আতিদ তূর্যের কয়েকটি অণুগল্প

কান্না

চলন্ত বাসের মধ্যে হেল্পারের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।
—চাচামিয়া, ভাড়া পঞ্চাশ টাকাই দিতি হবে। আর দিতি না পারলি সামনের মোড়ে নাইমে যাবেন। আমার য্যানো এক কথা বারবার কওয়া না লাগে!
বুড়োর কম্পমান হাতে ধরা ছিলো মাত্র তিনটা দশ টাকার নোট এবং তিনি হেল্পারকে সজল চোখে কাঁকুতি মিনতি করছিলেন তার গরিবি হালের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাকে এইবারের মতো দয়া করতে। তরুণ হেল্পারের মন গললো না বৃদ্ধের অনুরোধে। সে ড্রাইভারকে সামনের মোড়ে বাসটা থামিয়ে বৃদ্ধকে নামিয়ে দিতে উদ্যত হলো। হঠাৎ বছর সাতেকের একটি বালক বৃদ্ধের কম পড়ে যাওয়া বিশটাকা তার মাকে দিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।

চাকরি

সারাদিন শেষে লোকটি মাত্র ঘরে ফিরলো। তাকে আজ ভীষণ ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ঋণ প্রদানকারী একটি এনজিওতে মাঠপর্যায়ে চাকরি করেন তিনি। একমাত্র মেয়েটি বাবাকে আসতে দেখে হোমওয়ার্ক করা বাদ দিয়ে দৌড়ে চলে এলেও আজ তিনি কন্যাকে অন্য দিনের মতো কোলে তুলে নিলেন না। পকেট থেকে বের হলো না চকোলেটও। জামা-কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হতে আজ অন্যদিন থেকে তিনি অনেক বেশি সময় নিলেন৷ হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলেন এবং রাতের খাওয়া সারলেন পিনপতন নীরবতা বজায় রেখে। বাচ্চা মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়লে থমথমে মুখে স্ত্রী-কে জানালেন, ঋণ আদায়ে নির্মম হতে না পারার কারণে আজকে তার চাকরিটি চলে গেছে।

উৎসব

বিয়েতে দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন এসেছে। সারাদিন জুড়ে হৈ-হুল্লোড়, খানাপিনা চলেছে। কখন যে রাত নেমে এসেছে কেউ টের পায়নি। সকলের চেহারায় দেখা মিলছে ক্লান্তির ছাপ। মানুষ অনেক বেশি হওয়ায় পুরুষ ও নারী আলাদা ভাগ হয়ে গেছে ঘুমানোর সুবিধার জন্য। গায়ে-গায়ে শোয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। একটি খাটে আড়াআড়িভাবে বরের কিশোর ছোটভাইয়ের সাথে শুয়েছে দূরসম্পর্কের এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ আত্মীয়। পাশে শুয়েছে আরো চারজন মানুষ। সবার নিঃশ্বাস যখন ভারী হয়ে উঠেছে তখন কিশোরটি প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শটি টের পায়। আধোঘুমে সে বুঝতে পারে কেউ একজন তার হাফপ্যান্ট খুলে নিচ্ছে। ভয়ে ও আতঙ্কে শরীর জমাট বেধে যায় যেন। আচমকা উলঙ্গ কিশোর দৌড় দেয় মায়ের কামরার দিকে।

সঙ্কট

ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে একতোড়া টাকার একটি বান্ডিল কুড়িয়ে পেলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি স্কুলের জনৈক শিক্ষক। পরক্ষণেই মাথায় এলো ছেলেটার বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন, একমাত্র মেয়েটার আসন্ন বিয়েতে খরচের টাকাটা এখনো ম্যানেজ হলো না, স্ত্রীকে একটু জরুরি ভিত্তিতে ভালো হাসপাতাল থেকে চেক-আপ করানো দরকার, ভাড়া বাড়ির ঝামেলা থেকে এবার নিস্তার না নিলেই নয়… ইত্যাদি। মাস্টারমশাই নিজের জীবনের এতোসব ক্রাইসিসের কথা ভাবতে ভাবতে টাকার তোড়াটা নিয়ে স্থানীয় থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

মধুচন্দ্রিমা

সমুদ্র সৈকতে বিকালে হাঁটতে হাঁটতে এক নবদম্পতি সিদ্ধান্ত নিলো তারা পরস্পরের কাছে কনফেস করবে। ছেলেটি প্রস্তাবটি করলো। ছেলেটি বললো, জীবনে সে একবারই মাত্র বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পতিতালয়ে গিয়েছে এবং সেই কারণে তার এখনো অনুশোচনা হয়। এবার মেয়েটির পালা এলো। মেয়েটি বললো, তার বড়ো ভাইয়ের এক বন্ধু একবার সবার অলক্ষ্যে তাকে পেছন থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলো এবং তার প্রায় সাথে সাথেই দ্রুতবেগে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো। এই ঘটনার পরে ভাইয়ের বন্ধুটিকে আর কখনোই সে তাদের বাড়িতে আসতে দেখেনি। ছেলেটি মধুচন্দ্রিমায় ইস্তফা দিয়ে সেদিন রাতেই ফেরার বাসে রওনা হলো।

মশকরা

উস্তাদ, ওই দেহেন মাগী মাইনষে কেমনে বিটাগে মতো শার্ট-প্যান্ট পইরে হুন্ডা চালাচ্ছে।
—হে হে, আর কইস না। এগে জ্বালায় রাস্তায় বের হয়ে শান্তি নেই। বুক আলগা কইরে ঘুইরে বেড়াবে আর খালি নাঙগিরি ঠাপাবে।
—উস্তাদ, এগের বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করে কিডা? আর সোয়ামি বাঞ্চোতটাই বা কিরাম যে বউরে এইরাম রাস্তাঘাটে ছাইড়া দেয়?
—এগের কথা আর কইস না। এরা সব শালা এইরম। খানকির পুত জানি একেকটা।
—উস্তাদ, মাগীটার সাথে এট্টু মশকরা করন লাগে যে। ওরে একটু ভয় দিয়া দেন যাতে রাস্তায় আর বের না অয়।
—ঠিক কইছোস। আসলেই একটু শিক্ষা দেওঅন লাগে।

আজ শহরে ইস্কুটি থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়ে মারা গেছেন একটি বেসরকারি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী একজন নারী। প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে একটি বাস হঠাৎ পাশে চাপ দিলে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে যেয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। বাসটি দ্রুতগতিতে পালিয়ে যাওয়ায় চালক ও হেলপারকে ধরা সম্ভব হয়নি।

অন্ধকার

বৃষ্টি হচ্ছে ঝির ঝির করে। হিমেল বাতাসে এই মাঝরাতে শীতের কাঁপুনি দিচ্ছে রীতিমতো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলো তলপেটের চাপে। এক্ষুণি ব্লাডার খালি না করলে ফেটে যাবে এমন অবস্থা। এই চমৎকার ঘুমের পরিবেশে কাঁথা-কম্বলের আরাম ছেড়ে হলের একপ্রান্তের ওয়াশরুমে যেতে হবে ভাবলেই রীতিমতো বিরক্তি লাগছে ফাহিমের। অগত্যা, যাওয়া ছাড়া গতি নেই। চাপটা ক্রমশ বাড়ছে। ইউরেনাল প্যান অভিমুখে হলের করিডোর ধরে হাঁটছে সে। আশেপাশে কেউ নেই। সবাই আলস্যে কাদা হয়ে গেছে। রাতের নির্জনতার চাদরে মুড়ে আছে চারতলার আবাসিক হল। ওয়াশরুমের কাছাকাছি এগিয়ে আসলে কুকুরের অদ্ভুত এক আওয়াজ কানে এলো ওর। প্রস্রাবের বেগ বেশি থাকায় সেটাকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুতবেগে ইউরেনাল প্যানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ফিরে আসার সময় আবার সেই একই অদ্ভুত আওয়াজ কানে এলে এবার নির্ভার মনে এর উৎসমুখ সন্ধান করতে উদ্যত হলো সে। অবশেষে সিঁড়ি ঘরের পাশের অন্ধকার জায়গাটা থেকে এই আওয়াজ আসছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলো সদ্য মা হওয়া কুকুরটাকে পেছন থেকে ধরে রেখেছে ক্যান্টিনে নতুন আসা একজন বয়। ওর পায়ের আওয়াজ পেয়ে লোকটি ভূতগ্রস্তের মতো লুঙ্গিটা কোনোরকমে পরে নিয়ে পড়িমরি করে দৌড়ে পালালো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *