামরুল হাসান বেগ স্মারকগ্রন্থ (২০০৩), বাংলা লিটারেচার ও সাহিত্য চিন্তার কাগজ পর্ব।
মজিদ মাহমুদ মূলত কবি। আশির দশকে উন্মেষ ও আবির্ভাব। অনুবাদ, শিশুসাহিত্য, সম্পাদনা – সবখানেই প্রসিদ্ধি রয়েছে তাঁর, সব দিকেই তিনি সমান আগ্রহী। মজিদ মাহমুদ সময়ের সন্তান। তিনি এই সময়ের, এই সমাজের, এই দেশের। প্রবন্ধের পাশাপাশি তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, কবিতার শরীরজুড়ে কী নিবিড় মমতায় জড়াজড়ি করে আছে স্বদেশ, স্বকাল, স্বজাতি। ইতিহাস, মিথ, পুরাণ ও আধুনিকতা কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে নন্দনতাত্ত্বিক হয়ে উঠেছে। তিরিশ বছর আগে রচিত তাঁর অমর সৃষ্টি ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্য। কাব্যরসিক বিদগ্ধজনেরা ‘গত শতাব্দীর সর্বশেষ মঙ্গল কাব্য’ অভিধায় সনাক্ত করেছেন এ কাব্যকে। তিনি ‘নদী’ কবিতায় লিখলেন,
“সুউচ্চ পর্বতের শিখর থেকে গড়িয়ে পড়ার আগে
তুমি পাদদেশে নদী বিছিয়ে দিয়েছিলে মাহফুজা
আজ সবাই শুনছে সেই জলপ্রপাতের শব্দ
নদীর তীর ঘেঁষে জেগে উঠছে অসংখ্য বসতি
ডিমের ভেতর থেকে চঞ্চুতে কষ্ট নিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে
কিন্তু কেউ দেখছে না পানির নিচে বিছিয়ে দেয়া
তোমার কোমল করতল আমাকে মাছের মতো
ভাসিয়ে রেখেছে”
[ নদী, মাহফুজামঙ্গল ]
কবিতাটি পাঠ শেষে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাসমান এক জীবন। এ জীবন যেন আমারই। একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে আমাকে স্বীকার করতেই হয়, আমার মনন সতত সঞ্চরণশীল মাছের মতো। খুব বেশি থিতু নই কোনো একক বিষয়ের প্রতি। খানিকটা অস্থির, দ্বিধাগ্রস্থ, অবসাদে ম্রিয়মান কখনো। আমার মনস্তত্ত্বে খেলা করে জটিল সব ভাবনা, ছুটে চলাই নিয়তি যেন। মজিদ মাহমুদের কবিতা পাঠ করলে ভেতরে একধরনের ঘোরলাগা বিপন্নতা বোধ কাজ করে। কী বলতে চাইছেন কবি তা বোঝার আগেই শেষ হয়ে যায় কবিতাখানি। আবার প্রথম থেকে শুরু করলে আবিষ্কার করি, আপাত সরল মনে হলেও সরলরৈখিক পথে হাঁটে না মজিদ মাহমুদের কবিতা।
বল উপাখ্যান কাব্যে তিনি লিখছেন,
“আমার রক্তের মধ্যে দামোদর
আমার রক্তের মধ্যে মহিষ
মাগো তুই মহিষাসুর বধের মন্ত্র শেখা
আমি তোর কাছে যাবো।”
[বল উপাখ্যান, বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী ]
মজিদ মাহমুদের কবিতায় দামোদর নদী, বিদ্যাসাগর, মহিষ-শব্দগুলো আমাকে আমার শিকড়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। একেই হয়তো বলা হয়ে থাকে পাঠক-লেখক আন্তসংযোগ। মজিদ মাহমুদের লেখা পাঠকের ভাবনার সঙ্গে সংযোগ ঘটায়। তাঁর চিন্তাকে তাঁর লেখার মধ্য দর্শন করতে সক্ষম হয় পাঠক। পাশাপাশি মজিদ মাহমুদ তাঁর স্বকাল সচেতনতার জন্য পাঠকের অন্তরকে তীব্রভাবে ছুঁতে পারেন। জটিল সব ভাবনা তাঁর মনে আলোড়ন তোলে, তিনি সেগুলোকে পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেন নির্বিকার চিত্তে। পাঠকের হৃদয়ে নিজেকেও যেন গেঁথে দেন তিনি। মজিদ মাহমুদের কবিমানস মানবতাবাদী-চেতনার কতোটা গভীরে প্রথিত তার স্বাক্ষর কবির প্রতিটি গ্রন্থেই রেখেছেন। তিনি আশির দশকের একজন প্রভাব বিস্তারি কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক। মুক্তিবুদ্ধির চর্চা, বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা, প্রশ্ন উত্থাপন এবং যুৎসই ব্যাখ্যা হাজির করার দক্ষতা মজিদ মাহমুদের সাহিত্যের অন্যতম জাদুকরী বৈশিষ্ট্য। আজকে তাঁর জন্মদিনে কাব্যশীলনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।
এবং সুস্থ দেহে শতায়ু হোন মজিদ মাহমুদ, সর্বান্তকরণে এই কামনা করি।