শঙ্খশুভ্র পাত্রের দশটি ছড়া-কবিতা

পদ্মা-গঙ্গা

এই তো আমার গঙ্গানদী
ওই তো আমার পদ্মা,
এদের কথা বলতে গেলেই
আপনি জাগে শ্রদ্ধা ৷

দিনরাত্তির বইছে ওরা
ছলাৎছলাৎ ছন্দে,
সে-সুর শুনে আকাশ-বাতাস
মাতছে মহানন্দে ৷

খরস্রোতে রোদের ঝিলিক
কী মনোহর ! মানছি —
যখন দেখি তরতরিয়ে
ছুটছে ডিঙি-পানসি…

পদ্মা তখন দুচোখ মেলে
খিলখিলিয়ে হাসছে,
গঙ্গা আমার — এসব দেখেই
খুশির আলোয় ভাসছে ৷

হাঁসকাহিনি

ডিম খেলে আস্ত
হবে জোর স্বাস্থ্য
বই পড়ে জেনেছেন
অপরূপ দাস তো ৷

মন্ত্রীকে তড়িঘড়ি
দিয়ে কিছু টাকা-কড়ি
চালাঘরে পুষলেন
তিন কুড়ি হাঁস তো ৷

মন্ত্রী বলেন ডেকে,
টাকা-কড়ি থাক ট্যাঁকে
আগে তো টাইপ করে
দিন দরখাস্ত ৷

শ্রীদাস ভাবেন খুব
কখনো থাকেন চুপ
খাটছেন মন দিয়ে
রোজ উদয়াস্ত ৷

লোকজন আসে হেথা
শ্রীদাস জানেন কেতা
হাসিমুখে কন তিনি
হাঁসের নিবাস তো ৷

ডিম বেচি প্রতিদিন
আমি ভাই অতি দীন
বছরে একটা করে
কিনি মিনিবাস তো ৷

পাশের বাড়ির লোকটা

পাশের বাড়ির হিন্দিভাষী
লোকটা ভীষণ ফূর্তিবাজ,
বলেন, অামার জন্মদিবস
ষাট বছরের পূর্তি আজ ৷

মূর্তি আমার দেখলে লোকে
বলবে বয়স চব্বিশ-ই,
মাছ-মাংস ছুঁইনি বাছা
আহার আমার হবিষ্যি ৷

অবিশ্যি ফল-পাকুড় পেলে
ভোজনটা হয় দাম্ভিকের,
উদরটা বেশ ফুলতে থাকে
ডান পাশে নয়, বামদিকের ৷

তারপরে রাম-ঢেকুর তুলে
আওয়াজ করি ভয়ংকর,
এবার ঠাকুর আদেশ দেন —
ভোজনরসিক শয়ন কর্ ।

দাদুর চয়েস

তোমার যদি ভাল্লাগে ভোর
আমার তবে দুপুর,
মায়ের ভালো বিকেল বেলা
যখন রোদে উপুড় ৷

বাবা বলেন, সাঁঝবেলাটি
আমার বাপু ভালো,
যখন দেখি তুলসীতলায়
জ্বলে পিদিম আলো ৷

বোনটি বলে, পছন্দ মোর
গহন কালো রাতি,
ঘুমিয়ে থেকে নানারকম
স্বপন দেখে মাতি ৷

দাদু বলেন, বাই দ্য বাই
আমার ভারি চয়েস,
যখন আমি কল্পনাতে
কমিয়ে ফেলি বয়েস ৷

ফলবাহারি জলসা

আপেল-আঙুর-কমলালেবু-
ডালিম-লিচু-আতা…
ধন্যি বাপু ! ছাড়বিনে তুই
আমার পিছু হাঁটা ৷

জলপাই-বেল-পেস্তা-বাদাম-
কাঁঠাল-পেঁপে-পেয়ারা…
হুম-হুমা-হুম সুর ভাঁজে ওই
পালকি কাঁধে বেহারা ৷

আম-আনারস-নারকেল-পিচ-
সফেদা-কুল-রম্ভা…
তুই যে দেখি হিরোর মতন
চুল রেখেছিস লম্বা !

জাম-জামরুল-মিষ্টি খেজুর
কিসমিস আর আমলকি,
এই যে এত লিস্টি দিলুম
কথায় দিবি আমল কি ?

শশা-আখরোট-ইমলি-গুবাক-
তরমুজ-তাল-ফলসা…
এইখানে মোর সাঙ্গ হল
ফলবাহারি জলসা ৷

আমাদের দারোয়ান

শীতকালে গীত গায় আমাদের দারোয়ান
বাঁ-হাতে খৈনি ডলে, ঝেড়ে, কয় — “আরো আন ৷”
গায়ে তার কম বল, আরে না না, কম্বল
শিরে তার সম্বল কবেকার উষ্ণীষ !
কেউ এলে দরজায়, সাথে সাথে গর্জায়
চোখ জোড়া লাল করে বলে, “তুই ঘুষ নিস ?”

আমাদের দারোয়ান, ছিল আগে পালোয়ান
রাত হলে বলতোই — “একখানি আলো আন ৷
রাতকানা রোগ মোর — হাতখানা হুঁশিয়ার
সাড়া পেলে সাথে সাথে কিল-চড়-ঘুষি আর…
দিই কষে দমাদম — ধুমধাম করে বেশ ৷
আজ মুই দারোয়ান, নেই সেই অভ্যেস ৷”

ভূতেদের ইসকুল

ভূতেদের ইসকুলে আজগুবি কাণ্ড !
গুবগুবি বাজিয়েই শিক্ষক মামদো

ক্লাস নেন একটানা — খোনা-খোনা কণ্ঠে,
একানড়ে ছাত্রটি লেখাপড়া অন্তে —

দানোদের নিয়ে মাঠে খেলে ‘দাড়িবান্ধা’,
যেন আর কিছুতেই নেই কোনও ধান্দা ৷

আন্ধার নেমে এলে ভূতেদের গঞ্জে,
খুঁতখুঁতে মন নিয়ে কবন্ধ কন যে :

‘মুখ নেই—তবু দেখি, কপালের দোষ না ৷
তিতকুটে বিস্কুট, বিদঘুটে জ্যোৎস্না—

খেয়ে আর কদ্দিন বাঁচবো এ-মর্ত্যে !
ছেলেপিলে কাছে নেই—পেতনিটা গর্তে

রাতদিন রাঁধে-বাড়ে—গাল পাড়ে মন্দ,
ভাগ্যিস, ইসকুল একমাস বন্ধ !

রাঁধুনিক

কথাটুকু শুনবিনা — তুই খুব ফক্কড়
বলছি তো আম দিয়ে শোল মাছ টক কর্ ৷
খেতে বেশ লাগবে রে ! পটলের দোরমা
মনে পড়ে একদিন রেঁধেছিল তোর মা ৷
সেই স্বাদ ভুলি কই ? জিহ্বা ও দন্ত
চেটেপুটে-ছিঁড়ে তার করেছিল অন্ত ৷

কথাটুকু শুনবিনা — এই এক দোষ তো
মন দিয়ে কর দেখি আলুভাজা, পোস্ত ৷
নাহয় খরচা আছে, হবে জোর খাটনি
ভোলা যায় নুন দিয়ে আমড়ার চাটনি ?
লঙ্কা মাখিয়ে তাতে খেয়ে সেকী কান্না !
ছোড়দিটা বকেছিল — এই শেষ, আর না ৷

কথাটুকু শুনবিনা — যুগটা যে আধুনিক
কবে তুই হবি বল্ নামকরা রাঁধুনিক ৷

বলতে পারো ?

হাসনুহানার হাসতে মানা
বাঁধবে না সে খোঁপাটি,
জবা যতই জবাব দিক
রা কাড়ে না দোপাটি ৷

গন্ধরাজের গন্ধ ঢের
দুঃখ করে চম্পা,
মল্লি বলে, সবাই তাকে
জানাস অনুকম্পা ৷

শিউরে ওঠে শিউলিরানি
মুচকি হাসে কুন্দ,
কদম কেন বেদম রেগে
নাচায় নেড়া মুণ্ড ৷

চতুর্দিকে হুড়ুমদুড়ুম
কাকে বা আর দুষবো,
বলতে পারো দেখতে কেমন
যজ্ঞডুমুর পুষ্প ?

মিলেমিশে থাকবো সবাই

মিলেমিশে থাকবো সবাই
ঝগড়াঝাঁটি মিথ্যে,
ছল-চাতুরি, হিংসে করে
চাই না আমি জিততে ৷
ভালবাসার ভুবন গড়ে
রেখেছি এই চিত্তে,
প্রাণ খুলে তাই আলো হাওয়ায়
মাতবো গানে, নৃত্যে ৷
মনের কথা ছড়িয়ে দিলাম
বন্ধুজনের বৃত্তে,
এসো, এসো দু’হাত বাড়াও
কাজ কি একাকীত্বে ?

২ thoughts on “শঙ্খশুভ্র পাত্রের দশটি ছড়া-কবিতা

  • আগস্ট ২০, ২০২০ at ৪:১৫ অপরাহ্ণ
    Permalink

    ছড়ার প্রতিটি শর্ত রক্ষিত হয়েছে. শব্দ তান বিষয়বস্তু চমৎকার.

    Reply
  • আগস্ট ২০, ২০২০ at ৬:০৫ অপরাহ্ণ
    Permalink

    শঙ্খশুভ্রবাবু ছড়ায় মাতিয়ে দিয়েছেন। দাদুর চয়েস/রাঁধুনিক/ভূতেদের ইস্কুল/বলতে পারো?— অনবদ্য! “মিলেমিশে থাকবো সবাই” ছোটদের স্কুলে পড়ানো উচিত। বরাবরই তিনি আমার তালিকায় শ্রেষ্ঠ ছড়াকারদের একজন। কুর্নিশ!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *