কবিতা আত্মার খোরাক : শাহীন রেজা

শাহীন রেজা বাংলাদেশের আশির দশকের একজন প্রতিনিধিত্বশীল কবি। জন্মেছেন ১৯৬২ সালের ২৯ মে পিরোজপুর জেলার পুখরিয়া গ্রামে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২৯ টি। কবিতা ছাড়াও ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প মিলিয়ে তাঁর অন্যান্য প্রকাশনার সংখ্যা ৭টি। প্রথম কবিতার বই বের হয় ১৯৮২ সালে। বইয়ের নাম ‘অগ্নির স্রোতে জল’। তাঁর লেখালেখির শুরু ছড়া দিয়ে; সেই স্কুল জীবনে। এরপর তিনি কবিতায় স্থিত হন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘হরিণ আলোয় কাচ চোখ’, ‘দ্বিতীয় দরোজা’, ‘শরতেও মেঘ নামে’, ‘নারী কাব্য’, ‘পাখি চলে গেলে কবি বড় একা’, ‘প্রজাপতি ও বালিকারা’, ‘অসতর্ক জোছনায়’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘এসেছ কি ভুল চাঁদ পৌষের ঘরে’, ‘Selected Poems’ ইত্যাদি। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য লাভ করেছেন, ‘বন্দেআলী মিয়া স্মৃতি পুরস্কার’, ‘সুকান্ত স্মারক সম্মাননা’, ‘ঢাকা পোস্ট স্বর্ণপদক’, ‘কীর্তনখোলা পদক’, ”সাহিত্য দিগন্ত স্মারক সম্মাননা’, ইউকে বেসড পত্রিকা হোয়াটসঅন প্রবর্তিত ‘রাইটার অব দ্য ইয়ার’ সম্মাননা, ‘ক্যামব্রিয়ান কালচারাল একাডেমি এওয়ার্ড’ প্রভৃতি।

পেশাগত জীবনে সাংবাদিকতা ও মিডিয়ার সাথে জড়িত। কবি শাহীন রেজা সম্পাদনা করছেন ‘দৈনিক মুক্ততথ্য’ নামক একটি জাতীয় দৈনিক। তিনি কবিতা বিষয়ক পত্রিকা ‘কবি এবং কবিতা’র সম্পাদক। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘হৃদয় মিডিয়াভিশন’-এর চেয়ারম্যান শাহীন রেজা, বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান ‘ফেয়ার এন্ড ফেয়ার’ এরও কর্ণধার। আশির দশকের কবি
মুখোমুখি হয়েছেন সৃজনশীল ওয়েবম্যাগ কাব্যশীলনের। সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন ফখরুল হাসান এর সাথে।

ফখরুল হাসান: আপনার দৃষ্টিতে কবিতা কী?

শাহীন রেজা: আল মাহমুদ বলেছেন, ‘কবিতা কষ্টের কলা’। ফজল শাহাবুদ্দীন বলেছেন, ‘কবিতা একটি ঘোর’। আমি বলি, কবিতা হৃদয়ের স্ফূরণ। কবিতাকে নির্মাণ করা যায় না, আপনি এসে ভর করে। ঠিক জানালার গ্রিলে বাসন্তী হাওয়ায় উড়ে এসে বসা চড়ুই পাখিটার মতো। একে যত্নে করে অন্তরে পুষতে হয়। ব্যঞ্জনা দিয়ে, মমতা দিয়ে শাব্দিক দ্যোতনায় ঘটাতে হয় এর প্রকাশ।

ফখরুল হাসান: কবিতা লিখলেই কি কবি হওয়া যায়?

শাহীন রেজা: যায়, যদি সেটা কবিতা হয়। কবিতার নামে যা কিছু লিখে তা কবিতা বলে চালিয়ে দেয়া যায় সত্যি, কিন্তু এতে করে কবি হওয়া যায় না। ভারতের বিখ্যাত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ‘কবি হতে হলে প্রথমে মানুষ হতে হয়…’ আমিও সেটা বিশ্বাস করি।

ফখরুল হাসান: জীবনানন্দ তো বলেই গেছেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি…

শাহীন রেজা: একদম সত্যকথা। আমিও সেটা বিশ্বাস করি। আমাদের দেশে এখন অনেক কবি; কেউ লেবাসধারী কবি, কেউ লিটলম্যাগের কবি, কেউ পত্রিকার কবি, কেউ টেলিভিশনের কবি, কেউ অনুষ্ঠানের কবি, কেউ পদকের কবি, কেউ বইয়ের কবি, আবার কেউ ফেসবুকের কবি। কে যে কবি আর কে যে কবি নয়, এর প্রমাণ মেলে তার কবিতায়- অন্য কিছুতে নয়।

ফখরুল হাসান: একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য এদেশের লেখকদের (সবাই নয়) নির্লজ্জ তদবিরবাজিরও সীমা-পরিসীমা থাকে না। পুরস্কারের জন্য বোতল-বোতল মদ উজাড় করে দিতে তারা কার্পণ্য করে না- এমন কথা শোনা যায়। এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

শাহীন রেজা: এটা দেউলিয়াপনা। তদবির করে পদক বা পুরস্কার কখনোই আমি সমর্থন করিনা। এ প্রবণতা বৃক্ষ নয়, বনসাই তৈরি করে মাত্র।

ফখরুল হাসান: কবিদের মধ্যে এতো বিভাজন কেন?

শাহীন রেজা: প্রকৃত কবিদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। রাজনৈতিক কিংবা গোষ্ঠিক যে বিভাজন, তাকে আমি বড়ো করে দেখি না। আমি মনে করি, কবিদের একটাই আদর্শ- তা হচ্ছে কবিতা। কবিতার বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে এ সুকুমার বিষয়টি কলুষিত হবে। আমাদের উচিত কবিতার ঐক্য গড়ে তোলা। অন্তত কবিতার জন্য এটা জরুরি।

ফখরুল হাসান: রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, এমন কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যাও তো পৃথিবীতে কম নয়। তবুও এদেশের কবি-সাহিত্যিককে পাঠকরা সাধারণত রাজনীতি-নিরপেক্ষ হিসেবেই আশা করে। এর কারণ কী হতে পারে?

শাহীন রেজা: এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর অনেক স্থানের মানুষই সমর্থন করে না। রাজনীতিবিদ কবি থাকতে পারেন, কিন্তু তিনি যখন কবিতায় তাঁর রাজনৈতিক দর্শন প্রচার শুরু করেন, তখন তাঁর বিরোধী মতের মানুষেরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমাদের দেশে তেমন উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবিদ কবি নেই। আমাদের পাঠকেরা সাহিত্যকে নির্মল সাহিত্য হিসেবে দেখতে চায় বলেই তারা সাহিত্যের নামে রাজনৈতিক স্লোগান থেকে দূরে থাকে।

ফখরুল হাসান: এই ঐক্যটা কীভাবে সম্ভব?

শাহীন রেজা: যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তাঁদের এক কাতারে আসা অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। শুধুমাত্র এই একটি ইস্যুতেই ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে আমি মনে করি। সবার আগে আমার দেশ, তারপর অন্যকিছু।

ফখরুল হাসান: জাতির প্রতি কবিদের কর্তব্য কী?

শাহীন রেজা: দেখুন, কবিদেরকে রাষ্ট্র কিংবা সমাজের বিবেক বলে অভিহিত করা হয়।
কবিরা কালে কালে রাষ্ট্রের স্বপক্ষে এবং শোষণ, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন। সত্য ও আদর্শের বাক স্বাধীনতা এবং মুক্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে তাঁরা সোচ্চার হয়েছেন, জেল খেটেছেন এমনকি মৃত্যুবরণও করেছেন। একটা কথা ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছি, তা হচ্ছে, ‘পেন ইজ দ্য মাইটার দ্যান দ্য সোর্ড’। কবিরা তো অসি চালাতে জানেন না, কিন্তু মসী দিয়ে তাঁরা ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করতে পারেন, আর ন্যায় প্রতিষ্ঠায় করে তুলতে পারেন উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ।

ফখরুল হাসান: রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে মূল্যায়ন করবেন কীভাবে?

শাহীন রেজা: রবীন্দ্রনাথ বিশ্বে বাংলাকে পরিচিত করেছেন, যদিও যে কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি নোবেল পেয়েছিলেন তা রচিত হয়েছিল ইংরেজিতে আর নজরুল পরাধীন জাতিকে শিকল ভাঙার গান গেয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন স্বাধীনতার চেতনায়। এঁরা দু’জন ইতিহাসের অংশ। কে বড়ো কে ছোট এসব প্রশ্ন তুলে এঁদেরকে খাটো করা উচিত নয়। সূর্য কিংবা চন্দ্র দুটোই কিন্তু পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রার্থীত।

শাহীন রেজার বই সমূহ

শাহীন রেজার বই।

ফখরুল হাসান: জীবনানন্দের অবস্থান কোথায়?

শাহীন রেজা: নিঃসন্দেহে তিনি বাংলা কবিতায় একটি বাক বদলের নায়ক। আজ আমরা আধুনিক কবিতা বলতে যা বুঝি, তার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন তিনি। যদিও জীবদ্দশায় তিনি তাঁর প্রত্যাশিত স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু তাতে কি! সময়ই সবচেয়ে বড়ো বিচারক। সময় তাঁকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেছে।

ফখরুল হাসান: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের সাহিত্যে যে কাজ হয়েছে, তাতে কি আপনি তৃপ্ত?

শাহীন রেজা: অবশ্যই নয়। এতো রক্ত, এতো বলিদান, সামান্য কয়েকটি উপন্যাস, গল্প এবং কবিতায় বিবৃত হওয়া অসম্ভব। সাহিত্য হচ্ছে একটি জাতির দর্পণ। আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতো বেশি কাজ করবো, ততই জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য প্রাণ পাবে, প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। আমরা গৌরবান্বিত হবো। আমাদের চেতনা আরো শাণিত হবে।

কবির ছবি

শাহীন রেজার বই।

ফখরুল হাসান: আপনার অগ্রজ কিংবা সমসাময়িকদের মধ্যে কোন কবির কবিতা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?

শাহীন রেজা: অগ্রজদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ নিঃসন্দেহে আমার প্রিয় একজন। এছাড়া জাহিদুল হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আবিদ আজাদ, কামাল চৌধুরী, নাসির আহমেদ, জাহাঙ্গীর ফিরোজ প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে পারি। সমসাময়িকদের মধ্যে বন্ধু রেজাউদ্দিন স্টালিন এবং মারুফ রায়হান নিঃসন্দেহে আলোচিত এবং আমার প্রিয়।

ফখরুল হাসান: কথাসাহিত্যে কাকে কাকে আপনার সম্ভাবনাময় মনেহয়।

শাহীন রেজা: হুমায়ূন আহমেদের পর যিনি আমাদের কথাসাহিত্যকে এগিয়ে নিতে পারতেন, তিনি ইমদাদুল হক মিলন। কিন্তু তাঁর সেই লেখার ধার এখন আর নেই। এরপরে জীবনঘনিষ্ঠ অথচ বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে যাঁর নাম উল্লেখ করা যায়, তিনি মোহিত কামাল। আমার বিশ্বাস তিনি কথাসাহিত্যের বর্তমান শূন্যতা পূরণে সক্ষম হবেন।

ফখরুল হাসান: কবিতার সাথে ছড়ার কোনো দ্বন্দ্ব আছে কি?

শাহীন রেজা: না, নেই। ছড়া এবং কবিতা দুটোই পদ্যের অংশ। ছড়ায় ছন্দের চাল চালার সুযোগ আছে। ছড়া নিয়ে যতো দ্রুত পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায় কবিতায় ততোটা নয়।

ফখরুল হাসান: বর্তমান সময়ের কবিদের অনেককে দেখি গদ্যকবিতা লেখে, কিন্তু ছন্দটা জানে না। ছন্দ না জানলে, সেট তৈরি করতে না পারলে, সেই মোহটা আসে কি? কোনটা তৎসম, কোনটা তদ্ভব, কোনটা গুরু ধ্বনি, কোনটা লঘু ধ্বনি, পয়ার কী, ভাঙা পয়ার কী, স্বরবৃত্ত কী, মাত্রাবৃত্ত কী, অক্ষরবৃত্ত কী, এগুলো না জেনে কবিতা লেখাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শাহীন রেজা : কবিতা লিখতে গেলে কবিতার গ্রামার সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে। যারা এগুলো না জেনে বা না শিখে লিখতে আসেন তারা কিছুদূর হয়তো যেতে পারবেন, কিন্তু কালের ধারায় টিকে থাকবেন না।

ফখরুল হাসান: কাব্যশীলন ও আমাকে সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহীন রেজা: কাব্যশীলনকেও ধন্যবাদ এবং শুভকামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *