বর্তমানে কবিতার সনাতন ধারা ভেঙে নানান চর্চা চলছে ।। আহমেদ শিপলু

আহমেদ শিপলু একাধারে কবি, বাচিকশিল্পী ও লিটলম্যাগকর্মী। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ জুন মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার কোলাপাড়া জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোর থেকেই ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁর লেখালেখির শুরু নব্বই দশকে হলেও বিস্তার প্রথম দশকেই। আহমেদ শিপলুর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১১টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হল : ‘বালিকার আকাশ’, ‘প্রজাপতিরা ফিরে গিয়েছিলো’, ‘বিষণ্ণ ইস্পাত’, ‘বিষবৃক্ষের উল্লাস’, ‘কোনো প্রচ্ছদ নেই’, ‘হিমঘরে চাঁদের শয্যা’ ও ‘নিমজ্জিত মগ্নমায়া’। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন ছোট কাগজ ‘নন্দিতা’, আবৃত্তিশিক্ষার বই ‘কাব্যকল্প’, ‘আবৃত্তির শ্রেষ্ঠ কবিতা’। বর্তমানে তিনি সম্পাদনা করছেন শিল্পসাহিত্য ও মুক্তচিন্তার পত্রিকা ‘মগ্নপাঠ’।

সাম্প্রতিক সময়ে আহমেদ শিপলু তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন সৃজনশীল ওয়েবম্যাগ কাব্যশীলনের। তিনি কথা বলেছেন কবি ও সাংবাদিক শব্দনীলের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারের চুম্বকীয় অংশগুলো তুলে ধরা হল-

কাব্যশীলন :

আপনাকে বলা হয় নব্বই দশকের কবি। দশক চিহ্নিত করায় আপনাকে নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডিতে আটকে রাখা হচ্ছে বলে মনে করেন কী?

আহমেদ শিপলু :

আমি নিজে কখনো এমনটা দাবি করিনি। লেখালেখির শুরু ৯৩-৯৪ এর দিকে। তবে শূন্য দশকে যেমন প্রচুর লিখেছি, তেমনি দ্বিতীয় দশকে আরও বেশি লিখেছি এবং নিরীক্ষা চালিয়েছি। দ্বিতীয় দশকেই সাতটি পাণ্ডুলিপি বই আকারে এসেছে এবং দুটো পাণ্ডুলিপি হাতেও রয়েছে। সুতরাং নির্দিষ্ট কোনো দশকে আটকে থেকে আমি তৃপ্ত হতে পারবো না।

কাব্যশীলন :

মফস্বলে থেকে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন, তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ আছে, ‘শাহবাগ কেন্দ্রিক কবি-লেখকরা মূলত বাংলাসাহিত্যকে অস্থিতিশীল করে তুলছে’। আপনার কি তাই মনেহয় বা হলে কী কারণে এমনটা মনে করছেন?

আহমেদ শিপলু :

অস্থিতিশীল বলতে যদি এগ্রেসিভ এক্সপেরিমেন্ট বোঝায়, তাহলে বলবো এটা শাহবাগের ব্যাপার নয়, বৈশ্বিক বিষয়। বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। সুতরাং এখন আর মফস্বল বলে কিছু থাকার কথা নয়। শিল্প-সাহিত্যের নানান ইজম প্রভাব ফেলেছে বিশ্বব্যাপী। শতাব্দীজুড়ে এর বিস্তার বিশেষ লক্ষণীয়। মানুষের সময় যাপন, বিনোদন, পেশা-নেশা সবই এখন প্রযুক্তি নির্ভর। কবিতায় নানান নিরীক্ষা চলছে। সেসব ঘিরে চিন্তার দ্বন্দ্ব, গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব, ব্যক্তির দ্বন্দ্বও থাকতেই পারে। সুতরাং এটাকে শাহবাগ বা মফস্বল বলে ভাগ করার সুযোগ নেই। তবে অনেকেই এখনো পুরনো ধ্যানধারণার ভেতরেই রয়েছেন। আমি মনেকরি, সেখান থেকে বেরোতেও বেশি সময় লাগবে না হয়তো।

কাব্যশীলন :

সাহিত্যের অস্থিতিশীলতায় বিভিন্ন আন্দোলনের বা বিপ্লবের ঘটনাও আমরা দেখতে পাই। যেমন – হাংরি, নীম, শ্রুতি, কৌরণ ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে কোনো সাহিত্য আন্দোলন বা বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন বলে মনেহয় কী?

আহমেদ শিপলু :

বর্তমানে কবিতার সনাতন ধারা ভেঙে নানান চর্চা চলছে। বিশেষ করে শূন্য এবং দ্বিতীয় দশকে উঠে আসা কবিদের মধ্যে। কেউ কেউ একেবারে ভিন্ন এবং নতুন কিছু করার চেষ্টায়ও আছেন। যদিও আমাদের বেশিরভাগ পাঠক এবং অগ্রজগণ তা গ্রহণের জন্য মোটেও প্রস্তুত নন; হয়তো আরও সময় লাগবে। আন্দোলন আসলে বলে কয়ে হয় না। উত্তরাধুনিকতার পথ ধরে বহুরৈখিক সাঁকো অথবা সাঁতার এখনো শেষ হয়নি। হয়তো এর চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ হবে এই জেনারেশনের কাছেই। এখনো অনেকে হাংরির ভাষায় কবিতা লিখছেন। আবার অনেকেই এখনও উত্তরাধুনিক কবিতার পথই খুঁজে পাননি। তাই বিশেষ কোনো নতুন নামকরণ এখনো উচ্চারিত হতে শোনা যায় না। তবে বর্তমানে কবিতা ও সাহিত্য গণমানুষ থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতায় রয়েছে। এর পক্ষে জোরালো যুক্তিও আছে, তবুও বলবো জনবিচ্ছিন্নতাই শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।

কাব্যশীলন :

‘দর্শনে মুক্তচিন্তা বা চিন্তা উদ্রেককারীর তীর্যক উদ্দেশ্য না থাকলে সে কবিতাকে গড্ডালিকা প্রবাহ বলা যায়’ কথাটি দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন বা কাদের জন্য বলছেন?

আহমেদ শিপলু :

শিল্পের যেকোনো শাখায় কাজ করতে হলে আগে চিন্তার গণ্ডি অথবা দৈন্যতা ঘুচাতে হবে। সমাজ-রাষ্ট্র, সংবিধান, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম-বর্ণ ও লিঙ্গ- এসবের ঊর্ধ্বে ওঠে চিন্তার জাল বিছাতে হবে। সত্য-সুন্দর আর কল্যাণেই জগতের আনন্দ। শিল্প এর বাইরে নয়। শিল্পের কাজ মানুষকে ভাবাবিষ্ট করা, আনন্দ দেওয়া। আর সে কারণেই দর্শনের স্পষ্ট পাঠ দরকার। মুক্তচিন্তার মাঠে প্রবেশ করতে পারলেই খুলে যাবে অসংখ্য দ্বার। আর তখনই কবিতা হয়ে উঠবে ধারালো এবং গূঢ় অর্থবোধক বা ভিন্নচিন্তার উদ্রেককারী তীর্যক কথামালা।

কাব্যশীলন :

আপনি তো ‘মগ্নপাঠ’ সম্পাদনা করছেন। একটা সময় লিটল ম্যাগের মাধ্যমে প্রচুর নবীন লেখক উঠে আসতো এবং তাঁদের ভেতরে লিটল ম্যাগ নিয়ে একধরনের উদ্দীপনা কাজ করতো। এই সময়ে এসে ভিন্ন ওয়েব ম্যাগ বা পোর্টালের জন্য নবীনদের কাছে এর আবেদন বা জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে কী?

আহমেদ শিপলু :

এখনো অনেকেই ছাপার অক্ষরে পড়তে পছন্দ করেন। সম্পাদনার কাজও করছেন। আমিও করছি। এটা নষ্টালজিক অথবা অভ্যাসবশত। নতুন জেনারেশনের কাছে স্লেট-পেন্সিল অপরিচিত। সরাসরি কাগজকলমেই শুরু। বর্তমানে ট্যাব ও নোটপ্যাড চলে এসেছে। এটা সময়ের স্রোত। ওয়েবম্যাগই আগামী সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। একসময় এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে সবাই।

কাব্যশীলন :

‘নন্দিতা’ কোন ধরনের এবং কাদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে?

আহমেদ শিপলু :

‘নন্দিতা’রই নতুন নাম বলতে পারেন ‘মগ্নপাঠ’। দীর্ঘ বিরতির পরে নতুন নামে ফেরা। মগ্নপাঠ লিটলম্যাগের মতো হলেও মূলত ‘শিল্প-সাহিত্য ও মুক্তচিন্তার পত্রিকা’র স্লোগান ধারণ করে।

কাব্যশীলন :

কবিতাকে কলমে ও কণ্ঠে ধারণ করেছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্প দুটোকে কোন সত্তায় লালন করছেন?

আহমেদ শিপলু :

আমার কাছে দুটি আলাদা শিল্প; ভালোলাগা তো ছিলই। আমি সংগঠন প্রিয় মানুষ। সাংগঠনিক বাচিকচর্চার মধ্য দিয়ে সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতির যত্ন নেওয়া যায়। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে শ্রম দিয়ে আসছি। তবে এখন শুধু লেখালেখি, পঠনপাঠন আর সম্পাদনা নিয়েই বেশি কাজ করতে চাই।

কাব্যশীলন :

শহর বা মফস্বলে এই মুহূর্তে অনেক আবৃত্তির সংগঠন কাজ করছে। তাঁরা যতটা কাজ করছেন, ঠিক ততটা বা তার কাছাকাছি আবৃত্তি শিল্পী পাচ্ছি কি আমরা?

আহমেদ শিপলু :

তুলনামূলক অনেক কম। আজকাল প্রায় সকলেই সংবাদ পাঠ, উপস্থাপনা ও প্রমিত উচ্চারণ শেখা বা ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে আবৃত্তি কর্মশালায় আসে। এদের ভেতর থেকেই অনেকে জড়িয়ে যায় আবৃত্তিতে। কিন্তু শিল্পচর্চার জন্য পরিশ্রম, অধ্যবসায়, পঠনপাঠন দরকার। প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে বেশিদূর এগোনো যায় না। তাছাড়া ক্যারিয়ার চিন্তা, সংগঠনে নেতৃত্বের সংকট ও দ্বন্দ্ব – নেতিবাচক এসব প্রভাব তো রয়েছেই।

কাব্যশীলন :

সাহিত্যচর্চার শুরুর দিকের আহমেদ শিপলু এবং এই সময়ের আহমেদ শিপলুর মাঝে পার্থক্যটা বলতেন যদি…

আহমেদ শিপলু :

প্রতিনিয়তই নিজেকে নতুনভাবে উপলব্ধি করি। তবে চিন্তা, কাজ, প্রেম, সততার একটা স্ট্যাবিলিটি থাকলেও অন্তর্গত ধ্যান, দর্শনচিন্তা, নন্দনভাবনা- এসব নিয়ে বলা যায় এখনো অথৈ সাগরে আছি।

কাব্যশীলন :

দ্রোহ ও নান্দনিকতার দিক দিয়ে বাংলা সাহিত্যের কোন দশককে এগিয়ে রাখবেন আপনি?

আহমেদ শিপলু :

প্রত্যেক দশকেরই আলাদা গুরুত্ব আছে, ভিন্ন ইমেজও আছে। আমি ভিন্ন ভিন্ন ভাবেই মূল্যায়ন করতে চাই। এগিয়ে রাখা বা পিছিয়ে দেয়ার পক্ষে নই। তবে বলা যায়, বর্তমানই এগিয়ে থাকে চূড়ান্ত রূপে।

কাব্যশীলন :

সাহিত্য বা শিল্পচর্চা কেন করেন?

আহমেদ শিপলু :

পৃথিবীতে কতো মানুষ কতোকাল ধরে কতো সভ্যতা গড়লো, বিলুপ্ত হলো। শাসক-শোষিত, রাজা-উজির-প্রজা, পুরোহিত- কতো কতো চরিত্র। সব কালেই কিছু মানুষ ছিল, যাঁরা অন্যকে আনন্দ দানে তৃপ্ত হতে চেয়েছেন। এঁরা জ্ঞান চর্চায়ও নিবিষ্টচিত্ত। যদিও সভ্যতা এগিয়েছে এঁদেরকে উপেক্ষা করে। আমি মনেকরি শিল্পসাহিত্যের মননশীল মানুষেরা পৃথিবী ও সমাজের শুশ্রূষা করে, যত্ন করে, ধ্যানী ভাষ্করের মতো গড়ে দেয় নান্দনিক মন্যুমেন্ট।
নিজের ভেতরে তলিয়ে যেতে চাওয়ার আকুলতা থেকেও লিখতে আনন্দ পাই। একটা অমীমাংসিত অধ্যায়কে জীবন ভেবে যেমন পথ চলি, মানে খুঁজি, দ্বন্দ্বে জড়াই; প্রেম ও পঙ্কিলতা নিয়ে ঘুমোতে যাই প্রতিদিন। কবিতাচর্চাও সেরকম একটা অভ্যাস হয়ে গেছে, অথবা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ঘোর বলা যায় এটাকে – যা কখনো কুয়াশার মতো কেটে যায় না।

কাব্যশীলন :

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার মূল্যবান সময় কাব্যশীলনকে দেবার জন্য।

আহমেদ শিপলু :

আপনাকেও ধন্যবাদ এবং কাব্যশীলনের জন্য শুভকামনা রইল।

One thought on “বর্তমানে কবিতার সনাতন ধারা ভেঙে নানান চর্চা চলছে ।। আহমেদ শিপলু

  • সেপ্টেম্বর ৩, ২০২০ at ৯:৩১ অপরাহ্ণ
    Permalink

    শিপলুর কথাগুলো খুব ভালো লাগলো।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *