ঈদসংখ্যার সায়েন্স ফিকশন।। ফ্যাট হাট।। কমলেশ রায়

ফ্যাট হাট। বিশাল সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে নামটা। লেখাটার পাশে থলথলে চেহারার একজন মানুষের ছবি। মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। হাত ভর্তি টাকা। পথচারী ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায়। লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায় সাইনবোর্ডের দিকে।
গেটে দুটো অংশ। দু’রকম ব্যবস্থা। একাংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। অন্য অংশ দিয়ে বের। যারা ঢুকছে তাদের শরীর দশাসই। সবাই যেন সুমো কুস্তিগীর। চলতে ফিরতে কষ্ট হয়। তারপরও মুখে হাসি। আর যারা বের হচ্ছে তাদের বেশ ক্লান্ত দেখায়। দেখে মনে হয়, তাদের শরীর খানিকটা চুপসে গেছে।
এই আসা-যাওয়ার পথে পরিচিত দু’একজনের দেখা হয়ে যায়। কেউ হাঁক ছাড়ে, এ মাসে কত হলো ?
‘গত মাস থেকে চার ইউনিট বেশি’। কিংবা ‘এ মাসে ইউনিট দেড়েক বেড়েছে’। বেশিরভাগ সময়ই এ ধরনের উত্তর শোনা যায়। কখনও আবার বিপরীত। উত্তরদাতা বিষণœ গলায় বলে, এ মাসেও দুই ইউনিট কমে গেল। শরীরের কিছু একটা হয়েছে রে ভাই। বুঝতে পারছি না কী করব।
এটা খুব খারাপ লক্ষণ। দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যাও। প্রশ্নকর্তা বিজ্ঞের মতো উপদেশ দেয়।
উত্তরদাতা হালকা মাথা ঝাঁকায়। তাকে বেশ চিন্তিত দেখায়। গলা খাদে নামিয়ে সে বলে, তাই যেতে হবে দেখছি। যেভাবে ইউনিট কমছে, সংসার চলবে কী করে?
ধুর, এত চিন্তা করো না তো। মাঝে মধ্যে এরকম অনেকেরই হয়। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করো। খাও-দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। যাই ভাইয়া, আমার সিরিয়াল আবার পেরিয়ে না যায়। প্রশ্নকর্তা হনহন করে হাঁটতে চায়। কিন্তু শরীরের ব্যাপ্তির কারণে পারে না। তবে সে দ্রæত স্থান ত্যাগ করতে সচেষ্ট হয়। উত্তরদাতার মাথায় তখন হাজারও দুশ্চিন্তা। নিজের অজান্তেই সে থমকে দাঁড়ায়। রাজ্যের ক্লান্তি তাকে পেয়ে বসে। সে যেন পা বাড়াতে ভুলে যায়।
গার্ড এগিয়ে এসে বলে, অহেতুক দাঁড়িয়ে থাকবেন না। ভিড় জমে যাবে। অন্যকেও বের হতে দিন।
ভারী বিরক্ত হয় লোকটি। গার্ডের ওপর তার ভীষণ রাগ হয়। ধমক দিতে ইচ্ছে করে। যদিও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলায় সে। গার্ড তো আর মানুষ নয়, অ্যানড্রয়েড। চলে প্রোগ্রাম মতো। বেচারা। দেখতে হুবহু মানুষের মতো। অথচ নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছার সুযোগ নেই। সে আর.ম্যাক্সে থাকা প্রোগ্রামের দাস।
গার্ড আবার তাড়া দেয়। লোকটি এবার খেকিয়ে ওঠে, যাচ্ছি রে বাবা। এমন তো নয় যে তুমি খেতে যাবে, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। তাহলে এত তাড়া কীসের শুনি ?
বাজে বকবেন না। আমি আমার কর্তব্যের প্রতি দায়বদ্ধ। আপনি অনেক সময় নিচ্ছেন গেট পার হতে। দয়া করে আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না। গার্ডের ধাতব গলা এবার একটু কঠিন শোনাল।
লোকটি পা বাড়াল। তার পকেটে অনেক টাকা। তারপরও মন খারাপ। কারণ গত মাসের চেয়ে তার উপার্জন কম হয়েছে। ফ্যাট হার্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে টাকার সঙ্গে একটা লিফলেট দেওয়া হয়। তাতে বিভিন্ন নিয়ম আর উপদেশ লেখা। তবে শেষের কয়েকটি লাইন বেশ নাটকীয়। আপনি জানেন কি, আগে শরীরের মেদ কমাতে কত খরচ হত ? আর এখন সেই মেদ আপনাকে এনে দিচ্ছে পর্যাপ্ত টাকা। নিশ্চিন্ত জীবন।

দুই.
ছেলে দেখতে এসেছে কন্যাপক্ষ। ছিমছাম পরিবার। বাবা-মা আর ছেলে। সবকিছু দেখে শুনে তাদের পছন্দ হয়েছে। পাকা কথা দেওয়ার আগে এক কাণ্ড করে বসলেন মেয়ের বাবা। ছেলের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাকে ডাকা হলো। বেশ সুদর্শন। যথেষ্ট নাদুসনুদুস।
কী নাম তোমার ? মেয়ের বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
সায়ন। ছেলেটি লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দিলো।
সুন্দর নাম। তুমি কি আমার মেয়েকে দেখেছো ?
সামনাসামনি দেখিনি। তবে সাইবার যোগাযোগ হয়েছে। অনলাইন আড্ডা দিয়েছি। ছবি দেখেছি।
ওকে তোমার পছন্দ হয়েছে ?
সায়ন মুখ নিচু করে মিটিমিটি হাসতে থাকল। জবাব দিলো না। মা পাশ থেকে বলল, এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে। বল না পছন্দ হয়েছে।
ঠিক আছে, ওকে আর মুখে বলতে হবে না। যা বোঝার আমি ঠিক বুঝে নিয়েছি। সায়ন, তুমি যেন কোথায় চাকরি করো ?
একটা কম্পিউটার কোম্পানিতে।
ধ্যাৎ, ওই গৎবাঁধা চাকরি ছাড়ো। তোমার স্বাস্থ্য তো ভালোই। তা তোমার ওজন কত ?
১৬৭ কেজি।
না, ছেলেদের ওজন আজকাল দু’শ কেজি হওয়া উচিত। কমপক্ষে পৌনে দু’শ। শরীর বানাও, ফ্যাট হাটে যাও। পকেট ভর্তি পয়সা কামাও। এ যুগে এমন সুযোগ থাকতে কে করবে ওই নয়টা-পাঁচটা চাকরি?
সায়ন কিছু বলার আগেই মা বলল, ও কিন্তু ছয় মাসে একবার ফ্যাট হাটে যায়। বাড়তি ভালই আয় করে।
না, না, আমার মেয়েকে অনেক আদর-যত্নে বড় করেছি আমি। ও দু’হাতে খরচ করতে অভ্যস্ত। প্রতিমাসে ফ্যাট হাটে যাওয়া পাত্র ছাড়া ওর সঙ্গে অন্য কেউ সংসার করতে পারবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। তা বাবা সায়ন, তুমি চাকরি ছেড়ে একটু ভালো মতো খাওয়া-দাওয়া করো। তোমাকে আমার মেয়ের যোগ্য হতে হবে। কী পারবে তো?
অবশ্যই পারবে। না পারার কী আছে। মা কারও মতামতের তোয়াক্কা না করে বলে দিলো। এত ভালো পাত্রী, পাছে আবার বেহাত হয়। বাবাও কী বুঝে তাতে সায় দিলেন, হ্যাঁ, তাই তো। তাই তো…।
মেয়ের বাবা একগাল হেসে বললেন, তাহলে কথা একরকম পাকাই হয়ে গেল। ওরা দু’জন সামনাসামনি পরস্পরকে দেখুক। তারপর আমরা তারিখ ঠিক করব। কী বলেন?
বাবা-মা প্রায় একসঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তবে কথা বের হলো কেবল মায়ের মুখ থেকেই, ‘একদম ঠিক কথা বলেছেন বেয়াই সাহেব’।
মেয়ের বাবা এত তাড়াতাড়ি ‘বেয়াই’ সম্বোধনে একটু ভড়কে গেলেন। তবে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ছেলে মনে হয় বাবার গুণ বেশি পেয়েছে। আপনার কী মতামত হবু বেয়াইন?
কেন বলুন তো?
না, আপনি যথেষ্ট চটপটে। হবু বেয়াই একটু চুপচাপ ধরনের। ছেলেও দেখছি একটু লাজুক, কথা কম বলে।
ও তাই বলেন। আমি ভাবলাম কি না কি। হি-হি-হি।
সায়নের মায়ের হাসিতে সবাই যোগ দিলো। বাবা, সায়ন, মেয়ের বাবা, এমনকি তার সঙ্গে যে দু’জন আত্মীয় এসেছেন তারাও।

তিন.
আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়েছে গিরি। নামটা তার বেশ যুতসই। তার দেহ সত্যিই ছোটখাটো পর্বত। বিকেলের রোদ মরে এসেছে। প্রশস্ত বারান্দায় এক ফালি রোদ, ক্রমেই কমে আসছে। হেমন্তের হাওয়ায় শীতের আগমনী বার্তা। পাশে টি-টেবিল। বড় জগে দুধ রাখা। লিটার তিনেক হবে। একটু আগে গিরি ফলের রস খেয়েছে। আপেলের রস। একটানে দেড় লিটার শেষ। আধা ঘণ্টা পার হলে দুধটুকু সাবাড় করতে হবে। তার স্ত্রী নিমা ভীষণ কড়া। পানের থেকে চুন খসার উপায় নেই। ঘড়ি ধরে খাবার হাজির করে তার সামনে। দুধ-পর্ব শেষ হওয়ার পর চল্লিশ মিনিট বিরতি। সন্ধ্যার শুরুতেই তাকে খেতে হবে ছয়টা সেদ্ধ ডিম। নিমার মেজাজ ভালো থাকলে সপ্তাহে দু’একদিন ওমলেট মেলে। হাফ ডজন ডিমের ওমলেট। খাবারের ফিরিস্তি আরও দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেদিকে না যাওয়াই ভালো। তালিকা কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হবে। আসলে গিরি যতক্ষণ জেগে থাকে প্রায় ততক্ষণই খায়। খাওয়াই তার প্রধান কাজ।
ছোট্ট টুলে ফুটফুটে রেনি বসে আছে। গিরির মেয়ে। কথা বলতে খুব পছন্দ করে। বিভিন্ন বিষয়ে তার রাজ্যের কৌতূহল। রেনির কোলে সুন্দর পুতুল। আজই কিনে এনেছে ওর মা। বায়না ছিল অনেক দিনের। কিন্তু কেনা হয়ে উঠছিল না। গতকাল ফ্যাট হাট থেকে ফিরে গিরি বেশ খোশমেজাজে ছিল। গত মাসের চেয়ে তিন ইউনিটের দাম বেশি পেয়েছে। নিমার হাতে টাকা তুলে দিয়ে ক্লান্ত গলায় সে বলেছিল, তুমি কাল সকালে বের হয়ে পুতুল কিনে আনবে। মেয়েটা কতদিন ধরে বলছে।
অন্যসময় হলে নিমা হয়তো ক্ষেপে যেত। একসঙ্গে এত টাকা হাতে পাওয়ার কারণেই কিনা, সে দ্রুত গিরির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

রেনি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। পড়াশোনায় ভালো। তবে তার সহপাঠী অনেকের কথা তাকে প্রায়ই আহত করে। ‘তোর বাবা শুধু খায় আর খায়, ঠিক না?’ ‘সারাদিন তোর বাবা মজার মজার খাবার খান। বেশ মজায় আছেন উনি!’ ছোটন নামের এক সহপাঠী তো তার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছে। সে বুক ফুলিয়ে বলে, আমি গিরি আঙ্কেলের মতো হবো। মজার মজার খাবার খাব। পাহাড়ের মতো শরীর বানাব। মাসে একবার ফ্যাট হাটে যাব। টাকাই টাকা। ইচ্ছে মতো দু’হাতে খরচ করব।
ছোটনের কথা শুনে ক্লাসের অনেকেই হি-হি করে হাসে। আর রেনির দিকে তাকায়। তখন তার কেন যেন ভীষণ লজ্জা লাগে। বাবাকে নিয়ে রসিকতা একদম ভালো লাগে না তার।
গতকাল বেডরুমের মেঝেতে অনাদরে পড়ে থাকা লিফলেটটি মন দিয়ে পড়েছে রেনি। অনেক কিছু বুঝতে পারেনি। বিশেষ করে শেষের কয়েকটি লাইনের মাথামুণ্ডু কিছুই সে বুঝেনি। ফ্যাট হাট থেকে এলে বাবা ভীষণ ক্লান্ত থাকে। এ জন্য সে কিছু জিগ্যেস করেনি। আজ বাবাকে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। বিষয়টি জিগ্যেস করবে বলেই বাবার পাশে এসে বসেছে সে। যদিও বাবার কাছে থাকতে তার সবসময়ই ভালো লাগে।
গিরির খুব ভালো লাগছে আজ। মেয়ের অনেকদিনের শখ পূরণ করতে পেরেছে। এই পুতুলটার নাম প্রিটি ডল। দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি আধুনিক। ছোটদের মনোরঞ্জনের সব রকম কলাকৌশল পুতুলটির নখদর্পণে। আর দামও তাই অনেক বেশি। সাধারণ পরিবারের কেউই এত খরচ করে পুতুল কেনার সাহস করে না। একটা বিষয় নজর এড়াল না গিরির। এ পুতুল পেয়ে রেনির যতটা উচ্ছ¡সিত থাকার কথা তার মধ্যে সেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং সে যেন কী সব ভাবছে। হঠাৎ মেয়েটার হলো কী?
কী হয়েছে রেনি? গিরি জিগ্যেস করল।
না, তেমন কিছু না।
অবশ্যই কিছু হয়েছে। আমাকে কি বলা যাবে?
হ্যাঁ, যাবে। আমার কিছু প্রশ্ন ছিল।
কী প্রশ্ন বলো?
কীভাবে যে শুরু করি।
যে কোনো একটা দিয়ে শুরু করো। গুছিয়ে প্রশ্ন করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তো কেউ তোমাকে দেয়নি।
লিফলেটের একটা লেখা পড়েছ?
কোন লেখার কথা বলছ?
শেষের কয়েক লাইন।
হ্যাঁ, পড়েছি। কেন বলো তো?
একটা ব্যাপার ঠিক বুঝিনি।
কোন ব্যাপার?
আগে শরীরের মেদ কমাতে কেন খরচ হতো?
ফ্যাট হাটের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না বলে।
এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।
তাহলে তুমি কী জানতে চাও, বলো?
আগেকার দিনে মানুষ কেন শরীরের মেদ কমাতে চাইত?
তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান আজকের মতো এত উন্নত ছিল না। শরীরে মেদ বাড়লে বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিতো।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। শরীরে মেদ বাড়লে রক্তে চর্বির পরিমান বেড়ে যেত। রক্তনালীর প্রাচীরের পুরুত্ব বেড়ে গিয়ে সরু হয়ে যেত ভেতরের আয়তন। ফলে দেখা দিত উচ্চ রক্তচাপ, হৃদক্রিয়া বন্ধের ঘটনাও অহরহ ঘটত এসব ক্ষেত্রে। এছাড়া রক্তে চিনির পরিমান বেড়ে অনেকেই আক্রান্ত হতো ডায়াবেটিস রোগে। এক কথায় তখন শরীরে অত্যধিক মেদ জমলেই রোগব্যাধি হামলে পড়ত।
মানুষ তাই বেঁচে থাকার জন্যেই মেদ ঝরাতে চাইত।
একদম ঠিক বলেছ।
কিন্তু এজন্য টাকা খরচ হতো কেন? তখন কি মেদের বাণিজ্যিক ব্যবহার ছিল না?
না, ছিল না। বিভিন্ন স্লিমিং সেন্টারে গিয়ে পকেটের পয়সা খরচ করে চিকিৎসা নিতে হতো।
অবস্থাটা বদলালো কী করে?
সে তো বিরাট কাহিনী। অন্য একদিন বলব।
না, আমি আজই শুনতে চাই।
রাতারাতি এ দৃশ্যপট বদলের কৃতিত্ব বিজ্ঞানী সাইরাসের।
কী করেছিলেন উনি?
এক আবিষ্কারের মাধ্যমে বদলে দিয়েছিলেন পৃথিবী।
সেই আবিষ্কারটা কী?
ফ্যাটবোট।
এটা কি যন্ত্র?
হ্যাঁ, যন্ত্র। এক ধরনের ন্যানোবোট।
ন্যানোবোট কী ?
অনু আকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মেশিন। এটা কত ছোট জানো?
না, জানি না।
এক মিটারের একশ কোটি ভাগের মাত্র এক ভাগ। এক কথায় ন্যানোটেকনোলজির রোবটই ন্যানোবোট।
তার মানে এদেরও হাত আছে?
হ্যাঁ, আছে। শুধু তাই নয়, হাত দিয়ে তারা কোনো বস্তুকে ওপরে তোলা বা এদিক-ওদিক নড়াচড়া করতে পারে। মজার ব্যাপার কি জানো, এদের মস্তিষ্ক হলো ইলেকট্রনিক মস্তিষ্ক।
ফ্যাটবোটের কাজ কী?
শরীরের চর্বিকে অপসারণ করে।
এ ক্ষুদ্র যন্ত্র তাহলে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়?
ঠিক ধরেছো।
ব্যথা লাগে না?
খুব বেশি না। ইনজেকশন দিলে যেমন ব্যথা লাগে অতটুকু।
পিঁপড়ের কামড়ের মতো?
হ্যাঁ, কাছাকাছি।
ফ্যাটবোটও কি ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়?
ধরনটা একই রকম। তবে এটি আরও আধুনিক ও নিখুঁতভাবে করা হয়।
এই যন্ত্রটা কীভাবে কাজ করে?
একসঙ্গে লাখো ফ্যাটবোট শরীরে প্রবেশ করানো হয়। তারা দেহের মেদবহুল অংশ থেকে চর্বি সংগ্রহ করে বেরিয়ে আসে।
সর্বোচ্চ কতটুকু চর্বি সংগ্রহ করবে সেটা যন্ত্রটা কীভাবে বুঝবে?
যার শরীর থেকে চর্বি সংগ্রহ করা হবে প্রথমে তার শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। তারপর নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ কতটুকু চর্বি আহরণ করা যাবে। ফ্যাটবোটদের মস্তিষ্কে সেই মতো নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া হয়। যন্ত্রগুলো নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। তোমাকে তো আগেই বলেছি, ফ্যাটবোটের মস্তিষ্ক হলো ইলেকট্রনিক মস্তিষ্ক।
বাহ! এত ক্ষুদ্র একটা যন্ত্র কী সুচারুভাবে কাজ করে।
তোমার প্রশ্ন কি শেষ হয়েছে?
না, হয়নি।
এখনও বাকি!
হ্যাঁ, বাকি।
আর কী জানতে চাও, শুনি?
বিজ্ঞানী সাইরাস কি ফ্যাট হাট শুরু করেছিলেন?
হ্যাঁ। তবে সেটা উনি করেছিলেন ফ্যাটবোট আবিষ্কারের বেশ পরে। অনেকটা বাধ্য হয়ে।
বাধ্য হয়ে!
কী বিশ্বাস হচ্ছে না?
হচ্ছে। তবে কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে।
ফ্যাটবোট আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানী সাইরাস বাণিজ্যিকভাবে এর ব্যবহার শুরু করেন। তখন অভিনেতা-অভিনেত্রী, খেলোয়াড়, ধনী পরিবারের সদস্যরাই কেবল ফ্যাটবোটের সেবা নিতে পারত। কারণ এজন্য মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হতো।
পরিস্থিতি পাল্টে গেল কী করে?
এটাও আজই শুনতে হবে?
হ্যাঁ, আমি আজই শুনতে চাই। এক্ষুনি শুনতে চাই।
বিজ্ঞানী সাইরাসের নামডাক তখন ছড়িয়ে পড়েছে। একদিন উনি অদ্ভুত এক মেইল পেলেন। কেউ একজন প্রস্তাব করেছেন, তিনি শরীর থেকে অপসারিত চর্বি সংগ্রহে আগ্রহী। বিজ্ঞানী সাইরাস বিষয়টিকে প্রথমে গুরুত্ব দেননি। ভাবলেন, পরিচিত কেউ হয়ত দুষ্টামি করেছে।
তারপর?
উনি নিজেও শরীর থেকে অপসারিত চর্বি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। যদি বিশেষ কোন উপকারে একে ব্যবহার করা যায়। এর মধ্যে আবার মেইল। যিনি পাঠিয়েছেন তার মেইল নম্বরও কেমন বিদঘুটে। বিজ্ঞানী সাইরাস অনেক চিন্তাভাবনার পর জবাব দিলেন। লিখলেন, আপনি কে, কী আপনার পরিচয়, এসব না জেনে আপনার প্রস্তাবে কীভাবে সাড়া দেই বলুন তো?
ফিরতি মেইলে কী জবাব এলো?
শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী সাইরাস, আমি এক ভিনগ্রহবাসী। আপনাদের গ্রহ থেকে আমাদের গ্রহের দূরত্ব প্রায় দুই আলোক মাস১। এটাও দেখতে কমলালেবুর মতো। পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের প্রিয় গ্রহটির অদ্ভুত মিল। নাম বীথিপৃ২। একটু খেয়াল করুন, নামেও সাদৃশ্য আছে। কেবল বর্ণমালাগুলোর সজ্জা একটু ভিন্ন। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, পৃ দিয়ে আপনাদের শুরু. আমাদের শেষ। বী দিয়ে আমাদের শুরু আপনাদের শেষ। মাঝের থি’র অবস্থান উভয়েরই এক। অনেকটা নিরুপায় হয়েই আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। এই অধমও একজন যৎসামানায় বিজ্ঞানী। ধন্যবাদান্তে সরাইসা।
বেশ মজার মেইল তো। বিজ্ঞানী সাইরাস কী জবাব দিলেন?
উনি লিখলেন, পরিচয় জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আমাদের নামের ক্ষেত্রেও একই ধরনের কাকতালীয় ঘটনা লক্ষ্য করলাম। তবে কী কারণে আপনি চর্বি সংগ্রহে আগ্রহী তা কিন্তু জানাননি। লিখেছেন নিরুপায় হয়ে দ্বারস্থ হয়েছেন, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন কী?
বাবা, তুমি হুবহু এত কিছু মনে রেখেছো?
না রাখার কী আছে। ফ্যাট হাটে যায় অথচ বিজ্ঞানী সাইরাসের বিষয়ে জানে না এমন লোক নেই বললেই চলে। তোমাকে আমি একটা বই এনে দেবো, বিজ্ঞানী সাইরাসের জীবনী। পড়ে দেখো, তোমার ভালো লাগবে।
আচ্ছা এনে দিও। এখন বলো বিজ্ঞানী সাইরাসের মেইলের কী জবাব এলো।
সরাইসা লিখলেন, আমাদের গ্রহের বাসিন্দাদের মধ্যে চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ চুলকানি হয়, অসহ্য ব্যথা, সহজে সারে না। এটা পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল। বাসিন্দাদের এ বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। কিন্তু চর্মরোগ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় কী? অনেক গবেষণার পর একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছি। যথেষ্ট ব্যয়বহুল এ ওষুধের উপাদান সংকটে ভুগছি। আমাদের গ্রহে এর জোগান নেই বললেই চলে। তাই অনেক খোঁজখবর নিয়ে আপনার কাছে চর্বি সংগ্রহের প্রস্তাব দিয়েছি। কারণ মানব চর্বিতে ওষুধটির নব্বই ভাগ উপাদান রয়েছে। ও ভালো কথা, চর্বির বিনিময়ে কী চান? প্লাটিনাম নাকি সোনা? দুটোই দিতে আমরা প্রস্তুত।
বিজ্ঞানী সাইরাস এ প্রস্তাবে ঝটপট রাজি হয়ে গেলেন। ঠিক না?
আরে না। উনি লিখলেন, আপনার প্রস্তাব লোভনীয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করা দরকার। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব নয়।
তারপর কী হলো?
সরাইসা জবাব দিলেন, আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো একদম সময় নেই বিজ্ঞানী সাইরাস। আপনাকে দ্রæত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চোখের সামনে বীথিপৃবাসী অসহ্য কষ্ট পেয়ে মারা যাবে এটা কিছুতেই কাম্য নয়, মেনে নেওয়া যায় না। আপনি দ্রুত ভাবুন বন্ধু।
বিজ্ঞানী সাইরাস এরপর কী লিখলেন?
বন্ধু সরাইসা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। মানবজাতির জন্য হঠকারী হয় কিনা সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। ভালো থাকবেন। বীথিপৃবাসীর জন্য শুভকামনা, তারা দ্রুত আরোগ্য লাভ করুক।
দুজনের মধ্যে বেশ স্নায়ুযুদ্ধ চলেছিল মনে হচ্ছে।
স্নায়ুযুদ্ধ নয়, শেষমেশ বিজ্ঞানী সরাইসা যুদ্ধই ঘোষণা করে ফেললেন।
যুদ্ধ ঘোষণা!
হ্যাঁ, তাই। উনি লিখলেন, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আছি। বন্ধুর বিপদে বন্ধু এগিয়ে আসবে এটাই কাম্য। তা না হলে ঠুনকো বন্ধুত্বে কী লাভ? পাঁচজন মানুষকে ইতিমধ্যে আমরা অপহরণ করেছি। না, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তাদের কিছুই হবে না। আপনার সিদ্ধান্ত নিতে যাতে সহজ হয় এজন্য এ অপ্রিয় কাজটি করতে হয়েছে। এখন বিবেচনা করুন, প্রয়োজন মতো পৃথিবী থেকে আমরা মানুষ তুলে নিয়ে যাবো নাকি আমার প্রস্তাবে আপনি রাজি হবেন।
বিজ্ঞানী সাইরাস শেষপর্যন্ত বাধ্য হলেন সিদ্ধান্ত নিতে, ঠিক না?
হ্যাঁ, ঠিক। এছাড়া উনার কোনো উপায়ও ছিল না।
এরপর উনি বীথিপৃবাসীদের মানব চর্বি সরবরাহ করতে থাকলেন। বদলে তারা উনাকে সোনা আর প্লাটিনাম দিতে থাকল। বেশি করে চর্বির জোগান দেওয়ার জন্য গড়ে উঠল ফ্যাট হাট। যা একসময় রূপ নিল একটা শিল্পখাতে। ঠিক বলেছি না?
হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছো।
বলি, মেয়ের না হয় বয়স অল্প। তাই বলে কী তুমিও বুদ্ধির মাথা খেয়েছো? নিমা গজগজ করতে করতে বারান্দার দিকে এগিয়ে এলো।
এই সেরেছে। গিরি চাপা গলায় বলল।
রেনির হঠাৎ খেয়াল হলো, বাবা এখনও দুধ খায়নি। অথচ খাওয়ার সময় মিনিট পাঁচেক পেরিয়ে গেছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, তাড়াতাড়ি দুধ খেতে শুরু করো।
গিরি কথা না বাড়িয়ে দুধের জগ তুলে ঢকঢক করে খেতে শুরু করল।
কথা বলতে শুরু করলে বাপ-বেটির আর হুঁশ থাকে না। এটুকু বুঝে না, ঠিক মতো না খেলে শরীরে চর্বি জমবে কী করে। চর্বি কী আকাশ থেকে আসে। মাস গেলে দুটো টাকা ঘরে আসছে। একটু দুধে-মাছে আছি, সেটা যেন কারও সহ্য হচ্ছে না। সুযোগ পেলেই অনিয়ম করা চাই। বলি, সামনের মাসে যদি দুই ইউনিট কমে যায়, তাহলে সংসারের হাড়িতে টান পড়লে সেটা কে দেখবে শুনি? সে চিন্তা কী কারও আছে? আমার হয়েছে মরণ। যেদিকে খেয়াল না করব, সেদিকেই একটা অনিষ্ট হয়ে বসে থাকবে। কী যে করি…। নিমা বকবক করতে থাকে।
রেনি মায়ের এ আচরণে অভ্যস্থ। সে এসব কথাকে মোটেও গুরুত্ব দেয় না। বরং আকাশের দিকে তাকিয়ে দুটোর মেঘের প্রতিযোগিতা দেখতে থাকে।
নিমার বকবক বেশ লাগে গিরির। ইচ্ছে করলেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাহায্যে বউয়ের আচরণ বদলে ফেলা যায়। কিন্তু কী দরকার? বংশ পরম্পরায় নিমা যে জিন ধারণ করছে, কী প্রয়োজন সেটা পাল্টে ফেলার। মানুষ ক্রমেই কৃত্রিমতার দিকে ঝুঁকছে। থাকুক না কিছু বিষয় একেবারে আদি-অকৃত্রিম। যা আমাদের পূর্বপুরুষদের কথা মনে করিয়ে দেবে।

১. আলোক মাস : আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭শ ৯২ কিলোমিটার। এই হিসেবে আলো একমাসে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করে, সেটাই আলোকমাস।
২. বীথিপ্ : কল্পিত গ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *