প্রবন্ধ।। কবি ও কাক।। রেজাউদ্দিন স্টালিন

‘কবি ও কাকের সংখ্যা সমান’ -এই কথাটি কে কিভাবে প্রথম বলেছিলেন কিংবা কথাটির প্রচলন কিভাবে হলো তা’ জানা যায় না। তবে কবিদের আধিক্যজনিত কোনাে ঘটনা থেকেই যে, কথাটির উদ্ভব তা’ বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু কথা হলাে কবির সংখ্যা বেশি হলে ক্ষতি কি? কবিরা কি সমাজের কোনাে ক্ষতি করেন? কবিরা কি অন্যের দয়ায় বাঁচে, কিংবা কারো গলগ্রহ হয়ে থাকে? এসব প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা হচ্ছে কবির সংখ্যা বেশি হলে ক্ষতি নেই- কেননা কবিরা সমাজে কারাে তেমন ক্ষতি সাধন করেছে এ রকম কথা শােনা যায় না। কবিরা ধর্ষণ করেছে, কিংবা কাউকে হত্যা করেছে কিংবা কারাে সম্পত্তি ফাঁকি দিয়ে নিয়েছে, আত্মসাৎ করেছে কিংবা সন্ত্রাসী কোনাে ঘটনার নায়ক এরকম কথা শােনা যায়নি। কবিরা সৎ ও সত্যের পথে থাকেন বলে অর্থবিত্ত কম হতে পারে কিন্তু কারাে গলগ্রহ হয়ে বাঁচে এমন শােনা যায় না। বরং কবিরা সত্য উচারণ করেন, সমাজের ক্ষত এবং অবক্ষয়ের দিকগুলাে তুলে ধরেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিরাপােষ। এ কারণে কবিদের সংখ্যা বেশি হলে তাদের অসুবিধা যারা সমাজে অন্যায় এবং সন্ত্রাসের জন্ম দেন। যারা অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করেন এবং দেশে ও জাতির ক্ষতিসাধন করেন তাদের অসুবিধা হয় যদি কবির সংখ্যা বাড়ে তাহলে। কোনাে মহৎ কিংবা সৎ কবির পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থাকা সম্ভব নয়। হাজার বছরের বাংলা ভাষায় যে সমস্ত কবিতা রচিত হয়েছে তার অধিকাংশই অন্যায় ও অত্যাচার এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে। কবি আব্দুল হাকিম এর সেই কথাটি আজো গুরুত্বপূর্ণ – ‘বহু দেশে জন্মগ্রহণ করেছে অথচ বঙ্গকে’ মাতৃভূমিকে হিংসা করে-তার জন্ম কি সত্য’? কিংবা রবীন্দ্রনাথ যখন বলে, ‘অন্যায়ে যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’। নজরুল বলেন, যেদিন অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না- সেদিন তিনি শান্ত হবেন। সুকান্ত চট্টোপাধ্যায় বােধন কবিতায় যখন বলেন, প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তােরা/ ভেঙেছিস ঘরবাড়ি সে কথাকি আমি জীবনে মরণে/ কখনাে ভুলিতে পারি? আদিম হিংস্র মানবিকতায়/ যদি আমি কেউ হই, স্বজন হারানাে শশ্মানে তােদের/ চিতা আমি তুলবােই। এ রকম অজস্র উদাহরণ দিয়ে দেখানাে যাবে অন্যায় আর অসাম্যের বিরুদ্ধে কবিদের লেখনী কত তীব্র ও তীক্ষ। বাংলা ভাষায় নয় পৃথিবীর সমস্ত ভাষায় কবিরাই সবচে’ অগ্রণী এবং সমাজের বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার। হােমার, দান্তে, ভার্জিল, ট্যাসাে, শেক্সপিয়র, লুই আঁরাগ, নেরুদা, লােরকা কিংবা রােমান্টিক যুগের কবি শেলি, কীটস, বাইরন তারপরে ইয়েটস, এলিয়ট, কিংবা ব্যাঁবাে- বােদলেয়র পর্যন্ত সমাজকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন’ শব্দে অনুভবে আর সততায়। পৃথিবীর মহান রাষ্টবিজ্ঞানী প্লেটো কবিদের নির্বাসন দিতে চেয়েছিলেন, কোনাে কোনাে ধর্মগ্রন্থে কবিদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ আছে অর্থাৎ কবিরা কোনাে না কোনােভাবে বিপ্রতীপ অবস্থানে থাকে। তাদের কথার মূল্য আছে বলেই নজরুলের কাব্যগ্রন্থ একাধিকবার বাজেয়াপ্ত করতে হয়েছিল। লােরকাকে হত্যা করতে হয়েছিল। লর্ড বায়রণকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল এবং কবি ববি স্যান্ডসকে ফাঁসিতে ঝােলানাে হয়েছিল। কবিদের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহ পােষণ করেছিলেন। যারা, তারা এমন সব অমনাবিকতার জন্ম দিতে চেয়েছিলেন – এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এঙ্গোলা পরিস্থিতিজনক বিস্ফোরন্মুখ তখন জন.এফ. কেনেডি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত মারাত্মক পরিণতির মুখে কবি রবার্ট ফ্রস্টকে ডেকেছিলেন, হােয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বললেন রবার্ট ফ্রস্ট বলুন এখন আমি কি করবাে – যুদ্ধের ঘােষণা দেওয়া ছাড়া আর কি উপায় আছে? রবার্ট ফ্রন্ট একটু ভেবে বললেন , মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনার অঙ্গুলি হেলনে – এই সুন্দর পৃথিবীটা আবার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে – নিস্পাপ শিশুদের মৃত্যু হবে- ভেবে দেখুন এই সৌন্দর্য এই ফুল ফুলে উঠতে কত হাজার বছর সময় লেগেছে , এই নদী আর মানুষ ও প্রকৃতি গড়ে উঠতে সময় লেগেছে , এই ফুল ফুলে উঠতে কত হাজার বছর সময় লেগেছে , এই নদী আর মানুষ ও প্রকৃতি গড়ে উঠতে সময় লেগেছে কত লক্ষ কোটি বছর – এখন। আপনি সিদ্ধান্ত নিন-কি করণীয়। কেনেডি ছিলেন বিচক্ষণ – তিনি কি করণীয় । কেনেডি ছিলেন বিচক্ষণ – তিনি আর যুদ্ধের দিকে গেলেন না। এই পৃথিবী যে সুন্দর, নারীরা যে সুন্দর এবং মানুষ যে মহিমান্বিত প্রাণী, নির্বাচনশীল ও প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিদীপ্ত কর্মী তা কবিদেরই আবিষ্কার। আগে কবিরাই ছিলেন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী। মহাকবি গ্যেটের সামগ্রীক জীবন ছিল বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয়। এছাড়া আরাে উদাহরণ ইতিহাসখ্যাত। আমাদের সবার জানা চার্চিলের সেই মহৎ উক্তি – ‘রাজনীতি সমাজকে দূষিত করে আর কবিরা পরিচ্ছন্ন করে।’একথা থেকে যদি কবিদেরকে কাকে প্রতি তুলনায় স্থাপন করা হয় সে ক্ষেত্রে কিছু বলার নেই কিন্তু কোনাে হীন উদ্দেশ্যে কবিদের চরিত্র হননের জন্যে যদি এ ধরনের উক্তি কেউ করেন বুঝতে হবে সে কোনাে সমাজবিরােধী, স্বার্থান্বেষী কিংবা সন্ত্রাসী গােষ্ঠীর প্রতিনিধি- যার ভয় আছে কবিদের সত্যনিষ্ঠ উচ্চারণ দ্বারা আক্রান্ত হবার। একবার ভেবে দেখুনতাে সারা পৃথিবীতে কোনাে কবি নেই – অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে? মানুষ হবে আবেগীহন, যন্ত্রতুল্য রােবট। এমনকি সে তার প্রিয়তমা কিংবা স্ত্রীকেও সুন্দর করে দেখবার দৃষ্টি হারাবে। নারীরা কর্কশ রূঢ় ধ্বনি ছাড়া আর কোনাে প্রশংসার বাণী পাবে না। হৃদয়হীন নিষ্ঠুর বিমানবিক সেই পৃথিবীতে থাকবেন শুধু রাজনীতিবিদ আর অর্থনীতিবিদ আর সমরবিদগণ। ভাল, সারা পৃথিবী কি সেই দিকেই যেতে চায়? কবিদের বিরুদ্ধে এক ধরনের অপপ্রচার সারা পৃথিবীতেই ছড়ানাে আছে- বাংলাদেশেও। কবি দেখলেই অনেকে ভয় পান। যারা ভয় পান তাদের বেশির ভাগই রাজনীতিবিদ কিংবা বুদ্ধিজীবী। ইদানিং কথাশিল্পীদের বাজার একটু ভাল বলে মাঝে মাঝে তারাও কবিদের বিরুদ্ধে দু’কথা বলতে ছাড়েন না। কিন্তু আমি নিশ্চিত এইসব রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী কিংবা উপন্যাসিকরা অনেকেই কবিতা পাঠ করেন না। পড়তে ভয় পান। কেননা তাদের আদল যদি কবিতার আরশিতে প্রতিবিম্বিত হয়? আমাদের দেশে যারা কথাশিল্পী তাদের ক’জনার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ, ক’জনার লেখার অর্থে জীবন বােধ আছে? এক ধরনের ভণ্ডামী আর যৌনতা দিয়ে ভরা তাদের আপ্তবাক্য কালের গর্ভে বিলীন হতে বাধ্য কি কাঁটি কবিতার দু’একটি চরণ মহাকাল তার স্বার্থেই বহর করে নিয়ে যাবে এখনাে যাচ্ছে। অনেকে বলেন কবিতা বুঝি না। কি করে বুঝবেন তিনি কি আদৌ পড়েন? তিনি মানুষের হৃদয়কে হবার চিন্তায় ব্যস্ত – অন্যের সম্পদ, দেশের সম্পদ লুষ্ঠান ব্যস্ত- এতে নীতি আরবিবেকের কোনাে বালাই নেই। এখানেই সমস্যা কবিরা বিবেক ও নীতির প্রশ্নে অটল। তারা পারেন না অন্যের ক্ষতি করে সম্পদ গড়তে। ইদানিং এক ধরনের বুদ্ধিজীবী ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছেন বিবৃতি দেবেন ঘরে বসে – সময় বুঝে পালাবেন। সুবিধা বুঝে কণ্ঠ মেলাবেন নানা সুরে। মাও সেতুং এর একটা বিখ্যাত উক্তি – ’মাছ পচে মাথা থেকে আর দেশ পচে বুদ্ধিজীবীদের মাথা থেকে’। দেশ যাক শুধু আমারটা থাক এই হলাে বর্তমানের সমাজপতিদের অনেকের চাওয়া। বিবেকের নির্বাসন দিয়েছেন অনেকে। যত দোষ নন্দ ঘােষ অর্থাৎ কবিদের। কবিরা সংখ্যায় বেশি। তাহলে এত রাজনীতিবিদি, ক্রীড়াবিদ, অর্থনীতিবিদ, এনজিওবিদ, বুদ্ধিজীবীবিদ, কণ্ঠশিল্পীবিদ কেন? ওগুলােয় কোনাে সমস্যা নেই। কবিরাই সংখ্যায় বেশি হয়ে যাচ্ছে। ওরা সংখ্যায় বেশি হলে অনেক অসুবিধা- কেননা ওরা মানুষের মধ্যে আবেগ তৈরি করে দেবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে শেখাবে। ওদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাটাই ভাল। এইভাবে সত্যের শক্তিকে স্তিমিত করে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত। গত সাত বছরে কবিদেরকে নােবেল দেওয়া হচ্ছে না। পৃথিবীর নানা ভাষায় এমন সব মহৎ কবিরা আছেন যাদেরকে কয়েকবার নােবেল দিলেও ঠিকমত সম্মান জানানাে হবে না। তবুও নােবেল কমিটি বারবার উদ্দেশ্য প্রণাৈদিত হয়ে এখন পুরস্কার দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সপক্ষের বিষয়বস্তু সম্বলিত উপন্যাস এবং লেখকরা বিবেচিত হচ্ছে। গত ২০০২ এর চিনের ঔপন্যাসিক এ বছর ২০০৩ সালের কোয়েজস কিংবা ২০০১ এর লেখক, প্রত্যেকের নােবেল প্রাপ্তি ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে- একথা স্পষ্টভাবে বলা যায়। অর্থাৎ এখন পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রেও রাজনীতির কালাে হাত ঢুকে পড়েছে। সৎ লেখক ও নিষ্ঠাবান কবির’ ভাগ্যে নােবেল কিংবা কোনাে পুরস্কার মেলা ভার। এখন প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে কবিদের করণীয় কি? আমার একটাই উচ্চারণ ভাল, নতুন কবিতা লেখা। সত্য ও সুন্দরের সপক্ষে থাকা। নােবেল পুরস্কার লিও টলস্টয় পাননি, নােবেল পুরস্কার নেননি জা পল সতি -তাতে কিছু যায় আসে না। মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়াটাই বড় পুরস্কার। ১৯০১ সালে সােলে প্রুদম- নােবেল পেয়েছিলেন কিন্তু ক’জনা তার লেখা পড়েন কিংবা নাম জানেন? কিন্তু জা পল সতি, লিও টলস্টয় এখনও সজীব। আমি মনে করি এই কালবেলার অসংখ্যা নিষ্ঠাবান সৎ ও সাহসী কবির জন্ম হােক রাজনীতির পঙ্কিলাবর্তে ঘূর্ণমান দেশকে করুক উজ্জ্বল উদ্ধার। আর কবিদের মনে রাখতে হবে – যতটুকু সাহস ততটুকুই কবিতা।

One thought on “প্রবন্ধ।। কবি ও কাক।। রেজাউদ্দিন স্টালিন

  • মে ৬, ২০২১ at ৭:৪১ অপরাহ্ণ
    Permalink

    তথ্য-সমৃদ্ধ অপূর্ব বিশ্লেষণাত্মক বয়ান। ধন্যবাদ কবিকে

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *