প্রবন্ধ।। আতা সরকারের উপন্যাসে জীবনবোধ ও সমাজের গহীনভাষ্য।। রকিবুল হাসান
বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তার আগেও বাংলা ভাষায়
উপন্যাস বা উপন্যাস ধরণের আখ্যান রচিত হয়েছে। হ্যানা ক্যাথরিন ম্যুলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’,
প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও কাঙাল হরিনাথের ‘বিজয় বসন্ত’ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম বাঙালি লেখক যিনি বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাধারণ সবশ্রেণির পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন।
তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তুও ছিল অতীতের
লেখকদেও থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গঠনশৈলী ভাষা বিষয়বস্তু শৈল্পিকতা-সব দিক থেকে নতুনত্বে
পূর্ণ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের সেখান থেকেই শক্ত ও সফল অভিযাত্রা ঘটে। রবীন্দ্রনাথের মতো
বিরল প্রতিভাও উপন্যাসে প্রথম দিকে বঙ্কিমের জন্মপ্রিয়তার কাছে ম্লান ছিলেন। কিন্তু তাঁর
উপন্যাস সব দিক থেকে বঙ্কিম থেকে ভিন্ন ছিল। সময়ের সিঁড়ি ধরে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে
একসময় মগ্ন হয়ে ওঠেন বাঙালি পাঠক। বাংলা ছোটগল্পের সার্থক সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের হাতে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাস ও
গল্প রচনা লিখে রবীন্দ্রনাথের সময়কালেই তুমুল জনপ্রিয়তা পান। এভাবে মানিক-বিভূতি-
তারাশঙ্করর বাংলা উপন্যাসে বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলীতে পূর্বসুরীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও আকবর হোসেনও ও যে ব্যাপক জনপ্রিয় হতে
পেরেছিলেন তাদের উপন্যাসে বিষয়বস্তু গঠন ভাষাশৈলীতে পুরো নিজস্বতা বিদ্যমান ছিল।
উপন্যাসের এ ধারাবাহিকতায় নিজস্ব শৈলীতে বিখ্যাত হয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
জগদীশ গুপ্ত, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, রাজিয়া খাতুন,রাবেয়া খাতুন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন-সহ আরো অনেক কথাশিল্পী, তাঁরা
উপন্যাসে গতানুগতিক ধারাকে গ্রহণ করেননি।
যারা গতানুগতিকতা গ্রহণ করে সাহিত্য কর্ম করেছেন
তাদের অনেকেই সমকালীন সময়ে অনেকেই বাহবা লাভ করলেও কালের যাত্রায়বিস্মৃত ও অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছেন, তাঁদের সৃষ্টিকর্ম সেভাবে গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে পারেনি।
ফলে মেধাবী ও দূরদর্শী যে কোন কথাশিল্পীই সৃষ্টিকর্মে বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে গঠনপ্রক্রিয়া, শিল্পমান, মেসেজ,সমাজ-সমকাল-রাজনীতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-অর্থনীতি-অবক্ষয়এসব গ্রহণে ও সৃষ্টিশীলতায় সতর্ক থাকেন।
যাঁরা বাংলা কথাসাহিত্যে অমরত্ব অর্জন
করেছেন তাঁরা মৌলিকত্বে অসম্ভবরকম সচেতন থেকেছেন এবং সৃষ্টিকর্মে নিজস্ব স্টাইল
প্রতিষ্ঠা করে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ-অর্থনীীত-রাজনীতি
সহ আরো বহু বিচিত্র বিষয় উপন্যাসের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে নিজস্বতা সৃষ্টিতে দক্ষতা
দেখিয়েছেন। প্রত্যেকেই নিজস্ব মৌলিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আতা সরকার সত্তর দশকের
গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী। বহুমাত্রিক জীবনাভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব তিনি। তিনি বাংলা উপন্যাসে ও
গল্পে নিজস্বতা নির্মাণে সচেষ্ট। সে ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। তাঁর উপন্যাসে দায়বদ্ধতার ব্যাপারটি
আছে গুরুত্বের সঙ্গে। সস্তা গল্প সাজিয়ে পাঠকের মনের গহনে প্রবেশের চেষ্টা করেননি। তিনি
সুনির্দিষ্টভঅবে তাঁর উপন্যাস ও গল্পে মেসেজ দিয়েছেন, প্লট নির্মাণ, শিল্পশৈলী, সমাজ-
সমকাল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানের দুঃশাসন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ সমাজ-
রাজনীতি-প্রেম প্রণয়, কর্পোরেট বাণিজ্য বহু বিষয় গ্রহণ করে নিজস্ব স্টাইল ও শৈলীতে
উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন। গল্প বানিয়েছেন। আতা সরকার পূর্বসূরিদের অনুকরণে পথ
হাঁটেননি। তিনি নিজের মতো করে পথ তৈরি করে নিয়ে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর
সময়কালে তিনি স্বতন্ত্রধারার কথাশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর
বহুবিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতা, দূরদৃষ্টি, পর্যব্ধেসঢ়;ষণ ক্ষমতা, সমাজের সবশ্রেণির মানুষের সঙ্গে
সাবলীলভাবে চলা, কর্পোরেট জব অভিজ্ঞতা, সমাজ-রাজনীতির গতি-প্রকৃতি শাণিতভাবে
অনুধাবন করা এবং তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি– তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পকে নিজস্ব ধারায় রূপ
দিতে সাহায্য করেছে। এই জায়গাটিতে আতা সরকার বাংলা কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্র ও স্থায়ী
একটি স্থান প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন স্বরূপ হাসান আজিজুল
হকের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ-‘ এই লেখকের (আতা সরকার) ধাত্ধসঢ়; শক্ত-একটিও ছিঁচকাঁদুনে গল্প
লেখেননি। শক্ত ঋজু ভাষা-এমন ভাষাকে অলংকারহীন বলাই যথেষ্ট নয়-সব রং মুছে ফেলাই
যেন এ ভাষার কাজ। রং যদি লাগাতেই হয় একটি রং-এরই লিপ্ততা তাতে থাকুক-সে জীবনের রং।’ (আতা
সরকারের লেখালেখি, হাসান আজিজুল হক, আতা সরকার উপন্যাসসমগ্র আলোচনা, ২৬ মে
২০০৭) হাসান আজিজুল হকের এই বক্তব্যের ভেতরই দিয়েই আতা সরকারের সাহিত্যকর্মের মূল
স্বরূপটি চেনা যায়।
আতা সরকার লেখালেখি শুরু করেন ক্লাস টু থেকে। ক্লাস ফোরে পড়াকালে কবিতার লিফলেট
প্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় সাপ্তাহিক জনতার ‘সোনালী দিনের আসর’ পাতায়
। প্রথম গল্প প্রকাশ হয় দৈনিক পাকিস্তানের ‘সাত ভাই চম্পা’তে। সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন
পত্রিকা।ক্লাস এইটে পড়াকালে সম্পাদনা করেন ‘প্রভা’। জামালপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়
ছাত্রসংসদের নির্বাচিত ম্যাগাজিন সম্পাদক ছিলেন স্কুলবার্ষিকী পত্রিকার। ঢাকা কলেজে
পড়াকালে সম্পাদনা করেছেন ‘সারথি’। কিশোর পত্রিকা ‘পল্লব’ বের হয় তাঁর সম্পাদনায়।
‘প্রবন্ধপত্র’-এরও সম্পাদক ছিলেন তিনি।
বিভিন্ন সময়ে সরকারের ক্ষুরদৃষ্টির শিকার হতে হয়েছেন তিনি। আইয়ুবী কালাকানুনে
ম্যাগাজিন প্রভার সব কপি বাজেয়াপ্ত ও ম্যাগাজিন নিষিদ্ধ হয়েছিল। গোলাম কাদের ও তারিক
হাসান সম্পাদিত ও মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ্#৩৯;অনিকেত্#৩৯;-এ আতা সরকারের
গল্পের জন্য সব কপি বাজেয়াপ্ত ও সম্পাদকদ্বয় কারারুদ্ধ হন। কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
সম্পাদিত ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ্#৩৯;সূচীপত্র্#৩৯;-এ আতা সরকারের গল্পের জন্য
সম্পাদককে পুলিশী কৈফিয়তের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আবু সাঈদ জুবেরী, আহমদ বশীর ও
জাহিদ হায়দার সম্পাদিত ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত ্#৩৯;বিপক্ষ্#ে৩৯;-তে আতা সরকারের সামরিক শাসন
বিরোধী গল্পের জন্য সম্পাদকত্রয়ীর একজনকে জবাবদিহি করতে হয়। বাংলা সাহিত্যে আতা সরকার
বহুমাত্রিক প্রতিভা। তিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও কবিতা, নাটক, কলাম
ও প্রবন্ধ রচনা করে দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর নাটক: ‘রক্তস্নান’ এবং কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তিম
ট্রিওলেটগুচ্ছ’। তাঁর উপন্যাস-তিতুর লেঠেল, আপন লড়াই, একদা অনঙ্গ বৌ, চারদিক বৃষ্টি,
সোনাই সরদারের ঢাকা অভিযান, বালিকা বিষয়ক পাপ, যে যায় প্রজাপতি, কালো ধারাপাত,
উপন্যাস সমগ্র, পুষ্পকুন্তলা তুমি, চিতা কাহিনী। উপন্যাসিকা/ বড় গল্প: বীর বীরাঙ্গনা
কাপুরুষ। ছোটগল্প: বিপজ্জনক খেলা সম্পর্কে রিপোর্ট, সুন্দর তুমি পবিত্রতম, নিষিদ্ধ
রাজনীতির গল্প, ব্রেকহীন বাস, চলছে চলছে, সাহসী মানুষের গল্প, নির্বাচিত গল্প, রে স্বপ্ন রে
দুর্বৃত্ত, আতা সরকারের গল্প, সামরিক শাসন বিরোধী গল্প, কৃষ্ণপক্ষ লালট্রেন, অচল আনিতে
বিকিয়ে যায় পিতৃভূমি, চরমপন্থী মহিলা গ্রেপ্তার। প্রবন্ধ: সৃজনশীলতার সন্ধানে। জার্নাল:
মঞ্চকলাম: সকলি নাটক ভেল, নিউজ ডেস্ক: হলদে খবরের ফ্যাক্টরী, যুক্তি নেই তর্ক নিষেধ,
ক্যাবলাকান্ত। শিশু কিশোর সাহিত্য: গ্রহলোকের গোয়েন্দা, চন্দ্রলোকে গন্ডগোল, রাঙ্গামাটির
রহস্যরঙ্গ, অবাক বাড়ির সিংহ দরজা, পুতুল কন্যা, নির্বাচিত শিশু কিশোর সমগ্র, সিন্দবাদের
সাত দেশ, বাঁশের কেল্লার গণনায়ক,দুঃখী পাহলোয়ানের বীরত্ব গাথা, রাজার বাড়ি ধুম ধারাক্কা,
মামার বাড়ি পালাই পালাই।
আতা সরকার বাংলা কথাসাহিত্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একজন কথাসাহিত্যিক। তাঁর
সাহিত্যকর্ম বহু বিচিত্র বিষয় নির্ভর ও জীবন ঘনিষ্ঠ। তিনি দায়িত্ব বোধ থেকে সাহিত্য
সৃষ্টি করেছেন, যেখানে তাঁর চিন্তা-চেতনা-দর্শন স্পষ্ট। কিন্তু সব কিছুতেই তিনি শিল্পিত
ভঙ্গিটি রক্ষা করেছেন। যে কারণে তাঁর সাহিত্যকর্ম শিল্পগুণ সমৃদ্ধ। সমাজ-সমকাল-রাজনীতি-
মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা পরিবর্তন তিনি
পর্যবেক্ষন করেছেন খুঁটে খুঁটে এবং তা দক্ষতার সঙ্গে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন।
ফলে তাঁর সমকালে সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি বহু বিষয় সাহিত্যকর্মে উপজীব্য করে নিজস্ব
একটা স্টাইল তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। যেখানে রয়েছে তাঁর স্বতন্ত্র উচ্চারণ।
এক মলাটের মধ্যে আতা সরকারের পাঁচটি উপন্যাস বন্দিজীবন লাভ করেছে। উপন্যাসসমগ্র
শিরোনামে। উপন্যাস পাঁচটি হলো, তিতুর লেঠেল (১৯৮৭), আপন লড়াই (১৯৮৮), একদা অনঙ্গ-
বৌ (১৯৯০), চারদিক বৃষ্টি (১৯৯০) এবং সোনাই সরকারের ঢাকা অভিযান (২০০৩)।
আতা সরকারের উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে রাজনীতি, দেশাত্মবোধ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা,
প্রেম-দ্রোহ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পারিবারিক নানা অসঙ্গতি স্থান পেয়েছে। তাঁর প্রত্যেকটি
উপন্যাস বিশেষ কিছু ম্যাসেজকেন্দ্রিক নির্মিত। তাঁর উপন্যাসে জীবনদর্শন আছে,
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে, রাজনীতির নির্মম ভয়াবহতা, মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা
টানাপোড়েন, প্রেম-অভিমান, আত্মদংশন-আবেগ আছে। তিনি উপন্যাসের বিষয়বস্তু
নির্বাচনে অত্যন্ত সচেতন এবং কোনো উপন্যাস রচনার আগেই মস্তিষ্কে যেন এটি
সাজিয়ে নেন। তারপর প্রসব করেন সযত্নে, সাবধানে। সে-কারণে তাঁর উপন্যাসে মূল বিষয়বস্তুর
প্রয়োজনে অনেক উপকাহিনির সংযুক্ততা ঘটে। যা একবারেই বাস্তবতা থেকে সংগৃহীত। যেন
স্পর্শ করে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওযা যায়। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রতা আমাদের সমাজেরই
লোক-আমাদের অত্যন্ত চেনা, তবে এই চেনা লোকগুলোরই কেউ কেউ সাংঘাতিক রকম ভয়ঙ্কর, আর
কেউ আমাদের কল্যাণকামী, দেশ-জাতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ। এ থেকেই আমরা ধরে নিতে পারি,
আতা সরকারের উপন্যাসের বিষয়বস্তু কল্পনাপ্রসূত নয়, তাঁর দেখা-জানা-চেনা-অভিজ্ঞতাপ্রসূত,
কখনো ইতিহাসমিশ্রিত।
‘তিতুর লেঠেল’ (১৯৮৭) ইতিহাসমিশ্রিত উপন্যাস। তিতুমীরের সংগ্রাম-আদর্শ, দেশপ্রেম
উপন্যাসের নায়ক আব্দুল খালেকের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা স্পষ্ট। সাধারণ প্রজাদের প্রতি
তিতুমীরের দরদ, ভালোবাসা, দেশপ্রেম আর এর ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নিমিত্তে
বাঁশের কেল্লা গড়ে তোলা এবং তাঁর মেধাদর্শি বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সংগ্রাম এই উপন্যাসের
মূল উপজীব্য। আব্দুল খালেক এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। খালেকের পরিচয় তিতুমীরের লেঠেল।
তিতুমীরের সমস্ত কর্মকা- ঘটেছে লেঠেল খালেকের মাধ্যমে। খালেকের জীবনের প্রথম কিছুদিন
বাদ দিলে পুরোজীনটাই তিতুমীরের আদর্শধারিত-যার চিন্তা-চেতনা, দেশ-ধর্ম সাধারণ
মানুষের কল্যাণে। দেশের মানুষ ইংরেজ ও জমিদারকের কর্তৃক প্রতিনিয়ত শোষিত, অত্যাচারিত, এর
ফলে ভয়াবহ যে জীবনচিত্র তৈরি হয়েছিল তার প্রতিবাদ করতেই তিতুমীর সাহসী বুক উঁচিয়ে
দাঁড়ান-তৈরি করেন বাঁশের কেল্লা। আর এই সংগ্রাম-আদর্শকে ধারণ করে আব্দুল খালেকের জন্ম
ঘটে অমর নায়করূপে, যার ভেতর পাঠক মূলত তিতুমীরের মানসসত্তাটিকেই পেয়ে যান। তিতুমীরের
দেশপ্রেম-দরদিমন, ধর্মচেতনা শতভাগ মানসস্বরূপে গ্রহণ করে গড়ে ওঠেন আব্দুল খালেক। ফলে
গ্রন্থটির বিষয়বস্তু হিসেবে ইংরেজদের শোষণ, অত্যাচার, ধর্মবোধ, দেশপ্রেম নির্ণীত করা
যায়। জমিদার, জোতদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেসময় যে সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল-সে
সংগ্রাম ছিল প্রজাসাধারণকে শোষকশ্রেণির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, ইসলামের পতাকা
উন্নত রাখার জন্য, সর্বোপরি মানবতার জন্যে। তিতুমীরের দলে শুধু মুসলমানরাই ছিল না,
হিন্দুরাও ছিল। ইংরেজদের হাত থেকে প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করে সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা
করাই ছিল তিতুমীর বাহিনীর অন্যতম মূল লক্ষ্য। ‘তিতুর লেঠেল’ গ্রন্থে মূলত এ সত্যটিই
উপজীব্য হিসেবে এসেছে, বিন্যাসিত হয়েছে শিল্পীতআঙ্গিকে।
গ্রন্থে আব্দুল খালেকের মধ্যে তিতুমীরকে আবিষ্কার করা যেমন সম্ভব, তেমনই সেসময়ের জীবন-
কাল-সমাজ-ধর্ম-সংগ্রাম সম্পর্কেও সম্যক ধারণা জন্মে। ‘তিতুর লেঠেল’-এর বিষয়বস্তু
ইতিহাস থেকে গৃহীত হলেও এটি ইতিহাস গ্রন্থ নয়, লেখকের শিল্পশক্তির জোরে এটি
ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করে।
‘একদা অনঙ্গ-বৌ’ (১৯৯০)-কে মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনকাব্য হিসেবে অভিহিত করা যায়।
ডায়েরির ঢংয়ের লেখা। মফস্বল শহরে বসবাসরত একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনচিত্র সুন্দরভাবে
উপস্থাপিত হয়েছে এ-গ্রন্থে। নদীর প্রবাহমান স্রোতের মতো একটি গতি আছে এতে, যা
পাঠককে সাংঘাতিকভাবে টানে। এক নিশ্বাসে শেষ করার মতো। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাঠকের
কাছে গ্রন্থটির বিষয়বস্তু একেবারে চেনা। যে কারণে এক শ্রেণির পাঠকের কাছে মনে হতে
পারে এ যেন তাদেরই জীবননিংড়ানো কোনো এক সত্য ভাষণ। রাহেলা, মোশাররফ, রনজু, অন্তু, লিলি,
তমিজ সরকার, নিতু-এদের ঘিরেই এ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে। তমিজ সরকার ও নিতু
অন্য পরিবারের। বাকিরা একই পরিবারভুক্ত। এই পরিবারটিতে একসময় অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা
থাকলেও সময়ের স্রোতে অস্বচ্ছলতা বাসা বাঁধে। সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন
অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, বিবাহযোগ্য মেয়ে দুটিকে যথাসময়ে পাত্রস্থ করতে না পারায়
মানসিকপীড়ন এবং মায়ের সঙ্গে তমিজ সরকারের বিশেষ সম্পর্ক ভেবে অন্তুর মধ্যে
প্রতিমুহূর্তে রক্ষক্ষরিত হয়। যে কারণে পাঠক সারাক্ষণ একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ভেতর থাকে।
মধ্যবিত্ত পরিবারীয় আবেগ এই উপন্যাসে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে লেখক আতা সরকার তুলে ধরতে
পেরেছেন। এই উপন্যাসটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তু তার মাকে সন্দেহ করছে। সে
অনেকটাই নিশ্চিত তমিজ সরকারের সঙ্গে তার মায়ের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এই
সম্পর্ক মায়ের প্রতি শুধু নেতিবাচক ও অশ্রদ্ধা দৃষ্টিভঙ্গিই তৈরি করে না তার মধ্যে আত্মহত্যা
প্রবণতাও তৈরি করে। সে এতটাই যন্ত্রণাদগ্ধ ও ক্ষত-বিক্ষত যে নিজের প্রেম-ভালোবাসা বিসর্জন
দিয়ে দূরের পথে পা বাড়ায়। এরপর সে আর ফেরে না। এই অন্তু লেখকের এক অসাধারণ সৃষ্টি। আর
উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র বা নায়কও হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত এই অন্তু-ই। মধ্যবিত্তপরিবারীয় আবেগ-
ভালোবাসা, আত্মগ্লানি, ত্যাগের চমৎকার শৈল্পিক সৃষ্টি অন্তু হয়ে ওঠে পাঠকশ্রেণির মূল
আগ্রহের বিষয়। এটি বিশ্বাস করতেই হয় যে, লেখকের সযত্ন-সচেতন অনন্য সৃষ্টি অন্তু গোটা
মধ্যবিত্তশ্রেণির নায়ক বনে যায়-সব দরদ-সহানুভূতি যেন তার জন্যই সঞ্চিত হয়। আর
উপন্যাসটির বিষয়বস্তু মূলস্রোতও কিন্তু এটিই।
এই উপন্যাসটিতে আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করি, মফস্বল শহর কীভাবে বদলে যাচ্ছে, চেনা শহর কীভাবে
অচেনা হয়ে উঠছে, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের যে
চিত্র লেখকের দৃষ্টিতে তা একটুও এড়িয়ে যায় না। যে কারণে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, লেখক
একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটির কাহিনি গড়ে তুললেও সেখানে দেশ-কালসচেতনতা,
রাজনৈতিক চিত্র, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, প্রেমদোহও এসেছে। ফলে উপন্যাসটির বিষয় শুধু
একটি পরিবার কিংবা মফস্বল শহরের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়েনি, একটি বৃহৎ ক্যানভাসকে ধারণ
করেই উপন্যাসটির কাহিনিবৃত্ত গড়ে উঠেছে। এটি লেখকের শিল্পবোধশক্তিরই পরিচায়ক।
আতা সরকারের অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের উপজীব্যতা একেবারে বাস্তববিষয়কেন্দ্রিক। আকাশ
কিংবা নদী-সমুদ্র অথবা অবারিত সবুজের দিকে দুচোখ রেখে কল্পজগত থেকে আহরিত নয়।
কোনো কিছু কল্পনা করে তিনি লেখেন না, একেবারে কাছ থেকে দেখা, সমাজে-দেশে ঘটে
যাওয়া কোনো ঘটনা কিংবা এই সমাজেই রহস্যময় যেসব মানুষ হাঁটছেন, কথা বলছেন,
অকল্পনীয় ও অস্বাভাবিক উত্থানে যারা আকাশে উড়ছেন, ভদ্রতা-আদর্শের লেবাসে যেসব দুষ্টক্ষত এই
সমাজে-এই দেশে নোংরামিপনা করছেন, ক্ষত তৈরি করছেন-আতা সরকারের গল্প-উপন্যাসে এসবের
কোনো না কোনো বিশেষ দিক স্থান পায়।
‘সোনাই সরদারের ঢাকা অভিযান’ (২০০৩) এরই একটি দৃষ্টান্ত। আতা সরকার গল্প-উপন্যাস
নিছক লেখার জন্য লেখেন না, বিশেষ একটি উদ্দেশ্য থাকে, আদর্শ থাকে, ম্যাসেজ থাকে, সমাজ-
সমকাল থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সোনাই সরদারদের অবস্থান এখন পোক্ত। দলের সবল
বাহুবেষ্টিত হয়ে এদেশে সোনাই সরদারদের জন্ম এখন প্রতিষ্ঠিত একটি সত্য। কিন্তু এই অপধারা
কীভাবে তৈরি হলো, এর নেপথ্য নায়ক কারা, সোনাইরা বাংলাদেশের রাজনীততে কতটা অপরিহার্য ও
গুরুত্বপূর্ণ-‘সোনাই সরদারের ঢাকা অভিযান’ এসবের যথার্থ একটি উত্তর হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বৈরশাসক এরশাদের নয় বছর কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত । আশির
দশকের প্রায় পুরোটাই ছিল এই স্বৈরশাসকের দখলে। এই উপন্যাসটির ঘটনাকালও এই স্বৈরশাসকের
প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই। সোনাই সরদারদের উত্থানও স্বৈরাচার এরশাদের সময়েই। গ্রামের
উচ্ছৃঙ্খল, নারীলোলুপ গুন্ডা হাতবদল হতে হতে কীভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয়, কীভাবে
রাজনীতির নিয়ন্ত্রণকর্তা হয়ে ওঠে, তৃণমূল থেকে একেবারে শীর্ষপর্যায় পর্যন্ত কীভাবে
ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠে, ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদরা
কীভাবে তাদের ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদ মজবুত করে, কীভাবে এইসব সন্ত্রাসীরা ‘নেতা’ হয়ে
ওঠে, কীভাবে সাধারণ মানুষের ভাগ্যবিধাতা বনে যায়-‘সোনাই সরদারের ঢাকা অভিযান’
উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে এসবই। আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সন্ত্রাসের
বীজ সযতেœ লালিত হয়েছিল সোনাই সরদার তাদের প্রতীকি প্রতিনিধি। আতা সরকার এই
সময়কালের প্রত্যক্ষদর্শী ও পর্যবেক্ষক। তিনি দেখেছেন, এই সময়ে কীভাবে এই দেশকে রাজনীতির
অপছায়া গ্রাস করেছিল, গুন্ডা উচ্ছৃঙ্খল তরুণরা কীভাবে ক্ষমতার কাছের ‘অপরিহার্য মানুষ’
হয়ে উঠেছিল, কীভাবে সবকিছু নষ্টের দখলে গিয়েছিল! আতা সরকারের শিল্পীমনে এসব
দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। ভেতরে ভেতরে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, রক্তক্ষরিত হয়েছে।
আশির দশকে আমাদের রাজনীতিতে সন্ত্রাস, ব্যক্তিলোভ-লালসা, অস্বচ্ছতা, নারীলোলুপতা,
স্বেচ্ছাচারিতা, অদেশপ্রেম, অনৈতিকতা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো প্রবলবেগে স্থান করে
নেয়। আতা সরকার এসব দেখে ব্যথিত হয়েছেন। মর্মাহত হয়েছেন। একারণে তাঁর ব্যথাহত
শিল্পীমন একজন প্রতীকি সোনাই সরদারকে সমাজ-দেশের সামনে উপস্থাপন করেছেন, বলতে
চেয়েছেন-এই হলো আমাদের রাজনীতি! এই হলো আমাদের আদর্শ! এই হলো আমাদের নেতা!
এই হলো আমাদের ভবিষ্যৎ! তিনি অনুভব করেছেন যে শাসক দেশ পরিচালনা করছেন এর কাছে
‘নরমাংস, নারী দেহের চাইতেও ক্ষমতার স্বাদ তীব্র।’ ফলে আশির দশকে যে সোনাই সরদারদের জন্ম
হয়েছিল, আমাদের রাজনীতিতে এই সোনাই সরদাররা আজও তৈরি হচ্ছে, আজও সবকিছু এদের
দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, বর্তমান রাজনীতিতেও এরা অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ। আতা সরকার
বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের রাজনীতিতে যে অপছায়া ভর করেছে, যে অপধারা তৈরি হয়েছে তার
মৃত্যু সহজে ঘটবে না, বরং এই অপছায়াই আরও শক্তিশালী ও অপরিহার্য হয়ে উঠবে-তাঁর এই
বোধ ও দূরদর্শিতা থেকেই এই গ্রন্থটির প্রসব ঘটেছে। দেশকাল, প্রেম, আর্থ-সামাজিক,
রাজনীতিকে শিল্পীতআঙ্গিকে ধারণ করে এই গ্রন্থটি যথেষ্ট সুপুষ্টতা লাভ করেছে।
ক্ষমতাপিপাসু এই স্বৈরশাসক জাতির ভবিষ্যতে যে অশুভ কালোমেঘ লেপে দিয়েছিল দূরদর্শী লেখকের
তা অনুমান করতে একটুও ভাবতে হয়নি। তিনি সে-সময়ে রাজনীতির অন্দরমহলের চালচিত্র দক্ষতার
সঙ্গে তুলে ধরেছেন। স্বৈরশাসক এরশাদ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পনেরো দল, খালেদা জিয়ার
নেতৃত্বাধীন সাত দলের কর্মসূচি, সোনাই সরদারদের উত্থান-রাতারাতি নেতা ও কোটিপতি
বনে যাওয়া এবং দেশের সর্বমহলে তখন যে চিত্র বিরাজ করছিল লেখক তা নির্মোহ ও
আবেগমুক্তভাবে সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ করে গ্রন্থভুক্ত করেছেন। ফলে গ্রন্থটি সে-সময়ের রাজনীতি ও
আর্থ-সামাজিক অবস্থার ‘গদ্যসচিত্র অ্যালবাম’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
‘চারদিক বৃষ্টি’ (১৯৯০)-এর মূল কাহিনি একটি নাট্য সংগঠন ‘অভিনেতা-৭২’ এবং এই
সংগঠনটির কুশীলবদের ঘটনাবৃত্তকেন্দ্রিক গড়ে উঠলেও এর উপশাখা তৈরি হয়েছে অনেক।
অনেকটা মূল নদী চলার পথে যেভাবে শাখা তৈরি করে, অর্থাৎ আপনার প্রয়োজনেই শাখা-উপশাখার
জন্ম-এই উপন্যাসটির ক্ষেত্রেও এরকমটিই লক্ষ্য করা যায়। কাহিনির স্রোতে অনেক উপ-কাহিনি
তৈরি হয়ে মূল কাহিনিকে আরও অর্থবহ ও ব্যঞ্জনা দান করেছে। এই গ্রন্থটিতে ‘অভিনেতা-৭২’
নাট্যদলটির কুশীলবদের জীবনযাপন, খামখেয়ালিপনা, ভন্ডতা, অশালীনতা, নোংরামিসহ একান্ত
ব্যক্তিজীবনের কদর্য নানাদিক উদ্ভাসিত হয়েছে। মেধাবী অভিনেতা মামুন মোরশেদ ও
অভিনেত্রী সুলতাকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটির মূল কাহিনি তৈরি হলেও এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে
পড়েছে অনেক উপ-কাহিনি-যা কাহিনিসম্পৃক্ত। মামুন মোরশেদ অত্যন্ত মেধাবী অভিনেতা হলেও
তার মধ্যে গোছালো কোনো স্বভাব নেই। নোংরামিপনা ও ভন্ডামিতেই তার জীবন আঁকড়ে
থাকে। নারী দেহের প্রতি তার দুর্বার আকর্ষণ। তার চরিত্রে এসব কদর্যতা তৈরি হয়েছে তার
পরিবার থেকেই, তার পিতার অনৈতিক কর্মকান্ড-, অবৈধ শরীরী সম্পর্ক, নষ্টজীবনযাপনের
প্রত্যক্ষদর্শী সে নিজেই। স্ত্রীর প্রতি অমানবিক নির্যাতন যা তাকে মৃত্যুর শিকারে পরিণত
করে, বাসায় বিধবা কাজের বুয়া জমিলার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, পাশের বাসার
এসডিপিও-এর স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত অবৈধ শরীরী কার্যকলাপ এসব মামুনের কাছে দিবালোকের
মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে একদিকে বাবার প্রতি অশ্রদ্ধা, অন্যদিকে নিজের ভেতর বাবার
চরিত্রটিকেই যেন ধারণ করে, হয়তো নিজের অজান্তেই। এমনকি যে জমিলা বাবার লালসার শিকার
সেই জমিলার সঙ্গে ‘মামুনের এক অদ্ভুৎ লুকোচুরির সম্পর্ক’ গড়ে ওঠে। আবার
এসডিপিও-র মেয়ে ডলি মায়ের অবাধ অবৈধ সম্পর্ক দেখতে দেখতে একসময় তার মধ্যেও
মনোবিকৃতি ঘটে। ‘মামুনের চাইতে খানিকটা বড়’ ডলি মায়ের অবৈধ শরীরীসঙ্গী মনজুর
মোরশেদের ছেলে এই মামুন মোরশেদকেই পছন্দ করে এবং তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন
আগ্রহী হয়ে ওঠে-‘আমার মা আর তোর আব্বা যা করতে পারে, আমরাও তা করতে পারি। আজ
থেকে আমি তোর বউ। চির জনমের বউ’ বলেই ডলি তাকে শরীরে জড়িয়ে আদর করেছে, চুমু
খেয়েছে। ডলি মামুনের বউ হতে পারেনি, বিয়ে করে অন্য একজনকে। কিন্তু মামুনকে সে কখনো
ভুলতে পারেনি, অন্যের স্ত্রী হয়েও প্রবলভাবে অনুভব করেছে তাকে। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং
বছর দেড়েক যেতে না যেতেই স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, বিভিন্ন নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক
স্থাপন-যাকে-তাকে অশালীন প্রশ্নের মুখোমুখি ফেলে দেওয়া-অগোছালো উড়নচ-ী মামুনের
মধ্যে এসব স্বভাবসিদ্ধ হয়ে ওঠে। মর্তুজা ও মামুনের সম্পর্ক কর্মগত প্রণোদনাসূত্রে তৈরি
এবং উপন্যাসটিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
উপন্যাসটিতে রাজাকার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের চিত্র, গ্রামের জোতদারদের নিপীড়ন,
দখলদারিত্ব, জোতদার-প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে নেদা ফকিরের সংগ্রাম উপন্যাসটিকে
সার্বজনীনতায় রূপ দিতে সাহায্য করেছে।
নাট্যদলটির অধিকাংশ চরিত্র অগোছালো, অশালীন, অবাধ অবৈধ শরীরীসম্পর্ক, উচ্চাকাক্সক্ষা; এর
পাশাপাশি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে বিশেষ করে এসডিপিও মাকসুদুল আলমের স্ত্রী তসলিমা
আলমের সঙ্গে ফুড অফিসার মনজুর মোরশেদের অবাধ অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক, মায়ের অসভ্যপনায়
মেয়ের মধ্যে মনোবিকৃতি, পিতার অবাধ অবৈধ যৌনসম্পর্ক সন্তানকে বিপথগামী করে
তোলা, সমাজপতিদের দখলদারিত্ম, সেই সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ উপন্যাসটিকে
বৃহৎ ক্যানভাসে রূপ দিতে সাহায্য করে। কিন্তু বিচিত্র নানা বিষয় উপন্যাসটিতে একটি সূত্রে
গ্রন্থিত হলেও তা খুব বেশি সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। বা স্রোতধারাটা খুব
বেশি দূর প্রবাহিত হতে পারেনি। যে কারণে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হয়ে ওঠার সবরকম সম্ভাবনা
তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। তবে লেখকের কৃতিত্ব এখানে যে, অল্প পরিসরে নানান
বিষয়কে যুক্তিযুক্ত ও সাবলীলভাবে একটি স্বল্পআয়ুস্রোতে বেঁধে নান্দনিক গতি তৈরি করে
মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
‘আপন লড়াই’ (১৯৮৮) ইতিহাসকেন্দ্রিক উপন্যাস। হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র মুহসিন
উদ্দিন দুদুমিয়ার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আদর্শ-সংগ্রাম এ উপন্যাসের প্রধান
উপজীব্য। ইংরেজদের শোষণ-শোসন, নীলকর, জমিদার- জোতদারদের অমানুষিক ও অমানবিক নিপীড়ন-
নির্যাতন এবং এদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুসের আদর্শ-সংগ্রাম, ধর্ম-নৈতিকতা বিপ্লবী
চিত্র কাব্যিকভাষ্য হয়ে উঠেছে ‘আপন লড়াই’-এ।
শরীয়তউল্লাহ ইসলামের প্রকৃত স্বরূপকে তুলে ধরতে চেয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন
সমাজে-রাষ্ট্রে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসিত সময়ে তা সহজসাধ্য ছিল না। যে কারণে তিনি
ইসলামি আদর্শকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাজে-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রামকেই বেছে
নিয়েছিলেন। তাঁর সন্তান দুদুমিয়াও ছিলেন তাঁরই আদর্শে লালিত আর এক অকুতোভয় সাহসী
যোদ্ধা। জমিদার, নীলকর, সুদলোভী মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
শরীয়তউল্লাহ এবং দুদুমিয়ার নেতৃত্বে চালিত ফরায়েজি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক
নির্দোষ কর্মীকে ইংরেজরা অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে, হত্যা করেছে। নীলচাষে সাধারণ
কৃষকদের বাধ্য করেছে। সাধারণ প্রজাদের উপর অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে।
নারীদের অপমান করেছে। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং ইসলামকে রাষ্ট্রে-সমাজে প্রতিষ্ঠিত
করার জন্য হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তাঁর সন্তান দুদুমিয়া আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ‘ফরায়েজি
আন্দোলন’ নামে। মূলত এই আন্দোলনকে উপজীব্য করে ‘আপন লড়াই’ বিনির্মিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক এই বিষয়টিকে কথাশিল্পী আতা সরকার শৈল্পিকগুণ সমৃদ্ধ করে উপন্যাসের ফ্রেমে
বাঁধতে সক্ষম হয়েছেন।
আতা সরকারের উল্লেখিত পাঁচটি উপন্যাসে সমাজ-সমকাল, ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের স্বরূপ,
আর্থ-সামাজিক অবস্থা, কালচেতনা, প্রেম-প্রণয়, পারিবারিক অসঙ্গতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য,
মনস্তাত্ত্বিক নানাবিধ বিচিত্র বিষয় এসেছে। লেখক এ-সবের কখনও প্রত্যক্ষদর্শী, কখনও
পর্যবেক্ষক, কখনও কঠোর সমালোচক, আবার ইতিহাস-ঐতিহ্যগত যেসব বিষয় স্থান পেয়েছে,
সেসবের সঙ্গে লেখকের আদর্শগত বা চেতনাগত মিল থাকতে পারে বলে আমার ধরে নিতে পারি।
পরিবারে-সমাজে-দেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান নানাবিধ সমস্যাকে তিনি খুঁটে খুঁটে
দেখেছেন এবং এসব তাঁর উপন্যাসে গুরুত্বের সঙ্গে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। যে কারণে তাঁর
উপন্যাসে দেশ-কাল-চেতনা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নর-নারীর অন্তর্নিহিত রহস্যকাতরতা,
ইতিহাসের নানা গৌরবোজ্জ্বল বিষয় সংযোজিত হয়ে শিল্পগুণসমৃদ্ধতার সঙ্গে ব্যতিক্রমিতা ও
বিচিত্রতা তৈরি করতে পেরেছে।
আতা সরকারের উপন্যাসে ব্যক্তি আতা সরকার কতটা প্রভাবিত কিংবা আদৌ প্রভাবিত হয়েছেন
কিনা সে হিসেবটা গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসসমগ্র পড়ার সময় আতা সরকারকে বেমালুম ভুলে
গেছি-তাঁকে একটুও মনে পড়েনি, মনে হয়নি। হিসেবটা মেলাবো কীভাবে?
বাংলা কথাসাহিত্যে সত্তর দশকে আবির্ভূত আতা সরকার (১৯৫২-) একজন বিশিষ্ট
কথাসাহিত্যিক হিসেবে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। তাঁর উপন্যাস গতানুগতিকতার স্রোত থেকে
বেরিয়ে একটি ভিন্ন স্রোত তৈরি করে নিতে পেরেছে।তিনি ব্যতিক্রমধর্মী একজন লেখক।
সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে সস্তা চটুল প্রেমের গল্প তৈরি করে বাহবা কুড়োনো একেবারেই
তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তাঁর বক্তব্য স্বাতন্ত্র্য। ক্যানভাস সমাজ-সমকাল। দর্শনে বিশেষ ভিন্নমাত্রা।
আতা সরকারের উপন্যাস পাঠককে পড়তে হয় সচেতনভাবে এবং পড়ার পুরো মানসিকতা নিয়েই।
দুচোখ, কান খোলা রেখে, সমাজ-কালচেতনা সম্পর্কে নিজস্ব একটা ধারণা নিয়ে, বোধের
গভীরতা থেকে আতা সরকারের শিল্পমানস সত্ত্বা বুঝে নিতে হয়। যে কারণে আতা সরকারের
উপন্যঅস গড়গড় করে পড়ে যাওয়া যায় না, বারবার ফিরে আসতে হয়, ফিরে ফিরে আবার পড়ে যেতে
হয়-পড়তে হয়। পাঠের গভীরে গভীরভাবে মগ্ন হতে হয় পাঠককে, পাঠকের সামনে তখন স্পষ্ট হয়ে
ওঠে একটি বিশেষ সময়, সমাজ ও শৈল্পিক আঙ্গিকে উপস্থাপিত দর্শনবার্তা। পাঠককে ভাবতে
হয়-ভাবিত করে। আতা সরকারের ভাষা চমৎকার। ছোট ছোট বাক্য। স্রোতময়ী। প্রকাশভঙ্গী সরল,
সাবলীল। উপমা সমৃদ্ধ। বক্তব্য জোরালো। বাস্তবস্মত। দর্শন নিজস্ব। চিত্র- প্রেক্ষাপট চেনা। সময়ের
স্রোতে আলাদা; স্বাতন্ত্র্যবৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। আর এসবের ভেতওে তাঁর উপন্যাসে গভীরভাবে
জীবনবোধ অনুভূত হয়, সেসঙ্গে বুঝে নিতে পারি সমাজের গহীনভাষ্য।