ঈদসংখ্যার গল্প।। শহীদুল্লার ঈদ হবে না।। নাসরীন মুস্তাফা

শহীদুল্লা গত দু’দিন ধরে ভাবছে। কে ওকে অভিশাপ দিল? কে?
অভিশাপ কুড়ানোর মত কোন কাজটা সে করেছে গত আটাশ বছরে? কাজের নাম-ধাম— ফিরিস্তি শনাক্ত করতে পারছে না। কিন্তু ও শিয়্যর, কেউ একজন অভিশাপ দিয়েছে ওকে। নইলে এতসব কাণ্ড গত তিন সপ্তাহ ধরে…. নাহ! কেউ অভিশাপ না দিলে ওর ঘটনাহীন পান্তাভাত-মার্কা জীবনটায় এমন কাণ্ড ঘটার তো কথা না!
আহারে! শহীদুল্লা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর ভাবে এবারের ঈদটাও হ’ল না।
ঘটনা সত্য। বাবা-মা মরে যাওয়ার পর তিন ক‚ল ধবধবে ফর্সা হয়ে গেল মোহাম্মদ শহীদুল্লার। অথচ বয়স তখন কেবল সোয়া এক যুগ। করার তো কিছু ছিল না। তবুও গ্রামের ক’জন বুদ্ধিমানের পরামর্শে শহরে গ্রামতোতো এক মামার বাসায় এসে উঠল। ওঠার প্রক্রিয়াটা সম্মানজনক ছিল না মোটেও। তারপরের একযুগের পরিস্থিতিও নিম তেতোর সমার্থক।
কাজে কাজেই শহীদুল্লাহ ঈদ ব্যাপারটা কখনো টের পায়নি। ঈদের দিনে মামার অতিথি আপ্যায়ন আর বাজার ডিপার্টমেন্ট সামলে সন্ধ্যায় ঘুম। অতি টায়ার্ড শহীদুল্লা ঈদের নাটক মিস করেছে গত এক যুগ।
এইবার! হ্যাঁ, হচ্ছিল বটে শহীদুল্লার ঈদ! অর্থাৎ শহীদুল্লাহর ঈদ পালনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছিল… ঠিক তা না… হওয়া হওয়া করছিল এবং শেষমেষ ভেস্তেও গেল।
গত দু’দিন ধরে এ কারণেই ভীষণ বিষণ্ন মন নিয়ে শহীদুল্লা কেবল ভাবছে। ভাবছে, জীবনটা পচা কলার মোচার মতন অনর্থক। এবারের ঈদও মিস্ হয়ে গেল। কেনো? কার অভিশাপে? কার?
প্রথমতো মামার ভাষাটা কুৎসিত আর মামির ব্যবহার জঘন্যতম হলেও শেষমেষ শহীদুল্লাহর কপালে কিছু একটা জুটেছে। মামার সুপারিশে নিউমার্কেটের এক চশমার দোকানে চাকুরি হয়েছে ওর। তবে এমনি এমনি না, মামার কনিষ্ঠ কন্যাকে বিবাহ করার শর্ত আছে। এই শর্ত গত কোরবানি ঈদের দিন মামি ঘোষণা করেন। মামির ঘোষণার উপসংহারটা বোবা কন্যা বিয়ে করার চেয়েও কঠিনতর শোনাল ওর কাছে। বাড়ির হবু জামাইকে বাড়িতে রাখাটা লজ্জাজনক। কাজেই শহীদুল্লাহ আপাতত কিছুদিন বাইরে থাক। বিয়ের পরে আবার ওঠা যাবে বাড়িতে।
বলাবাহুল্য, সেই ঈদের নাটকও মিস্ হ’ল।
শহীদল্লার স্বভাবটা পরগাছার মতো। একা কোনো ডিসিশান নিতে পারে না। একা একা কোথাও থাকবার কথা ভাবতেই পারে না। মামাকে সমস্যাটা বলেছিল সাহসে বুক বেঁধে। তিনি তীব্র দৃষ্টি হেনে বলেছিলেন, ভ্যান্দা বলদ কোন্হানকার। যা! ভাগ্ সামনেত্থে।
অত:পর এই মেসটাতে এসে উঠেছে শহীদুল্লা। ঈদের পর বিয়ে। কয়েকটা দিন শহীদুল্লাকে একা থাকতে হবে। বাজারে হারিয়ে যাওয়া তিন বছরের খোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। মুখের মানচিত্রটা যথেষ্ট জলীয় বাষ্পপূর্ণ। কিন্তু চার দিনের দিন ওর মনে হ’ল, নিজের মতো করে থাকাটা মন্দ নয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে বিয়ের প্রসঙ্গ মনে পড়তেই গরম লাগতে লাগল। হাত-পা-ঘেমে যা-তা অবস্থা।
এ মাসের বেতন আর বোনাস পকেটে পুরে ও নিজেকে খলিফা হারুন-অর-রশীদ ছাড়া অর কিছু ভাবতে পারল না। দু’প্যাকেট বাদাম কিনে এক বুড়ো মতো রিক্সাওয়ালার রিক্সায় উঠে রাজার মতো হুকুম দিল- চলো। সোজা যাবে। নো ডান, নো বাম। সোজা।
সেদিনের দেড়টা ঘন্টা ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। খোলা রিক্সায় বাদাম চিবুতে চিবুতে বিকেল কি করে সন্ধ্যা হয় দেখলো এবং বিস্মিত হ’ল। আনন্দে পানি এসে গেল চোখে। বিড়বিড় করে বলে, সোবান আল্লা! তোমার দুইন্নাডা এত সোন্দর, রাহমানুর রাহিম!
রাতে হালিম খেল এবং খাওয়াল। শহীদুল্লার একজন বন্ধু হয়েছে। ওর রুমমেট, করিম চাকলাদার। তাকেই খাওয়াল হালিম। এবং তখনি ওর মনে হ’ল এবারের ঈদ… হবে। কেনো হবে? হবে কেননা, ঈদের দিনে করার মতো কাজ ও পেয়েছে। আর সবার মতো ও-ও একা আড্ডা দেবে, ঘুরতে বেরুবে। প্রিয় বন্ধুকে ও বলেই ফেলল, গত ঈদগুলো কেমন কেটেছে। চাকলাদার যা হয়ে গেল একদম। খুব দু:খিত হল। ঠিক করল, বাড়ি যাবে না, থাকবে শহীদুল্লার সাথে। একসাথে ঈদ করবে, বেশ হবে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে শহীদুল্লা। আহ্হারে চাকলাদার! কত স্বপ্ন দেখিয়েছি ওকে! কী হ’ল শেষটায়! ওর ঈদ বেশ না শেষ!
মনে পড়ল ফর্দটার কথা। নিজের হাতে ঠিক করেছিল কি কি কিনবে, কাকে কি দেবে। মিনুটা বোবা হলেও বিয়ে যেহেতু করতে হবে, শহীদুল্লা ওর জন্য স্পেশাল কিছু কিনবে। দিতে লজ্জা লাগবে, এটা ঠিক। তবুও কিনবে। বেচারা তো নিজের ইচ্ছায় সাধ করে বোবা হয়নি। সবাই তো ভাগ্যের লিখন।
তখনি চাকলাদার বলেছিল, দোস্ত! নিজের জন্য কিছু কিনোন লাগোইন।
নিজের জন্য!
চাকলাদারের কথা, এটাই নিয়ম। ঈদের নিয়ম।
শহীদুল্লাহ একদম হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। বছরের পর বছরে ওর পোশাক ছিল দুটো লুঙ্গি, দুটো শার্ট এবং একটা গেঞ্জি। গেঞ্জিটা ময়লা হলে শুধু শার্ট পরত। বেশ চলত। বাড়ি থেকে আসার সময় মামি একটা প্যান্ট দিয়েছে। মিনুর বড় ভাইয়ের পুরনো প্যান্ট। তো সে লোকের সাইজটা শহীদুল্লার দেড় গুণ হলে প্যান্টের-ই বা কী দোষ, আর মামির-ই বা কী করার ছিল! শহীদুল্লা প্রথম প্রথম দড়ি দিয়ে কষে বাঁধত কোমরে। পরে চাকলাদার একটা পুরনো বেল্ট ওকে গিফট করেছে।
শহীদুল্লা কোনোদিন কেনাকাটা করেনি। কাজেই চাকলাদারের পরামর্শ না মেনে ওর উপায় রইল না। অবশ্য পরামর্শটা খুবই আন্তরিক ও সৌহাদ্যপূর্ণ ছিল। শহীদুল্লা অস্বীকার করতে পারবে না কিছুতেই ।
চাকলাদার ওকে হারুন টেইলার্সের ঠিকানা দিয়েছিল। কিচ্ছু না। একদিন যেতে হবে। শহীদুল্লার বডির মাপ নেওয়া হবে। গজ কাপড় হারুনের দোকানে ঝোলে। সেখান থেকে পছন্দ করে টাকা দিলেই শার্ট এন্ড প্যান্ট প্যাকেট বন্দি হয়ে চলে আসবে ঈদ-ঈদ গন্ধ ছড়িয়ে।
নো ঝামেলা। শহীদুল্লা রাজি হবে না কেন?
ফুল-হাতা শার্টটা আর খাকি রঙের প্যান্টটা যে সুন্দর ছিল না তা নয়। শহীদুল্লার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তবে সাইজটা মিললো না, ঢলঢল করতে লাগল দুটোই। শহীদুল্লা লজ্জিত দৃষ্টিতে তাকাল চাকলাদারের দিকে। মনে মনে ভাবল, কপাল এমন! জামা-কাপড়গলো ওর মাপে কোনোদিন হ’ল না। বড়– শুধু বড় হয়ে যায়। কী লজ্জা!
চাকলাদার কড়া গলায় বলল, ব্যাটা হারুন্ন্যা মাপ ভুল কইরছান। নাকি আর কারো জামা দিয়া দিলইন?
এরপর ওকে সান্ত¦না দিয়ে বলেছিল, দোস্ত! মন খারাপ করইন না। কাইল সক্কালেই ফেরত দিয়ে আসুইন।
শহীদুল্লা বিব্রতকণ্ঠে বলে, না— না— ও আমার অভ্যেস আছে।
চাকলাদার ওর আদমের আপেলটার ঘনঘন উত্থান-পতন দেখে দ্রæত সরে গেল ওখান থেকে। এত ভালো মানুষ দোস্তটার ঈদের পোশাক পরার কী আহ্লাদই না ছিল! মাটি করে দিল হারুন্ন্যা। বাজারে দক্ষ দর্জি বলে নাম ডাক আছে ব্যাটার। ও নিজেও ঢাকায় আসাতক হারুনের বানানো জামা-কাপড়ই পরছে। এমনতো কখনো হয়নি। তা হোক, কাল সকালে হারুনকে আচ্ছামতো বকতে হবে। দেখা যাক, কাপড় পাল্টানো যায় কিনা। কেটে কুটে সাইজ করা যায় কি না, সেটাও দেখতে হবে।
নতুন কাপড়ের গন্ধ এত সুন্দর হয়, কীভাবে জানাবে শহীদুল্লাহ? নিজের চারপাশটা যেন ভুরভুর করছ। ওর যে কী ভালো লাগছিল! খুশির চোটে নতুন কাপড় পরেই শুয়ে পড়ল। ঠিক করল, ঈদের আগের দিন লন্ড্রিতে দিয়ে ইস্ত্রি করিয়ে নেবে।
শুয়ে তো পড়ল, কিন্তু ঘুম যে আসে না। নিজেকে কী রকম রাজা-রাজা লাগছে, অথবা —কী রকম যে–নাহ্। দোকানে যাবার পথে বলাকা সিনেমা হলের গায়ে লাগানো পোস্টারের নায়কের মতো লাগছে– সানগ্লাস!
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল শহীদুল্লা। অন্ধকারেই জ্বলজ্বল করছে চোখ। ঘামছে। রেডিওতে শোনা সিনেমার গান ঘুরছে মাথায়। নাচতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে— মনে হচ্ছে হাজার হাজার লোক চোখ বড় বড় করে দেখছে ওকে। ও আকাশ-বাতাস কাাঁপিয়ে অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠে গাইছে, পাগল মন—মন রে!
অত্যধিক উত্তেজনার কারণেই হয়তো একটু পরেই ক্লান্ত হয়ে গেল ও।
এবং সুস্থির হ’ল। এতক্ষণ কীসব ভাবছিল মনে পড়তেই প্রচণ্ড লজ্জা পেল। নিজেকে নিয়ে এ কী ভেবেছে! ছি!
অবাক হ’ল। জীবনে এই প্রথম ভিমরতিতে ধরল ওকে। মুখচোরা ভ্যান্দা বলদ শহীদুল্লা কী না সিনেমার নায়ক হয়ে গান গাইছিল! ওহ্! ওর কী হয়েছে!
পানি খাওয়া দরকার। গলা শুকিয়ে কাঠ। নিজেকে পাঁচবার গুণে গুণে গাল দিল মামার ভাষায়। এরপর বিষম খেল। কারণ?
কারণ ওর শার্ট এবং প্যান্ট। সাদা স্ট্রাইপের শার্ট আর খাকি রঙের প্যান্টটা এরকম লাগছে কেন? টকটকে লাল প্যান্টের সাথে ফিরোজা স্ট্রাইপের শার্ট। ছোট্ট আয়নাটা খুঁজতে চাইল। পেল না। দরকারের সময় কোনো জিনিস ঠিকমতো পাওয়া যায় না, জানে ও। বিড়বিড় করে নিজেকে বকছে, ভ্যান্দা শাদু! তর মওত আইয়্যা পড়ছে মনে হয়। আল্লার নাম ল! বিসমিল্লাহ—বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম— আউজুবিল্লাহে—।
আরো আছে। শার্ট-প্যান্ট দুটোই এখন দারুণ ফিট করেছে, মোটেও ঢলঢল করছো না। তাজ্জব কি বাত! শহীদুল্লা হতাশ হয়ে ভাবল, শেষ সময় যখন এসেই পড়েছে, তখন আর অত ভেবে লাভ কি! তার চেয়ে শুয়ে পড়া যাক। আল্লা গরিবের সহায়!
বিছানায় গিয়ে বালিশে মাথা দিতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল ওর। কেন জানি ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে মামির মুখটা ভেসে উঠল ওর চোখে এক সেকেন্ডের জন্য। এরপর গাঢ় ঘুম এক কাতেই রাত শেষ।
পরদিন সকালে চাকলাদার কাপড় পাল্টানোর প্রসঙ্গ তুলতেই ওর মনে পড়ল গত রাতে দেখা লাল টকটকে প্যান্ট আর ফিরোজা স্ট্রাইপের শার্টের কথা। মনে মনে হাসল নিজের কাণ্ড ভেবে। কিন্তু কাপড় পাল্টানোর প্রস্তাব নাকচ করে দিল ও। বলল, ফিট অয়্যা গ্যাছে! ফাস ফেলাস!
চাকলাদার খুশি হ’ল। যাক, ঈদের আনন্দটা তাহলে মাটি হবে না।
শহীদুল্লা এর পরের তিন সপ্তা অদ্ভুতভাবে কাটিয়েছে। চাকলাদারকে একদিন খুলেও বলেছে। চাকলাদার কিন্তু বিশ্বাস করেনি। কে বিশ্বাস করবে? ওর শার্ট এবং প্যান্টটি প্রায়ই নাকি রঙ পাল্টায়। সত্যি সত্যি। আল্লার কসম।
ক্যামনে পাল্টায় কইনছেন দেহি?
জানি না ক্যামনে পাল্টায়। তয় পাল্টায়। এই লাল তো দুই ঘন্টা পর এক্করে নীল, পরে হয়তো হইলদা! বেশিরভাগ সময় গোলাপী, এক্কেরে হাওয়াই মিঠাই মার্কা।
চশমা কিনোইন দোস্ত। চশমা লাগাবো আপনার। কাপড়-চোপড় বুুলে রঙ পাল্টায়। হা-হা-হা! কাপড় কি বিয়া বাড়ির বাত্তি যে রঙ বেরঙের আলো বারাইবো? হা-হা-হা!
এরপর থেকে ও আর চাকলাদারকে কিছু বলে না। তবে নিজে নিজে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে রঙ পাল্টানো ব্যাপার-স্যাপার। এর ফলে হ’ল কি, প্রতিদিন ও পরছে সেই শার্ট-প্যান্ট। ঈর্দে কাপড়ের যে নতুন নতুন সুবাস থাকার কথা, এগুলো হারিয়ে ফেলছে।
চাকলাদার খোঁচায়, ঈদের দিন কি পইরবাইন দোস্ত? খালি গায় ঘুরতে বাইরাবিননি? পুলিশে খবর দিব কইলাম। পাগল কইয়া চালান দিব সো-জা পাব-নায়। হা-হা-হা!
বোকা-বোকা হাসি হেসে শহীদুল্লা প্রতিবারই বলে, আইজকেই শ্যাষ। কাইল ধুইয়া তুইলা রাখমু। এক্কেরে ঈদের দিন পরুম।
কিন্তু কথা ও রাখতে পারে না। মনে হয় কে যেন অদৃশ্যভাবে ওকে বাধ্য করে ওগুলো পরার জন্য। তারপর চাকরিতে গিয়েও যন্ত্রণা! প্রায়ই ভুলে যায়- ও কে? ও কি শহীদুল্লা না সিনেমার নায়ক?
এসবের জন্য কত্ত কী যে হচ্ছে! এই সপ্তায় মালিকের দেয়া ইফতার পার্টিতে গেল। শরবত খাওয়ার সময় দেখল, প্যান্ট-শার্ট দুটোই শাদা ধবধবে। পরে বিরানি হ’ল। খেয়ে দেয়ে বেরুনোর সময় আফজাল নামের সে ছেলেটা ওরই মতো সেলসম্যানের চাকরি পেয়েছে, সে হেসে বলল, আপনাকে দেখে অবাক হলাম ভাই!
জ্বী!
দারুণ ফ্যাশন সচেতন তো আপনি! এরই ভেতর পোশাক পাল্টে এসেছেন! চমৎকার!
পার্কে গেল এক বিকেলে, হাওয়া খেতে। ঘাসের ওপর বসে দেখছিল, খানিক দূরে এক দঙ্গল টোকাই ক্রিকেট খেলছে। মরা গাছের ডালে উইকেট সাজিয়ে ভাঙ্গা তক্তার ব্যাট নিয়ে প্লাস্টিকের বল ছুঁড়ে মারার খেলা। ঐ সময় ওর প্যান্ট ছিল ঘাসরঙা সবুজ আর শার্টটা বিকেলরঙ কমলা।
এইসব রঙ বদলের খেলা চলছিল। শহীদুল্লা কিছুই বুঝতে পারছিল না, বুঝতে চাইছিলও না। কাপড়ের রঙ বদলটা যেন খুবই স্বাভাবিক। এখন ওর এরকমই মনে হয়।
আজ থেকে ঠিক চারদিন আগে ওর মনে হল অভিশাপের কথাটা। হাঠাৎ শার্ট-প্যান্ট দুটোই টাইট টাইট মনে হতে লাগলো। এটা সকাল বেলার কথা। বিকেল হতে হতে শার্টের হাতা উঠে গেল কবজি অবধি, প্যান্ট দুটো হাঁটু ছুঁয়ে থাকল। অবাক শহীদুল্লা স্ট্যান্ড ইজ হয়ে দাঁড়িয়ে হা করে দেখছিল আর দেখছিল।
চাকলাদার সন্দেহের দৃিষ্টতে দেখতে শুরু করেছে। বলছে না কিছু। শুধু তাকিয়ে থাকছে। কী যে যন্ত্রণা!
সত্যিই কি অভিশাপ দিল কেউ? কে দিল?
এখন শার্ট আর প্যান্টটার যে সাইজ তাতে দু’দিনের শিশুর গায়েও টাইট হয়ে যাবে। শহীদুল্লার তাকিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া ওর আর কী-ই বা করার আছে?
জামা-কাপড়ের বুদ্ধি আছে? বয়স বাড়লে সাইজ বাড়ে কমে? এমন কথা তো শহীদুল্লা দু:স্বপ্নেও কোনোদিন শোনেনি। ওর বোধবুদ্ধি সব যেন লোপ পাচ্ছে। তবুও একটা মাত্র কৌত‚হল বুকে পাথর হয়ে চেপে বসেছে। এসবের শেষ ও দেখতে চায়।
হয়নি।
মোহাম্মদ শহীদুল্লার আর সব আশার মতো সব শেষ দেখার আশাও বুদবুদের মত অসীমে মিলিয়ে গেল। একদম সক্কাল বেলায় দেখল জামা-কাপড়ের প্যাকেটটা উল্টে-পাল্টে পড়ে আছে। পাশেই ঢেকুর তুলছে মেসের পেট মোটা বেড়ালটা। শহীদুল্লা পারলে ঝাপিয়ে পড়ে ওটার ওপর। ব্যাদ্দব বেড়াল! ওর এত সাধের জামা-প্যান্ট খেয়ে ফেলেছে! আজ ওটার একদিন কি ওর একদিন।
খাটের স্ট্যান্ডটা দু’দিন ধরে নড়বড়ে করছিল। ওটা টেনে নিল অস্ত্র হিসেবে। তারপর বেড়ালের সাথে চোর-পুলিশ খেলা চলল। চলতই হয়তো যদি না মেসের বাকিরা দৌড়ে না আসত। সবার আগে চাকদালার। ওর বিস্ময় ভাবটা আরো প্রকট হয়েছে।
চিৎকার করছে শহীদুল্লা। জীবনে গলার আওয়াজ উদারা ছেড়ে মুদারাতে যায়নি। অথচ এখন ঐ মোড় থেকেই শোনা যাচ্ছে ওর চিৎকার। বলছে, শালা শুয়োরের বাচ্চা! হারামির পো! তরে আইজ আমি মাইরাই ফালামু!
কারে মারবাইন?
ওই বিলাইর বাচ্চা বিলাইরে।
ক্যান্ মারবাইন? ক্যান?
ওই হারামির পুত আমর জামা, আমার ঈদের জামা— জামা— জামা— খাইয়া ফালাইছে! শহীদুল্লা ভেঙে পড়ে কান্নায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
কেউ কেউ না বুঝেই ওকে সান্ত¦না দিতে দিতে এল। কেউ কেউ জামার প্যাকেটটা নেড়েচেড়ে দেখল। নাহ! একদম ফাঁকা। কোথায় গেল শহীদুল্লার ঈদের শার্ট-প্যাান্ট?
শহীদুল্লাহ চোখের পানি লুঙিতে মুছে ভাঙা গলায় বিলাপ করছে, ওরে আমার কপালরে! জনম শ্যাষ অইয়া গেল। তয় এট্টা ঈদ পাইলাম না। আল্লাগো! এ ক্যামন লীলা তোমার!
কেউ বুঝছে না শহীদুল্লা কেন কাঁদছে! বেড়াল কি ছাগল যে, যা পায় তা-ই খায়? এমন কি ঈদের জামাও খেয়ে ফেলল? এসব আবোল-তাবোল কথা কে বিশ্বাস করবে?
কেউ করেনি। মামা তো রেগে টং হলেন। কষে দুটো চড় মারলেন ওকে। তারপর ভেংচি কেটে বললেন, ভ্যান্দা বলদ দেহি ভাউ ধরছে! চাকরি পায়া লাট হয়ছে। আমার সাথে চালাকি? বিয়া না করার মতলব? বুঝি না মনে করছস্? বদমাইশের হাড্ডি কুনহানকার!
সেইদিন সন্ধ্যায় শহীদুল্লার বিয়ে হয়ে গেল। ও ইশারা ইঙিতে বোবা বউটাকে বোঝাতে চাইল পুরো ঘটনাটা। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কপালে নাইক্কা! আল্লা মাবুদ!

আসলে ঘটনাটা কি? সেসব জানতে হারুন দর্জির দোকানে না গিয়ে উপায় নেই। সেখানে একজন এসে বলছে, সাপ্লাই নম্বর সাঁইত্রিশ চাই।
এই একজন কথাটা বলার সময় তার দেড়ফুট লম্বা পাঁচটি কান নামিয়ে ফেলেছিল। হারুন দর্জির কথা শুনতে হলে অ্যারন গ্রহপুঞ্জের জি সেভেন এক্স ট্রিপল নামের গ্রহবাসীর কান না নামিয়ে উপায় নেই।
হারুন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, একটা ভুল হয়ে গেছে। ওটা বেড়াল খেয়ে ফেলেছে।
দারুন ভয়ে তিনবার রং পাল্টালো সেই একজন।
বেড়াল কি?
হারুন দর্জি ভাবে, এও ছিল কপালে! শেষ পর্যন্ত বেড়ালও চেনাতে হচ্ছে? বলল, এই এতটুকুন বড়, চোখ জ্বলে—— দাঁত ধারওয়ালা— থাবায় নখ—আপনে চেনেন না!!
হারুন কপট কাশি দিয়ে বলল, সাপ্লাই নম্বর আটত্রিশ—
লোকটি কেনো যেন অস্থির হয়ে উঠছে। ফিসফিস করে বলল, আমার কথা কি তুমি কাউকে বলেছ?
আরে না! ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা রক্ষা ব্যবসার ধর্ম। তবে হ্যাঁ— কি অসুখ বলেন তো আপনার? কানে টিউমার না ফোঁড়া? চোখেও তো সমস্যা! এত্ত বড়! ফুলে গেছে? এত ফুলেছে যে দুই চোখের মাঝখানে কোনো জায়গাই নেই। আর বলেন তো, এত সাপ্লাই নিয়ে কী করেন আপনি?
লোকটি জবাবে মুখ দিয়ে কী রকম এক শব্দ করল। রশিদ লিখতে লিখতে হারুন বলল, আমার চৌদ্দগুষ্ঠি দর্জি ছিল, কিন্তু এমন কাপড়ের কথাতো শুনিনি। বলেন তো, এ কেমন কাপড়, বিড়ালে যা খেয়ে ফেলে? কী তাজ্জব কাণ্ড!
হারুন এই প্রশ্নের জবাব পেল না। কারণ রশিদ নেওয়ার তর সয়নি অদ্ভুত লোকাটার। কখন যেন চলে গেছে। হারুন নিজের উপর বিরক্ত হলো। এত কথা বলা ওর উচিত হয়নি। ক্লায়েন্ট গোস্বা হলে ব্যবসার ক্ষতি! ছি: ছি:! এ কী হয়ে গেল! কে জানে লোকটা যদি আর না আসে?
হারুন মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। আগামীকাল ঈদ। এই রকম খুশির সময় আল্লাহর রহমত চায় ও। ব্যবসা আরো বাড়–ক। আরো। ও শুধু সেলাই করতে চায়। সেলাইয়ের পর কোন কাপড়টা বেড়ালে খেল না ইঁদুরে খেল, এই সব খোঁজ ও আর কক্ষনো নেবে না। কখনো না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *