ছোটগল্প।। বুনোফুলের ঘ্রাণ।। কানিজ পারিজাত

ব্যাপারটি খুব দ্রুত ঘটে গেল। এত তাড়াতাড়ি বিষয়টি সামনে আসবে আজমল সাহেব ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। তবু বুকের ভেতর ছাইচাপা হয়ে থাকা ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুন অবশেষে নিভতে যাচ্ছে। কান থেকে মুঠোফোনটি নামিয়ে রেখে আড়চোখে তাকালেন রেহানার দিকে। তারপর একটু ধীরে ধীরে বললেন,

─কাল একটু ঢাকার বাইরে যেতে হবে। একটা ভিজিট আছে। দুদিনের ট্যুর।

শুনেও শোনেনি এমন ভাব দেখিয়ে খানিক বিরক্তমুখে রেহানা হাতে থাকা পানিরগ্লাস শব্দ করে টেবিলে নামিয়ে রেখে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। আজমল সাহেব ড্রয়িং রুমের সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে গেলেন। সোজা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সমস্ত শরীর কী এক অজানা রোমাঞ্চে শিহরিত, শিরায় শিরায় কিসের এক টান। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে চাপা উত্তেজনার রেশ খানিকটা সয়ে এলে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন। মেদহীন পেটানো শরীর তার। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই করলেও তাকে এখনো অনায়াসে চল্লিশ বলে পার করে দেওয়া যায়। শার্টের দুটি বোতাম বুকের কাছে একটু আলগা করে দিলেন। কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। খুব ভোরে ট্রেন। ঢাকা থেকে সিলেট। রাতে আর কিছু খেলেন না আজমল সাহেব। রেহানা শুধু বিরক্তমুখে একবার এসে বলে গেল,

─খাবে না সেটা আগে বললেই হতো। অহেতুক আমাদের সময় নষ্ট হয়।

কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়লেন আজমল সাহেব। আজ কোনো কিছুতেই মন ভার করা চলবে না। সামনে তার ভরা পদ্মা, তিনি তুখোড় সাঁতারু। সাঁতার কাটবেন, প্রাণভরে সাঁতার কাটবেন তিনি।

দুই.

একটি ফার্স্টক্লাস কেবিনের মুখোমুখি সিটে বসে আছেন আজমল সাহেব ও মোরশেদ আলম নামের অতি মোসাহেবি স্বভাবের লোকটি।

─স্যার, সব ধরনের ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমি নিজে স্যার… আমি নিজে গিয়ে পুরো জায়গা ভিজিট করে এসেছি। আপনার এত

ভালো লাগবে─ ‘স্যার, কী বলব!’

‘ভালো লাগবে’ এই কথাটি বারবার বেশ জোর দিয়ে বলছে লোকটি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে─ সারি সারি গাছপালা যেন সরে সরে যাচ্ছে। ট্রেন চলছে ঝিক্ঝিক্ ঝিক্ঝিক্ ঝিক্ঝিক্─ আজমল সাহেব নিজের বুকের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন ধুকপুক ধুকপুক ধুকপুক। ট্রেন চলছে ধীরগতিতে, জানালা দিয়ে বেশ ঠান্ডা অথচ মিষ্টি বাতাস এসে লাগছে গায়ে। ট্রেন যেমন মসৃণ গতিতে চলছে তেমন মসৃণ অবশ্য ছিল না আজমল সাহেবের জীবন। প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে, তিনি অবশ্য সফল হয়েছেন। একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার তিনি; আর দু’বছর পরে রিটায়ারমেন্টে যাবেন। লাভ-লোকসানের হিসাব বুঝলেও জীবনের হিসাব সঠিক বুঝে উঠতে পারেননি আজমল সাহেব। প্রথম দেখাতেই রেহানাকে বেশ ভালো লেগেছিল। ব্যবসায়ী বাবার আধুনিক মেয়ে।

কচি-কোমল ছিপছিপে শরীর─ ভালো লাগার মতোই। কিন্তু পার্থিব সব প্রাপ্তির আড়ালেও অপার্থিব কোনো অপ্রাপ্তির হাহাকার থেকে যায়─ তা সেদিনের পঁচিশ বছরের টগবগে আজমল বুঝে ওঠেননি।

সময় গড়িয়েছে। শাড়ি-গহনা আর আসবাবের ওজন মাপতে থাকা রেহানা দুটি সন্তানের জন্ম দিয়ে মুগ্ধতার খাতায় ইস্তফা নিয়েছে। মানসিক অপূর্ণতা─ এই বিষয়টি বুঝতে আজমল সাহেবের বেশ দেরি হয়ে যায়। আর রেহানাÑ আজমল সাহেবের তল খুঁজে না পেয়ে সুতো মজবুত করতে গিয়ে গিঁট শুধু শক্ত করে বেঁধেই গেছে সারা জীবন; সুতো যে গোড়া থেকেই আলগা হয়ে আছে তা বুঝে উঠতে পারেনি কোনোদিন।

তিন.

─স্যার, হটপটে খাবার আছে─ আমার ওয়াইফ পারভীন─ স্যার, নিজের হাতে আপনার জন্য বানিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘স্যারের খিদে লাগলে দেবে।’

তৈলাক্ত মুখে কথাগুলো একশ্বাসে বলে মোরশেদ আলম। আজমল সাহেব মোরশেদ আলমের কথায় নিরুত্তর থাকেন। ভেতরে ভেতরে কেমন এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। এক ধরনের চাপা উত্তেজনা আবার এক ধরনের শূন্যতার বোধ─ সব মিলিয়ে  অদ্ভুত রকমের মিশ্র এক অনুভ‚তি। চোখ বন্ধ করে ঠান্ডা বাতাস গায়ে মাখতে ভালো লাগছে তার। রেহানার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বাবা যুবক আজমলকে দেখে ঠিকই বুঝেছিলেন, তার মেয়ে অপূর্ণ থাকবে না, থাকেওনি। কিন্তু আজমল সাহেব তখনো বোঝেননি একটি বিশেষ অপূর্ণতা সম্পর্কে। সব কিছু পূরণ হওয়ার পরও অপার্থিব অজেয় কোনোকিছু মানুষকে অপূর্ণ করে রাখে আর তা হলো─ ‘মানসিক শূন্যতার বো’। এই ‘শূন্যতার বোধই’ ধীরে ধীরে যেন গ্রাস করেছে তাকে।

দুপুর নাগাদ ট্রেন এসে থামল সিলেট স্টেশনে। মোরশেদ আলম সব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল। গাড়ি ও ড্রাইভার আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে মোরশেদ আলম যথানিয়মে নানারকম তৈলাক্ত কথা বলে যাচ্ছে।

─বেশি দূরে নয় স্যার, মাত্র চল্লিশ মিনিটেই পৌঁছে যাব। ওখানে আগে থাকতেই বলা আছে। আজমল সাহেব পেছনের সিটে, মাথাটা একটু পেছনের দিকে হেলান দিলেন। বন্ধু লিয়াকত, রায়হান, মুহিত─ এরা প্রায়শই ঢাকার বাইরে ভিজিটে যায়। তিনি এবারই প্রথম─ বন্ধু লিয়াকতই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। সব ব্যবস্থা করে নিজেই কাল মুঠোফোনে আজমল সাহেবকে নিশ্চিত করেছে। সামনের লোকটি এখনো কথা বলে যাচ্ছে। সারমর্ম একটাই─ সামনের পি.ও. [প্রিন্সিপাল অফিসার] ফিট লিস্টে যেন তার নামটা থাকে। আজমল সাহেব কান বন্ধ করে রেখেছেন। গড়ানো দুপুরের একটু কম ঝাঁজের রোদ তার গালে এসে পড়ছে। চলন্ত গাড়িতে তার গালে এক অদ্ভুত আলো-ছায়ার খেলা। আবারও শরীরের ভেতর কেমন টানটান উত্তেজনা। শিরায় শিরায় কী এক অদ্ভুত শিহরণ ! গাড়ি ছুটে চলেছে─ ছুটে চলেছেন আজমল সাহেব─ পাহাড়,পর্বত, উপত্যকা ডিঙিয়ে─ দুরন্ত ছুটে চলা এক টাট্টু ঘোড়া যেন তিনি।

চার.

গাড়ি এসে সোজা থামল এক অপূর্ব সুন্দর কটেজে। সত্যিই বন্ধু লিয়াকত মিথ্যে বলেনি। পাহাড়ি টিলার খাঁজে একটু ঢালুর দিকে ছোট্ট কটেজ। গেট থেকে কাঁকর বিছানো পথ। পথের দুই পাশ সেজে উঠেছে নানাগাছের শোভায়। একদম দক্ষিণে কটেজের পেছন দিকে বাঁধানো ঘাটসহ ছোট্ট জলাশয়। সব মিলিয়ে নিখুঁত পরিপাটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা ছোট্ট কটেজ। বন্ধু লিয়াকত ও অন্যরা এদিকে ভিজিটে এলে এই কটেজেই ওঠে। আজমল সাহেবের হালকা ক্লান্তি থাকলেও চাপা উত্তেজনার রেশে তা যেন চাপা পড়ে গেছে। বাথটাবে হালকা গরম জলে গোসল সেরে নেন তিনি। একটি ব্লু কালার টি-শার্টের সাথে অফহোয়াইট রঙের প্যান্ট পরেন─ বেশ ঝরঝরে লাগছে। দুপুরের খাবার প্রস্তুত ছিল। মোরশেদ আলম লোকটি সত্যিই করিৎকর্মা। কেয়ারটেকার ফজলুকে সাথে নিয়ে বিশাল আয়োজন করে ফেলেছে─ দেশি চিতল, পাবদার ঝোল, ঝাল-ঝাল বন মোরগের মাংস, আখনি, ছোট মাছ, সবজির বড়া, সাদা ভাতের সাথে সাতকড়ার আচার, সব মিলিয়ে চমৎকার আয়োজন। একটু কম খাওয়ার অভ্যেস আজমল সাহেবের। সবকিছু থেকে হালকা করে ছুঁয়ে গেলেন যেন। খানিক বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আজমল সাহেব কটেজটি ঘুরে দেখতে বের হলেন। পায়ের নিচের কাঁকর বিছানো পথ, ঘাসের ভেতর ফুটে থাকা একরকম হলুদ হলুদ বুনো ফুল, কটেজের পেছন দিকে বেশ কিছু আমগাছ, আমের মুকুল ফুটে কিছুডালে কচি কচি আমের থোকা─ আজমল সাহেবের নাকে যেন পুরনো চেনা এক গন্ধ এসে লাগছে। অদ্ভুত বুনো বুনো মিষ্টি একটা গন্ধ। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এসে থমকে দাঁড়ালেন─ গাছে নিচে কৃষ্ণচ‚ড়ার লাল পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হঠাৎ যেন বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া এক চেনা দৃশ্য মনে পড়ে গেল─

এক কিশোরীর মাথায় কৃষ্ণচূড়ার ফুলসহ গুঁজে থাকা ডাল, কোঁচড়ে কুড়িয়ে পাওয়া কয়টি কচি আম─ ভাসা ভাসা চোখের মিষ্টি মুখের মেয়ে আমেনা। তার গায়ে ছিল মিষ্টি বুনো ফুলের ঘ্রাণ। সারাদিন একসাথে বেড়াতেন─  ডিঙি নৌকায় মাছ ধরা, শাপলা তোলা, পুকুরের জলে ঝাঁপ দেওয়া, গাছ ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বড়ই পাড়া, সব কাজের সঙ্গী আমেনা─ ধীরে ধীরে কেমন করে তার মনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল ! আজমল সাহেব ধীর পায়ে কটেজে ফিরে গেলেন। বুনো ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ যেন তার নাকে লেগে রইল।

পাঁচ.

বিকেল গড়িয়ে এলে মোরশেদ আলমের সাথে আনা কিছু দাপ্তরিক ফাইলের কাজ দেখলেন আজমল সাহেব। কাজের শেষে শশব্যস্ত লোকটি বেশ আর্দ্র গলায় জানাল,
─স্যার, কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে।
আজমল সাহেব চুপ করে নিজের কামরায় গেলেন। অফিশিয়াল যেকোনো অ্যানুয়াল স্পোর্টসে তিনিই চ্যাম্পিয়ন হন─ ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ব্যাডমিন্টন। গ্রামের ছেলে ছিলেন─ দুরন্ত, ডানপিটে। খেলাধুলায় পারদর্শী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন দক্ষ সাঁতারু। এ বয়সেও তার পেটানো শরীর দেখে যেমন বিপরীত মেরুতে থাকা কেউ কেউ মোহাবিষ্ট হয়, তেমনি জীবনের পড়ন্ত বিকেলেও তার ফিটনেস দেখে কিঞ্চিৎ ঈর্ষান্বিত হন বন্ধু-সহকর্মীরাও। আজমল সাহেব আবারও যেন শৈশবে ফিরে গেলেন─ একটি ঘরের বারান্দায় খুঁটির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো ছিপছিপে আমেনা, হাতের তেলো বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া ঝোলাগুড় চেটে চেটে পরম তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে─ উঠোন থেকে পেছন ফিরে দাঁড়ানো আমেনার দিকে নিরিখ যায় আজমলের। এক দৌড়ে আমেনাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার। ছুঁয়েও দেন─ কিন্তু ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যাওয়া আমেনা ব্যথাতুর চোখে আজমলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
─আজু ভাই, এইডা কী করলা?
তার হাতের গুড় তখন ধুলোয় মাখামাখি। খেলায় জয়ী হতে গিয়েও যেন পরাজিত হয় আজমল। অপরাধীর চোখে তাকিয়ে ফিক্ করে হাসার চেষ্টা করে─ আমেনা ততক্ষণে মন খারাপ করে বাড়ির পথ ধরে। এর দুই ঘণ্টা পরে আমেনাদের বাড়ির উঠোনে আজমল─ হাতে এক হাঁড়ি ঝোলাগুড়; আমেনার জন্য। চার চারটে ঝুনা নারকেলের বিনিময়ে জোগাড় করেছে গুড় বিক্রেতা ফতে খাঁর বাড়ি থেকে। খুট করে শব্দ হয় দরজায়─ ভাবনায় ছেদ পড়ে আজমল সাহেবের।
কেয়ারটেকার ফজলুর হাতে ট্রেতে সাজানো সবুজরঙা বোতল, সঙ্গে বরফের টুকরো, ঘিয়েভাজা মুড়ি, চিপস , চিকেনফ্রাই,
ফিশফ্রাই। মোরশেদ আলম পাঠিয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছ; আজমল সাহেবের বুকের ভেতর যেন ঘণ্টা বাজছে দ্রিম্ দ্রিম্ দ্রিম্। বোতলটির দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে যান তিনি─ খুব একটা আকর্ষণ নেই তার এসবে─ শুধু বন্ধু মহলে কখনো কখনো অল্প ছুঁয়েছেন। কিছুদিন ধরেই লিয়াকত তাকে উৎসাহ দিচ্ছিল─ তিনিও যেন ক্ষণিক মুক্তির স্বাদ পেতে চেয়েছিলেন। এত তাড়াতাড়ি লিয়াকত ব্যবস্থা করবে ভাবেননি। সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে, আজমল সাহেবের বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। সময় যত গড়াচ্ছে উত্তেজনায় বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে তার।

ছয়.

সন্ধ্যার একটু পরেই দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। মোরশেদ আলমের পেছনে আড়ষ্ট পায়ে যে ঘরে ঢুকল─ সে পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের একটি মেয়ে। গায়ের রং হালকা শ্যামবর্ণ, অনেকটা ছাইরঙা কবুতরের মতো মসৃণ। পুরু ঠোঁট, চ্যাপ্টা কিন্তু টিকালো ও আকর্ষণীয় একটা নাক। চুল পেছনে পরিপাটি করে টেনে বাঁধা, ছোট কিন্তু মায়াময় দুটি চোখ। মোরশেদ আলম নিঃশব্দে চলে গেল, যাওয়ার সময় দরজা টেনে দিতে ভুলল না। মেয়েটি ও আজমল সাহেবের মধ্যে দূরত্ব মাত্র এক কি দুই হাত। ঠিক কীভাবে শুরু করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না আজমল সাহেব। মেয়েটির পরনে জংলি ছাপা শাড়ি, পায়ে হাওয়াই স্যান্ডেল। নিচের দিকে তাকিয়ে মেঝেতে আঙুল ঘষছে সে। আজমল সাহেব সহজ হওয়ার জন্য কথা বলার চেষ্টা করলেন,
─আপনার নাম? পরিষ্কার বোঝা না যাওয়ায় গলা খাঁকারি দিয়ে আবার বললেন,
─তোমার নাম?
মেয়েটি যেন একটু সহজ হলো─ শান্তভাবে উত্তর দিল,
─রমিছা।

বেশ কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। জীবনে কখনো এমন মুহূর্ত আসবে তা ভাবেননি আজমল সাহেব ; তার হঠাৎ মনে পড়ল─ এমন কত রাত তিনি রেহানার দরজায় গিয়েছেন, টিমটিমে মৃদু আলোয় অনাগ্রহী ও বিরক্ত রেহানার মুখের দিকে তাকিয়ে অব্যক্ত এক হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছেন। মেয়েটি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আজমল সাহেব কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নিজের ওপর রাগ হতে লাগল─ বন্ধু লিয়াকত, মুহিত ওরা শুনলে কী বলবে? ভরা পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন─ এত ভালো সাঁতারু তিনি─
অথচ ঝাঁপ দিতে পারছেন না!
এবার একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করলেন যেন─ জিজ্ঞেস করলেন,
─কিছু খাবে?
ঘাড় নেড়ে সায় দিল মেয়েটি। আজমল সাহেব ট্রে থেকে খাবারের বাটিগুলো এগিয়ে দিলেন। মেয়েটি মেঝেতে বসতে যাচ্ছিল─
ইশারায় তাকে বিছানায় বসতে ঈঙ্গিত দিলেন তিনি। মেয়েটি খাচ্ছে গোগ্রাসে─ ঘিয়েভাজা মুড়ি খাচ্ছে─ পরম তৃপ্তি নিয়ে। বোঝা গেল বেশ ক্ষুধার্ত সে। আজমল সাহেবের কী যেন মনে পড়ে গেল─ মেয়েটির সাথে আমেনার কোথায় যেন মিল ! অল্প দূরত্বে বসে তিনি মেয়েটির গায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছেন─ কেমন এক ধরনের বুনোফুলের মতো। যেমনটা থাকত আমেনার গায়ে। কেমন যেন লাগছে তার─ এক অদ্ভুত অস্বস্তি। এতদিন পর বারেবারে আমেনার কথা মনে পড়ছে কেন তার ? সেই আমেনা─ যার এক সন্ধ্যায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ধান-চালের আড়তের মালিক ঈমান আলীর সঙ্গে। আজমলের জন্য আমেনার বুকভাঙা কান্না দেখে আমেনার পিঠে দুই-চার ঘা বসিয়ে দিয়েছিল বাড়ির লোকেরা। আর আমেনার বিয়ের আগে ছেলের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আজমলের মা ছেলের জন্য আমেনাকে চাইতে গিয়ে দারিদ্র্যের অপমানে অপমানিত হয়ে ফিরেছিলেন। বিয়ে হয়ে যায় আমেনার। আর তার কিছুদিন পরই গ্রাম ছাড়ে অভিমানী তরুণ আজমল─ দারিদ্র্যকে জয় করতে।
সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আজমল সাহেবের। মাথাটা কেমন ভার-ভার লাগছে। অস্বস্তি কাটাতে বিছানা থেকে উঠে টেবিলের দিকে যান তিনি। রঙিন বোতলের দিকে হাত বাড়ান। গলায় দুই ঢোক ঢালার পরে মাথার ভার ভাবটা যেন একটু কমে─
মাথাটা একটু হালকা হলো যেন। ঘাড় ঘুরাতেই যে-দৃশ্য দেখলেন তাতে তিনি ক্ষণিকের জন্য অসাড় হয়ে গেলেন। একটু একটু করে নিরাভরণ হচ্ছে মেয়েটি─ উদরপূর্তির কৃতজ্ঞতায় যেন নিজের সবটুকু দিয়ে পূরণ করবে, দয়াবান এই মানুষটির ভিন্ন ক্ষুধা। এক অদ্ভুত ঘোর তৈরি হচ্ছে আজমল সাহেবের─ বাইরে অন্ধকার রাত, চারপাশে সুনসান নীরবতা, জানালায় লুটেরা বাতাস, ঘরের মৃদু আলোয় তার সামনে দাঁড়ানো নিরাভরণ কষ্টিপাথরের এক নারীমূর্তি─ যেন ভরা পদ্মায় পূর্ণিমার জোয়ার। আবার শিহরণ! আজমল সাহেব যেন ভেতরে ভেতরে এক আদিম উল্লাসী মাদলের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। দেবেন─ ঝাঁপ দেবেন তিনি। প্রচন্ড দাপটে ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে বেড়াবেন ভরা পদ্মার এপার-ওপার। উদ্দাম নৃত্যে শান্ত করবেন পদ্মার উথাল পাথাল ঢেউ। কী এক আদিম শিহরণ! আজমল সাহেব এবার আরও একটু এগোলেন মেয়েটির দিকে। কাছে যেতেই বেশ নাড়া খেলেন যেন─ মেয়েটির গায়ে কয়েক জায়গায় দাগ─ পোড়া ক্ষতের মতো। প্রশ্ন করতেই মেয়েটি আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে আজমল সাহেবকে যে-কথাগুলো বলল
তার সারমর্ম হলো:
অভাবের সংসারে বড়ো হওয়া মেয়েটি চা-বাগানে কাজ করত। সেখানেই রঙ্গুর সাথে পরিচয় ও বিয়ে। জুয়াড়ি ছিল স্বামী─ মারধর করত। মারের সময় কয়েকবার গরম কয়লা চেপে ধরে পুড়িয়ে দিয়েছে। চোলাই মদসহ বিশেষ কিছুবিক্রির দায়ে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে নিরুদ্দেশ। কয়েক মাসের ছেলে শিশুকে নিয়ে রমিছা এখন বাপের বাড়ি─ বাপ বেঁচে নেই, অসুস্থ মায়ের কাছে ছেলে রেখে চা-বাগানে কাজ করেছে কিছুদিন। ছেলের শ্বাসের টান─ সব সময় ওষুধ-বদ্যি লাগে। তাছাড়া কাজও সবসময় পায় না─ পেট চালানোই দায় ! ছেলের ওষুধ জোগাড় করতে জীবন পার। অবশেষে মহাজন দামোদরের হাত হয়ে এই পথে। এর আগেও কয়েকবার এসেছে। বাবুরা খুশি হয়ে যা দিয়েছেন, তা দিয়ে ছেলের বদ্যি-পথ্যি জোগাড় করেছে সে।
আজমল সাহেব কানে কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না যেন। তার চোখ আটকে আছে রমিছার গলার নিচের পোড়া দাগে। বিয়ের পাঁচদিন পর বাপের বাড়িতে ফিরতি এসেছিল আমেনা। গালে, গলায়, পিঠে, কালশিটে মারের দাগ। শুভাকাক্সক্ষীদের মারফত ঈমান আলী জেনেছে আজমল সম্পর্কে─ তাই আমেনার জন্য এই উপহার। বাড়িতে আসার একদিন পরেই ভোরে আজমলের বাড়ির পেছনে জামগাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল সারাগায়ে মারের দাগসহ বর্ণহীন প্রাণহীন আমেনা। শূন্য দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া দেখেছিল তাকে রক্ষায় ব্যর্থ আজমল। উহ্ ! সবই কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আজমল সাহেবের। রমিছা বারবার আমেনা হয়ে যাচ্ছে। আজমল সাহেব এগোলেন, নিচু হয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকা শাড়ি তুলে মেয়েটির শরীর পরম মমতায় ঢেকে দিলেন।
মেয়েটির অবাক চাহনিমাখা দৃষ্টির উত্তরে মেয়েটিকে বিছানায় শোবার ইঙ্গিত দিয়ে নিজে সোফায় গিয়ে বসলেন। একটি বিদেশি চুরুট ধরালেন তিনি। অনেক দিন আগের এক বন্ধ দরজা খুলে গেছে যেন, বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করছে তার।

সাত.

দুদিনের ভিজিটের একদিনেই সমাপ্তি টানছেন আজমল সাহেব। মোরশেদ আলমকে জানিয়েছেন ব্যবস্থা করতে। ঢাকা ফিরবেন তিনি। অনেক কাজ বাকি আছে তার। রমিছা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, যেন অনেকদিন পর একটু শান্তি ও স্বস্তিতে ঘুমাচ্ছে মেয়েটি।
আজমল সাহেব বের হওয়ার কিছুক্ষণ আগে নাশতার টেবিলে মোরশেদ আলম আরও একটু তৈলাক্ত মুখে বলে,
─একটু কি ভেবে দেখবেন, স্যার ? আজ থেকে গেলে এর থেকেও ভালো ব্যবস্থা আছে, স্যার। ভ্রু কুঞ্চিত করে তার দিকে একবার তাকালেন আজমল সাহেব, তারপর একটু উঁচু গলায় বললেন,
─আপনি তো বোধহয় টাইপিস্ট হিসেবে ঢুকেছেন শুনেছি ; পি.ও. [প্রিন্সিপাল অফিসার] বা এস.পি.ও. [সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার]
পদে যেতে আপনাকে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি কিছু প্রশিক্ষণ কোর্স করতে হবে। এদিকের ব্যবস্থায় কম মনোযোগ দিয়ে নিজেকে ফিট করার ব্যবস্থায় একটু বেশি মনোযোগ দিন।
আজমল সাহেব হেঁটে যাচ্ছিলেন গাড়ির দিকে, পেছন থেকে দৌড়ে আসে রমিছা। হাতে বাড়িয়ে ধরা টাকা─ যা তিনি রেখে এসেছিলেন ঘুমন্ত রমিছার মাথার কাছে, রমিছার জন্য। রমিছার সরল কৃতজ্ঞ চোখে অকপট জিজ্ঞাসা,
─তু তো কিছু করিস লাই বাবু? ই পয়সা কিসের লাই?
পরম মমতায় রমিছার কাঁধে হাত রাখেন আজমল সাহেব,
─পয়সা তোমার ছেলের জন্য, ছেলের চিকিৎসা করাও। মনে করো আমি তোমার বন্ধু। খুব শিগ্গিরই তোমার─ তোমাদের জন্য ভালো কিছু করতে চাই। এসব কাজ আর তোমাকে করতে হবে না।
কথাগুলো বলে গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন আজমল সাহেব। পেছনে তাকালে দেখতেন─ রমিছার কৃতজ্ঞ চোখ দুটো অদ্ভুত মায়াজলে ভরে উঠেছে।
ফিরে চলেছেন আজমল সাহেব। বন্ধু লিয়াকতের প্রশ্নের উত্তরে কী বলবেন, তা এখনো ভাবেননি। সকালটা তার অদ্ভুত ভালো লাগছে─ সেই টানটান উত্তেজনা কিংবা হু-হু ভাব কোনোটিই এখন আর নেই। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে মনটা যেন ছেয়ে আছে।
জীবন ফুরিয়ে যায়নি ! অনেক কাজ এখনো বাকি আছে তার।
গাড়িতে ওঠার সময় পথের পাশের হলুদ হলুদ বুনোফুল দেখে আকৃষ্ট হলেন। একটু নিচু হয়ে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলেন বুনোফুলগুলোকে। গাড়ি ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে। আজমল সাহেবের নাকে চেনা এক ঘ্রাণ এসে লাগছে। বেশ মিষ্টি মিষ্টি থোকা থোকা বুনোফুলের ঘ্রাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *