শহীদ বুদ্ধিজীবী : আমাদের চেতনা ও আদর্শ ড. আবদুল আলীম তালুকদার

আমরা এমন এক সময়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদ্যাপন করছি, যখন সারাবিশ্বে করোনা মহামারীর (কোভিড-১৯) দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। যেসব রাষ্ট্র নিজেদেরকে মহাশক্তিশালী মনে করে থাকে, তারাও এই মহামারীর কবলে পড়ে রীতিমত বেসামাল হয়ে পড়ছে; পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। কিছুতেই মৃত্যু ও সংক্রমণ বৃদ্ধির ঠেকাতে পারছে না। এর সাথে আমাদের দেশে নতুন করে যোগ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। ‘কোনটি ভাস্কর্য আর কোনটি মূর্তি’ এ নিয়ে দেশব্যাপী চলছে পাল্টাপাল্টি বিতর্ক-বাহাছ ও মিটিং-মিছিল। ইদানীং পত্রিকান্তরে অরেকটি খবর গুরুত্বের সাথে চাউর হচ্ছে, তাহল- জামুকার ভাষ্যমতে, গেজেটভূক্ত প্রায় ৫৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার সব ধরনের তথ্য ফের যাচাই-বাছাই করা হবে। এবং প্রতি উপজেলায় ০৪ সদস্যবিশিষ্ট যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব মুক্তিযোদ্ধা ২০০২-২০১৪ সালে তালিকাভূক্ত হন। কিন্তু সেইসময় ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০০২’ অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। সন্দেহের তালিকায় থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধারা যাচাই কমিটির কাছে নিজেদের সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলে, তবেই গেজেট বহাল থাকবে। অন্যথায় গেজেটেড সনদ বাতিলের পাশাপাশি ভাতাও বন্ধ হয়ে যাবে। স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ায় এরকম একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আজও একটা সুরাহায় আসতে পারিনি; এটা জাতির জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়। যাহোক, এবার মূল আলোচনায় আসা যাক —

১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিবস। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে একটি স্মরণীয় ও কলঙ্কের দিন। যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বরকে আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করে থাকি। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরেই হানাদার বাহিনী তথা পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের এদেশীয় দোসরেরা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জ্ঞানীগুণী ও মুক্তবুদ্ধির অধিকারী সূর্যসন্তান তথা বুদ্ধিজীবী হত্যার ছক কষে। ৭১ এর ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বুঝতে পারে যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। তাই বাঙালি জাতি যাতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, এজন্য তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার পরিকল্পনা ও নীলনকশা প্রণয়ন করতে থাকে। সেই ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিজয়ের ঊষালগ্নে ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ হতে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবিদের বিভিন্ন বধ্য ভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়ের বাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্ত ও করা যায়নি, পাওয়া যায়নি বহু লাশ। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যা কাণ্ডের কথা স্মরণ করেই প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। নাগরিক কবি শামসুর রাহমান শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আজ এই ঘোর রক্ত গোধুলিতে দাঁড়িয়ে/ যারা আমার কলিজায় সেঁটে দিয়েছে/একখানা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ।’

কোনো জাতির অগ্রগতি ও উন্নতির পেছনে থাকে তাদের বুদ্ধিজীবিদের অবদান। জ্ঞান-মেধা-মননে এবং সংস্কৃতিতে উন্নত জাতি হিসেবে কাজ করেন বুদ্ধিজীবিরা। জাতি গঠনের কারিগর বলা হয় বুদ্ধিজীবিদের। জাতির সেই মেধাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল বর্বর পাকিস্তানিরা।

দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করার জন্য দেশের কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, চলচ্চিত্র শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পী, চিত্রশিল্পী সহ বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁদের ভূমিকা শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতার বিরুদ্ধে, পরবর্তীতে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন এবং ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে তাঁরা ছিলেন অনুপ্রেরণা দাতা। কেউ কেউ ছিলেন সামনের কাতারে। বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, অত্যাচারের বিষয় সাধারণ মানুষকে অবগত করেছিলেন তাঁরা। বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছিলো একথা সবাই জানতো। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সারণীর মাধ্যমে সে সত্যটা জনগণের সামনে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন। তারাই সর্বপ্রথম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটো স্বতন্ত্র অর্থনীতি চালুর কথা বলেছিলেন। বাঙালি সাংবাদিকরা তুলে ধরেছেন প্রতিটি আন্দোলনের খবর। সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাস, নাটক, গান লেখা ও শিল্পীদের মাধ্যমে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়ে গণতান্ত্রিক মৌলিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের প্রতি সচেতন করে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা কখনো স্বতন্ত্র, কখনো একই সঙ্গে করেছেন আন্দোলন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন বুদ্ধিজীবিরা।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী সম্মেলন। ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ব্যাপী এ সম্মেলনে বিশ্বের ২৪টি দেশের ১৫০ জনের মতো বুদ্ধিজীবী যোগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ব্যাপক সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রখ্যাত ফরাসী মনীষী আঁন্দ্রে মারোকে এই সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছিল। তিনি অপারগতার কথা জানিয়ে এক চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি এই মর্মে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর বয়স এখন সত্তরের ঊর্ধ্বে। এসময় প্যারিস থেকে বিমানে দিল্লী আসার ধকল সহ্য করার মতো যদি তাঁর শারীরিক সামর্থ্য থাকতো, তাহলে তিনি আরও কিছুদূর এগিয়ে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতেন। এতে অন্ততঃ এই বয়সেও তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতায় একটা নতুন অধ্যায় সংযোজিত হত।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে আশ্রয় নেয়া বুদ্ধিজীবিরা গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ — যার সভাপতি ছিলেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক (এ আর মল্লিক)। যিনি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তাঁকে সভাপতি এবং সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জহির রায়হানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ। বুদ্ধিজীবিদের সংগঠন মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেল গঠন করেন। বিশ্বের বুদ্ধিজীবিদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সরবরাহ ও বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদীয় দলের সাথে সাক্ষাৎ ও সাহায্যের আবেদন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য প্রদান, শরণার্থীদের উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁরা ভূমিকা রাখেন। শরণার্থী শিবির শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে পঞ্চাশোর্ধ স্কুল খুলে শরণার্থীদের বাচ্চাদের শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র — যা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের প্রেরণার উৎস ছিল। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন।

স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। তারা আরও মনে করেছিল যে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে তারা বসবাস করতে পারবে না। তাই পরিকল্পিত ভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের বুদ্ধিজীবিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অনেকে ভাগ্যবশত মৃত্যু এড়াতে পেরেছিলেন। পরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন কিংবা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বিদেশে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। দিল্লী ও কোলকাতার লেখক বুদ্ধিজীবিরাও সে সময় বাংলাদেশের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন।

পরিশেষে, আমাদের বুদ্ধিজীবিরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রগতির রূপকার। তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সৃজনশীল কর্মকান্ড, উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা জাতীয় অগ্রগতির সহায়ক। জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত দেশের বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ প্রদানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে ব্যাপক অবদান রাখেন। শহীদ বুদ্ধিজীবিদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে কল্যাণকর ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক সমাজ গড়তে পারলেই তাঁদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহ. অধ্যাপক, সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *