প্রবন্ধ।। সাহিত্যে প্রেম ও দেশপ্রেম।। আলী রেজা

জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু? আদৌ কি কোন পার্থক্য আছে নাকি জীবন ও সাহিত্য একই সূত্রে গাঁথা? একজন নিরেট বিষয়সচেতন ব্যক্তি জীবনকে যেভাবে সাজাতে চান সে জীবনে সাহিত্যের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা খুব একটা নেই। কিন্তু যারা জীবনকে নান্দনিক করতে চান, জীবনকে শুধু ভোগের না করে উপভোগের করতে চান তাদের জীবনে সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সাহিত্য ভোগের বিষয় নয়, উপভোগের বিষয়। জীবনটাও শুধু ভোগের বিষয় নয়, উপভোগেরও বিষয়। তাই জীবন ও সাহিত্যের পার্থক্য বিচার না করে উভয়ের সম্পর্ক বিচার করলেই তা জীবনঘনিষ্ঠ হয়। জীবন সুখ-দুঃখ, সমস্যা-সংকট, আনন্দ-বেদনা, বিরহ-মিলন ইত্যাদি অনুভূতির সমষ্টি। এই অনুভূতিগুলোই সাহিত্যে রূপায়িত হয়। তাই সাহিত্যচর্চা জীবনচর্চারই আর এক নাম। সাহিত্যে সামগ্রিকভাবে জীবনকেই মেলে ধরা হয়। তাই সাহিত্য ও জীবন একই সূত্রে গাঁথা। তবে সাহিত্যের রস আস্বাদনের মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ্য করে তুলতে পারেন না অনেকেই। যারা পারেন তাদের কাছে জীবনের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠে। আর যারা পারেন না তাদের জীবনে সাহিত্যের তেমন কোন মূল্য নেই। তারা অনেকেই সাহিত্যচর্চাকে পাগলামি কিংবা অর্থহীন কাজ মনে করতে পারেন। সাহিত্যে প্রতিফলিত প্রেমানুভূতির সাথে ব্যক্তির যাপিত জীবনের প্রেমানুভূতি মেলাতে হলে সাহিত্যের সাথে জীবনের মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। এই মেলবন্ধন ঘটে সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে। সাহিত্যের একটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী প্রবণতা আছে। পাশাপাশি একটি জাতীয় চেতনাও আছে। জাতীয় চেতনা রাজনীতির মাধ্যমে উজ্জীবিত হয় কিন্তু এই চেতনা যুগের পর যুগ মানবমনে প্রবাহিত হয় সাহিত্যের মাধ্যমে। সাহিত্য একটি চেতনার প্রবাহ। চেতনা জাতিগত হোক কিংবা ব্যক্তিগত হোক দুটোকেই টিকিয়ে রাখা সাহিত্যের কাজ। দেশপ্রেম একটি জাতীয় চেতনা। দেশপ্রেমকে ধারণ করার মাধ্যমে সাহিত্য জাতীয় চেতনাকেই ধারণ করে। শুধু ধারণ করে না, ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র এবং টিকিয়ে রাখে দীর্ঘকাল। নর-নারীর প্রেমানুভূতির মাঝেও থাকে এক ধরনের ব্যক্তিগত চেতনা, যে চেতনা লালিত হয় হৃদয়ে। তাই প্রেম হলো হৃদয়বৃত্তির চর্চা। প্রেম ও দেশপ্রেম দুটোই জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে। তাই আমরা সাহিত্যকে যখন জীবনচর্চা বলি তখন সাহিত্য প্রেম ও দেশপ্রেম কোনটাকেই পরিহার করে চলতে পারে না। মানুষের হৃদয়বৃত্তি ও মানবিকবোধ চর্চার ফসল হলো প্রেম। নর-নারীর প্রেম একটি হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। প্রেমকে ঠিক যৌনতার সাথে মেলানো যায় না। কারণ যৌনক্রিয়া একটি শারীরিক বিষয়। কিন্তু প্রেম কোন শারীরিক বিষয় নয়। প্রেম বা হৃদয়বৃত্তির চর্চার জন্য শরীর কোন মুখ্য বিষয় নয়। শারীরিক উপস্থিতি প্রেমের অনুভূতিকে তীব্র করতে পারে এবং প্রেমের অনুভূতি নর-নারীকে যৌনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে প্রেমহীন যৌনক্রিয়া কোন মানসিক প্রশান্তি এনে দিতে পারে না। প্রেমের আলোচনায় অনেক সময় যৌনতাও চলে আসে প্রাসঙ্গিকভাবে। তাই বলে দুটোকে গুলিয়ে ফেলা যায় না। সাহিত্যে প্রেমের উপস্থিতি যেমন চিরায়ত বিষয়; যৌনতার উপস্থিতিও তেমনি চিরায়ত। প্রেমানুভূতি শাশ^ত ও চিরন্তন, কিন্তু যৌনানুভূতি চিরন্তন নয়। যৌনক্রিয়ার জন্য ব্যক্তির শারীরিক সক্ষমতার গুরুত্ব অপরিসীম। শারীরিক সক্ষমতার অভাবে ব্যক্তির যৌনাকাক্সক্ষার নিবৃত্তি ঘটে থাকে। কিন্তু প্রেমের অনুভূতি মনের গভীরে জন্ম নেওয়া বিষয়। নান্দনিক সাহিত্যে প্রেমের উপস্থিতি ঘটে অনিবার্যভাবেই। প্রেমকে পরিহার করে যেমন জীবন চলতে পারে না তেমনি সাহিত্যও নির্মিত হতে পারে না। প্রাচীন সাহিত্য থেকে শুরু করে সমকালীন সাহিত্যের সকল শাখায় নর-নারীর প্রেমের উপস্থিতি ঘটেছে প্রবলভাবে। বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ- এ নর-নারীর যাপিত জীবনের যে চিত্র বা বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে প্রেমের উপস্থিতি প্রবল। বড়– চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মধ্যযুগের বাংলাসােিত্যর একমাত্র নিদর্শন। সেখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমই প্রধান উপজীব্য। রাধা- কৃষ্ণের প্রেম হৃদয়বৃত্তির সীমা অতিক্রম করে যৌনক্রিয়ায় উপনীত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। মধ্যযুগে রচিত বাংলাসাহিত্যের রোমান্টিক প্রণয়য়োপাখ্যানগুলোতে নর-নারীর প্রবল প্রেমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রেমের কারণে প্রাণবিসর্জন দিয়েছেন অনেক নর-নারী। অর্থ-বিত্ত ও ভোগবিলাসী জীবন প্রত্যাখ্যান করে দুঃখ-কষ্ট ও সংকটাপন্ন জীবন বেছে নিয়েছেন প্রেমের কারণে। বাংলাসাহিত্যের মঙ্গলকাব্যগুলো অনেকটা পৌরাণিক কাহিনিনির্ভর হলেও তা নর-নারীর প্রেমেরই উপাখ্যান। দেব-দেবী বা অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রভাব মানবজীবনকে কখনো কখনো দূর্বিষহ করে তুললেও শেষমেশ মানুষেরই জয় হয়েছে। মানবপ্রেমের শক্তি সকল অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করেছে। নর-নারীর এই প্রেমের প্রবল শক্তি দেখা যায় ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র পালাগুলোতে। এই পালাগুলোতে নারীর প্রেমশক্তির উত্থান ঘটেছে অত্যন্ত তীব্রভাবে। বংশগৌরব আর অর্থবিত্তের মোহ ভুলে অনেক নর-নারী কুলত্যাগী হয়েছে শুধুমাত্র প্রেমের জন্য। বিশেষ করে ময়মনসিংহ গীতিকা’র নারী চরিত্রগুলো সমাজ ও ধর্মের শাসনকে অমান্য করে প্রেমের মর্যাদা রক্ষা করেছে। আধুনিক বাংলাসাহিত্যে নারীপ্রেমের এক অসাধারণ চিত্র অঙ্কন করেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পতিত, অবহেলিত ও নিচু পেশার নারীদেরকে মহামানবিক করে নির্মাণ করেছেন তিনি। শরৎচন্দ্রের নারীরা অনেকেই সমাজ ও ধর্মের বিচারে অপরাধী ও অস্পৃশ্য হলেও প্রেম ও মানবতাবোধে অতি উচ্চ আসনে সমাসীন। সাহিত্যে প্রেম কখনো কখনো যৌনক্রিয়ার পর্যায়ে উপনীত হতে দেখা যায়। যাপিত জীবনেও নর-নারীর প্রেম যৌনক্রিয়ার দিকেই ধাবিত হয়। যৌনপ্রেষণা প্রেমকে তীব্র করে তোলে। যার যৌনপ্রেষণা খুব বেশি সক্রিয় নয় তার প্রেমের অনুভূতিও খুব বেশি তীব্র হয়ে ওঠে না। যৌনক্রিয়া প্রথাবিরোধী পন্থায় হলে কিংবা সমাজ ও ধর্মের অনুশাসন মোতাবেক না হলে তা যৌনঅপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের যৌনঅপরাধের চিত্র প্রতিফলিত হয় যে সাহিত্যে সে সাহিত্যকে অনেকেই প্রেমের সাহিত্য বলতে নারাজ। কিন্তু প্রেমের পরিণতিতে নর-নারীর যে যৌনজীবন তা সব সময় ধর্ম ও সমাজের অনুশাসন মোতাবেক হয় না। কারণ সাহিত্যে প্রথাবিরোধী চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। এই প্রথাবিরোধিতাই সমাজকে বদলে দেয় ও এগিয়ে নিয়ে যায়। এই প্রথাবিরোধিতা শুধু প্রেমের ক্ষেত্রে নয়. যাপিত জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। কারণ সাহিত্য সব সময় প্রথাগত হতে পারে না। সাহিত্য সব সময় প্রথাগত হলে তা চিন্তার বিবর্তন ও প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারবে না। নর-নারীর প্রেম যুগে যুগে নতুন শক্তি লাভ করেছে। এক সময় প্রেম এতোটাই গোপন ও নিন্দনীয় বিষয় ছিল যে, প্রেমের সম্পর্ক প্রকাশিত হলে আত্মহত্যার মাধ্যমে তার পরিণতি ঘটতো। প্রেমের সম্পর্ক প্রকাশ হওয়ার পর সম্ভাব্য লোকনিন্দার ভয়ে আত্মহত্যা না করে অনেকে গৃহত্যাগী বা কুলত্যাগী হতো। অনেকে পরিবার ও সমাজ-ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতো। বর্তমান সমাজভাবনায় প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেওয়ার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এই যে চিন্তার বিবর্তন এই বিবর্তনকে অস্বীকার করে সাহিত্য নির্মাণ সম্ভব নয়। সাহিত্যকে সময়বাস্তবতা নিরীক্ষণ করতে হয় এবং ভবিষ্যৎ নির্দেশ করতে হয়। তাই সাহিত্যের কারবার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতকে পাঠ করে ভবিষ্যতের পথনির্দেশ করতে পারে যে সাহিত্য সে সাহিত্যই ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। অতীতমুখিতা নয়, ভবিষ্যতমুখিতাই সাহিত্যকে সরস ও জীবন্ত করে থাকে। সাহিত্যে প্রেমবিষয়ক চিন্তার বিবর্তন সব সময়ই সমাজব্যবস্থাকে অতিক্রম করে যায়। তাই প্রেমবিষয়ক সামাজিক মনোভাব সাহিত্যে প্রতিফলিত প্রেমের সমান্তরালে চলতে পারে না। সমাজ পিছিয়ে থাকলেও প্রেম এগিয়ে যায়। নর-নারীর প্রেম প্রগতিশীলতার সাথে পাল্লা দিয়ে চলে। বর্তমান সাহিত্যে প্রেমের উপস্থিতি আগের মতো গোপনীয় নয়, নিন্দনীয়ও নয়। প্রেম প্রথাবিরোধী যৌনতার পর্যায়ে উপনীত না হলে তা মানবপ্রেম বা মানবতাবোধের বৃহৎ অঙ্গনে তার সুধা বর্ষণ করে। তাই প্রেম মানবতাবাদী চেতনারও বিকাশ ঘটায়। প্রেমিক মানেই মানবিক চেতনার ধারক। সাহিত্যে প্রেমের প্রতিফলন ঘটে নানা মাত্রায়, নানারূপে। এই প্রেম কি শুধুই নর-নারীর প্রেম বা মানবপ্রেম? না, প্রেম সর্বত্রগামী। প্রকৃতি বা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতি মনের যে আবেগ-অনুভূতি সেটাও প্রেম। এই প্রকৃতিপ্রেম সাহিত্যের একটি বড় অংশ দখল করে আছে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য মানবমনের ব্যাকুলতা চিরকালের। যে প্রকৃতি বা দেশমাতৃকায় মানুষ বড় হয়ে ওঠে সেই দেশমাতৃকার প্রতি মানুষের যে ভালবাসা বা আবেগ সেটাই দেশপ্রেম। নর-নারীর প্রেম যেমন সাহিত্যের একটি প্রধান উপাদান তেমনি দেশপ্রেমও সাহিত্যের একটি প্রধান উপাদান। সাহিত্যে দেশপ্রেমের উপস্থিতি থাকলে তা সকল শ্রেণির পাঠককেই মুগ্ধ করে। দেশপ্রেম মানুষের অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকে। কবি যখন বলেন, ‘স্বদেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া’ তখন কবির কল্পনায় দেশপ্রেম মূর্ত হয়ে ওঠে। কবি দেশের মাটিকে খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি বলতে চান। মা, মাটি ও দেশকে একই সমান্তরালে রাখতে চান। কবির কাছে পথের ধূলাও অত্যন্ত খাঁটি ও আদরের। এই মাটিতে বেড়ে ওঠাই শেষ কথা নয়, মৃত্যুর পর কবি এই মাটিতেই মিশে যেতে চান। কবির ভাষায় : ‘মধুর চেয়েও আছে মধুর, সে এই আমার দেশের মাটি/ আমার দেশের পথের ধূলা, খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি’ কিংবা ‘তোমার ধূলিতে গড়া এ দেহ আমার/ তোমার ধূলিতে কালে মিশাবে আবার’। এ শুধু কাব্যকথা নয়। এটা দেশপ্রেমের পরম নিদর্শন। সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রতিফলন ঘটেছে সর্বযুগে। কী প্রাচীন সাহিত্য, কী আধুনিক সাহিত্য; কী পুঁজিবাদী সাহিত্য, কী সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী সাহিত্য; কী ধর্মীয় সাহিত্য, কী নান্দনিক বা আদি রসাত্মক সাহিত্য- সকল সাহিত্যেই দেশপ্রেম এক তীব্র আবেদন নিয়ে দেখা দিয়েছে। গল্প-উপন্যাস, কবিতা, সংগীত, নাটক- তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল আঙ্গিকেই দেশপ্রেম প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে দেখা দিয়েছে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী নর-নারীদের নিয়েও রচিত হয়েছে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী দেশপ্রেমিকগণ সর্বদেশে সর্বকালে বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। আর এভাবেই দেশপ্রেম সাহিত্য নির্মাণের একটি প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছে যুগে যুগে। দেশপ্রেমের অনুভূতির সাথে প্রকৃতিবন্দনার একটি যোগসূত্র থাকে। দেশ মানেই তো দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি বিষয়। এই বিষয়গুলোর সাথে যাপিত জীবনের একটি যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্যভাবে গড়ে ওঠার মাধ্যমে ব্যক্তিমনে দেশপ্রেমের স্ফূরণ ঘটে। দেশপ্রেম প্রবল হতে হতে দেশ ক্রমশ প্রেয়সী হয়ে ওঠে। দেশের সেবা হয়ে ওঠে পূণ্যকর্ম। দেশের শত্রæ মানেই নিজের শত্রæ, দেশের বন্ধু মানেই নিজের বন্ধু- এই ভাবাবেগ ব্যক্তিকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে তোলে। একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকের দায়িত্ব হলো এই দেশপ্রেমের উদ্দীপনা ব্যক্তির চেতনায় প্রবাহিত রাখা। সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রতিফলন ঘটলে সে সাহিত্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণ একটি দেশের সাথে সে দেশের মানুষের বন্ধন অবিচ্ছেদ্য। সারাবিশ^ পরিভ্রমনকারী ব্যক্তির মনেও জন্মভূমি এক বিশেষ ভাবাবেগের আশ্রয়। কারণ জন্মভূমিতেই মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীর আলোয় আবির্ভাব ঘটে মানবশিশুর। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধর্মান্তরিত হয়ে দেশত্যাগ করে সুদূর ফ্রান্সের বিলাসবহুল নগরীতে অবস্থান করার সময়ও তাঁর জন্মভূমির ছোট্ট কপোতাক্ষ নদকে ভুলতে পারেননি। কবির হৃদয়মথিত উক্তি ‘বহুদেশে দেখিয়াছি বহু নদদলে/ কিন্তু এ ¯েœহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে।’ এই দেশপ্রেমের চেতনা সাহিত্যকে করেছে সৌন্দর্যমÐিত। রবীন্দ্রসাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে দেশের প্রতি ভালবাসা আর দেশপ্রেমের আকুতি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের চেতনায় সমৃদ্ধ। কবি নজরুলের মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম- দুটোই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর দ্রোহী চেতনার মধ্য দিয়ে। নজরুল দ্রোহী হয়েছেন প্রথমত পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার জন্য, দ্বিতীয়ত মানুষের মাঝে প্রেমহীনতা দেখে। প্রেমে ব্যর্থ হয়েই নজরুল বিদ্রোহী হয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু নজরুলের দ্রোহীচেতনার মূলে পরাধীনতা ও প্রেমহীনতা একযোগে কাজ করেছে। ফলে নজরুলসাহিত্যে প্রেম ও দেশপ্রেম- দুটোই তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে এবং একই সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার প্রত্যয় নিয়ে মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন মানুষ দেশপ্রেমেও উজ্জীবিত হয়। এ কারণেই ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকালে ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেমের উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনামলকে বলা হয় ভারতবর্ষের অগ্নিযুগ। অগ্নিযুগের সাহিত্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল প্রবল এবং সেই চেতনার একদিকে ছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, অন্যদিকে ছিল দেশপ্রেম। এ বিষয়টি শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। ফলে ব্রিটিশ আমলে সবচেয়ে বেশি সাহিত্যকর্ম নিষিদ্ধ হয়েছে। লেখকগণও শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছেন। নিষিদ্ধ সাহিত্যকর্মের সবগুলোই ছিল স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ শাসনের অবসান (১৯৪৭) হলে ভারতবর্ষ দুইভাগে বিভক্ত হয়। বাংলাসাহিত্যও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলাসাহিত্য নির্বিঘেœ বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করলেও পূর্ববাংলা বা ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাসাহিত্য পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে। ভাষা আন্দোলনে (১৯৫২) বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ববাংলার বাংলাসাহিত্য বিকাশের একটি পথ নির্মিত হলেও পুরো পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাসাহিত্যের শত্রæসংখ্যা কম ছিল না। শাসকগোষ্ঠীর দাদাল হয়ে উঠেছিল এক শ্রেণির সুবিধাবাদী লেখক। পাকিস্তান আমলে বাংলাসাহিত্যের দুটি ধারার মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ধারা ছিল দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার ধারা। এই ধারার সাহিত্য পূর্ববাংলার প্রকৃতি ও মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করেছিল। সাহিত্যে প্রতিফলিত এই দেশপ্রেম পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে (১৯৭১) বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যে জাতীয় চেতনার জন্ম দিয়েছিল এবং সেই জাতীয় চেতনাপ্রসূত সাহিত্যে দেশপ্রেমের যে প্রাবল্য ছিল সমকালীন সাহিত্যে তা দেখা যায় না। এর একটি কারণ হতে পারে জাতীয় সংকটের অভাব। জাতীয় সংকটই জাতীয় চেতনার জন্ম দেয়। পরাধীনতা ছি একটি প্রধান জাতীয় সংকট। স্বাধীনতা লাভের পর সেই জাতীয় সংকট দূরীভূত হয়। ফলে জাতীয় ঐক্যও তার প্রয়োজন হারিয়ে ফেলে। সংকট বলতে এখন সবই ব্যক্তিসংকট। ব্যক্তিসংকট কোন দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করতে পারে না। ব্যক্তিসংকট ব্যক্তিকে জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্ররোচিত করে। সময়বাস্তবতার নিরিখে যাপিত জীবনের নানা সংকট তুলে ধরতে গিয়ে সাহিত্য এখন ব্যক্তিকে নিয়েই ব্যস্ত। ব্যক্তির মনস্তত্ত¡, ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্কের জটিলতা, ব্যক্তির সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বৈশি^ক সম্পর্ক ও সংযোগের মাধ্যমে মূল্যবোধের পরিবর্তন- এ সবই এখন সাহিত্যকে ব্যক্তিসংলগ্ন করে তুলেছে। ব্যক্তিসংলগ্ন হলেও সাহিত্য ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। ব্যক্তির একটি প্রবল প্রতিপক্ষ হলো প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান কখনো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মেনে নেয় না। রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে নির্মমভাবে দমিয়ে রাখে। ব্যক্তিসংকটের কথা বলতে গিয়ে, ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে সাহিত্যকে কখনো কখনো রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি ধর্মের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হয়। এটা করতে গিয়ে সাহিত্যের পক্ষে দেশপ্রেমের নান্দনিক বয়ান উপস্থাপন করা যায় না খুব একটা। ব্যক্তিচেতনা বা ব্যক্তির হৃদয়বৃত্তিকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত বর্তমান সাহিত্যে তাই প্রেম যতটা প্রবলভাবে উপস্থিত, দেশপ্রেমের উপস্থিতি ততটা প্রবল নয়।

আলী রেজা
প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যচিন্তক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *