আনোয়ার রশীদ সাগর এর দুটি অণুগল্প

প্রতিনিধি

জীবন ও জীবিকার জন্য দৌড়াতে হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে টাকা আদায় করতে হয়। এও এক মজার জীবন, কষ্টেরও জীবন।
বেশ কয়েক বছর আগে মাস্টার্স পাশ করে চাকুরি খুঁজতে শুরু করি। বাবা ভ্যান চালায়। মা এক অসহায় ও গর্বিত গৃহিণী।
মায়ের আদর স্নেহে আমার ছোট আরো তিনটি বোন মানুষ হচ্ছে। শত কষ্টের মধ্যেও বাবা-মা তাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে। আমি ওদের বড় ভাই।চলার পথের এবং বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। হাজারো স্বপ্ন হাজারো প্রত্যাশা নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে আমার দিকে।
এক সময় একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকুরি পেলাম। ঠিক ওই সময়ই দুটো বোন একসাথে এসএসসি পাশ করে। বড় হওয়ার আশায় ও বড় করে তোলার স্বপ্নে, ওদের জেলা শহরের একটি ভালো কলেজে ভর্তি করে দিই। মেসে একই রুমে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেও দিই।
ছোটবোন রুবি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তিনটি বোনের ‘ভাইয়া ভাইয়া’ ডাকে মুগ্ধ হয়ে থাকি।
ব্যাংকের চাকুরিতে বেতন বেশ ভালো। মনের আনন্দে চলছিল বেশ।
হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে খবর এলো, বাবা খুবই অসুস্থ। মা আমাকে মোবাইলে বার বার বাড়ি যাওয়ার জন্য বলছে, বাপ তুই ইকটু তাড়াতাড়ি আয়।
তারপর কাঁদতে থাকে, মোবাইলে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এবার রুবি ফোন ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ভাইয়া বাবার অবস্থা ভালা না, তুমি চইলি আইসু।
আমি অস্থির হয়ে পড়ি। ফোন করি কলেজে জলি ও মলির কাছে, হারে তুরা কোথায়?
মোবাইলে হড়হড় শব্দ হচ্ছে। এই শব্দের মধ্যেই ওরা বলছে, ভাইয়া আমরা বাড়িতে যাইছি, তুমি তাড়াতাড়ি চইলি আইসু।
আমি আর কিভাবে স্থির থাকি?
ম্যানেজার স্যারের দরজায় গিয়ে সালাম দিলাম।উনি পেপার পড়ছিল। চোখ তুলে না তাকিয়েই, সালামের উত্তর না দিয়েই বললো, কী হয়েছে আলম সাহেব?
আমি উনার কক্ষে প্রবেশ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললাম, স্যার আমার বাবা খুবই অসুস্থ, এখনি বাড়ি যেতে হবে।
উনি বললেন, তোমার নতুন চাকুরি, বাড়ি যাবে কেন?- বাবা তো মরে যাইনি?
আমি উনার কথা হজম করেই বললাম, স্যার মা বার বার ফোন করছে, ছোট বোনরাও অস্থির হয়ে পড়েছে।
উনি ঘাড়টা উঁচু না করেই বললেন, আলম সাহেব এখন জুন ফাইনাল চলছে, বাবা তো বেঁচে আছে, যান চাকুরি করেন, মরার সংবাদ এলে বাড়ি যাবেন।
মনে হচ্ছিল, সামনে থাকা চেয়ারটি তুলে ম্যানেজারের মাথায় মারি। পরক্ষণেই জীবনের অভাব-অনটন আর দারিদ্রতার কথা ভেবে, নীরবে উনার কক্ষ থেকে বের হয়ে আসি।
কী আর করা?
আবারও জলি আর মলি ফোন দিচ্ছে, ভাইয়া তুমি কতদূর?
আমি মিথ্যা বলি, পথের মধ্যে আছি, অপেক্ষা কর্ চলে আসছি।
ম্যানেজার স্যারের কক্ষে না গিয়ে, সোজা বেরিয়ে পড়ি বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বাড়ি এসে দেখি বাবা উঠানে পড়ে আছে। তার পা দুটো ভেঙে গুড়ু হয়ে গেছে। রক্তে ভিজে আছে মাটি।
রাস্তায় ভ্যান চালানোর সময় একটা মোটর সাইকেলে তিনজন কিশোর উঠে, রাস্তায় চালাচ্ছিল। তারা এসে পিছন দিক থেকে ভ্যানকে ধাক্কা দিলে, বাবা কাইত হয়ে ডান পাশে পড়ে যায়।ওই সময় একটি ট্রাক এসে দু’পায়ের উপর দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যায়।
স্থানীয় লোকজন ধরে পা’দুটো কাপড় দিয়ে জড়িয়ে বেঁধে আমাদের বাড়িতে রেখে যায়।
আমি দেখে হতবাক হয়ে গেছি। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, একটা কিছু কর্ বাবা।
আমি দ্রুত একটি মাইক্রোতে করে, বাবাকে নিয়ে এসে জেলার সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। তখন বাবা আমার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বাবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
বাবার পাশে হাসপাতালে দুদিন থাকলাম। তারপর মা এবং জলিকে হাসপাতালে রেখে চলে আসি অফিসে।
ম্যানেজার স্যারকে সালাম দিতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী চান আলম সাহেব?
আমি খুব কষ্ট সহ্য করে, অনেক অনুরোধের সুরে বাবার দূর্ঘটনার কথা জানালাম।
উনি মৃদু হেসে বললেন, আলম সাহেব এটি বেসরকারি ব্যাংক। চাকুরিটা হারিয়ে ফেলেছেন।
অনেক অনুরোধ করার পরও কোনো কথা রাখলেন না। বরং চেয়ার থেকে উঠে চলে গেলেন অন্যদিকে।
বাড়ি এসে কাউকে কিছু না বলে, এক বন্ধুর সহযোগিতায় কসমেটিক কোম্পানীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করলাম।
ছয়টি বছর ধরে দৌড়াচ্ছি।
এর মধ্যে গ্রামের হাইস্কুলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, একজন অফিস সহকারী নেওয়া হবে।
গেলাম হেড স্যারের কাছে। উনি খুব সুন্দর করে বললেন, তোমার মত ছেলে পেলে তো স্কুল ও অফিস দুটোই ভালো চলতো। তবে আমার কিছু করার নেই বাবা। তুমি সভাপতির কাছে যাও, যুগজামানা তো পাল্টি গিছে। দেখো, উনি কি বলে।
গেলাম সভাপতির কাছে। উনি বললেন, তুমি তো ভালো ছেলে? অনেকে সাত-আট লাখ টাকা দিতে চাচ্ছে। তুমি না হয়, লাখ পাঁচেক টাকা জোগাড় করো।
মনে মনে ভাবলাম, আমি তো পাঁচ’শ টাকাও দিতে পারবো না।
আবার দৌড়ানো শুরু করলাম।- বিভিন্ন দোকানদারকেও স্যার বলে সম্বোধন করে অনুরোধ করি, স্যার একটা আইটেমের মাল নেন।
কত গ্রামের সাধারণ মোদী দোকানদার কত রকম আচরণ করে, সবই হজম করি, সংসার চালানোর জন্য। দুটো টাকা আয় করার জন্য।

জানাজা

ধীরে ধীরে আমার জানাজার প্রস্তুতি চলছে। শ’খানিক লোক জানাজায় দাঁড়িয়েছে। সামনে ঈমাম সাহেব, পিছনের লোকগুলো আমার চেয়ে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে। সে সারিতে আমার আদরের কয়েক জন সন্তানও আছে।
যখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন আমার অনেক টাকা ছিল। ঢাকা শহরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও নামকরা হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু ডাক্তার ও নার্সরা করোনা-করোনা বলে চিৎকার করা শুরু করে। ঠিক তখনই আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ও সন্তানেরা আমাকে রেখে, তারা হাসপাতালের বাইরে চলে যায়।
আমি বড় একা হয়ে পড়ি। রাতে আইসি ইউতে কিছুক্ষণ সময় রেখে, ছবি উঠায়ে, আবার বের করে পাশেই একটা রুমে আমাকে চিৎ করে শুয়ায়ে রেখে দেয়। সকালে স্ত্রী একটা চিরকুটসহ চেকবই পাঠিয়েছে, নার্সকে দিয়ে। চিরকুটে লেখা ‘প্রতিদিন তোমার তিনলাখ করে টাকা লাগবে। সেই হিসাব করে অনেকগুলো চেকের পাতায় স্বাক্ষর দিও।’
অথচ আমার জন্য কোনো ভালো খাবারও পাঠাইনি।
আমি তো আইসিইউতে নেই, আমাকে তেমন কোনো চিকিৎসাও দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে কেন এত টাকা লাগবে?
কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে পায়নি। কতবার হাত ইশারা করেছি, সবাই দূরে সরে গেছে।
তারপর আমাকে প্রশাসনের সহযোগিতায় কবরস্থানে আনা হয়েছে।
জানাজায় যারা এসেছে তারা সবাই পাওনাদার। আমি ওদের কাছ থেকে চাকুরি দেওয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকা নিয়েছিলাম। খরচ করেছি আমার সন্তানদের পিছনে। ওদের বাড়ি গাড়ি করে দিয়েছি।
গরুর ফার্ম করে দিয়েছি, মার্কেট করে দিয়েছি, ঢাকা শহরে ফ্লাট কিনে দিয়েছি, বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য ফার্ণিচার করে দিয়েছি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু মানুষের জীবিকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। যাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি তারা কেউই আসেনি।
আহা, সারাজীবনের প্রেমভালোবাসা স্ত্রীকে দিয়েছি। তাকেও দেখছি না।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো গুণগুণ করে উঠলো। তারা সকলেই টাকা পাবে। অথচ আমি খাটোয়ায় শুয়ে ওদের বলতে চাচ্ছি, শোন আমি পৃথিবী থেকে কিছুই নিয়ে যাচ্ছি না। সুন্দর গাছগাছালি, স্নিগ্ধভালোবাসা অথবা ভয়ংকর অহংকার সবই রেখে যাচ্ছি।
আমার কথা কেউ শোনছে না। আমার সন্তানরাও অন্যলোকদের মতই অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
মৌলানা সাহেব বললেন, আজ এই মৃতু ব্যক্তি হিংসা-বিদ্বেষ, আদর-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা এবং সকল ধনসম্পদ পৃথিবীতে রেখে চলে গেছে। কিছুই নিয়ে যায়নি, পৃথিবীর মানুষের মধ্যেই রেখে গেছে। আপনারা সকলেই মাপ করে দেন।
এরপর একে একে সবাই চলে গেল। আমার সন্তানেরাও চলে গেল, শুধু প্রশাসনের ছয়জন লোক আমাকে কবরের ধারে নিয়ে গিয়ে রাখলো। তখন আমার এক গরীব বোন এসে দাঁড়ালো। যাকে আমি কোনোদিন দেখতেও যাইনি। বরং ওর ছেলের চাকুরি দেওয়ার কথা বলে, বাড়ির ভিটিটাও বিক্রি করে নিয়ে, আমার ছেলেকে ইউরোপে পাঠিয়েছিলাম। আমার সে ছেলে আমাকে দেখতেও আসেনি।
সামান্য দূরে বোনটি বার বার হুঁহুঁ করে কাঁদছিল এবং ফুপিয়ে ফুপিয়ে চোখ মুছতে ছিল।
প্রশাসনের দু’জন লোক আমার গরীব বোনটিকে সকল প্রকার সাহায্য দিতে প্রতিশ্রুতি দিলে, সেও চলে গেল।
আমি অজানা অন্ধকারে অথবা কোনো ঠিকানাহীন পথে ধীরে ধীরে চলে গেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *