প্রবন্ধ।। শিশুদের বই নির্বাচন: অভিভাবকদের করণীয়।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

মানুষের বিকাশের শুরু ভ্রণ অবস্থা থেকেই শুরু হলেও জন্মের পর থেকে বিভিন্ন মাইলস্টোন অতিক্রম করে বিকাশ ঘটতে থাকে। এই বিকাশকে দুটি দিক থেকে বিবেচনা করা হয়; যেমন- শরীরের বৃদ্ধি ও বুদ্ধির বা মানসিক বিকাশ। শারীরিক বৃদ্ধি যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি মানসিকও বিকাশও গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক বিকাশ বা বুদ্ধি বিকাশ না হলে মানুষ জড় পদার্থেরই নামান্তর। আর এই বুদ্ধির বিকাশ জন্মের পর থেকে শিশুর যত্ন, মিথস্ক্রিয়া এবং বিভিন্ন উপকরণের ওপর নির্ভর করে। শিশু বিকাশের জন্য জন্মের পর থেকে নানা রকম খেলনার গুরুত্ব রয়েছে এবং বিভিন্ন খেলনার মাধ্যমে শিশুদের মস্তিস্কের নিউরন সিস্টেম জোরালো হয় যা পরবর্তী সময় মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খেলনার পরেই শিশুকে যদি বুদ্ধিদীপ্ত শিশু গড়ে তুলতে হলে তাকে দিতে হবে মজার মজার ছবির বই। শিশুর তিন বয়স দুই বা তিন বছর হলেই তাকে ছবির বই দেওয়া প্রয়োজন। ওই বয়সে শিশুরা পড়তে পারবে না, কিন্তু বইয়ের ছবির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সে পারিপাশির্ক জগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করতে থাকবে যা ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি বা সিঁড়ি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে এখানেই অভিভাবকদের চিন্তা করতে হবে যে, কী ধরনের বই শিশুদের হাতে দিতে হবে? যেকোনো বই দিলেই শিশু বুদ্ধিদীপ্ত হওয়ার সিঁড়ি তৈরি হবে তা নয়। বই হতে হবে শিশুর বয়স উপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত। শিশুদের বয়স অনুযায়ী কী ধরনের বই হওয়া উচিত বা অভিভাবকদের কী ধরনের বই বাছাই করা উচিত তা নিয়ে আমরা এই নিবন্ধে আলোচনা করছি।   

                মানসিক বিকাশের জন্য তিন বছর বয়স থেকে ভালো শিশুদেরকে দেওয়া উচিত অনেকেই বলে থাকেন। প্রশ্ন হলো ভালো বই বলতে কী বুঝায়? আরও অনেকেই বলে থাকেন ভালো লেখকের বই দেওয়া উচিত। প্রশ্ন হলো ভালো লেখকের সব বইই কি সব শিশুদের উপযোগী? এর মাপকাঠি কী? ভালো বই ও ভালো লেখকের বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিশুর বয়স উপযোগী শিশুর পছন্দের বই দেওয়া উচিত। শিশুর জন্য ভালো বই বলতে আমরা তখনই বুঝবো যখন বইটি শিশুকে আনন্দ দেবে, বইটি পড়তে উৎসাহিত হবে বা আগ্রহী হবে, শিশুর বয়স উপযোগী হবে, তার মানসিক বিকাশের জন্য উপযোগী। শিশুর অপছন্দের বই না হলে ভালো বই বা ভালো লেখকের বই বলে কোনো লাভ নেই। অযথাই সময় ও অর্থ ব্যয় ছাড়া কিছুই নয়; শিশুর জীবনে কোনো কাজে আসবে না। শিশুদের বিকাশের কয়েকটি দিক অভিভাবকদের লক্ষ রাখা প্রয়োজন; যেমন- শারীরিক, ভাষা, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, আবেগীয়, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বিকাশ। এখানে যেহেতু বই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তাই শারীরিক বিষয়টি বাদ দিয়ে বাকিগুলোর প্রতি আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। লক্ষ করা যায় শারীরিক বিকাশ ছাড়া অন্যান্য বিকাশগুলো যদিও পারিবারিক ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সাধিত হওয়ার কথা তথাপি বইয়ের ভূমিকা ও প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন আসতে পারে কী ধরনের বই শিশুদের এসব বিকাশের জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে বা কোন বিষয়গুলো অভিভাবকদের বিবেচনা করা দরকার? এর উত্তর খুঁজতে শিশুদের বই বাছাইয়ের জন্য আমরা নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে পারি।

চিত্তাকর্ষক বা হৃদয়গ্রাহী (Subjective Appeal) বই 

                শিশুদের বই নির্বাচন করার পূর্বেই অভিভাবকদের প্রথমে তাদের বয়স বিবেচনা করতে হবে। কেননা, মানুষের একেক বয়সের রুচি, ধ্যান-ধারণা, অভিজ্ঞতা, পছন্দ ও উপলব্ধি একেক ধরনের হয়। নিজেকে প্রশ্ন করলেই এর উত্তর পাওয়া যায়? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, আপনার কোন বয়সে কী ধরনের বই ভালো লাগত? কোন ধরনের বই পড়তে আপনি আনন্দ পেতেন ও আগ্রহী হতেন? এর উত্তর পাওয়া যাবে যে, একেক বয়সে একেক ধরনের বই পড়ে আনন্দ পাওয়া যেত। এই উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতেই শিশুদের বই নির্বাচনের জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। 

                বই হতে হবে চিত্তাকর্ষক বা হৃদয়গ্রাহী। চিত্তাকর্ষক বা হৃদয়গ্রাহী বলতে কী বুঝব? কাদের জন্য চিত্তাকর্ষক বা হৃদয়গ্রাহী? শিশুদেরকে আকর্ষণ করে, তাদেরকে পড়তে আগ্রহী করে যেসব বই সেগুলোকেই এখানে চিত্তাকর্ষক বা হৃদয়গ্রাহী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ যেসব বই শিশুদের মনোজগতকে আকৃষ্ট করে বা শিশুদেরকে পড়ার জন্য আগ্রহ জাগায় এমন বই নির্বাচনই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হতে হবে। এর বিকল্প কখনই হতে পারে না। বড়দের পছন্দ কোনোভাবেই শিশুদের ওপর চালিয়ে দেওয়া যাবে না। অভিভাবকদের বা বড়দের পছন্দের চেয়ে শিশুদের পছন্দের বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আপোসহীন। তাই অভিভাবকদের উচিত হবে শিশুদের পছন্দের বই নির্বাচন করতে সাহায্য করা।

                অনেক অভিভাবক মনে করেন যে শিক্ষামূলক বা নন-ফিকশন তথ্যবহুল বই শিশুদের উপযোগী বই। এ কথা কার্যত অনেক ক্ষেত্রে অর্থহীন  এবং সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। শিক্ষামূলক বা তথ্যবহুল বই স্কুল-কলেজেই পড়ানো হয়, তাই অতিরিক্ত বই হিসেবে শিশুর পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য এবং বিকাশের জন্য “সর্বকর্ম সাধনের” বই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ ধরনের প্রবণতা পরিহার করে শিশুদের পছন্দের বই দিয়ে তাদের পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বড়দের বাছাই করা বই সব সময় খারাপ হবে তা নয়, তবে মনে রাখতে হবে শিশুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো বই দিলে ধীরে ধীরে শিশুর পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এক সময় তার পড়ার অভ্যাস চিরতরে বন্ধ হয়েও যেতে পারে। অনেক সময় যেসব শিশু বই পড়তে পছন্দ করে না বা বই পড়ার প্রতি যাদের আগ্রহ নেই তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয় ওরা পড়তে চায় না। কিন্তু সমস্যার স্বরূপ সন্ধান করলে দেখা যাবে যে, পড়ার প্রতি শিশুর পড়ার আগ্রহ না থাকা বা পড়তে না চাওয়ার পিছনে মূল কারণ হলো ছোট বয়স থেকে তাদের পছন্দমতো পড়তে দেওয়া হয় নি কিংবা পড়ার জন্য তাকে বইই দেওয়া হয়নি। এর মানে তাদের আনন্দ দিতে পারে এমন বই তারা কখনই পায় নি। এর কারণ হলো, অভিভাবক অসচেতন এবং বই পড়াকে গুরুত্বহীন মনে করে। অনেক মাবাবা আছে যারা শিশুদের স্কুলের নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো বই হাতে দিতে চায় না। পড়তে দিতে চায় না। এ ধরনের মানসিকতা ও অভ্যাস জ্ঞানের বিশ্বে কখনই কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই অভিজ্ঞতাই বেশি ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। পৃথিবীর উন্নত দেশের মানুষের সঙ্গে আমরা পাল্লা দিয়ে চলতে পারছি না প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। মনে রাখা দরকার যে, শিশুদের এমনভাবে প্রতিপালন করা উচিত যাতে তারা বই পড়ে এবং জীবনব্যাপী বই ভালোবাসে ও পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলে। যে অভ্যাসটি গড়ে তোলার জন্য শিশুর বয়স তিন বছর হলেই শুরু করার জন্য অভিভাবক বা মা-বাবাকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আর এই অভ্যাসের জন্য তাদের বই নির্বাচন করতে তাদের সন্তুষ্টি থাকবে, থাকবে আত্মতুষ্টির বিষয় থাকবে, তাদেরকে আগ্রহী করবে এমন বই নির্বাচন করে দিতে হবে।

                একটি প্রশ্ন আসতে পারে? শিশু কেন পড়তে পছন্দ করে না? এর উত্তর পাওয়া যাবে যদি অভিভাবককে একই প্রশ্ন করা হয়। যেসব বই আপনার কাছে পড়তে ভালো লাগে না সেসব বই কি আপনি পড়েন? অবশ্যই না। ঠিক এ কথা শিশুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি শিশুদেরকে চাপিয়ে দিয়ে পড়ার অভ্যাস করানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে সে চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই খেয়াল রাখতে হবে, যেসব বই শিশুদেরকে আত্মমগ্ন করবে, পড়তে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করবে সেসব বই তাদেরকে পড়তে দিতে হবে বা নির্বাচন করতে হবে। শিশুদেরকে আগ্রহী করে বা শিশুদের চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী কী থাকে তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। সাধারণত, শিশুদের উপযোগী প্রতিপাদ্য বিষয় (থিম) ও গল্পের ধরন, অলঙ্করণ, বইয়ের আকার, লেখার ধরন ইত্যাদি কয়েকটি বিষয় শিশুর বইয়ের জন্য বিবেচ্য বিষয়। একই সঙ্গে      শিশুদের বইয়ের বিকাশের বিষয়ও মূল্যায়ন করতে হবে। কিছু বাজে বইয়ের প্রতি শিশুদের প্রবণতা যা আমাদের মনের মধ্যে তাদের বিকাশের ধারণা রাখি, যে বইয়ে আত্মনিষ্ঠতার আকর্ষণ রয়েছে সেখানে আপনার পছন্দের ব্যাপারে অটুট থাকলে চলবে না। কিন্তু শিশুদের পড়ার জন্য উৎসাহ দেওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর, এখানেই সব চেয়ে বড় পাওয়া হলো শিশুরা কিছু পড়ে আনন্দ পাচ্ছে!

বয়স উপযোগী আকর্ষণীয় বিষয় (Attractive theme)

                বই নির্বাচনের পূর্বে শিশুর জন্য উপযোগী বা আকর্ষণীয় বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। আকর্ষণীয় বিষয় ছাড়া শিশু বই পড়তে আগ্রহী হবে না। শিশুদের বইয়ের জন্য ‘বিষয়’ বলতে কী বুঝায়? ‘বিষয়’ বলতে বুঝায় যা পাঠ করার সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু। ধরা যাক, কোনো বইয়ের শিরোনাম হলো বানর। এখন বানর দিয়ে কি বানরের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে, নাকি বানর দিয়ে কোনো গল্প তৈরি করা হয়েছে? সাধারণভাবে যদি বিজ্ঞানের বই হয় তাহলে বানরের বৈশিষ্ট্য বা বানরের আচরণ হবে। এখানে দেখার বিষয় শিশু কি বানরের বৈশিষ্ট্য বা আচরণ পছন্দ করে নাকি কোনো বানরের কোনো গল্প পছন্দ করে! গল্পের ভেতরের বিষয়বস্তুকেই এখানে প্রতিপাদ্য বিষয় বলা হয়েছে।

                উপরের হৃদয়গ্রাহী বইয়ের সঙ্গে আকর্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। অর্থাৎ হৃদয়গ্রাহী বই আকর্ষণীয় প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়। অর্থাৎ শিশুর পছন্দের বিষয় হলে সেই বইটি তাকে চুম্বকের মতো পড়ার জন্য আকর্ষণ করবে।

                একটি শিশুর অভিজ্ঞতার কিছু বিষয় একই বয়সের অন্য শিশুদের জন্য প্রযোজ্য হয় অনেকাংশে। তবে তা নির্ভর করে শিশু কোন পরিবেশি লালিতপালিত হচ্ছে তার ওপর। গ্রামের শিশুরা সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় হাঁসমুরগি, অন্যদিকে শহরের শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠে এমন কিছু দেখতে পায় না। তাই গ্রামের একই বয়সের শিশুদের জন্য একই অভিজ্ঞতার বিষয় অন্যশিশুদের জন্য প্রযোজ্য। একইভাবে বিভিন্ন দেশের শিশুদের জন্মের পর থেকে বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই শিশুদের জন্য নিজ নিজ দেশ ও সংস্কৃতির উপাদান রয়েছে এমন বই শিশুদের বেশি পছন্দ করবে। 

                বয়স অনুযায়ী শিশুরা কী করে, কী ভাবে, কী করতে পছন্দ করে সেসব বিষয় সেসব বিষয়ই শিশুর অভিজ্ঞতা এবং এমন বিষয়ের বই হলেও শিশুরা পছন্দ করবে? উদাহরণস্বরূপ, অনেক শিশু দুই বছরের মধ্যে মূল ভাষা ও ভাষার ধারণা অনুসন্ধান করে, বিভিন্ন উপায়ে নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ করে এবং একই সঙ্গে তার চারপাশের জগতের অনেক বস্তু চিনতে শিখে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা এক শিশু অন্য শিশুর সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। দুই/তিন বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের পছন্দের বিষয় তার চারপাশের কিংবা পরিচিত প্রাণী, বস্তু, গাছ, সংখ্যা, বর্ণমারা ইত্যাদি উপযোগী। এখানেও বলে রাখার দরকার, শিশুর সেবাযত্ন, খাওয়া-দাওয়া, বাসস্থানের পরিবেশ, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর বয়সের ক্ষেত্রে তারতম্য হতে পারে। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশের শিশুর জন্য তিন বছর গণ্য করা হলেও হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে সেখানে বয়সের কিছু তারতম্য থাকা খুব স্বাভাবিক। তবে এখানে বয়স অনুযায়ী সে আলোচনা করা হয়েছে সেটি আন্তর্জাতিক মানের ভিত্তিতে। 

                শিশু বড় হতে থাকে, পরিবর্তন হতে থাকে তার অভিজ্ঞতার, উপলব্ধি, ধ্যান-ধারণা, রুচি, আবেগ ও চিন্তার। এ কারণেই তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের জানার আগ্রহ বেড়ে যায়, তারা নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে বড়রা কী বলে? অনেক শিশু বাসা থেকে এটা সেটা নিচে ফেলে দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কাজটি ভালো না খারাপ হলো। মাবাবা কী বলে তা উপলব্ধি করতে চায়। অনেক শিশু কাগজ ছিঁড়ে, বই ছিঁড়ে, এটাসেটা নষ্ট করে। আবার একই বয়সের শিশুরা নিজেদের জিনিস যেমন বই, জুতো, পুতুল, খেলনা গুছিয়ে রাখে। এর মাধ্যমেও শিশুরা অভিজ্ঞতা অর্জন করে বুঝতে চায় তার চারপাশের পরিবেশ ও আপনজনদেরকে। তখন ওরা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আলোকে আরও বেশি শিখতে চায়, জানতে চায় পৃথিবীতে কীভাবে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে, ঘটনার পর কী হয় ইত্যাদি। যেসব শিশু অনুসিন্ধুৎসু ও কৌতূহীল তারা নানা রকম কাজে ব্যস্ত থাকে, কেবল ঘটনা ঘটাতে চায় আর বড়দেরকে প্রশ্ন করে। এর প্রতিটি কাজের পিছনেই কিন্তু তাদের শেখার আগ্রহ থেকে হয়। তাদের ইন্দ্রিয় ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, পিতামাতা, ভাইবোন ও বন্ধুদের মধ্যে সম্পর্ক খোঁজে, সমমর্মিতা অনুভব করে, মূল্যবোধ অনুসন্ধান করতে শিখে। আর তখনই যদি ছবির বইয়ের মাধ্যমে শিশুদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে জানার সুযোগ হয় তাহলে চিন্তার প্রসার ঘটবে, প্রশ্ন করতে শিখবে, বুঝতে চেষ্টা করবে এবং ক্রমাগতভাবে তাদের জ্ঞানের তৃষ্ণা বেড়ে আর এরকম তৃষ্ণা থেকেই শিশুর সামাজিক, জ্ঞানমূলক, ভাষা, আবেগীয়, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শেখার ভিত্তিটি জোরালোভাবে তৈরি হয়ে যায়। আরও একটি মজার ব্যাপার হলো, এই বয়সের শিশুদের জন্য যদি ‘নিজের দ্বারা করা’ এমন কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাহলে ওরা আরও বেশি আগ্রহী হবে এবং নিজেও ওই চরিত্রের সঙ্গে মিশে যায় বা ওই চরিত্রে মধ্যে নিজে খুঁজে আনন্দিত হয়। ওই বয়সের শিশুদের বইয়ের বিষয় তাহলে কী হবে? আগেই বলা হয়েছে তার অভিজ্ঞতা ও তার চারপাশের যা কিছু আছে তা নিয়ে ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে হবে। এখন একজন লেখককেই চিন্তা করে দেখতে হবে, ওই শিশুর চারপাশে প্রিয় জিনিস কী আছে? একটু ভেবে রাখা দরকার, ওই বয়সের মধ্যেই অনেক শিশু স্কুলে যাওয়া শুরু করে। তাই এখানে দুটি বিষয় ধর্তব্য, একটি যারা এ বয়সে স্কুলে যায় এবং যারা যায় না। লেখক হিসেবে চিন্তা করতে হবে আমি কার জন্য লিখছি। তবে প্রতিটি শিশুর জন্য পৃথক পৃথক গল্প লেখা সম্ভব নয় এবং গল্পকারের কাজও তাই নয়। কিন্তু সর্বজনীন বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। অভিভাবক হিসেবে চিন্তা করতে হবে, কোন বইটি ওর অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানানসই হয়।  

                পাঁচ বা পাঁচের পর বছরটি সবদেশের শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের জীবনের সবচেয়ে ভালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। অর্থাৎ স্কুলে যাওয়া, লেখাপড়াই তাদের মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে যদিও অবস্থাভেতে স্কুলের বয়স বিভিন্ন হয়ে থাকে তাই এখানে সরলীকরণ কিছুটা অসম্ভব। তবে অভিভাবক হিসেবে চিন্তা করতে তার চারপাশে কী ঘটছে? সেসব ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার বই নির্বাচন করলে ভালো হয। ছয় থেকে আট/নয় বছরের শিশুদের জন্য বয়স উপযোগী বিষয় সাধারণত স্কুলের বন্ধু ও শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক, পোষা প্রাণী, নৈতিক চরিত্র গঠন, পারিবারিক সম্পর্ক, শিশুতোষ খেলাধুলা ইত্যাদি।

                বয়সের এই স্তরে, অর্থাৎ দশ থেকে বারো বছর বয়সে-বলা যায় বাংলাদেশের শিক্ষা মানদন্ডে পঞ্চম শ্রেণি বা মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়। তখন শিশুদের পড়ার অভ্যাসও কিন্তু বদলে যায়। এই সময়ের বইপত্রে ছবির অংশ কমে যাবে এবং ভালো গল্প বা বিষয়ের বই বাছাই করে দিতে হবে। একই বইয়ে একাধিক গল্প যাকে চ্যাপ্টার বই বলা হয় সেসব বই বাছাই করা যেতে পারে। এই বয়সের গল্পে অবশ্যই বন্ধুত্ব, ভালো-মন্দের দ্ব›দ্ব, দুঃসাহিক অভিযাত্রা, বীরত্ব, নিজ সংস্কৃতি, মানবহিতৈষীমূলক গল্প শিশুদেরকে বেশি টানে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের মতো বীরত্বের ঘটনার বই শিশুদের জন্য বাছাই করা অত্যন্ত জরুরি। এখানে অভিভাবকের আরও একটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে যে, শিশুর পড়ার দক্ষতা কেমন। পড়ার দক্ষতা ভালো না হলে বই বিচেনার সময় চিন্তা করতে হবে বড় হরফের কম লেখার বই তাকে পড়তে দেয়া যাতে পড়ার সময় কোনো প্রকার চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে। পড়া হতে হবে শান্ত নদীর পানি সরল প্রবাহে বাধাহীনভাবে গড়িয়ে পড়ার মতো সাবলীল। যখন বয়স উপযোগী বিষয় হয়তো কোনো শিশুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়েছে, তবু মনে রাখতে হবে যে, খুব সাধারণভাবে বিশেষ বয়সের শিশুর তার নিজের আগ্রহ ও আনন্দের বিষয়টি পছন্দ করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *