শিল্প বিনির্মাণের বিষয়, বিনির্মাণ আমদানি করার বিষয় না : হাসনাইন হীরা

হাসনাইন হীরা। জীবনবোধ এবং দর্শন যার কবিতাকে গ্রাস করার চেষ্টা করে, তারাই সমর্পিত হয়ে নতুন বাঁক তৈরি করার কাজ করছে প্রতিনিয়তো। মাটির পুতুল যে ভাবে তৈরি হয়, ঠিক সেভাবে নিজের ভেতর কবিতাকে লালন করে তৈরি করেন তিনি। তারই উদাহরণ ‘বাঁক বাচনের বৈঠা’।

এই কাব্যগ্রন্থটি তাকে এনে দিয়েছে জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার-২০২০। হাসনাইন হীরা ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার বাঙ্গালা গ্রামে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। বর্তমানে এই কবি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক হিসাবে কর্মরত আছেন।

তিনি লিখছেন দ্বিতীয় দশক থেকে। কাব্যচর্চার অলিগলি ধরে হেঁটে হেঁটে, একটু জিরিয়ে হাসনাইন হীরা কথা বলেছেন ওয়েব পোর্টাল ‘কাব্যশীলন’-এর সঙ্গে। তার সঙ্গী ছিলেন কবি ও সাংবাদিক শব্দনীল।

কাব্যশীলন : কবিতা লেখার জন্য সমাজে চলতে ফিরতে কখনও কি কটাক্ষ শুনেছেন? যদি শুনে থাকেন তবে এই দায়ভার কার?

হাসনাইন হীরা : আমাদের সোসাইটিতে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা মনে করে, ‘কবিতা লেখা উদ্ভট কাজ। যারা কবিতা লেখে, তারা উন্মাদ। সত্যিকার অর্থে কবি উন্মাদই। উন্মাদ না হলে সৃষ্টি অসম্ভব। কিন্তু মুশকিল হলও, এটাকে আজকের সোসাইটি পজেটিভলি দেখে না। কারণ, তারা নতুনত্বকে স্বাগত জানাতে ইতস্তত বোধ করে। আরেকটা অংশ মনে করে, কবিতা লিখে কবির ভাত জোটে না। কারণ, সোসাইটির ভেতর আজ ফিনান্সিয়াল ব্যাপারগুলো বড় হয়ে উঠেছে। বাঙালির মধ্যে যে রাঙালিয়ানা একটা ভাব ছিল। সেখান থেকে বাঙালি অনেক দূরে সরে গেছে। আজ তারা নিজেদেরকেই চেনে না। পশ্চিমা আগ্রাসন থেকে বেরুতে পারছে না। এটা একধরনের উপনিবেশ। একটা উপনিবেশ থেকে বেরুতে না বেরুতেই আরেকটা দিয়ে কব্জা করে ফেলছে। বুঝে না বুঝে আমরা তা কপচ্ছাছি। এর মানে, আমাদের সোসাইটি যেভাবে তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে দাঁড়ায়নি। যাদের তৈরি করবার কথা ছিল, তারাও সোসাইটির ভেতরে থেকে শুঁয়োপোকার মতো নীরবে শেকড় কাটার কাজটি করেছে। এর জন্য কাকে দোষ দেবেন আপনি? গণতন্ত্র ব্যবস্থায় তো আপনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী। সেটা কি হতে পেরেছেন? উল্টো আপনাকে সিস্টেমের গ্যাঁড়াকলে ফেলে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। যেন আপনার কোনও কিছু বলার নেই। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, গণতন্ত্র ফালতু জিনিস। এর মডিউল চেঞ্জ করতে হবে। না হলে সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশ সম্ভব না। তাহলে মননশীল মানুষ তৈরি করবেন কি করে? কি করে আপনি সমাজ বদলাবেন?

কাব্যশীলন : মানুষ তৈরি করা যায়?

হাসনাইন হীরা : হ্যাঁ, মানুষ তো তৈরি করার বিষয়। মানুষ কখনই মানুষ হিসাবে জন্মায় না। জন্মায় দুর্বলতর একটা নিরীহ প্রাণী হিসাবে। তারপর ফর্মায় ফেলে তাকে মানুষে রূপান্তরিত করি। শক্তিশালী সেই ফর্মার নাম ‘সংস্কৃতি’। হা হা…

কাব্যশীলন : আচ্ছা। কবিতার দিকে যাই। ইদানীং দেখা যাচ্ছে বাংলা কবিতার চিরাচরিত মৌলিক উপাদানগুলোকে উপজীব্য করে কেউ কেউ ইউরোপ বা পশ্চিমা সাহিত্যের কোনও এক ধারাকে হুবহুব উপস্থাপন করে নতুনত্ব বলছে। এই নতুনত্ব কতটুকু যুক্তিসংগত –

হাসনাইন হীরা : পরের ধোনে পোদ্দারী করা যায় কি? করলে তা কতক্ষণ? আপদানী করা ধারা সমাজের উপযোগিতা অনুযায়ী আংশিক প্রযোজ্যতা ডিমান্ড করতে পারে। ধরেন, পুঁজির আস্ফালনকে আঘাত করতে চাইলে মার্কসীয় মডিউলকে আপনি কাজে লাগাতে পারেন। কিংবা নির্দিষ্ট অঞ্চলের কোনও ট্যাবু বা প্রথা অথবা ডিসকোর্সকে ভাঙার জন্য অন্য কোনও ডিসকোর্স আমদানি করা যেতে পারে। কিন্তু তা ধোপে টেকে না। শিল্প সেই প্রশ্রয়টা দেয় না। কেননা শিল্প বিনির্মাণের বিষয়। বিনির্মাণ আমদানি করার বিষয় না। ফলে আমদানিতে নতুনত্ব বলে কিছু নেই। বিষয়টা একটু অন্যভাবে বলি, অন্যের জন্ম দেওয়া বাচ্চা কি নিজের বলে দাবি করা যায়? আপনি বড়জোর পালন কর্তা হতে পারেন, নিজের বলে দাবি করা যায় না ? যারা করে, তারা পালন করাটাকে বড় করে তোলে। জন্ম দিতে পারে না, জনক হতে পারে না। সুতরাং নতুনত্ব দাবি করার এখতিয়ারও তার নেই। যারা করছে, তাদের শিল্প সাহিত্যের বোধ নিয়ে আমার শঙ্কা আছে।

কাব্যশীলন : সমসাময়িক কাদের কবিতা, গল্প, গদ্য পড়ে মনে হচ্ছে আমরা নতুন প্রজন্মকে কিছু দিতে যাচ্ছি –

হাসনাইন হীরা : সম্ভব্য কথা না বলাই ভালো। আমি তো ভবিষ্যৎ জানি না। তবে এটা বলে রাখি, আগামী তিন দশকের মধ্যে বাংলা সাহিত্য ইউটার্নের মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সেই আলোকায়ন ঘটছে, সেটা টের পাচ্ছি। সেই সাহিত্য অনেক বেশী বুদ্ধিদীপ্ত আর রহস্যে আবর্তিত হবে। একই সাথে যা আমরা শেকড়ের কাছে ফেলে আসছি, তার পুনরুদ্ধার হবে। অনেকের লেখার মধ্যেই সেটা ঘটছে। মজনুশাহ’র কবিতা পড়েছেন নিশ্চয়! তারপর দ্রাবিড় সৈকতের গদ্য পদ্যেও তার একটা দিশা খুঁজে পাওয়া যায়। আমার সময়েও অনেকেই লিখছেন। আপনার কবিতাতেও শেকড় সন্ধানী অনুধাবন দেখেছি।

কাব্যশীলন : যেহেতু সমসাময়িক পাঠে আপনার আগ্রহ দারুণ, তাহলে একটি বিষয়ে জানতে আগ্রহ হচেছ, সমসাময়িক কবিতা, গল্প, গদ্যে কাব্যরস এবং দরদী অনুভূতি আপনার কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা কতটুকু মিটাতে পারছে –

হাসনাইন হীরা : প্রত্যাশা তো অন্তহীন। সাহিত্যরুচির বিভিন্ন স্তর আছে। পলিটিক্যালি ভিউ, রুচি ও বোধ বিচারে এই স্তর তৈরি হয়। আমি কাব্যরসের চেয়ে চিন্তাকে বড় করে দেখি। রসবোধের চেয়ে চিন্তা অনেক উপরের জিনিস। তবে চিন্তাকে চূড়ায় পৌঁছাতে হলে যথার্থ শিল্পায়োজন লাগে। মানে শিল্প এবং চিন্তা উভয়েরই কম্বিনেশন দরকার।

শিল্প-সৌকর্য যেন পোশাকের মতো চিন্তাকে আড়াল করে না দেয়। সেটা হলে, তিনি যত বড় সৌকর্যের স্রষ্টা হন না কেন, লাভ নেই। দুঃখজনক হলও আমাদের সাহিত্যপাড়ায় এই পাল্লাটাই ভারী বেশি। এর ফাঁকে আলোকায়নও ঘটছে। সেটা ক্ষীণ হলেও তার শক্তি অনেক বেশি গতিশীল। ফলে আমি হতাশ নই। মুগ্ধ হওয়ার মতো অনেক কারণ আছে। সেটাই ভরসা।

কাব্যশীলন : শূন্য দশকের পর থেকে শিল্প-সাহিত্যের নিজস্ব উপাদানের চেয়ে বাহ্যিক উপাদানে জোর দিয়ে পাঠকের কাছে এক শ্রেণীর লেখক কিছুটা সময় নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছে বলে মনে হয় কি?

হাসনাইন হীরা : হ্যাঁ, কারো কারো মধ্যে সেই প্রবণতা প্রাবল। তারা কনটেন্টের চেয়ে কাঠামোকে বেশি গুরুত্ব দিচেছ। এটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কাঠামো তো খুব দ্রুত বদলে যায়। কিন্তু কনটেন্ট সোসাইটিতে দীর্ঘদিন বিরাজ করে। যেমন ধরুন, কাহলিল জিবারন, রিলকে কিংবা চেশয়াব মিউশ আমাদের জ্ঞানকাণ্ডে বসে আছে কনটেন্টের জোরে, কাঠামোর তকমা নিয়ে নয়। আবার বড়ু চণ্ডিদাসের কথাই ধরুন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’এই নিয়ে আমাদের মাঝে এখনও সে ব্যাপকভাবে উপস্থিত। আমরা এর বাইরে যেতে পারছি না। আরও হাজার হাজার বছর থাকবে। এর পিছনে কনটেন্টের ভূমিকাই বেশি। তবে কাঠামো কোনও উড়ো চিঠি নয়। কাঠামোরও দরকার আছে। চিহ্নায়নের ক্ষেত্রে কাঠামো কাজে দেয়। তবে কাঠামো ছাড়াও কনটেন্টের জোরে লেখক দাঁড়াতে পারে। কিন্তু শুধু কাঠামোর জোরে লেখক হওয়া যায় না। সময় তাকে পথের মাঝে ফেলে রেখে এগিয়ে যায়। তাই কনটেন্টের উপরে আমাদের বেশি জোর দেয়া উচিত। আমাদের সংস্কৃতজাত চিন্তা আমরা স্টাবলিস করতে না পারলে, উপনিবেশ কখনই আমাদের পিছু ছাড়বে না। আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। ঠিক এই জায়গাতেই আমাদের নিজস্বতা লুকিয়ে আছে।

কাব্যশীলন : আপনাকে অভিনন্দন, জেমকন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পুরস্কার আপনাকে চার দেয়ালে বন্ধি করছে না তো?

হাসনাইন হীরা : বরং এর উল্টোটাই হচ্ছে। জেমকনের এই পুরস্কার দেয়ার মাহত্ত আপনি জানেন। সুতরাং যেটুকু সম্ভবনা তারা লক্ষ্য করেছেন, তাকে কাজে লাগানোর প্রেরণা পাচ্ছি। ফলে ভেতরকার টাট্টু ঘোড়াটাকে দাবড়ানোর খেলায় রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মেতে আছি।

কাব্যশীলন : আপনি দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন, নিজের ভেতরের বিবর্তন সম্পর্কে যদি বলেন—

হাসনাইন হীরা : চমৎকার প্রসঙ্গ তুলেছেন। লিখতে এসে যে হাসনাইন হীরা তৈরি হয়েছে, সে এখন আমাকে শাসন করে। ফলে এখন আমি অনেক বেশি দায়িত্বশীল। সমাজ কিংবা ব্যক্তির অপকীর্তি অনেক বেশি আঘাত করে আমাকে। আমি যেন মুক্তির জন্য খাঁচা ভাঙার লড়াই করে চলেছি। লেখকের হয়তো এটাই অপ্রিয় ভ্রমণ। যার কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য নাই। ফলে ভিড় দেখলে এখন আর এড়িয়ে যাই না। বরং ভিড়ের মধ্যে অসহায়ত্বের যে একাকিত্ব, তাকে বুঝবার চেষ্টা করি।

কাব্যশীলন : টিকে থাকার জন্য একজন লেখকের নিজস্বতা বা মৌলিকতা আয়ত্ত করা কতটুকু জরুরী বলে মনে করেন—

হাসনাইন হীরা : দেখুন, অক্তাবিও পাজের একটা কথা আছে, “প্রত্যেক কবিই জন্ম নেন নিজস্ব কিছু বলবার জন্যে এবং তার প্রথম কর্তব্য হলো পূর্বজদের অস্বীকার করা। তাদের অলংস্কারাদিকে পরিত্যাগ করা।” সুতরাং মৌলিকতা থাকতে হয়। এটা লেখক হওয়ার প্রাইমারী আলোচনা। এটা দুটো দিকে হতে পারে, একটা শিল্পের দিক দিয়ে, অন্যটা টেক্সটের দিক দিয়ে। আবার দুটোর কম্বিনেশনেও হতে পারে। তবে টেক্সেটের দিক দিয়ে মৌলিক হওয়া কঠিন। জার্মান ফিলোসোফার নীটসে তো মৌলিকতাকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, “পৃথিবীতে মৌলিক বলতে কিছু হয় না, যা হয়—তা রিপিটেশন। কেবল ফর্ম চেঞ্জ হয়।” সেই ক্ষেত্রে মৌলিকতার প্রশ্নে কাঠামো অনেক শক্তিশালী। কিন্তু আমরা দেখছি, সভ্যতাও নানা জিনিস উৎপাদন করে। সেখানে কেবল যে রিপিটেশন হয়, ব্যাপারটা তেমন নয়। তার সাথে নতুন কিছু যোগও হয়। এই যোগ হওয়াটাই ইউনিকের জায়গা দখল করে। তাছাড়া প্রতিটি মানুষ কোনও না কোনোভাবে যখন মৌলিক, তখন লেখকের লেখা কোনও না কোনও ভাবে মৌলিক। খেয়াল রাখতে হবে, এই মৌলিকতা যেন নিছক খেলনা হয়ে না যায়। যে মৌলিকতা সমাজের কোনও কাজে লাগে না, তা অনেক বেশি গৌণ মনে করি। সুতরাং লেখকের মুল ফোকাস হতে হয় সোসাইটির দিকে। সেখানে তিনি কি নিয়ে হাজির হলেন, এবং তা মনুষ্যজগতের কতটুকু কাজে লাগল, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য টেক্সট কাঠামোর চাইতে অনেক পাওয়ারফুল। এই টেক্সটের উপরেই লেখক টিকে থাকে। ধরুন, আমরা বড়ু চণ্ডিদাসকে এখনও বহন করে চলেছি কেন? তার কাঠামো কি আমাদের সাথে যায়? যায় না। কিন্তু তার টেক্সট এখনও পাওয়ারফুল। তাকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এটাই হলো আসল শক্তি। এজন্য প্রকৃত লেখক নিজের অজান্তেই নিজস্ব একটা চিন্তাচিহ্ন রেখে যান। সেটাই লেখকের বড়ত্ব, সেটাই লেখকের মজবুদ খুঁটি। এই খুঁটির জোরেই লেখক প্রতিকুলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন শতাব্দীর পর শতাব্দী।

কাব্যশীলন : ‘‘বাঁক বাচনের বৈঠা” কাব্যগ্রন্থ লিখতে গিয়ে আপনার অন্তর্দৃষ্টিতে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন। এবং এই অন্তর্দৃষ্টিকে পেছনে ফেলে নতুন সৃষ্টির পথে এগোতে গিয়ে ‘‘বাঁক বাচনের বৈঠা”র প্রভাব কতটুকু মুক্ত হতে পেরেছেন—

হাসনাইন হীরা : আপনার প্রশ্ন অনেক জটিল। মনে হচ্ছে অংক করতে হবে। হা হা…..। এটুকু বলা যায়, ‘‘বাঁক বাচনের বেঠা” লিখতে গিয়ে নিজেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। বাকি যেটুকু আমি অবশিষ্ট থাকি, ওইটুকু আমার মনোলোক। যে কিনা ভেতর থেকে বাহির দেখার কাজে ব্যস্ত ছিল। এই যে ভেতর এবং বাহিরের মাঝখানে ফাঁকা একটা জায়গা! অনেকটা ধূসর। ঠিক ঐ জায়গাতে আরেকটা জগতের ইমারত গাঁথার কাজে সচেষ্ট ছিল। মানে একটা বাছ-বিচারের মতো ঘটনা ঘটছিল। যতটুকু পেরেছে তার পুরোটাই দেয়ার চেষ্টা করেছে। একজন অথরের যেমন থাকে। অথচ এখন মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি।

এই যে কিছুই হয়নি, সেটা যখন টের পেয়ে গেছি। আর টের পাওয়া মানে নতুন করে রণ কৌশল করা। ঠিক এখান থেকে আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও মেলাতে পারবেন। সুতরাং ‘বাঁক বাচনের বৈঠা’ থেকে আমার দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে।

কাব্যশীলন : একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়, পাঠক গ্রন্থ পেয়ে নিজের মতো ভাবে এবং বিশ্লেষণ করে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি তেরি করতে লেখকের দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়। মানে বলতে চাইছি, কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির মধ্য দিয়ে ছোট ছোট গল্প তৈরি হয়। যা পাঠকের কাছে অজানাই থেকে যায়। “বাঁক বাচনের বৈঠা” পাণ্ডুলিপি তৈরির পিছনের গল্প শুনতে চাই।

হাসনাইন হীরা : লেখালেখি করা আর বই করা এক জিনিস নয়। এটা ভাবতাম। একটা ভালো লেখা লেখার পর মনে করতাম, এটা দিয়ে বই করবো। ফলে কবিতা জমতে থাকে। কোথাও ছাপতে দেই না। ধারনা ছিল, অপ্রকাশিত লেখা দিয়ে বই করতে হয়। কিন্তু বই আর প্রকাশ করা হয় না। এরই মধ্যে হাতে পাই, অনন্ত সুজন সম্পাদিত, ‘শূন্যের সাম্পান’। শূন্য দশকের নির্বাচিত কবি ও কবিতার সংকলন। এ বইটা পড়ার পর মনে হলও একটা কবিতাও লিখতে পারিনি আমি। ফলে লোরকার মতো কবিতাগুলোকে পুড়িয়ে ফেলার ইচ্ছে হলও। শেষমেশ পোড়াতে পারলাম না, কিন্তু বাতিল হয়ে গেল প্রায় তিন শতাধিক কবিতা।

আবার নতুন করে লেখা শুরু করি। পাঠের তালিকায় যোগ হতে থাকে সমকালীন কবিতা। এবং ২০১৫ সালের বইমেলা থেকে সংগ্রহ করি, প্রবন্ধের বই ‘লেখার শিল্প, লেখকের সংকল্প’। এই বইটা আমার কাব্যচিন্তা অনেকটা বদলে দিল।

পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে গিয়ে আবারও ধন্ধে পড়ে গেলাম। পড়তে লাগলাম আব্দুল মান্নান সৈয়দ, শাসছুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ হক, নির্মেলেন্দু গুণসহ প্রমুখের কবিতার প্রথম বই। আর মনে মনে এইসকল অগ্রজদের চ্যালেঞ্জ করতে থাকি। মূলত নিজের প্রথম বইকে সাজানোর একটা দূর্বার চেষ্টা। আসলে কাউকে চ্যালেঞ্জ করার কিছু নেই। নিজের সাথে নিজের চ্যালেঞ্জটাই প্রকৃত প্রস্তুতি।

সেই প্রস্তুতির ফাটলে কিছুটা জল যোগ করলো অর্বাক ও কবিতা জংশনের আড্ডা। আড্ডায় নানা আইডিয়া যোগ বিয়োগ হতে থাকে। ভেঙে চূড়ে ঢুকে পড়ি কবিতার নতুন এক জগতে। যার জন্যেই এতদিন উপেক্ষা আর অপেক্ষা করতেছিলাম। অবশেষে পাণ্ডুলিপি তৈরি হলও। এবার নাম নিয়ে পড়ে গেলাম বিপাকে। কিছু নাম বন্ধুদের দেখাই। একজন একটা পছন্দ করে তো আরেকজন অন্যটা। কোনটাই ফাইনাল করতে পারি না।

একবার পাণ্ডুলিপি প্রিন্ট দিয়ে বাঁধাই করার জন্য বাংলাবাজারে গেলাম। তখন পর্যন্ত পাণ্ডুলিপির নাম ছিল ‘পরিব্রাজক সাবানের ফেনা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স করা একজন ছাত্র নামটা দেখে আগ্রহে পাণ্ডুলিপি হাতে নিল। এবং পড়তে গিয়ে বিব্রত বোধ করলো। কারণ, নাম দেখে সে মনে করেছিল, কোনও রসায়ন বা পদার্থের বই হবে। জনৈক অই পাঠককে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কনফিউশনেও পড়ে গেলাম। কারণ খুঁতখুঁতানি স্বভাবটা আমার অনেক দিনের। চলে যায় আরও একটা বছর। বই হয় না বলে বন্ধুদের ঢিল ছোঁড়ানো কথা আবারও পাশকাটাতে থাকি। হয়ে উঠি একজন দক্ষ স্বৈরাচার। একদিন পেয়েও যাই ‘বাঁক বাচনের বৈঠা’। পাণ্ডুলিপিও পেয়ে যায় বইয়ের ঠিকানা।

কাব্যশীলন : শিল্প সাহিত্যের জন্য আমাদের দেশে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব দেখছেন না তো, যদি দেখে থাকেন, তবে এই দায় কার?

হাসনাইন হীরা : ‘অভাব’র চাইতে ‘অবহেলা’ শব্দটা বেশি প্রাধান্য দিতে চাই। কারণ শিল্প-সাহিত্যে যাদের ডেটিকেট করার কথা, তারা ক্ষমতা ও পুঁজির সারথি। আর ক্ষমতা ও পুঁজি তার নিজের দৌরাত্ব ঠিক রাখার জন্য শিল্প-সাহিত্য তথা সাংস্কৃতিক শক্তিকে দমিয়ে রাখতে চায়। সংস্কৃতির কথা নিতে চায় না। কারণ, সংস্কৃতির উত্থান মানে মানুষের মননের উত্থান। মানুষ কথা বলা শিখেবে। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। কারও দাসত্ব সে আর স্বীকার করতে চাইবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকতা ঘটবে। কিন্তু এখানকার ক্ষমতাবানরা সেটা চায় না। উল্টো পুঁজির দালালি করে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চায়। ফলে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাদের নেগলেন্সি ন্যক্কারজনক। যতটুকু পৃষ্ঠপোষকতা আছে, এটা লোক দেখানো। এটাও একটা পলিটিক্যালের ভেতরই পরে। এখন যদি দায়ের কথা বলেন, তবে দায় তো রাষ্ট্রের। কারণ রাজনৈতিকভাবে কোনও কিছুর চেঞ্জ না হলে কোনও কিছুই বদলায় না। ধরেন আপনি ০৫টা সিম ব্যবহার করেন। কোনও একটা সিম কি সরকারি অনুমোদনের বাইরে ব্যবহার করতে পারছেন? পারছেন না। সুতরাং রাষ্ট্রকে চাইতে হবে। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও রাষ্ট্র তার উল্টো দিকেই হাঁটছে। এর খেসারত একদিন দিতেই হবে। কারণ, সংস্কৃতির বিকাশ না হলে সমাজে অপরাধ ও অকর্ম বেড়ে যাবে। অলরেডি তার প্রবণতা কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। কিশোর অপরাধের মতো ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে।

কাব্যশীলন : একটি কবিতা বা গদ্য লিখে কতদিন ধরে এডিট বা সংস্কার করার চেষ্টা করেন।

হাসনাইন হীরা : এইটার নির্দিষ্ট কোনও সীমারেখা নেই। একদম ছাপাখানার প্রুফ দেখার সময় পর্যন্ত এডিট চলতে থাকে। এমনও হয়েছে, দুই বছর যাবৎ একটা কবিতা লিখেছি। টিএস এলিয়েটের একটা কথা আছে, পুনঃ পুনঃ লেখার নামই কবিতা। এলিয়েটের এই ধারণাটা আমি বিশ্বাস করি।

কাব্যশীলন : আপনি একজন পাঠক, তরুণ লেখকদের পাঠ করার সময় কখনও কি অনুভব করেছেন তাদের ভেতর বড্ড তাড়া আছে। যদি করে থাকেন, তবে এই তাড়নার দায়ভার কার বলে মনে করেন—

হাসনাইন হীরা : এটা সময়ের একটা চরিত্র। মানুষের জীবন যাপনই এখন এমন। কারণ তার চারপাশ এখন হরেক রঙের আভায় মোড়ানো। যার ফলে নতুন লেখকের মনোলকেও এর একটা প্রভাব পড়েছে। লেখক যেহেতু সমাজের সবচাইতে সচেতন মানুষ। তাই তাকে উন্মাদনায় ভেসে বেড়ানো ঠিক নয়। লেখক মানেই সে একটা সাংস্কৃতিক বলয়ের প্রতিনিধি। তাকে অনেক হিসেব করে চলতে হয়। সুতরাং এর দায়ভার লেখকের নিজের।

কাব্যশীলন : সাহিত্য চর্চার জন্য পর্যবেক্ষণের এবং ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ভাষা কতটুকু জরুরী-

হাসনাইন হীরা : আমি তো মনে করি, কবিতা মানেই পর্যবেক্ষণের ভাষা। কবিতাতেই ভাষার মেকানিজমটা তুলনামূলক বেশি। কবিতাই ভাষাকে দ্রুত বর্ধনশীল ও পরিশীলিত জায়গায় নিয়ে যায়। ভাষা সর্বজনীন বিষয়। এখানে ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে প্রমোট করার সুযোগ কম। কারণ ভাষা তৈরি হয় সোসাইটিতে। সোসাইটির ভেতরকার ভাষা কবি পরিশীলিত আকারে হাজির করেন। সাহিত্য সেটা ডিমান্ডও করে।

কাব্যশীলন : আপনি কবিতায় নতুন ফর্ম ‘বিনুনিবিতান’ এনেছেন। পাঠক হিসাবে বলতে পারি, আমি নতুনত্ব পেয়েছি। তবুও আপনার কাছে জানতে চাই, বিনুনিবিতানের রহস্য—

হাসনাইন হীরা : কবিতার যে পথ দিয়ে হাঁটছি, সেটা আমার পথ কিনা? আমার আত্মপ্রকাশ নতুন কোনও অন্বেষণের দিশা হাজির করতে পেরেছে কিনা? এই প্রশ্নগুলো আমাকে পাহারায় রেখেছিল। আমি তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বাংলা সাহিত্যে এত এত ভালো কবিতার বই! সেখানে আমার বইটা আপনি পড়বেন কেন? কিংবা এত এত কবিতা বইয়ের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে কবিতা লিখতে পেরেছি? এই সমস্ত প্রশ্ন আমাকে জাগিয়ে রেখেছিল। সেখান থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য প্রথমত নতুন চিন্তার দিকে দৌড়াতে থাকি। দেখলাম আমার সময়ই আমার কাছে নতুন। সেটাই আমার কবিতাযাত্রার টাট্টু ঘোড়া । ফলে তার পিঠে চেপে বসি, চাবুক নাড়াই। চাবুক হলও কবিতার ভাষা। সেটাকে নিজের মতো করে বাঁধার চেষ্টা করেছি। তারপর দেখলাম, চিন্তায় কতটুকু আর মৌলিক হওয়া যায়? ফলে চ্যালেঞ্জটা তখন কবিতার দিকে। কবিতাকে নতুন পথ দেখাতে থাকি। কবিতার নতুন সেই পথের নাম দিই ‘বিনুনিবিতান’। আরেকটু ডিটেইলে যাই। বিতান মানে দোকান। দোকানের যেমন তাক থাকে। থাকে সমতল ভূমি। ফলে দোকানের দশটি তাক দশ লাইনে বিন্যাস্ত করা বাক্য। বাকিটা সমতল। যা গদ্যের প্যাটার্নে সাজানো হয়েছে। এখানে দশ লাইন যে কোনও ছন্দে লেখা যাবে। এবং সমতলে এসে যে যেভাবে পারে গড়তে পারবে। ফলে বিনুনিবিতান নির্দিষ্ট হয়েও অনির্দিষ্টতায় মোড়ানো। যে যেভাবে পারে একটাকে ব্যবহার করতে পারবে। সেই সুযোগ রেখেই ফর্মটি দাঁড় করানো হয়েছে। যা ভবিষ্যৎ কবিতাকারের কাজে দেবে বলে বিশ্বাস।

কাব্যশীলন : শেষ প্রশ্ন, আপনি কেন লেখেন—

হাসনাইন হীরা : জগতের কোনও কাজই উদ্দেশ্যবিহীন হয় না। বরং উদ্দেশ্যই ঠিক করে দেয় কাজটি কিভাবে করতে হবে। এই যে প্রক্রিয়া, এর মধ্যে একধরণের দায়ভার থাকে। যা ভেতরে ভেতরে আপনাকে অনেক বেশি সচেতন করে তোলে। মানে যুক্তি তর্কের ভেতর দিয়ে আপনাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে চায়, উৎকর্ষের দিকে ধাবিত করে। এই মুক্তি প্রথমত আত্মিক। আত্মিক মুক্তি না হলে কোনও মুক্তি সম্ভব না। কারণ, নিজে জীর্ণতার মধ্যে থাকলে সচলতার দিকে যাবেন কি করে? হাংরি জেনারেশনের লোকেরা যেমন মনে করতেন, ‘নিজের জীবনের গোলমালে কিছু মানুষ অনুভূতি এবং চেতনায় সংলঘু হয়ে যায়’। এটা করতে গেলে আপনাকে সত্য ও সুন্দরের পথ চিনতে হবে। যার ভেতর দিয়ে আত্মিক মুক্তি ঘটবে।দ্বিতীয়ত, আপনি যেহেতু একটা জীবন যাপন করেন! সুতরাং সমাজের নানা এলিমেন্ট আপনার সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত। এগুলোকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। সুতরাং আপনাকে মাহত্ত নানা জিনিস ড্রিল করতে হয়। এগুলো শিল্প-সাহিত্যের বাইরে নয়। আমার মনে হয়, শিল্প-সাহিত্য ছাড়া জীবন ও জগতকে ভ্রমণ করা যায় না। শিল্প-সাহিত্যই পারে বৃহত্তর সমাজ ও মানুষের মুক্তির দার উন্মোচন করতে। সে অর্থেই লিখি। কাজে লাগলে ভালো। না লাগলে কিচ্ছু যায় আসে না। তবু হয়তো লিখবো। লিখেই নষ্ট করবো একটা জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *