ঈদসংখ্যার অনুবাদ- তৃতীয় সমর্পণ মূল: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ভাষান্তর: সুরাইয়া ফারজানা হাসান

আবারো সেই শব্দ। সেই ঠান্ডা, সূচালো, উলম্ব শব্দ এখন সে খুব ভালোমতো চিনে গেছে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেই শব্দটি, তার কাছে এমন ধারাল আর যন্ত্রণাদায়কভাবে এলো─যেন সে এটাতে সারা রাতেও অভ্যস্ত পারেনি। শব্দটি তার শূন্য মাথার ভিতরে ঘুরপাক খেয়ে মাথাটাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে। যেন একটা মৌচাক, তার মাথার খুলির চার দেয়ালের ভিতরে গজিয়ে উঠে, অবড় থেকে বড়তর হচ্ছে। আর মৌচাকটি অবিরত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে, শরীরের নির্দিষ্ট লয়ের মাত্রার বাইরে, অনিয়মিত স্পন্দনের মাধ্যমে, মেরুদণ্ডের রজ্জুকে কাঁপিয়ে দিয়ে তাকে ভিতর থেকে প্রহার করছে। তার মানব শরীরের কাঠামোয় কিছু একটা তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না; যেটি ‘এই সময়ে’ স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। এখন তার মাংসবিহীন, কঙ্কালসার হাত দুটো যেন মাথায়─হাতুড়ি পেটাচ্ছে; আর তাকে জীবনের সমস্ত তিক্ত অনুভূতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তার জান্তব শক্তি বজ্রমুষ্টি পাকিয়ে রগগুলোকে সঙ্কুচিত করেছে─যেটি ভয়ানক ব্যথা আর নিষ্পিষ্ট চাপের মাধ্যমে নীল, বেগুনি ধমনিগুলোকে অঙ্কুরিত করেছে। শব্দটি─তার ষ্পর্শকাতর হাতের তালুর মাঝে, হীরের মতো ধারাল খাঁজ দিয়ে এই ক্ষণটাকে ছ্যাঁদা করে দিচ্ছে; সে সেই শব্দটি পাকড়াও করতে চায়। গৃহপালিত বিড়ালের একটি ছায়মূর্তি, তার পেশীর সংকোচন করেছে। সে কল্পনা করছে, এটি তার তপ্ত, জ্বরে আক্রান্ত মাথার নিপীড়িত কোষগুলোকে দাবড়াচ্ছে। এখন সে এই বিড়ালের ছায়ামূর্তিটিকে ধরবে। না। শব্দটির গায়ে পিচ্ছিল পশম আছে, যেটি বলতে গেলে ষ্পর্শ করা যায় না। কিন্তু সে এক বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে শব্দটিকে শক্ত হাতে হতাশার সর্বশক্তি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে প্রস্তুত। সে আর এটিকে তার কান দিয়ে প্রবেশ করে, মুখ দিয়ে বের হয়ে আসতে, অথবা চোখের জল দিয়ে পতিত হতে দিবে না। তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে। যেন চোখটা অন্ধ হয়ে, শব্দটির উড়ে যাওয়া দেখছে চূর্ন বিচূর্ণ অন্ধকারের গভীরতা থেকে। সে তার করোটির দেয়ালের অভ্যন্তরে, বরফ নক্ষত্র, আর কাচ কাটা স্ফটিক ভাঙতে দেবে না। শব্দটি ছিল: অন্তহীন, যেন একটি শিশু তার মাথা একটি কংক্রিটের দেয়ালে ঠুকছে। যেন প্রকৃতির সকল অনঢ় অবস্থানের বিপক্ষে কঠিন আঘাত হানছে। কিন্তু সে যদি

শব্দটিকে ছেঁকে ধরে, বিচ্ছিন্ন করতে পারতো─তবে, এটি আর তাকে যন্ত্রণা দিতে পারতো না। সে নিজেকে বলছে─যাও, শব্দটির ছায়া থেকে পরিবর্তনশীল নকশা কেটে ফেলো; এটিকে খাবলে ধরে, চিপে নাও, হ্যাঁ একবার আর চিরতরের জন্য; দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে এটিকে রাস্তায় ছুড়ে দিয়ে, এর উপর হিংস্রভাবে হেঁটে যাও; যতক্ষণ না পর্যন্ত উর্ধ্বশ্বাসে বলতে পারো, শব্দটিকে হত্যা করেছ─যে শব্দটি তোমাকে, পাগল বানিয়েছে আর তোমার জীবনকে একটি পূর্ণাঙ্গ মৃত্যুতে রূপান্তরিত করে, এখন মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে নিতান্ত মামুলি জিনিসের মতো। কিন্তু নিজের রগকে চেপে ধরা, বাস্তবে তার জন্য অসম্ভব ছিল। হাতটি তার দেহের ওপর এমন খাটো করে রাখা, যেন ওটা কোন বামুনের হাত: ছোট, নিটোল, মেদ বহুল। সে মাথা ঝাঁকাতে চেষ্টা করে। ঝাঁকায়। আর দুমদাম শব্দটি তখন তার খুলির ভিতর প্রচন্ড বেগের রূপ নিল। শব্দটি কঠিন থেকে কঠিনতর─বড় থেকে বড়তর হচ্ছে। শব্দটি নিজেই অনুভব করছে অভিকর্ষের প্রচন্ড আকর্ষণ। দুমদাম শব্দটি বড্ড প্রচন্ড আর কঠিন। এতটাই প্রচন্ড আর কঠিন যে, সে যখন এটিকে ধ্বংস করে দিলো, তার এমন বোধ হচ্ছিল─যেন সে একটা সীসার তৈরী ফুলের পাতা টেনে তুলছে। সে একই রকম গোঁ ধরে শব্দটি শুনে গেছে, ‘অন্য সময়ে।’ এটি প্রথমে সে শুনেছে, প্রথমবার যেদিন মারা গেছে─সেদিন। সেই সময়─যখন সে একটি লাশ দেখতে পায়─আর উপলব্ধি করে, এটি তার নিজের লাশ। সে লাশটির দিকে তাকাল, ষ্পর্শ করল। তখন সে নিজেকে এমনভাবে অনুভব করল─যেন সে অচ্ছুত, স্থান আর অস্তিত্ব বিহীন। সে সত্যিই একটি লাশ ছিল। ইতোমধ্যেই সে তার নবীন, অসুস্থ দেহে মৃত্যুর অতিক্রমণ অনুভব করে ফেলেছে। বাড়ির ভিতরের পরিবেশে সর্বত্র কেমন অদ্ভুত কঠিন ভাব বিরাজ করছিল। যেন বাড়িটি সিমেন্ট দিয়ে ভর্তি। আর ওই স্থানের মাঝখানে─যেখানে বাতাসের বাতাবরণ ছিল─সেখানে সে ছিল, কঠিন আর স্বচ্ছ সিমেন্টের তৈরী কফিনের ভিতরে সযত্নে রাখা অবস্থায়। ‘শব্দটি’ তার মাথায় সেই সময়েও ছিল। তার দুপায়ের তলা কফিনের প্রান্ত ছাড়িয়ে, শীতল হয়ে পড়ে আছে! তার পায়ের নিচে স্বজনেরা একটা বালিশ পেতে রেখেছে। কারণ বাক্সটি তার দেহের তুলনায় অনেকটাই বড়। তার ছোট্ট দেহ, নতুন আর শেষ যাত্রার পোশাক বাক্সের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বালিশগুলো রাখা হয়। স্বজনেরা তাকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে, চোয়াল ঘিরে একটা রুমাল বেঁধে দিয়েছে─যেন তাকে রীতিমত সুদর্শন দেখায়। সে কফিনে সমাহিত হবার জন্য প্রস্তুত হলেও─জানত সে তখনও মরেনি। সে যদি উঠে দাড়াতে চাইত, তবে তা পারত। ‘আধ্যাত্মিকভাবে,’ অন্তত। কিন্তু এটি

তার সমস্যায় কোন কাজে লাগত না। বরং ভালো ছিল তাকে সেখানে দেহত্যাগ করার সুযোগ দেয়া। ‘মৃত্যুর’ কারনে দেহত্যাগই─ছিলো তার অসুস্থতা। এই অসুস্থতাটি বেশ কিছু সময় তার জীবনে ছিল। ডাক্তার তার মাকে আবেগহীন শুকনো গলায় বলেছিলেন: ‘সেনিওরা, আপনার বাচ্চাটিা গুরুতর অসুস্থ: ও মারা গেছে। তা সত্তে। ও,’তিনি বললেন, ‘আমরা ওকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখব। আমরা স্বয়ংক্রিয় পুষ্টির জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওর দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল রাখব। শুধুমাত্র ওর মটর ফাংশনটা একটু অন্য রকম হবে। ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নড়াচড়া করতে পারবে না। ওর বাড়বৃদ্ধি স্বাভাবিক উপায়ে হবে। যদিও এটি নিছকই একটি জীবন্ত মৃত্যু। ‘প্রকৃত আর সত্যিকারের মৃত্যু…।’ সে এলোমেলো ভাবে কথা গুলো স্মরণ করে। মনে হচ্ছে এধরনের কথা সত্যি কখনো শোনেনি। কথাটি তার মস্তিষ্কের তৈরী। কারণ টাইফয়েডের প্রচন্ড জ্বরের

সময় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে তার মস্তিষ্কে কিছু একটা ঘটেছে। সেই প্রবল উত্তেজনার ঘোরে ডুবে থাকা দিনগুলোতে সে ফারাওদের মমির কাহিনিটি শুনেছে। টায়ফয়েডের জ্বরটা বেড়ে গেলে নিজেকে এধরনের কোন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ভেবে নিতো। তখন থেকেই তার জীবনে এক ধরনের শূন্যতা শুরু হয়েছে। তখন থেকেই সে─কোনটা তার উত্তেজনাকর অবস্থার অংশ, আর কোনটা বাস্তব জীবনের─তা বিশেষ আলাদা করতে পারত না। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্মরণ করতে পারত না। সেজন্য সে এখন দ্বিধাগ্রস্ত। হতে পারে, ডাক্তার ‘জীবন্ত মৃত’ ─এই অদ্ভুত কথাটি কখনো বলেননি।’ কথাটি─অযৌক্তিক, আপাতবিরোধী, ও পুরোপুরি পরষ্পর বিরোধী। কথাটি তার মধ্যে সন্দেহ তৈরী করে─হয়তোবা আদৌ সে মরেনি। এমনটি সে আঠারো বছর পর্যন্ত ভেবে এসেছে।  যখন তার মৃত্যু হয়, তখন সে সাত বছর বয়সী একটা বাচ্চা ছেলে─তার মা কাঁচা কাঠ কেটে তার জন্য একটি ছোট্ট, বাচ্চাদের উপযোগী কফিন বানিয়ে ছিলেন, তবে ডাক্তার তাঁকে, একজন স্বাভাবিক প্রাপ্ত বয়ষ্কের উপযোগী বড়সড় কফিন বানাতে বলেছিলেন─কারন তার ক্ষয়িষ্ণু দেহের বৃদ্ধি হবে, সে একটা বিকৃত মৃতব্যক্তি অথবা বলা যায়, অস্বাভাবিক জীবিত ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। অথবা দেহ বৃদ্ধির ধারণা তাকে মনে করিয়ে দিবে তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ডাক্তারের সতর্কবাণী শুনে, তার মা প্রাপ্তবয়ষ্ক লাশের উপযোগী বড়সড় কফিনই তৈরী করেছিলেন। কফিনের ভিতরে তার ছোটখাটো দেহটা যাতে

আঁটোসাঁটো হয়ে থাকে, সেজন্য পায়ের কাছে তিনটি বালিশ গুঁজে দিয়েছিলেন। খুব শিঘ্রই, সে বাক্সের ভিতরে এমনভাবে বেড়ে উঠতে থাকে, যে─প্রতি বছর বালিশের কিনারা থেকে কিছু কিছু উল সরিয়ে নিতে হয়, যাতে তার বেড়ে উঠার পর্যাপ্ত যায়গা থাকে। এভাবেই সে অর্ধেক জীবন─অর্থাৎ আঠোরো বছর কাটিয়েছে। (তার এখন পঁচিশ বছর বয়স) আর সে তার স্বাভাবিক, সর্বশেষ উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। ডাক্তার সাহেব আর ছুতার মিস্ত্রি, তাদের হিসেবে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। কফিনটি দুই ফুট অতিরিক্ত লম্বা হয়ে গেছে। তারা ভেবেছে─সে বোধহয় তার বাবার উচ্চতা পাবে। তার বাবা ছিলেন দৈত্যাকৃতি। সে তার বাবার মতো হয়নি। কেবলমাত্র ঘন দাড়ি গোঁফ পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে। সেজন্য মা, তার ঘন, নীল দাড়ি মাঝে মাঝে আঁচড়ে দিতেন, যাতে তাকে কফিনেও কিছুটা ভালো দেখায়। যেদিন গরম পড়তো, সেদিন তার কাছে ওই সুসজ্জিত দাড়ি গোঁফ বিরক্তিকর ঠেকত। ’শব্দটি’ থেকেও কিন্তু, এমন কিছু খারাপ ছিল─যা তাকে বিচলিত করত। আর তা ছিল ইঁদুর! এমনকি সে যখন ছোট্টটি ছিল─কিছুই তাকে এতটা আতঙ্কিত করত না, যেটি ইঁদুর করত। তার পায়ের নীচে যে মোমবাতি পুড়তো─ওগুলোর গন্ধে ওরা আকৃষ্ট হতো। ইঁদুর এরই মধ্যে তার জামা কাপড় কেটে কুটি কুটি করেছে। সে জানে─ ওরা শিঘ্রই তার শরীর খুবলে খাওয়ার জন্য, কামড়ানো শুরু করে দিবে। একদিন সে দেখতে পায়: পাঁচ পাঁচটি চকচকে, দৃষ্টি পিছলে যাওয়া ইঁদুর টেবিলের পায়া বেয়ে বাক্স পর্যন্ত উঠে এসেছে। ওরা তাকে যেন গিলে খাচ্ছিল। মা বুঝে ফেললেন─ এভাবে ইঁদুরের উপদ্রব হলে কফিনে পাঁথরকুচি আর তার শক্ত হাড়গোড় ছাড়া কিছুই থাকবে না। তবে, তার মনের ভীতির─কারন কিন্তু এই নয় যে, ইঁদুর তাকে ভক্ষণ করবে। আর যাই হোক, সে কঙ্কাল নিয়েই দিব্যি বেঁচে থাকতে পারতো। সে মুহূর্তে যে বিষয়টি তাকে যন্ত্রনা দিচ্ছিল, তা হলো─ওই ছোট্ট প্রাণীগুলোর সর্ম্পকে তার সহজাত ভীতি। ওই মখমলে মতো তুলতুলে প্রাণীগুলোর কথা ভেবে─তার চুল খাড়া খাড়া হয়ে উঠল। ইঁদুরগুলো তার সারা শরীরময় দৌড়াদৌড়ি করছিল, চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে, হিম শীতল থাবা দিয়ে ঠোঁট মুছে দিচ্ছিল। একটা ইঁদুর তার চোখের পাতা বেয়ে উঠে, কর্নিয়া কামড়ানোর চেষ্টা করছিল। সে সেই দৈত্যাকৃতির বিরাট ইঁদুরটিকে দেখেছে। প্রাণীটি মরিয়াভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে তার রেটিনার মধ্যে দাঁত বসাতে। এদিকে সে মাথার প্রচন্ড ঝিমঝিমানিতে কুপোকাত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে─এটি আরেক ধরণের মৃত্যু।

সে স্মরণ করে─একদা তার বয়োঃপ্রাপ্তি ঘটেছিল। তার বয়স হয়েছিল, পঁচিশ। তার মানে হলো─তার দেহের আর কোন বাড়বৃদ্ধি হবে না। তার মুখমন্ডল দৃঢ়, গম্ভীর হবে। কিন্তু সে যখন স্বাস্থ্যবান হলো─তখন সে আর শৈশব সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না। তার কোন শৈশব নেই। সে মৃত হয়ে সময়টুকু কাটিয়েছে। তার মা সেই সময়─তার শৈশব আর বয়সন্ধিতে প্রচন্ড যত্ন নিয়েছেন। তার কফিনটি যে ঘরে ছিল─সে ঘরটির পরিবেশ যথার্থ স্বাস্থ্য সম্মত রাখার ব্যপারে রীতিমত উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি ফুলদানির ফুল ঘন ঘন পরিবর্তন করতেন। প্রতিদিন জানালা খুলে দিতেন─যাতে বিশুদ্ধ বাতাস ঘরে ঢোকে। তিনি সেই দিনগুলোতে, বেশ সন্তুষ্টি সহকারে গজ ফিতে দিয়ে দিয়ে ছেলের দৈর্ঘ্য মাপতেন। মেপে দেখতেন─ছেলে কয়েক সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে, তার আসল সন্তুষ্টি ছিল─ছেলেকে জীবিত দেখতে পাওয়া। সে সময়, তিনি খেয়াল রাখতেন─বাড়িতে যেন অপরিচিত কেউ না আসে। এটাও সত্যি, একটি পরিবারে দীর্ঘ সময় লাশের উপস্থিতি খুবই রহস্যময় এবং মেনে নেয়া কঠিন। তিনি অবশ্য এসবের খুব একটা তোয়াক্কা করতেন না। তবে, খুব শিঘ্রই তাকে হাল ছাড়তে হলো। বিগত বছরগুলোতে সে মাকে বিষণ্ন বদনে গজ ফিতে দিয়ে তাকে মাপতে দেখেছে। তিনি দেখতেন তার সন্তান আর বাড়ছে না। এ সময়ে সে এক মিলিমিটারও বাড়েনি। মা বুঝে গেছেন─এখন তার প্রিয়তম সন্তানের লাশে জীবনের চিহ্নমাত্র আর দেখতে পাবেন না। তাঁর ভয় হয়─হঠাৎ কোন একদিন সকালে, তিনি দেখবেন, তার সন্তান ‘সত্যিকারের’ মৃত। তিনি, কফিনে তার গায়ের গন্ধ শুকে, হতাশায় ভেঙ্গে পড়বেন। তাঁর মনে পড়বে─ইদানিং তিনি ছেলেটির দিকে মনোযোগে গাফিলতি করেছেন। এতদিন যেমন গজ ফিতে দিয়ে ছেলেকে যেমন সতর্কতার সাথে মেপেছেন, তেমনটি আর করছেন না। তিনিও বোধকরি জেনে গেছেন─ ছেলেটি আর বাড়বে না। আর সেও জানতো─সে এখন সত্যিই মৃত। তার দেহের যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এতদিন ধরে কোনমতে তার জীবনকে টেনে নিয়ে গেছে─সেগুলো হঠাৎ যেন কোথাও গুম হয়ে গেছে। বড় অসময়ে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। তার যে স্পন্দন সূক্ষ্নলয়ে চলতো─সেটিও উধাও হয়ে গেছে। দেহটা ভারী হয়ে গেছে পৃথিবীর আদিমতর পদার্থের প্রতি প্রবল আকর্ষণের টানে। মনে হচ্ছে─অভিকর্ষের চাপ তাকে আকর্ষণ করছে, অনড় ক্ষমতার বলে। একটা সত্যিকারের লাশের মতো ভারী। সে এখন বিশ্রামে আছে। তাকে এখন মৃত্যুর মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য, এমনকি শ্বাস প্রশ্বাসও নিতে হয় না। সে কল্পনায়, নিজেকে ষ্পর্শ না করে, একে একে তার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাঝ দিয়ে গেছে। কফিনে একটা শক্ত বালিশের উপর, তার মাথাটা বাঁদিকে একটু

কাঁত হয়ে আছে। সে কল্পনা করেছে─তার মুখটা একটু খোলা কারণ, ঠান্ডা সরু দন্ড তার কানের কাছে গলার ভেতরে ভরে গেছে। তার দেহ পঁচিশ বছর বয়সী গাছের মতো টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা হয়েছে। হয়তোবা, সে তার খোলা মুখটা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। মুখে বাঁধা রুমাল, তার চোয়ালকে ফাঁক করে রেখেছে। সে নিজেকে জায়গা মতো, সুবিন্যস্ত, ভদ্রস্থ লাশের মতো ভঙ্গিতে রাখতে অক্ষম। তার মাংশপেশী, অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো, আর আগের মতো আর সাড়া দেয় না। আগের মতো আর স্নায়ুতন্ত্রের ডাকে সাড়া দেয় না। আঠারো বছর আগে সে যা ছিলো, এখন আর তা নেই। সে এখন আর স্বাভাবিক কোন শিশু নয়─যে ইচ্ছে মত নড়াচড়া করবে। সে তার হেলে পড়া হাতটা অনুভব করে। হাতটা, কফিনের বালিশের ওপর শক্ত হয়ে চিরতরের জন্য নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার পেটটা অনেকটা আখরোট গাছের বাঁকলের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আর পা দুটোও তার প্রাপ্তবয়ষ্ক দেহের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে অসাড় হয়ে পড়ে আছে। তার শরীর এখন প্রশান্তিময় বিশ্রাম নিচ্ছে। যাই হোক, পৃথিবীটা হঠাৎ, শান্তিপূর্ণভাবে, কোন প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই থেমে গেছে। কেউ আর তার নিরবতা ভাঙ্গাবে না। যেন পৃথিবীর সব ফুসফুসের শ্বাস প্রশ্বাস

বন্ধ হয়ে গেছে─যাতে বাতাসের কোমল নিরবতাটুকু না ভাঙ্গে। সে অবোধ শিশুর মতো সুখ বোধ করে। একটি শিশু যেমন চোখ জুড়ানো ঘন সবুজ ঘাসের দিকে চেয়ে থেকে অথবা বিকেলের আকাশে এক টুকরো মেঘ উড়তে দেখে খুশিতে আপ্লুত হয়─অনেকটা তেমন তার সুখবোধ। সে সুখী─যদিও জানে, সে মরে গেছে, আর কৃত্রিম সিল্কের আবরণ দেয়া কফিনে চিরদিনের জন্য বিশ্রাম নিবে। এখন সে অনেক প্রাণোজ্জ্বল। অথচ, প্রথম মৃত্যুর পর সে এমনটি ছিল না। তখন সে নিস্তেজ, অবসন্ন বোধ করেছে। চারটে মোম তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। প্রতি তিনমাস অন্তর মোমগুলো পরিবর্তন করে নতুন মোম রাখা হয়। আজ সকালে মায়ের আনা রক্তবেগুনী ফুলের নৈকট্য এইমাত্র অনুভব করলো সে। লিলি আর গোলাপ ফুলের সৌরভ অনুভব করে। কিন্তু ওই সব ভয়ানক বাস্তবতা, তার ভিতরে কোন উদ্বেগের জন্ম দেয় না। বরং সে সেখানে নিঃসঙ্গতায় একাকী থেকেও সুখী। সে এখন ভয় পায় না। তবে কী ভবিষ্যতে ভয় পাবে? কে নিশ্চিত করে তা বলতে পারে? বিষয়টি চিন্তা করা কঠিন─সেই মূহুর্তে, যখন হাতুড়ি তার কফিনে পেরেক ঠুকবে, কাঁচা কাঠের ভিতরে, কফিনটা আরেকবার গাছ হবার আশা নিয়ে শব্দ করবে, স্যাঁতস্যাঁতে, কাদার মতো নরম মাটির গভীরে, তার শরীর─চার ঘন বর্গফুট উপরের, পৃথিবীর ভর অনুভব করবে। কবর খননকারীর শেষ আঘাতে জ্ঞান হারাবে সে। না। সে কবরে ভয়ই পাবে না। সেটি হবে মৃত্যুর দীর্ঘসূত্রীতা─তার অবস্থার চরম প্রাকৃতিক প্রলম্বন। তার দেহে এমনকি একটি ডিগ্রি তাপমাত্রাও নেই। তার মজ্জা চিরকালের জন্য জমাট বেঁধে যাবে। আর ছোট ছোট বরফ নক্ষত্র তার অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করবে।

কেমন করে সে তার নতুন জীবনে, মৃত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে! একদিন, যাই হোক, সে অনুভব করবে─তার কঠিন বর্ম ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে। সে তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের একটি করে নাম দিবে। ওগুলোকে অনুভব করবে, তবে দেখতে পারবে না। সে অনুভব করবে─ওগুলোর আর কোন সুনির্দিষ্ট আকার আকৃতি নেই। মৃত্যুর কাছে সমর্পণ করে জানবে─সে তার পরিপূর্ণ পঁচিশ বছর বয়সী শরীর হারিয়ে, কোন জ্যামিতিক মাত্রা ছাড়াই, এক মুঠো ধুলোয় পরিনত হয়েছে। বাইবেলে উল্লেখিত মৃত্যুর ধুলো। হয়তোবা তখনই সে খানিকটা স্মৃতিতাড়িত হবে। স্মৃতিটা কোন দৈহিক লাশের নয়─বরং একটা কাল্পনিক, বিমূর্ত লাশের নিকট জনকে ঘিরে অষ্পষ্ট স্মৃতি। তখন সে জানবে─একদিন সে কৈশিক নাড়ীসহ একটা আপেল গাছ হিসেবে পৃথিবীর বুকে জেগে উঠবে। কোন এক শরতে, কোন এক শিশুর খিদের নিরীহ কামড়ে জেগে উঠবে। জানবে─সে তার অখন্ডতা হারিয়েছে: সে আর স্বাভাবিক, সাধারণ কোন মৃত ব্যক্তি নয়─ব্যাপারটা তাকে বিষন্ন করে তুলবে। গতরাত সে তার নিজের লাশের সাথে একাকী সময় কাটিয়েছে। কিন্তু নতুন দিনের আগমনে, খোলা জানালায় কুসুম গরম সূর্যের প্রথম রশ্মির প্রবেশের সাথে সাথে, সে অনুভব করল─তার ত্বক কোমল হয়ে যাচ্ছে। এক মূহূর্ত সে বিষয়টা ভাবল। শান্ত, অথচ দৃঢ় চিত্তে। সে শরীরের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যেতে দিলো। কোন সন্দেহ নেই যে: সেখানে ‘গন্ধটি’ আছে। রাতের বেলায় লাশ পচে গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। তার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, অন্যসব মৃতব্যক্তির দেহের মতো পচতে শুরু করেছে। ‘গন্ধটি’  সন্দেহাতীতভাবে চটচটে মাংসের মতো। হঠাৎ চলে যায়, একটু পরে এসে আবার নাকে ধাক্কা দেয়। তার শরীর গত রাতের প্রচন্ড তাপে পচতে শুরু করেছে। হ্যাঁ। সে পচছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে, সে ফুলে রূপান্তরিত হবে। তার দেহের পচনশীল মাংসের পূতিগন্ধ ফুলের সুরভী হয়ে মায়ের নাকে গিয়ে পৌঁছাবে। তখন ওরা তাকে, অন্যান্য মৃত্যুর সাথে, দ্বিতীয় মৃত্যুর কালঘুমের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ, ভয় তাকে পিছন থেকে ছুরির ফলার মতো আঘাত করে। ভয়! এমনগভীর শব্দ, এতাটাই অর্থবহ! এখন সে সত্যি সত্যিই ‘শারিরিকভাবে’ ভীত। কারনটা কী? সে যথার্থভাবে উপলব্ধি করে আঁতকে উঠল: সে বোধহয় মৃত নয়। ওরা তাকে বাক্সের ভিতর রেখেছে। বাক্সটা অত্যন্ত নরম কোমল। এর ভেতর এতো বেশী কুশন রাখা হয়েছে যে, এটি এখন রীতিমত ভয়ানক আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। তবে, ভয়ের অপচ্ছায়া, চরম বাস্তবতার জানালা খুলে দিলো: ওরা তাকে জীবন্ত কবর দিতে যাচ্ছে!


সে মৃত হতে পারে না। কারন সবকিছুর প্রতি তার সচেতনতা পুরোমাত্রায় আছে: জীবনটা ঘূর্ণীর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে, আর তার সম্পর্কে ফিসফাস করছে। রামধনু রঙা হেলিওট্রোপ ফুলের মিষ্টি সুরভী, খোলা জানালা দিয়ে ভেসে এসে অন্য ফুলের ‘গন্ধের’ সাথে মিশে যাচ্ছে। সে ঠিকই বুঝতে পারছে─চৌবাচ্চা থেকে পানি ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ির কোণে যে ঝিঁঝি পোকাটি ছিল, সেটি তখনও ডেকে যাচ্ছে। ঝিঁঝি পোকাটা হয়তোবা ভেবেছে ভোর হয়ে গেছে। পৃথিবীর সবকিছু তার মৃত্যুকে প্রত্যাখ্যান করছে। সবকিছু, শুধুমাত্র ’গন্ধটা’  ছাড়া। কিন্তু, সে কীভাবে জানবে গন্ধটি তার? হতে পারে, তার মা আগের দিন, ফুলদানির পানি পরিবর্তন করতে ভুলে গেছে, আর তাই ফুলদানির ভেতরে ফুলের ডাঁটাগুলো পচতে শুরু করেছে। অথবা সেই ইঁদুর, যেটিকে বিড়াল তার ঘরে টেনে এনছে─সেটি প্রচন্ড উত্তাপে পচতে শুরু করেছে, সেখান থেকেও তো গন্ধটা আসতে পারে। না। ‘দুর্গন্ধটি’ কখনোই তার শরীর থেকে আসতে পারে না। কয়েক মূহুর্ত আগে, সে তার মৃত্যু নিয়ে খুশী ছিলো। কারন একজন মৃত মানুষ─তার অনারোগ্য শরীর নিয়ে সুখী হতে পারে। কিন্তু, একজন জীবিত ব্যক্তি নিজেকে জীবন্ত সমাধিতে সমর্পণ করতে পারে না। এখন অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো তার ডাকে সাড়া দেবে না। সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে না। আর এটাই এখন তার ভয়ের কারন, তার জীবনের আর মরণের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। ওরা তাকে জীবন্ত কবর দিতে যাচ্ছে। কফিনের বাক্সে ওরা যখন শেষ পেরেকটা ঠুকবে, সেই মূহুর্তটি সে হয়তোবা তা অনুভব করতে পারবে, জানতে পারবে। সে তার বন্ধুদের কাঁধের ওপর শুয়ে, তার থেমে যাওয়া দেহের শূণ্যতা অনুভব করতে পারবে। তার যন্ত্রণা আর হতাশা শবযাত্রার প্রতি পদক্ষেপের সাথে জন্ম নেবে। সে নিরর্থক উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করবে। চেষ্টা করবে সমস্ত দূর্বল শক্তিকে জড়ো করে, অন্ধকার, সরু কফিনের ভিতরে আঘাত হানতে─যেন শবযাত্রার লোকজনেরা জানতে পারে, সে এখনও জীবিত, আর ওরা তাকে জীবন্ত কবর দিতে যাচ্ছে। তবে এ প্রচেষ্টা নিস্ফল হবে। এখন আর অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো তার স্নায়ুতন্ত্রের শেষ আর জরুরী ডাকে সাড়া দিবে না। সে পাশের ঘরের শব্দ শুনতে পায়। এমন কি হতে পারে যে, সে ঘুমিয়ে আছে? সব মৃত মানুষের জীবনটাই কী শুধুমাত্র একটা দুঃস্বপ্ন? তবে থালা বাসনের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। সে বিষন্ন হয়ে গেল। হয়তোবা এজন্য কিছুটা বিরক্তও হলো। সে চেয়েছিল পৃথিবীর সব থালা বাসন, ঠিক তার পাশে দড়াম করে ভেঙ্গে খান খান

হয়ে যাক, অথবা বাইরের কোন কিছুর শব্দ তার ঘুম ভাঙ্গাক, যেহেতু তার নিজের ইচ্ছেটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু না। এটি স্বপ্ন ছিল না। সে নিশ্চিত ছিল─এটা যদি স্বপ্ন হতো, তবে তার বাস্তবে ফিরে আসার শেষ ইচ্ছেটা ব্যর্থ হতো না। সে আর জেগে উঠবে না। সে কফিনের কোমলতা অনুভব করে। আর ‘গন্ধটা’ আরো কড়া হয়ে তার কাছে ফেরত আসে। এতো বেশী কড়া যে─তার রীতিমত সন্দেহ হচ্ছে, যে এটি তার গন্ধ। সে সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ার আগে, স্বজনদের দেখতে চাইবে। তার পচে গলে বিকৃত হবার দৃশ্য, তারা দেখুক। প্রতিবেশীরা কফিনের বাক্স ফেলে, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ভয়ে পালাবে। ওরা থুতু ফেলবে। না। এ কাজটি ওরা করবে না। এখন এটিই ভালো হয়─ওরা তাকে কবর দিয়ে দিক। ‘সেটির’ বাইরে যত তারাতারি সম্ভব বের হতে পারলে ভালো হতো। এমনকি, এখন সে তার লাশের মধ্য থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। এখন জেনে গেছে─সে প্রকৃতপক্ষেই মৃত। অথবা, অন্তত উপলব্ধি করছে সে মৃত। সে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণের শেষ প্রার্থনা, শেষ লাতিন ভাষায় প্রার্থণা, আর সহকারী যাজকের তাতে এলোমেলো তাল মেলানো শুনতে পাবে। কবরস্থানের ঠান্ডা, ধুলো আর হাড়গোড়─এমনকি তার হাড়ের ভিতরে প্রবেশ করবে আর ‘দুর্গন্ধটি’ ছড়িয়ে পড়বে হয়তোবা খানিক। হয়তোবা─কে জানে!─সেই মূহূর্তের নৈকট্য তাকে অবসাদ থেকে বের করে আনবে। সে নিজেকে অনুভব করবে─নিজেরই ঘামে সে সাতার কাঁটছে, একটি চিটচিটে, থিকথিকে পানিতে, যেমন করে সে জন্মের আগে মায়ের জঠরে সাঁতার কেঁটেছে। হয়তোবা

তখনও সে বেঁচে আছে। কিন্তু সে মৃত্যুর কাছে এতাটাই সমর্পণ করেছে যে, নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পিত করে ভালোভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। প্রকাশকাল ১৯৪৭ পাদটীকা বা ‘তৃতীয় সমর্পণ’ মার্কেসের প্রথম ছোটগল্প। তিনি তখন কলম্বিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করছেন, যদিও সেখানে আইন পড়া তাঁর মতলব নয়। টুকটাক কবিতা লিখছেন, সেগুলোও খুব একটা যুৎসই হচ্ছে না। এমন সময় তাঁর জীবনে কাফকার আগমন ঘটে। একদিন বিকেলে তাঁর এক বন্ধু তাকে বোর্হেসের অনুবাদে কাফকার  ‘মেটামরফোসিস’ পড়তে দেন। কাফকা হাতে পেয়ে তিনি তাঁর বোর্ডিং হাউজের কামরায় গিয়ে জুতো খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বইটির প্রথম লাইন

১০

পড়ে তিনি তাজ্জব বনে যান, তাঁর কল্পনার জগৎ খুলে যায়। তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ আবিষ্কার করলেন। একটানে ‘মেটামরফোসিস’পড়ে শেষ করার ঠিক পরেরদিনই, তিনি নিজেই একটি গল্প লিখতে বসে যান, এবং লিখে ফেলেন, তাঁর জীবনের অদ্ভুত উচ্চাকাঙ্খী প্রথম গল্প ‘তৃতীয় সমর্পণ’। গল্পটি ‘এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা যে কিনা নিশ্চিত নয়, সে আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে, কিংবা হতে পারে সে জীবিত ও মৃত─দুটোই। তবে একজন জীবন্তব্যক্তি সমাধিস্ত হবার জন্য নিজেকে সমর্পন করতে পারে না। সে মুহূর্তে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার ডাকে সাড়া দিচ্ছিল না। সে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না, আর তখন সে তার জীবন, এমনকি মরণেরও সবচেয়ে বড় আতঙ্কে পড়ে যায়─ওরা বুঝি তাকে জীবন্ত কবর দিতে যাচ্ছে।’ গল্পটি এলোমেলো, খাপছাড়া হলেও তা যেন সাহিত্যকে ছাপিয়ে ওঠে, পাঠককে অদ্ভুতরকম সম্মোহনকরে রাখে এবং গল্পের প্রতিটি বিবরণে একজন শিক্ষানবিশ লেখককের নির্ভুল আত্মবিশ্বাস এবং বিস্ময়কর সঙ্কল্প টের পাওয়া যায়। গল্পটি ছাপানোর জন্য পত্রিকা অফিসে পাঠানো হয়। ঠিক দুই সপ্তাহ পরে, তিনি যখন বোগোতার মলিনো ক্যাফেতে বসে আছেন, তখন এল এস্পক্তাদরের পুরোপৃষ্ঠা জুড়ে ‘ছুটিরদিন’ লেখা ক্রোড়পত্রটি তাঁর নজরে আসে। তিনি উত্তেজিত হয়ে পত্রিকাটির একটি সংখ্যা কিনতে গিয়ে দেখতে পান বরাবরের মতো তাঁর ‘পাঁচ পয়সা কম পড়ে গেছে’। তিনি দৌড়ে বোর্ডিং হাউজে ফিরে গিয়ে বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে পত্রিকা সংখ্যাটি কিনে আনেন। ১৯৪৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, শনিবার,  এল এস্পক্তোদর পত্রিকার তের পৃষ্ঠায় শিল্পী এর্নান মেরিনোর চিত্রণে প্রকাশিত হয় ‘তৃতীয় সমর্পণ’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *