বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে বিশেষ নিবন্ধ।। তোমার জন্মদিন আমাদেরও।। সেলিনা হোসেন

বঙ্গবন্ধু তোমার সঙ্গে হেঁটে যাওয়া আমাদের স্বপ্ন। হিমালয় পর্বতের চেয়ে বড়ো যদি কিছু থাকে সে তোমার উচ্চতা। বঙ্গবন্ধু তোমার উচ্চতা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে আমরা হেঁটে যাব হাজার বছরের বাংলাদেশে। আমাদের বাংলাদেশে পথের ধারে ফুটে থাকবে ফুল, গাছের ডালে থাকবে পাখির ঝাঁক, সোনালি ধানের শীষে ভরে থাকবে ক্ষেত, আর সব শিশুদের জন্য থাকবে নিরাপদ জীবন। শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত বাংলাদেশ স্মরণ করবে তোমাকে বঙ্গবন্ধু। স্মরণ করবে ত্রিশ লক্ষ অমর শহিদকে।

তাই তো আমরা সমবেত কণ্ঠে বলি, তোমার জন্মদিন আমাদেরও। এদিন আমাদের আনন্দের, শেখার এবং নিজেদেরকে সাহসী করার দিন। ইতিহাস শেখার দিন। তোমার জন্মদিন আমাদের মানবিক অধিকার শেখার দিন। তোমার জন্মদিন আমাদের দেশ ও মানুষকে ভালোবাসা শেখার দিন। প্রতিদিনের স্মরণের মাঝে আমাদের জীবনে উদিত হবে নতুন সূর্য। ইতিহাস-ঐতিহ্যে টিকে থাকা তুমি আমাদের চিরকালীন মানুষ।

তোমার দেশে আমরা ভাগ্যবান প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু। জন্ম নিয়েই আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েছি। দেখেছি জাতীয় পতাকা। গেয়েছি জাতীয় সংগীত। আমাদের আছে সংবিধান। আমাদের জন্য আছে মুক্ত আকাশ। মাঠ ভরা ফসল। বিস্তৃত সবুজ। পাহাড়, নদী। আমরা জন্ম থেকেই এসব পাওয়ার অধিকারী হয়েছি। আমাদের চারদিকে সবই আছে। এখন আমাদের বড়ো হয়ে ওঠার সাধনা করতে হবে। আমরা তোমার জন্মদিনে এই সাধনার শপথ গ্রহণ করি বঙ্গবন্ধু। আমরাও চাই তোমার মতো সাহসী মানুষ হব। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াব। দেশকে ভালোবাসব। আমরা তোমারই মতো হয়ে গড়ে উঠব বঙ্গবন্ধু।

আমরা তো জানি আধুনিক বিশ্বে সব ক্ষেত্রেই আছে প্রতিযোগিতা। আছে অর্থনীতির প্রতিযোগিতা, শিল্পের প্রতিযোগিতা, শিক্ষার প্রতিযোগিতা, জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, ক্রীড়ার প্রতিযোগিতা। সবার উপরে আছে মেধা-মনন ও সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় আমাদেরকে অংশ নিতে হবে। নিজেদেরকে পিছিয়ে রাখা চলবে না। প্রতিযোগিতায় জয় আছে, পরাজায় নেই। পরাজয়ের অর্থ আমরা বদলে দিয়েছি। আমাদের কাছে পরাজয়ের অর্থ চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা। যারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় না তারা পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়ে। আমরা পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়ে হব না। পরাজয়কে স্বপ্নের জায়গায় নিয়ে যাব। স্বপ্নকে বুকে নিয়ে এগিয়ে গেলে জয় আমাদের হাতের মুঠোয় এসে যাবে। আমরা জীবনভর বড়ো মানুষ হওয়ার সাধনায় থাকব বঙ্গবন্ধু।

আমরা আজকের শিশু। আগামী দিনের পরিণত মানুষ হব। আমাদেরকে নিতে হবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশের মুখ উজ্জ্বল করব আমরা। নানাভাবেই তা করা যায়। আমাদের বড়ো ভাইয়েরা ক্রিকেটে বিশ্ব জয় করে জন্মভূমির গৌরব ছড়িয়ে দিয়েছে দেশে দেশে। আমাদের বিজ্ঞানীরা বিশ্বের গবেষণা কাজে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন দেশে। তাঁরা গৌরবের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে দেশকে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে লেখাপড়া করছে। ভালো রেজাল্ট করছে। অনেক দেশের ছেলেমেয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভালো ফল করছে। আমাদের আপুরা হিমালয়ের চূড়ায় উঠেছে। ভাইয়ারাও পর্বতের চূড়ায় উঠেছে। তোমার দেশের সোনার ছেলেমেয়েরা যখন ভিন্ন দেশের মাটিতে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেয় তখন বসন্ত বাতাস সে দেশের মানুষের হাসি নিয়ে তাকিয়ে দেখে জ্বলজ্বল করছে তোমার নাম। বঙ্গবন্ধু তুমি আমাদের এভাবে নিয়ে যাও দূর থেকে দূরে। আমাদের কানে বিপুল শব্দে বাজে তোমার বজ্রকণ্ঠ। ‘আমরা করব জয়’-আমাদের এই জয়ের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন তোমার দেশের চারদিকে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধু। তুমি আমাদের মাথার ওপর হাত রাখো।

আমরা শুনেছি ১৯৭৫ সালের ১৭ই মার্চ তোমার শেষ জন্মদিন পালিত হয়েছিল। তুমি অনেকটা সময় আমাদের মতো শিশুদের সঙ্গে কাটিয়েছিলে। সবাইকে বলেছিলে, তোমরা খেলো, দৌড়াও। গণভবনের মাঠ আজ তোমাদের, যা খুশি করার জন্য খোলা। শুধু তোমরা গাছের ডাল ভাঙবে না, ফুল ছিঁড়বে না। ঠিক তো? তোমাদেরকে নিজেদের পরিবেশ রক্ষা করা শিখতে হবে। আমরা গাছ নষ্ট করব না বঙ্গবন্ধু। সেদিন ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিল। তারপর কচিকাঁচার মেলা, খেলাঘর, স্কাউটস ও গার্ল গাইডের প্রায় সাত-আটশ ভাইবোন সেদিন গণভবনে তোমার জন্মদিন সাজিয়ে তুলেছিল। তোমাকে কাছে পেয়ে ওদের খুশির সীমা ছিল না। সেদিন তুমি গাড়ি থেকে নামতেই কচিকাঁচার মেলার ভাইবোনেরা গেয়েছিল গান। তোমার জীবনী পড়ে আমরা জেনেছি তোমার কৈশোরে তুমি ব্রতচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলে। তোমার জন্মদিনের দিন ভাইবোনেরা ব্রতচারী আন্দোলনের একটি গান গেয়েছিল : ‘সবার প্রিয় সকলের আদরণীয়/সকল কাজে বরণীয়/প্রভুএই মিনতি, দীর্ঘজীবন তারে দিও/সফল জীবন তারে দিও।’ সেই সময়ে আমাদের ছোটো বন্ধুরা তোমার দীর্ঘজীবনের প্রার্থনা করেছিল গানে গানে। বঙ্গবন্ধু আমাদের সামনে তুমি তো দীর্ঘজীবনেরই মানুষ। তোমার শারীরিক মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু সেই মৃত্যুর বিপরীতে তোমার হাজার বছরের বেঁচে থাকা আছে বঙ্গবন্ধু।

তুমি বলেছিলে, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ পাকিস্তান কারাগারে তুমি দেখেছিলে তোমার কবর খোঁড়া হচ্ছে। তুমি ওদেরকে বলেছিলে, আমার লাশ আমার দেশে পাঠিয়ে দিও। এমনই নির্ভয় ছিল তোমার বেঁচে থাকার সত্য। এভাবেই তুমি আমাদের আদর্শের জায়গা ঠিক করে দিয়েছ বঙ্গবন্ধু। আমরা ভুলে যাই না যে, মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য আমাদের লড়াই আছে। তুমিই তো প্রথম বাঙালি যিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করেছিলে। আমরা ভুলে যাই না যে, আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই আছে। স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব আছে। তুমিই তো বজ্রকণ্ঠে দেশের মানুষকে বলেছিলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তুমিই তো সেই নেতা যিনি দেশের মানুষকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়তে বলেছিলে। পাকিস্তান সরকারের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলে, ‘সাতকোটি বাঙালিরে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এইসব বাণী আমারে সামনে তোমার তর্জনির মতো উঁচু হয়ে থাকে। বাংলার সব ধর্মবিশ্বাসী শিশু তোমার সেই কথা মনে রাখবে। তুমি বলেছিলে, ‘বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন, তারা সকলেই এ দেশের নাগরিক। সকল ক্ষেত্রে তারা সমঅধিকার ভোগ করবেন।’

আমরা জানি ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তুমি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলে। সেদিন তুমি তোমার ভাষণে বলেছিলে, ‘আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু, মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’

রমনা রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ভাষণে তোমার বজ্রকণ্ঠ আবার পৌছে দিয়েছিল মানুষের হৃদয়ে । বঙ্গবন্ধু মানুষকে এত শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় দেখার মতো মনের সাহস সবার থাকে না। তুমি এক অসাধারণ মানুষ। তোমার মতো বুঝে ওঠার মানুষ আমরাও হতে চাই।

তুমি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সেবা দেয়ার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলে। ১৯৭২ সালের ২৪শে মে বাংলাদেশ বিমানে কবিকে ঢাকায় আনা হয়। সরকারের নির্দেশে কবির চিকিৎসার তদারকীর জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। তিনি তো সেই অমর কবি যিনি লিখেছিলেন : ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’। আমাদেরকে মাথা উঁচু রাখার এই ধারণা যে কবি তাঁর কবিতায় লিখে রাখেন তাঁকে তুমি যে সম্মান দিয়েছ তা আমাদের অহংকার।

তোমার রেখে যাওয়া কাজগুলো এখন আমাদের ভালোবাসার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের দায়িত্বে করে যাচ্ছেন। আমরা তাঁর হাত ধরে পথে হেঁটে যাই। তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ গ্লানিমুক্ত করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করার জন্য ট্রাইবুনাল গঠন করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে তাদের বিচারের রায় হয়েছে। রায় কার্যকর হয়েছে। তিনি আমাদেরকে মর্যাদার জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা মাথা তুলে হেঁটে যাব পৃথিবীর পথে। বলব, আমরা দেশের মাটি কলঙ্কমুক্ত করেছি। আমরা বীর জাতি। আমরা সব পারি।

বঙ্গবন্ধু এই সময়ের শিশুরা এমন ধারণা নিয়েই বড়ো হবে। ওরা অনবরত বলবে সবার উপরে মানুষ সত্য। ওরা মানুষের অধিকার বুঝতে শিখবে। ওরা শিখবে মনুষ্যত্ববোধের ধারণাই মানুষের সবচেয়ে বড়ো ধারণা। মানুষ ধনী হতে পারে, গরিব হতে পারে কিন্তু মানুষ সমাজের নানা পেশার কারণে কখনোই নীচু শ্রেণির মানুষ হবে না। তার মানবিক মর্যাদার জায়গা উন্নত থাকবে। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা নিজেদেরকে তৈরি করছি বঙ্গবন্ধু।

২০১৫ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ, এবং আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি তাঁর পুরস্কার দেশের মানুষকে উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের আশা আমরা এই অর্জনকে অনেক দূরে নিয়ে যাব-সেখানে ধ্বনিত হবে তাঁর কণ্ঠস্বর। আমরা আমাদেরকে বলতে চাই তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা নন। তিনি এই মাটির সন্তান। শিশুদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। শিশুদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্ম-পরিকল্পনা দেশজুড়ে চলছে। তিনি আমাদের মাথার ওপর ছায়া। তুমিও তো বঙ্গবন্ধু শিশুদের শিক্ষার জন্য ৩৭ হাজার প্রাইমারি স্কুলকে সরকারি স্কুলে পরিণত করেছিলে। শিশুদের জন্য আইন করেছিলে। তুমি বিশ্বাস করতে ‘মানবজাতির সর্বোত্তম যা কিছু দেয়ার আছে, শিশুরাই তা পাওয়ার যোগ্য।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অসংখ্য শিশু বাবা-মা হারিয়ে অনাথ ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। ১৯২৪ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘লীগ অব নেশনস্’-এর কনভেনশনে ঘোষণা করা হয়েছিল সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য এমন অসাধারণ উক্তি। তুমি গভীর চিন্তায় এই উক্তিকে তোমার দেশের শিশুদের জন্য কাজে লাগিয়েছিলে।তোমার মৃত্যুর কত বছর পেরিয়ে গেল বঙ্গবন্ধু।

মার্চ মাস এলে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প। এই গল্প শুনে আমরা বড়ো হচ্ছি বঙ্গবন্ধু।আমাদের ইতিহাসে ৭ই মার্চ আছে। তোমার জন্মদিনের ১৭ই মার্চ আছে। ২৫শে মার্চের গণহত্যা আছে। এই দিন বীর বাঙালির যোদ্ধা হওয়ার সূচনার দিন। ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা দিবস আছে। তোমার জন্মদিন স্বাধীনতার ইতিহাসে মিশে থাকে। তাছাড়া ঋতুরাজ বসন্তের এই সময়ে তোমার জন্মদিন বঙ্গবন্ধু। বসন্তের বাতাস তোমার জন্মদিনের সৌরভ ছড়ায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *