শিশুতোষ গোয়েন্দা গল্প শেষ পর্ব।। গরমের ছুটিতে গোয়েন্দাগিরি।। আহমেদ রিয়াজ

সারাদিন অনেক ঝক্কি গেছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম নেমে এলো চোখে। যে ঘরে ও শুয়ে আছে, তার সামনেই বারান্দা। হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ওর। চোখ মেলল। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ঘরটা অন্ধকার। জানালা দিয়ে আবছা একটা আলো আসছে ঘরে। মশারির ভিতর থেকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কলার কাঁদিটা ঝুলছে। আরে! ওগুলো কী! কিচ কিচ শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাদুড়! কলার সুবাসে বাদুড় এসে হাজির হয়েছে তাহলে।
আরে! ওরা আবার কারা? বানর!
কলার লোভে বানরও চলে এলো। মাসুক ভাইকে ডাক দেয়া দরকার। ওই ঘরেই আরেকটা বিছানায় শুয়ে আছেন মাসুক ভাই।
আস্তে আস্তে হাঁক দিল সুমন, ‘মাসুক ভাই। ও মাসুক ভাই?’
নাহ। মাসুক ভাইয়ের সাড়া নেই। ডাকার পর উল্টো নাক ডাকতে শুরু করেছেন। এতক্ষণ ডাকেননি।
ওদিকে কলা নিয়ে বানরদের মারামারি শুরু হয়ে গেছে। কাঁদির কলাগুলো মনে হয় নষ্ট করেই ছাড়বে। ওদের একটু ভয় দেখানো দরকার। কিন্তু ভয় দেখাতে গেলে যদি আবার খামচি দেয়? কিংবা যদি কামড়ে দেয়? বানরের অভ্যাসই এমন।
একটু পর বানরদের লড়াই থেমে গেল। চলে গেল সব বানর। কাঁদি থেকে অনেকগুলো কলা ছিঁড়ে খেয়েছে। নিয়েও গেছে বেশ কিছু কলা। সাহস করে দরজা খুলে বাইরে এলো সুমন। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটু উঠান। উঠানে একটু হাঁটাহাটি করল। আর তখনই জিনিসটা ওর চোখে পড়ল। জিনিসটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেল ও।

‘সুমন! এই সুমন! ওঠো।’
আরে! মামার গলা না? জামালপুরে চাকরি করেন মামা। তবে কি মামা এসেছেন?
চোখ মেলেই লাফ দিয়ে উঠল সুমন। চেঁচিয়ে উঠল, ‘মামা! আপনি? কখন এসেছেন?’
মামাকে দেখে ভীষণ খুশি হলো ও।
হঠাৎ বাইরে থেকে মাসুক ভাইয়ের গলা, ‘বাবা দেখে যাও। কারা যেন কলাগুলো নষ্ট করে দিয়ে গেছে।’
ঘুম থেকে ওঠার পরও একটা তন্দ্রাভাব থাকে। সেটাও নেই এখন। বড় বড় চোখ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কলার কাঁদিতে একটাও ভালো কলা নেই। যে কয়টা আছে সব থ্যাতলানো।
সুমন বলল, ‘আমি জানি কে করেছে?’
দৌড়ে এলেন মাসুক ভাই। হিস হিস স্বরে জানতে চাইলেন, ‘কে করেছে?’
মাসুক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল সুমন। ভয়ও পেল একটু। কী বলবে বুঝতে পারল না। আবারও হিস হিস স্বরে বললেন মাসুক ভাই, ‘বলো কে করেছে? আমার হাত থেকে ওর রেহাই নেই।’
পুরো ঘরে চোখ বোলালো সুমন। ওর সামনে মামা। মাসুক ভাই জানালার ওপাশে। তাঁর হাতে কলার নষ্ট হওয়া কাঁদি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন মামি। হাসি হাসি মুখ। হাসিমুখে মামি বললেন, ‘বলো সুমন, কাজটা কে করেছে? মাসুকের প্রিয় কলাগুলো কে নষ্ট করেছে?’
সুমন বলল, ‘বাদুড়।’
মাসুক ভাইয়ের গলায় আর্তনাদ, ‘বাদুড়!’
বাদুড় শুনে খুব হতাশ হয়েছেন মাসুক ভাই। আবারও আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘বাদুড়!’
সুমন বলল, ‘প্রথমে বাদুড়। এরপর বানর।’
‘বানর!’
মাসুক ভাইয়ের গলায় এবার অবিশ্বাসের সুর। ‘বানর! এখানে বানর আসবে কোত্থেকে?’
সুমন বলল, ‘কোত্থেকে এসেছিল জানি না। কিন্তু এসেছিল। আমি দেখেছি।’
‘তখন আমাকে ডাকলে না কেন?’
‘ডেকেছিলাম। আপনি গভীর ঘুমে ছিলেন।’
মামা বললেন, ‘ঘুমিয়ে পড়লে মাসুকের আর হুঁশ থাকে না।’
আবারও বললেন মাসুক ভাই, ‘কিন্তু এখানে বানর এলো কোত্থেকে?’
সুমন বলল, ‘কেউ এনেছে।’
মাসুক ভাই, মামা আর মামি-সবার চোখ এবার কপালে। মামা বললেন, ‘এনেছে? কে এনেছে? কেন এনেছে?’
সুমন বলল, ‘মনে হয় সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে এবার।’
মামি বললেন, ‘বেড়াতে এসে এখনও নাশতা না খেয়ে আছে ছেলেটা। উফ। তোমরা আগে ওকে খেতে দাও তো!’

ঠক ঠক ঠক।
কোনো সাড়া নেই।
মামা বললেন, ‘তুমি ঠিক বলছ তো?’
সুমন বলল, ‘আমি একশভাগ নিশ্চিত।’
‘কিভাবে নিশ্চিত হলে?’
‘যুক্তি খাটিয়ে। দুইয়ের সঙ্গে দুই মিলিয়ে।’
মাসুক ভাই বললেন, ‘বিষয়টা কি ব্যাখ্যা করে বোঝানো সম্ভব?’
সুমন বলল, ‘এখন নয়। আগে লোকটাকে ধরা যাক।’
আবারও ঠক ঠক ঠক। আরো জোরে দরজায় শব্দ করলেন মাসুক ভাই। কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ভিতরে কি কেউ নেই?
সুমন বলল, ‘চলেন বাড়িটার চারপাশ দেখে নেই।’
বাড়ির ডানপাশটায় চলে এলো ওরা। মামা, মাসুক ভাই আর সুমন। নাশতার পর সবাইকে সুমন বুঝিয়েছে, গ্রামের নারকেল চোর ধরতে যাচ্ছে ও। এবং ও জানে কে সেই চোর।
হঠাৎ একটা বস্তার দিকে চোখ গেল সুমনের। কাত হয়ে পড়ে আছে বস্তাটা। মুখ খোলা। ওটা দেখিয়ে সুমন বলল, ‘এই যে দেখেন।’
মাসুক ভাই বললেন, ‘আরে! এগুলো তো আমাদের সেই গাছের ডাব। সুমন তোমার মনে আছে? গতকাল তোমাকে এই গাছের নিচে নিয়ে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম এ গাছের ডাব সবচেয়ে মজার। এগুলো সেই গাছের ডাব। এখানে এলো কী করে?’
বলেই বস্তাটা উপুড় করে দিলেন মাসুক ভাই। আর গড়গড়িয়ে বস্তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো ডাব।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল, ‘এখানে কী হচ্ছে? কে আপনারা?’
চট করে পিছনে তাকালেন মাসুক ভাই। আরে! এ তো সেই বানরনাচ দেখানো লোকটি!
মামা বললেন, ‘তাহলে সব তোমার কা-কীর্তি? দেখাচ্ছি মজা।’
এবার খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল লোকটি। বলল, ‘মজা তো আমি দেখাবো।’
মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করল লোকটি। আর অমনি এক পাল বানর বেরিয়ে এলো ঘরের ভিতর থেকে। তেড়েমেড়ে, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে। বানরের তাড়া। চাট্টিখানি কথা নয়। পড়িমরি করে ছুটে পালাল সবাই।

বড় রাস্তার উপর এসে বসলো সবাই। মামা বললেন, ‘থানায় তো খবর দিলাম। এখন কী করা যায়?’
সুমন বলল, ‘পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। লোকটার উপর নজর রাখতে হবে। যাতে কোনোভাবেই পালাতে না পারে।’
মামা বললেন, ‘কিন্তু পুলিশ এখনও আসছে না কেন?’
সুমন বলল, ‘গতকাল রাতে পাশের গাঁয়ে লুট হয়েছে। সেটা পর্যবেক্ষণ করতে গেছে। ওটা শেষ হলেই এখানে আসবে।’
মাসুক ভাই বললেন, ‘তুমি কিভাবে জানলে যে ওই লোকটাই ডাব চুরি করিয়েছে? তাও আবার বানর দিয়ে?’
সুমন বলল, ‘কাল রাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। একটা বানরের গা থেকে একটা পোশাক খুলে পড়ে যায় উঠানে। সেটা দেখেই চিনতে পারি। বুঝতে পারি বিকেলে হাটের মাঠে খেলা দেখানো বানরগুলোই এসেছিল। সন্দেহটা তখনই জাগে, এত রাতে প্রশিক্ষণ পাওয়া বানরগুলো এত দূরে কেন? ব্যস। বাকিটা বোঝা তো কঠিন কিছু নয়। আর লোকটার বাড়িতে গিয়ে তো প্রমাণ পেয়েই গেলেন যে আমার কথা সঠিক।’
মামা জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু লোকটি যে বানর দিয়ে ডাব-নারকেল চুরি করিয়েছে এটা কিভাবে বুঝতে পারলে?’
সুমন বলল, ‘এক দল মানুষের পক্ষে এক রাতে বিশ পঁচিশটা গাছের নারকেল ডাব চুরি করা সম্ভব নয়। সাধারনত শখের কারণে মানুষ ডাব-নারকেল চুরি করে। শখে কেউ গাছের পর গাছ ফাঁকা করে দেয় না। তখনই মনে হয়েছে এটা অবশ্যই কোনো কেরামতি।’
মাসুক ভাই বললেন, ‘বলেছিলাম না? এটা কেরামতি?’
সুমন মুচকি হেসে বলল, ‘অবশ্যই এটা কেরামতি। তবে বানরদের কেরামতি। টপাটপ গাছে উঠে গাছ থেকে ডাব-নারকেল পেড়ে ফাঁকা করে ফেলেছিল।’
মামা বললেন, ‘বানর ডাব পাড়তে পারে?’
সুমন বলল, ‘শুধু পারেই না, মানুষের চেয়ে ভালো পারে। ইন্দোনেশিয়ায় বানর দিয়েই গাছ থেকে ডাব-নারকেল পাড়ানো হয়।’
মাসুক ভাই চোখ কপালে তুলে দিয়ে বললেন, ‘বলছ কি! লোকটা সেটা জানত?’
সুমন বলল, শুধু জানতই না। লোকটা বানরদের সেই ট্রেনিংও দিয়েছে। তাড়া দেওয়ার ট্রেনিংও দিয়েছে। দেখেছেন বানরগুলো কিভাবে আমাদের তাড়িয়ে দিল!’
বলতে না বলতেই পুলিশের গাড়ি হাজির। তারপর যা ঘটল! কয়েকশ মানুষ জড় হলো ডাবচোর ধরা দেখতে। সহজে ধরা দিতে চাইল না লোকটি। পুলিশদের পিছনেও বানর লেলিয়ে দিল। লাঠির ভয় দেখিয়ে বানরদের শান্ত করল পুলিশ। আটক করল একে একে ছাব্বিশটা বানর। সঙ্গে বানরওয়ালাকেও। ঘর থেকে পাওয়া গেল গত রাতে লুট হওয়া জিনিসগুলোও।
বাব্বাহ। বড্ড চালাক চোর। দারুণ প্রশিক্ষক। বানরগুলোকে দিয়ে সুন্দর ডিসকো নাচ দেখিয়ে ভালোই আয় করছিল লোকটি। কেন যে লোভে পড়তে গেল?
আজব লুটেরা ধরার জন্য কিন্তু পুরস্কার পেল সুমন। অবশ্য পুরস্কার না পেলেও চলত। গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে এসে একটা সফল গোয়েন্দাগিরি করতে পেরেছে ও। এতেই খুশি। খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেলগুলোতেও ফলাও করে দেখানো হয়েছে সব। আর কী চাই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *