জং পাইহুয়া ও তাঁর কবিতা ভূমিকা ও তরজমা: মনসুর আজিজ
বসন্ত এবং আলো
তুমি কি জানো বসন্তের গোপন রহস্য
অনুভব করো লজ্জার স্পর্শ
প্রজাপতির নরম পাখা ঝাপটানো
তোমার হৃদয়ে ভেসে থাকা তাবৎ সঙ্গীত
অবিরল বেজে চলে আত্মার গহীন কোণে
আসে দিন, চলে যায় রাত্রি
মুক্ত স্বাধীন অবিরাম গানের মতো
যেনো অরিয়ল পাখি
তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই
যেমন সুরভীত ফুলের পাপড়িতে টানো শ্বাস
হৃদয় গলে পড়ে বসন্তের গোলাপের প্রতি
তুমি কি জানো আলোর গোপন রহস্য
যখন বাতাসে আন্দোলিত হয় গাছপালা
সন্ধ্যার সূর্যের আলো নেমে আসে
নাচের শেষ মুদ্রাটি রেখে ডুবে যায় পশ্চিমে
তুমি কি দেখেছো পাহাড়ে চাঁদের আনাগোনা
রাতের মীমাংসা করা জোছনার জোয়ার
তুমি কি সেলাই করো তার শীতল শিহরণ
তুমি কি অনুভব করো নিশাচর তারার আলো
কিংবা অনুভব করো
রূপালি ছাউনিতে উড়বার সাধ
রাতের তারার সাথে।
বাগানে
আমরা পায়চারি করেছি বাগানে
একটি দুঃখফুল নিবেদন করেছি তোমাকে
‘এই নাও আমার আত্মা’ আমি বললাম
তুমি কম্পিত হাতে ফুলটি নিলে
তোমার দুচোখে ঝরনার গান
ভোরের শিশির বিন্দু
আমি ফিসফিস করে বললাম
‘এই দেখো আমার আত্মা’
জীবনটা কতো পরিপূর্ণ।
আমরা
আকাশগঙ্গার নিচে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, একসাথে
পৃথিবীর সব মানুষ নিমজ্জিত ঘুমে
যমজ তারারা জ্বলছে আকাশে
তাদের প্রতিবিম্ব আমাদের হৃদয়ে
তোমার হাতটি ধরে আছি হাতে, নিরবে
আকাশের দিকে তাকাও–
কী রহস্যময় তারকার কম্পন
দুটি হৃদয়ের মাঝে রেখে যায় গভীর অনুরণন।
বীণার গানে
সাগরবীণার শব্দ শুনে
নুয়ে আসে আমার মাথা
এই পৃথিবী
এই জীবন
অফুরন্ত সবকিছু
হৃদয়ের ভিতর দুঃখগীতি, আমি শুনে যাই
এরপর শুনে যাই নতুন সঙ্গীত
আমাকে করে তোলে শঙ্কিত
আমার হাত থেকে পুষ্পগুচ্ছ
খসে পড়ে মাটিতে
হৃদয় আচ্ছন্ন হয় গভীর অন্ধকারে
এরপর অশ্র“
তারপর অশ্র“…
অবিরাম বৃষ্টিধারা।
চাঁদের বিষাদগীতি
বন্ধু চাঁদটি ছেড়ে গেছে পৃথিবী
তার শেষ আলো রেখে গেছে পর্বতের চূড়ায়
আমাকে ডেকে তুলেছে ঘুমের উপত্যাকা থেকে
পর্বতের ঢালে অর্ধঘুমে ঝুলে আছি নুড়ির মতো
বালিশের গালে চুমু খেয়ে পড়ে আছি
মেঘ ছুটছে কালো চুল উড়িয়ে
ঘুম ও জাগরণের সন্ধিক্ষণে আচানক জেগে উঠি
পৃথিবীর কতোদূরে আমি
মানুষের প্রিয় জগৎ আমি তোমাকে নিয়ে ভাবছি কতো
তুমিতো এখন আমার চোখে মরীচিকা
এতোটা নিরুত্তাপ কেনো, বলো?
কি কারণে আর সাধো না সুর
কোথায় গেলো সেই কবিরা যারা শোনাতো বিচিত্র কবিতা
আমি কেনো শুনি না হার্পের নিনাদি সুর
যেই সুর বেঁধেছিলো আমাকে
কোনো প্রেমিকা আর নেই বাহুবন্ধনে
নির্জন বাগানে নেই কোনো অভিসারিনী
খোলা জানালা দিয়ে আর শুনতে পেলাম না
জামার আস্তিন গোটানো কোনো শিল্পীর বিরহগীতি
নিবিড় বনভূমি উজাড় হয়ে শহর প্রসারিত করেছে তার দেয়াল
আমার চোখ ফেটে বের হয় অশ্র“র ধারা, বুক কাঁপে থরথর করে
যারা ভালোবাসো পৃথিবীকে, তারা ভুলে যাও আমাকে
দ্রাক্ষালতা লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে দেয়ালে, ভালোবাসে
তারা মাথা দুলিয়ে এখনো জানায় সম্ভাষণ
আন্দোলিত বাতাসে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে
আমার আত্মার প্রতিফলন দেখি লেকের গাঢ় সবুজ পানিতে
ক্রিস্টালের দীপ্তি ছড়িয়ে আমার উপর
দুঃখ ভারাক্রান্ত পদ্মফুল
বুজে আসে তার চোখের পাতা, অশ্র“ ভেজা, ঘুমিয়ে আছে পুুকুরের পানিতে
পাহাড়ের ঢালগুলো দুঃখভেজা, যেন কালো মেঘের কবরে ঘেরা
শব্দহীন তাকিয়ে আছে আমার দিকে
পুবদিকে ঝর্ণারা কাঁদছে ফুঁপিয়ে
হে পৃথিবীর প্রিয় মানুষ! আমি দেখি না কোথাও তোমাদের অবয়ব
আমার মাথাটিও মেনে নেয় কান্নার অধীনতা
চোখদুটো রক্তবর্ণ
আমিও বিলীন হবো সকালের কালেমেঘে।
জীবন প্রবাহ
জীবন আমার কাছে মেঘের তরঙ্গের মতো
সমুদ্র আকাশের মতো সীমাহীন নীলের প্রতিবিম্ব
জীবন আমার কাছে তরঙ্গহীন ছোট্ট নদীর মতো
যাতে প্রতিফলিত হয় পাহাড়ি লতাগুল্মের প্রতিবিম্ব
জীবন আমার কাছে বীণার সূক্ষ্ম তারের মতো
যার মায়াবী সুর শরতের তারাজ্বলা রাতে
ছড়িয়ে পড়ে পাইন বনে
জীবন আমার কাছে
তোমার যৌবন তরঙ্গের মতো
তোমার বুকের ওঠানামা
আমাকে স্পর্শ করে যেভাবে।
ক্ষুদ্র কবিতা
জীবনবৃক্ষের একটি ফুল পান্ডুর
খসে পড়লো আমার বুকের উপর
আলতোভাবে আমি তুলে রাখলাম হৃদয়ে
ফুলটি যখন পেলো আমার অন্তরের স্পর্শ
গলে গিয়ে কবিতাফুল হয়ে ফুটে উঠলো সামনে।
সাগরের তীরে
আজকের চাঁদের আলো
তার প্রতিবিম্ব রেখে গেলো আমার হৃদয়ে
নির্জন সাগরের তীরে
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম
শুনতে পেলাম সুমিষ্ট সুর
এই নাক্ষত্রিক গোলকে।
একটি ফুল নির্জনে
ঘুম থেকে জেগে উঠলো আমার পাশে
আমি নিঃশ্বাসে টেনে নিলাম তার গন্ধরস
আহা চাঁদ রাতে স্বপ্ন কতো বিস্তীর্ণ
যখন আমি স্পর্শ করি ফুলটিকে
সে যেনো বাসরসজ্জার স্বপ্নে বিভোর
আমার জন্মভূমিতে এই আমার অনুভূতি
আমি যখন চাঁদের শীতল আলো-ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
কবি
জানালার পাশে সূর্যাস্তের মুহূর্তে
ব্যবধানহীন অসীম আকাশ
বৃষ্টির পর
জেগে ওঠে রঙধনু
একজন কবি বুনে যায়
জীবনের দুঃখ মেঘের সুতো দিয়ে
মহাশূন্য জয় করার মহান সঙ্গীত
ব্যবধানহীন করে ফেলে সকল সময়কে।
শীত
তুষারের শুভ্র দীপ্তি
ধূষর গাছের বাদামি পাতা
তুষারের চাদর গায়ে মেখে পড়ে আছে সবকিছু
যতোদূর জানি বন্ধুরা আমার
এই শীত তোমার হৃদয়ে কষ্টের ধুকপুক যদিও
কিন্তু যেনো
সেতো পুষ্পফোটা নতুন বসন্তের আগমনী বার্তা।
শেলী
বীণার মতো ঝুকে আছে ব্যালকনি
উত্তুঙ্গ সুর ধ্বনিত হচ্ছে সেখান থেকে
যখন প্রবাহিত হয় বাতাস
বসন্তের পাখির মতো
নীল মেঘ ইতস্তত: ছড়িয়ে আছে আকাশে
অতিক্রম করার সময়
তাদের বিদায়ী সঙ্গীত
রেখে যায় প্রবাহিত সুরে
শেলী!
আমি আমি তোমার ভিতর সেই প্রলম্বিত সুরটি সুনতে পাই।
গ্যাটের দেশে
তোমার প্রশান্ত চোখ দুটো
যেনো ধরে আছে সমগ্র বিশ্বকে
এখনও করেনি ছলনা
যদিও ঝাপসা মেঘের আশ্রয়ে এখন
শিশুর মতো কোমল হৃদয়টি তোমার।
সকাল
চলে যায় রাত
উঁকি দেয় ভোর
একটি হীমশীতল রশ্মিকে রেখে
রাতের অস্পষ্টতা ভেঙে দিয়ে
আশ্রয় নেয় আমার ছোট্ট ঘরে।
রাতের অস্পষ্ট আলোতে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোণাকাঞ্চির কালো
দৌড়ে পালায় ভোরের আলো ফুটবার আগেই।
বাস্তবতার রঙ ছোটে বিছানার চাদরে
খুলে যায় মহাজগতের কপাট
বিসারিত হয় অপচ্ছায়া
আহা! কী নিবিড়ভাবে বুনে যায় পৃথিবীকে
ঢেকে ফেলে আমার ভাঙা, একেলা পড়ে থাকা হৃদয়টিকে।
সবুজ ছাউনি
জাগো!
হে সবুজ ছাউনি, স্বপ্নের মতো জাগো
আলিঙ্গনে সিক্ত কর