গদ্যনির্বাচিত

গদ্য।। বাংলাদেশের উপন্যাস: একটি সহজিয়া পর্যালোচনা।। মো. রেজাউল করিম

মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসের মাধ্যমে বঙ্গদেশের মানুষের মাঝে জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তিন পর্বের বিষাদ সিন্ধু সর্বশেষ খণ্ডসহ ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয়। সে-সময়ে উভয় বঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় ফারসি ভাষা থেকে ইংরেজি ও বাংলা ভাষা রপ্ত করতে শুরু করেছে। বাংলা ভাষায় প্যারী চাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরের প্রথম উপন্যাস আলালের ঘরের দুলাল প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। বাংলা উপন্যাসের প্রথম সফল নির্মাতা বঙ্কিম চন্দ্রের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা ভাষায় উপন্যাস সাহিত্যের বলিষ্ঠ এক মাধ্যম হিসেবে স্থান করে নিতে থাকে। এ-সময়ে মীর সাহেব বঙ্গের সংখ্যাধিক্য জনগোষ্ঠী, অথচ শিল্প-সাহিত্যে পিছিয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক এক মর্মান্তিক ঘটনার সাথে সম্পর্কিত পুরাণকে উপজীব্য করে শক্তিশালী ভাষাশৈলীতে উপস্থাপন করেন বিষাদ সিন্ধু, যা আজ অবধি এই বঙ্গে তথা বাংলাদেশের সাধারণ পাঠককুলের কাছে জনপ্রিয় এক সাহিত্য বলেই বিবেচিত হয়। তাঁর লেখা ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’ ও ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ও সমৃদ্ধ গদ্যসাহিত্য।

মীর সাহেবের পরে প্রায় অর্ধ শতাব্দী এই বঙ্গে আর কেউ সফল উপন্যাস রচনায় অবদান রাখতে পারেননি। যদিও অপর বঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসে কালজয়ী শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস রচনা করেন, সাধারণ ও বোদ্ধা পাঠক উভয়েই তাতে অবগাহন করে সাহিত্যের রসাস্বাদন করেন। ’৪৭-এ ভারত বিভাগের পরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে, (আজকের বাংলাদেশে) বেশ কয়েকজন ঔপন্যাসিকের নাম আমরা জানি। এঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবুল ফজল, কাজী আব্দুল ওদুদ ও সরদার জয়েনউদ্দিন অন্যতম।

সরদার জয়েনউদ্দিন পঞ্চাশের দশকে শিশুতোষ গল্প, ছোটগল্প ও ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি সমকালীন সামাজিক সংকট, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, গ্রামের অবহেলিত মানুষের সুখ-দুঃখের চিত্র, জমিদার- জোতদারদের শোষণ-নিপীড়ন তুলে ধরেছেন। তিনি উপন্যাসও রচনা করেন। তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিষয়বস্তু সমকালীন প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক, অথচ তিনি চার দশকের সাহিত্যচর্চায় এমন কোনো উপন্যাস রচনা করতে পারেননি যা শিল্পোত্তীর্ণ। কথাশিল্পী আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ক্ষেত্রেও একই বিশ্লেষণ প্রযোজ্য। শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল  উপন্যাস,  ছোটগল্প, নাটক, আত্মকথা, ধর্ম, ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ত্রিশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত সাহিত্যকর্মে যুক্ত ছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও পূর্বে সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হন। ১৯২৬ সালে তিনি ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ সালে মৃত্যু অবধি সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। বলতে অত্যুক্তি নেই যে, সরদার জয়েনউদ্দিন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল ফজল সকলেই বিদগ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁদের লিখিত প্রবন্ধ তৎকালীন সমাজের দর্পণ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। তাঁদের লিখিত প্রবন্ধ এই বঙ্গের প্রবন্ধ-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে তাঁরা যে কথাসাহিত্যিকও ছিলেন, তাঁদের লিখিত কোনো উপন্যাসই আজ তা প্রমাণে ব্যর্থ।

শওকত ওসমানের ১৩টি প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে ‘জননী’ ও ‘ক্রীতদাসের হাসি’ সমধিক পরিচিত। জননী উপন্যাসে তিনি তৎকালীন সমাজের রূঢ় ও জটিল আন্তঃমানব সম্পর্ক চিত্রায়ণের চেষ্টা করেছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আখ্যানভাগে লেখক মৌলিকত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে আখ্যানবয়ান বিশ্লেষণ করলে একথা বলতে দ্বিরুক্তি জাগে না যে, কিছু চরিত্র চিত্রায়ণে অবাস্তবতা ও অসংগতি বিরাজমান। তথাপি আখ্যানের মৌলিকত্ব, আখ্যানবয়ানে সাবলীল ও নান্দনিক ভাষার প্রয়োগে মুন্সিয়ানা ‘জননী’ উপন্যাসকে শওকত ওসমানের মৌলিক উপন্যাস হিসেবে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত। শওকত ওসমানের আর এক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’। ষাটের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ যখন এই বঙ্গের স্বকীয়তা ধ্বংসে তৎপর; মুক্ত চিন্তা ও তার স্বাধীন প্রকাশ যখন বাধাগ্রস্ত; তখন শক্তিমান চিন্তাবিদ ও ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসকে মাধ্যম করে পূর্ব বাংলার শোষিত-নিগৃহীত সমাজের মানসিক ও সামাজিক চিত্রপটকে মেটাফরিকালি শব্দছন্দে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর উপরোক্ত দুটি উপন্যাস ছাড়া অবশিষ্টগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত প্রায় আঠারো বছরে তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করেছেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ও একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, তাঁর মতো শক্তিমান লেখকের এতগুলো উপন্যাস কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া দুঃখজনকই বটে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রায় একই সময়ে কথাসাহিত্যের জগতে পদচারণা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। তিনি চল্লিশটির অধিক ছোটগল্প ও মাত্র ৩টি উপন্যাস রচনা করেন। ‘নয়নচারা’র ন্যায় তাঁর লেখা বহুসংখ্যক ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। অপরদিকে মাত্র ৩টি উপন্যাস রচনা করেই তিনি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে স্থায়ী আসন পোক্ত করে নিয়েছেন। কালজয়ী উপন্যাস ‘লালসালু’ তে তিনি বাংলাদেশের ধর্মীয় গোঁড়ামিযুক্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জনপদের এমন এক আখ্যান-চিত্র নির্মাণ করেছেন, যা সত্তর বছর পরেও এই বাংলাদেশে বিরাজমান। লালসালুর আখ্যান নির্মাণ, ঘটনাপ্রবাহের অসাধারণ সঙ্গতিপূর্ণ ধারাবাহিকতা, আখ্যানবয়ানে অপূর্ব ভাষাশৈলী শুধু যে গ্রন্থটিকে দীপ্তিময় কাহিনিচিত্র রূপায়ণে অসাধারণত্বের পরিচয় দিয়েছে তা-ই নয়, আখ্যানবয়ান পাঠককে শিল্পসমৃদ্ধ পাঠানন্দে বিভোর করে তুলেছে। বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, লেখক যেন নিপুণ কারিগরের মতোই শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে এমন এক কাব্যিক আখ্যান বয়ান তৈরি করেছেন যা লেখককে আলাদা করে চিনিয়ে দিবে কালকে অতিক্রম করে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রাজনীতি করতেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশে অবস্থান করে যা যা করা সম্ভব তিনি তা করেছেন। তিনি রাজনীতিসম্পৃক্ত মানুষ ছিলেন না সত্য, তবে সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগুলোতে বরাবরই উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং বেঁচে থাকার অপূর্ব স্পৃহা। বাংলা সাহিত্যের বিদগ্ধ এই সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, ধর্মের নামে প্রতারণা, মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন, বাংলার লোকায়ত ধ্রুপদী জীবনধারা প্রভৃতি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। উপন্যাস এবং গল্পে সমান বিচরণের কারণে আজো তিনি সর্বস্তরে প্রশংসিত। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ কথাশিল্পী। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর অতুলনীয় অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে যেমনি অনুপ্রাণিত করেছে তেমনি বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।

১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ওয়ালীউল্লাহর আরেক অনবদ্য উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’। এই উপন্যাস পড়ে অনুভূত হয় মানুষের নিজের ভেতরে লালন করা ন্যায়বোধের সাথে নিজেরও যে লড়াই হয়, সে লড়াইয়ে সামাজিক প্রতিপত্তিও যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার অসাধারণ এক আখ্যান ‘চাঁদের অমাবস্যা’। গভীর অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে আপাত বিশ্বাসকে যুক্তির আঘাতে ভেঙে সত্যকে আবিষ্কার করেন ওয়ালীউল্লাহ।

পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশে উপন্যাসের ভিত্তি রচিত হয় বলা যেতে পারে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালু’ যেন সেই ভিত্তির অলোকবর্তিকা। এ-সময়ে আবুল ফজল, সরদার জয়েনউদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সত্যেন সেন, আবু ইসহাক, শহীদুল্লাহ কায়সার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন। এঁরা সকলেই উপন্যাসের বিষয়-বৈচিত্র্য, তৎকালীন সমাজের অভ্যন্তরীণ মিথস্ক্রিয়া, বয়ানরীতিতে ভাষার প্রকরণ ও প্রয়োগ শিল্পোত্তীর্ণ- এ-কথা বলাই যায়। উল্লেখ করা অসঙ্গত হবে না যে, এই চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে এদেশে আরও কয়েকজন শক্তিশালী ও মেধাবী লেখক তাঁদের নিজ নিজ রীতিতে সাহিত্যচর্চা করেন। কিন্তু তাঁদের লিখিত উপন্যাস এ-দেশের সাহিত্যে বিশেষত্ব কিংবা স্থায়িত্ব লাভ করেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পঞ্চাশের দশক থেকে অসাম্প্রদায়িকতার যে সলতে ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে, ষাটের দশকে এসে তা শক্তিশালী স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়। সামরিক শাসন বিরোধী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেশের মানুষের মাঝে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির চেতনা থেকে বেরিয়ে নবতর চেতনা জাগ্রত হয়। পরিবর্তিত চেতনার সাথে সঙ্গতি বিধানে অসমর্থ বা অনিচ্ছুক লেখকবৃন্দের অনেকেই মেধাবী, বিজ্ঞ ও বাংলা সাহিত্যে পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও শিল্পোত্তীর্ণ ও কালজয়ী উপন্যাস রচনায় ব্যর্থ হন। এঁদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমেদ, আবুল ফজলের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, এদেশীয় সাহিত্যিকবৃন্দ উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন মূলত চল্লিশের দশকে। সে-সময়ে এদেশের মানুষ শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী ছিল বা বোদ্ধা পাঠকের ব্যাপক সমাহার ছিল এমনটিও না। আবার সে-সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের দরুন অধিকাংশ মানুষের মনন ধর্মীয় ভাবধারা প্রভাবান্বিত ছিল। সুতরাং এমন অনুসিদ্ধান্তে আসা নিন্দনীয় হবে না যে, তদানীন্তন ঔপন্যাসিকবৃন্দ তৎকালীন সমাজের পাঠকবৃন্দের মেধা ও মননকে প্রাধান্য দিয়েই উপন্যাস রচনা করেছেন। সময়ের চেয়ে অগ্রগামী সাহিত্য সৃষ্টিতে ব্রতী হননি।

তবে এই ক্রান্তিকালে রচিত আবু ইসহাকের উপন্যাস ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’র নাম উল্লেখ না করলেই নয়। ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। লেখক আবু ইসহাক এই উপন্যাসে কুসংস্কারের বাতাবরণে গড়ে ওঠা আখ্যানের গভীরে প্রবেশ করে কুসংস্কারের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছেন। অজ্ঞ সমাজের মানুষের কুসংস্কারের প্রতি গভীর বিশ্বাস এবং এর প্রভাব সমাজের দুর্বল মানুষের নিকট কত ভয়ংকর হতে পারে তার সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসে। ভাষিক পর্যালোচনা উপন্যাসটি সহজপাঠ্য, অথচ বয়ান-রীতি গভীর। নিগূঢ় অর্থবোধকতায় সমৃদ্ধ উপন্যাসটিতে সাবলীল বয়ানে সমাজের এমন এক বিষয়কে কথাশিল্পী আবু ইসহাক পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন যার আবেদন সত্তর বছর পরেও সমাজে বিদ্যমান। সাধারণত উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ ঘটলে বোদ্ধা পর্যালোচকবৃন্দ উপন্যাসের আবেদন হারিয়ে গিয়েছে─ এমন মন্তব্য করেন। বাংলা সাহিত্যে যে কটি উপন্যাসভিত্তিক চলচিত্র পর্যালোচকবৃন্দের কাছে সমাদৃত হয়েছে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসটি তার মধ্যে অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিক পর্যায়ের আসনে উপবিষ্ট হওয়ার দাবি রাখে। ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারসহ ৭টি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৫টি পুরস্কার অর্জন করে।

ষাটের দশকে বাংলা উপন্যাসে আবির্ভাব ঘটে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের। সুদীর্ঘ ষাট বছর তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের প্রায় সকল শাখায় রাজত্ব করেন। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম উপন্যাস ‘অচেনা’। এর পরে তিনি ২০১৯ সালে মৃত্যু অবধি বাংলাদেশের উপন্যাস জগতে নিজের বলদর্পী পদচারণা অব্যাহত রাখেন। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে মানব-জীবনের অন্তর্নিহিত টানাপড়েন, মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন, না-বলা আকাঙ্ক্ষা নির্বেদ, ও প্রজ্ঞাদীপ্ত এষণা। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস নিখুঁত আঙ্গিক বিন্যাস, সুললিত ও সাবলীল ভাষার গভীর ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ অপূর্ব শব্দসম্ভার।

এই দশকেই লেখকবৃন্দ শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন, যা বাণিজ্যিকভাবে সফল। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পরে মানুষের মাঝে পাকিস্তান আন্দোলনের মোহমুক্তি ঘটেছে। গোটা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয়েছে। তার প্রভাব এদেশের মানুষের মাঝেও লক্ষ্য করা যায়। এই দশকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাঝে জাতীয়তাবাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটতে শুরু করে। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার প্রসার লেখকবৃন্দকেও আলোড়িত করে।   

ষাটের দশকে এদেশের উপন্যাস-সাহিত্য বিশেষ এক গতিপথ তৈরি করে নেয়। এই সময়ে ঔপন্যাসিকবৃন্দ একই সাথে শিল্পমান ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি দুটোকে প্রাধান্য দিয়েই উপন্যাস রচনা করেন। বলা যায়, এই দশকেই এদেশের উপন্যাসের জগতে শিল্পোত্তীর্ণ কালজয়ী উপন্যাস নবতর ধারা সৃষ্টি হয়। এই দশকে একঝাঁক প্রগতিশীল চিন্তক এদেশীয় সমকালীন প্রেক্ষাপটকে উপজীব্য করে নবতর আখ্যান, শিল্পোত্তীর্ণ আঙ্গিক, আখ্যান-বয়ানে নিজস্ব রীতি, বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ শব্দসম্ভার ব্যবহার করে উপন্যাস রচনা করেন। গ্রামীণ সমাজের দারিদ্র্য, ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত সমাজে পারিবারিক টানাপড়েন, ভাষা আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সময়কার উপন্যাসের আখ্যান হয়ে ওঠে। এঁদের মধ্যে প্রথমেই ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্রে’র জনক আলাউদ্দিন আল আজাদের নাম উল্লেখ করতে হয়। কবি, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার আলাউদ্দিন আল-আজাদের উপন্যাস ষাট বছর পরে এখনও বোদ্ধা পাঠকবৃন্দকে আকৃষ্ট করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালু’ পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত, তবে ষাটের দশকে তাঁর অপর দুটি উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ ও ‘চাঁদের অমাবস্যা’ শিল্পোত্তীর্ণ কালজয়ী উপন্যাস নির্দ্বিধায় তা বলা যায়। পঞ্চাশের শেষ পাদে ‘জননী’ লিখে খ্যাতি অর্জনকারী শওকত ওসমান ষাটের দশকে সামরিক শাসনকে কটাক্ষ করে  রূপকধর্মী উপন্যাস রচনা করেন ‘ক্রীতদাসের হাসি’। এই উপন্যাসটি পরবর্তীতে রূপকধর্মী উপন্যাসের পরিচয় ছাপিয়ে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন তৈরি করে নেয়।   

বাংলাদেশের আর এক শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শওকত আলী ষাটের দশকে ‘পিঙ্গল আকাশ’ লিখে উপন্যাস রচনায় নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখেন। পরবর্তীতে যদিও তিনি ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘দক্ষিণায়নের দিন’ ও ‘উত্তরের খেপ’ লিখে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় রেখে যান। এছাড়াও রশীদ করীম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, হুমায়ুন কাদির, দিলারা হাশেম, শওকত আলী, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন, আবুবকর সিদ্দিক, সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, মাহমুদুল হক সম্ভাবনাময় কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে সমর্থ হন।

জহির রায়হান এর প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে ’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ অবধি তাঁর আটটি উপন্যাসের খোঁজ পাওয়া যায়। শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজকে নিয়ে উপন্যাস রচনায় তিনি যেমন বুৎপত্তি প্রদর্শন করেন, তেমনি গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে উপন্যাস রচনায় সমান বৃৎপত্তি প্রদর্শন করেন। হাজার বছর ধররে উপন্যাসেও তেমনই ভাষা শিল্পীর পরিচয় রেখে যান। তাঁর লেখা ‘বরফ গলা নদী’ শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আটপৗরে ক্লেদাক্ত জীবনের প্রতিচিত্র তুলে ধরেন, যে জীবনে আনন্দ, স্বস্তি ও শান্তির অস্তিত্ব নেই বললে চলে, যদিও এই সমাজের তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে আনন্দময় জীবন যাপনের। আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে তিনি যে ভাষাশৈলীর সাক্ষর রেখেছেন তা তাঁকে বাংলা উপন্যাসে অমরত্ব দান করেছে। উল্লেখ্য আলোচ্য দুটি উপন্যাসই পঞ্চাশ বছর পরেও পাঠকসমাজে জীবন্ত আখ্যানবয়ান বলেই বিবেচিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি সেদিন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ২৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ ১৯৭১, মাত্র তিন দিনের ঘটনাপঞ্জিকে উপজীব্য করে এপ্রিল থেকে জুন তিন মাস সময় তিনি অমূল্য দলিল তথা শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ রচনা করেন, যা একই সাথে উপন্যাস এবং ঐতিহাসিক ঘটনার কালপঞ্জি। ‘৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী তাঁকে অপহরণ ও হত্যা করে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত উপন্যাসসমূহের মধ্যে এই অমূল্য গ্রন্থখানি ভিন্ন রীতিতে লেখা এক কাব্যিক উপন্যাস। বইটি প্রসঙ্গে প্রাজ্ঞ সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ অধ্যাপক আবুল ফজল লিখেছেন, “এ বই-এর ভাষা আর রচনাশৈলী এমন এক আশ্চর্য শিল্পরূপ পেয়েছে যে পড়তে বসে কোথাও থামা যায় না। তার এমন নিখুঁত ছবি, এমন শিল্পোত্তীর্ণ রূপায়ণ আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।”

নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পুরো এক দশক আমাদের উপন্যাস সাহিত্যে শক্তিশালী আঁচড় কাটতে পারেনি। ভারত বিভাগের পরপরই দেশ বিভাগের জঠর যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জন্মভূমি ত্যাগ করে নতুন দেশে মানুষের জীবন-সংগ্রাম নিয়ে উর্দূ ভাষায় অনেক কালজয়ী ছোট গল্প, কবিতা ও উপন্যাস রচিত হয়। সেসব উপন্যাসের বেশ কিছু ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিতে সমর্থ্য হয়। কিষাণ চন্দর ও খুশবন্ত সিং-এর উপন্যাসসমূহ সত্তর বছর পরেও উপমহাদেশে জনপ্রিয় স্থান দখল করে রেখেছে। সত্তরের দশকেও দেশের ঔপন্যাসিকবৃন্দ উপন্যাস রচনা করেন। কিন্তু রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব কম সমৃদ্ধ উপন্যাসই রচিত হয়েছে। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে অনেকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেও ভুলে গেলে চলবে না যে, সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং ’পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশ হয়১৯৯৬ সালে সিনেমা তৈরী হয়। এছাড়া এই দশকে বাংলাদেশে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য উপন্যাস প্রকাশিত হয়নি, যা বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে স্থায়ী আঁচড় কাটতে সমর্থ হয়েছে। দশকের শেষ প্রান্তে সেলিনা হোসেন রচিত ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ শিল্পোত্তীর্ণ একটি উপন্যাস। তবে একথা উল্লেখ করা অসঙ্গত হবে না যে, জাতীর জীবনে সংঘটিত এত বড়ো একটি ঘটনা, যে ঘটনার মধ্য দিয়ে হাজার বছরের এক জনগোষ্ঠী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, অথচ সেই দেশের উপন্যাস-সাহিত্যে তার খুব বড়ো আঁচড়ই পড়ল না।

সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ সাধারণ ও বোদ্ধা পাঠক উভয়ের কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। অনেকেই এমন মত ব্যক্ত করতে দ্বিরুক্তি করেন না যে, সৈয়দ হক তাঁর উপন্যাসে যৌনতার অবতারণা করেছেন। উপন্যাসের আখ্যান, আঙ্গিক, বয়ান আপাতদৃষ্টিতে প্রাসঙ্গিক মনে হলেও অন্তর্নিহিত অর্থে Libido তাড়িত কিনা তা বিবেচনাযোগ্য। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে, সৈয়দ হক সময়ের অগ্রবর্তী চিন্তক ছিলেন। যে-কারণে বাংলাদেশের উপন্যাসের আখ্যানে প্রচলিত ট্যাবু ভেঙে যায় এবং উপন্যাসের আখ্যানে যৌনতা যুক্ত হয়; কোনো লেখক উপন্যাস-আখ্যানে যৌনতাকে শিল্পিতরূপে চিত্রায়িত করেন। এই দশকে সৈয়দ হক মুক্তযুদ্ধভিত্তিক দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ‘ এবং ‘নিষিদ্ধ লোবান’ লেখেন।

আশির দশকে বাংলাদেশে কথিত জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস আলোচনায় হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক ও প্রণব ভট্টের নাম প্রণিধানযোগ্য। একথা অস্বীকার করা অসঙ্গত হবে না যে, জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস বাংলাদেশের সাহিত্যজগত ও পাঠকমহলকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস বাংলাদেশের বাজারে পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাসের একচেটিয়া বাজারকে বিপরীতমুখী করে দেয়। বিপুল-সংখ্যক তুরণ-যুবক জনপ্রিয় ধারার উপন্যাসমুখী হয়ে পড়ে; বিশেষত হুমায়ূন-সাহিত্যে তারা বুঁদ হয়ে পড়ে। পরবর্তী দশকগুলোতেও অনেক নতুন ঔপন্যাসিক বিশেষত হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসরীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। প্রসঙ্গক্রমে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়; হুমায়ূন তাঁর বহু-সংখ্যক উপন্যাসে সাবলীল ও  বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলির অবতারণা করেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায়। তাঁর উপন্যাসগুলোতে মূলত সংলাপনির্ভর, বর্ণনা পরিমিত এবং স্বল্প পরিসরে বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভায় পারঙ্গম। ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগারে’র মতো নিপাট সামাজিক উপন্যাস দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে তিনি অতিবাস্তব, পরাবাস্তব উপন্যাসে ঝুঁকে পড়েন। হিমু, মিসির আলী, রূপা চরিত্র নিয়ে একের পর এক উপন্যাস রচনা করেন। বেশির ভাগ উপন্যাসে তিনি মধ্যবিত্তের ক্লেদাক্ত জীবনের পটচিত্র চিত্রায়ণ করেছেন। তাঁর লেখার আর এক বৈশিষ্ট্য হিউমার, যা তাঁর সকল সৃষ্টিতেই পরিদৃষ্ট হয়। তবে একথা অনস্বীকার্য নয় যে, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে আখ্যানবয়ানে যে সাবলীলতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা অনন্য। সৈয়দ শামসুল হক তাঁকে শব্দশিল্পী বলে অভিহিত করতে কার্পণ্য করেননি। ইমদাদুল হক মিলন শক্তিমত্তাসহ আবির্ভূত হন। তিনি ‘নুরজাহান’ ও ‘ভূমিপুত্রে’ তাঁর দৃঢ় সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তিনি হালকা রোমান্টিক উপন্যাস রচনায় ঝুঁকে পড়েন।

আশির দশকের শেষ পাদে শহীদুল জহির কথাসাহিত্যে নিজস্বতার পরিচয় তুলে ধরেন। আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু যদিও প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে এবং প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার পায়। ১৯৮৮ সালে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, মুখের দিকে দেখি বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন বলে বিবেচিত হয়। তিনি অবশ্য ছোট গল্পের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখেছেন তা-ই তাঁকে অবিনশ্বর করে রেখেছে। শহীদুল জহির ছিলেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্র ধারার লেখক। তাঁর সাহিত্য প্রথাগত ধারার বাইরে হওয়ায় একশ্রেণির পাঠকের কাছে বিস্ময়করভাবে সমাদৃত হয়েছে, আবার কিছু পাঠক তাঁকে ল্যাটিন আমেরিকার নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। শহীদুল জহির বাংলা কথাসাহিত্যের একঘেয়েমি গতানুগতিকতার বলয় থেকে বের হয়ে যাদুবাস্তবতার পরশমাখা আখ্যান রচনা করেন।

নব্বই এর দশককে বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। এই দশকে বাংলাদেশের উপন্যাসের শক্তিশালী পদযাত্রা স্থায়ী রূপলাভ করে। এ-সময়ে হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, প্রণব ভট্ট, আনিসুল হক জনপ্রিয় উপন্যাসের স্থায়ী পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সমর্থ হন। একই সাথে শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস রচিত হতে থাকে। পুরনো লেখকবৃন্দ নব্বই দশকে অনেক কালজয়ী শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস রচনা করেন। ‘সোনালী কাবিন’ খ্যাত কবি আল মাহমুদ গদ্যসাহিত্যে বিশেষত উপন্যাসে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হন এই দশকেই। ‘উপমহাদেশ’ আল মাহমুদ রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জীবনচিত্রকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যায় না, তবে যুদ্ধের ভয়াবহতা, হিংস্র্রতা, যুদ্ধের মাঝে প্রেম, দেশপ্রেম এ-সব কিছুরই প্রতিচ্ছবি তিনি দারুণ নিষ্ঠার সাথে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন লেখক এই উপন্যাসে। একজন কবি যখন গদ্য লিখেন তখন গদ্যকে যে ছান্দসিকভাবে উপস্থাপন করা যায় উপন্যাসটি যেন তারই প্রতিফলন।

প্রাবন্ধিক, ভাষা-বিষয়ক গবেষক হুমায়ুন আজাদ ১৯৯০-এর দশকে উপন্যাস রচনা করে শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর ভাষা দৃঢ় ও বিশুদ্ধ, কাহিনির গঠন সংহতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর উপন্যাস ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’ নব্বইয়ের দশকে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর রচিত ১৩টি উপন্যাসের মধ্যে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে সাহসী লেখক সত্তার পরিচয় বহন করে।

নাসরিন জাহান এমনই একজন ঔপন্যাসিক যিনি তাঁর প্রথম উপন্যাসের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সৃজনশীল সাহিত্যজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’ ১৯৯৪ সালে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে। অদ্যাবধি তাঁর চৌদ্দটি উপন্যাসের সন্ধান পেয়েছি। তাঁর মধ্যে নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস  লেখার প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়। নাসরিন জাহান তাঁর উপন্যাসে সস্তা পাঠকপ্রিয়তাকে অগ্রাধিকার  না দিয়ে বরং আখ্যানবয়ানে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে চেয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তাঁর উপন্যাস আত্মস্থ করতে হলে অ্যাখানের গভীরে অনুপ্রবেশ করতে হয়, চিন্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, সবশেষে বিশ্লেষণধর্মী মনন দিয়ে হৃদয়ের গভীরে ধারণ করতে হয়। তিনি বরং বিষয়বস্তু ও প্রকরণগতভাবে পূর্বের উপন্যাসের তুলনায় বিপরীত এক অবস্থানে বৈঠা নিয়ে তরী চালিয়েছেন, সবশেষে সফলভাবে কাঙ্ক্ষিত ঘাটে নোঙর করেছেন। নাসরিন জাহান সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিগূঢ় জীবন-সংগ্রামের চিত্র অসাধারণ শব্দমালায় পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর রচিত আখ্যান পাঠে সময় লেগে যায়, কেননা, তাঁর প্রতিটি রচনাতেই পাওয়া যায় কথকের উপস্থাপনায় বিশেষ এক দর্শন, সে দর্শন আত্মস্থ করতে না পারলে নাসরিন জাহানকে পড়া হয় না। কোনো কোনো পর্যালোচনাকারী তাঁর রচনাকে নারীবাদী তকমায় অভিহিত করলেও দোষের কিছু দেখি না। পুরুষনির্ভর এই সমাজে মর্যাদা, বোধ ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে নারীকে বিশেষ ভূমিকায় উপস্থাপন করা– তা-ও তিনি করছেন শৈল্পিক নান্দনিকতায়। তাঁর রচনার আর এক বৈশিষ্ট্য নারী-পুরুষের রমণক্রিয়ার শৈল্পিক উপস্থাপন।  আল মাহমুদের ‘জল বেশ্যা’ গল্পে তিনি নারী-পুরুষের রমণক্রিয়ার যে মাত্রায় শৈল্পিক উপস্থাপন করেছেন, নাররিন জাহানের সব লেখাতেই এমন নান্দনিকতার স্বাক্ষর পাঠকের নিকট জাজ্বল্যমান করে তুলেছেন।

নব্বইয়ের দশকে পূর্বতন লেখকগণ আরও বেশ কিছু শিল্পোত্তীর্ণ কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেছেন। এর মধ্যে শওকত আলীর ‘উত্তরের খেপ’, আখতারুজ্জামানের ‘খোয়াবনামা’, আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, ‘পুষ্প বৃক্ষ’ এবং ‘বিহঙ্গ পুরাণ’, ‘অলাতচক্র’ অন্যতম। পরবর্তী দশকেও আলোচ্য ধারা অব্যাহত থাকে। আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসটি মূলত রূপকধর্মী। এই গ্রন্থে তিনি উচ্চতর শিক্ষালয়ের শিক্ষকবৃন্দ পদ-পদবির মোহে যে মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে পারেন, তা তুলে ধরেছেন নিখুঁত বর্ণনায়। এই ধারা বর্তমানে আরও প্রকট হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ‘পুষ্প বৃক্ষ’ এবং ‘বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসে স্বীয় জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়, অকৃতদার জীবনের ব্যতিক্রমধর্মী মনোভাব, নিজ মতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রবল মনোশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সামনে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টা, শতজনের শত মন্তব্যে কিংবা কটাক্ষে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে নিজ মনোবাসনা চরিতার্থ করার প্রবল প্রবণতা, বৃক্ষের সাথে মানবজীবনের গূঢ় সম্পর্কের প্রকাশ, বিহঙ্গ তথা পক্ষীকুলের সাথে নিবিড় সম্পর্কের অকাট্য দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসে। হিন্দু-পুরাণ অনুসারে ‘ওঙ্কার’ শব্দের অর্থ ‘আদি ধ্বনি’ বা সকল ধ্বনির মূল। আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ বাংলাদেশে সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরিসরের উপন্যাস। ‘ওঙ্কার’ আপাদমস্তক ভাবগাম্ভীর্যে পূর্ণ একটি উপন্যাস। আহমদ ছফা তাঁর পুরো রচনায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন সৌন্দর্যের ফুল। শব্দশৈলীর গাঁথুনি সবল ও ছন্দময়। ওঙ্কার পাঠান্তে এর সাহিত্যরস অনুধাবনে প্রয়োজন অন্তর্দৃষ্টি। ওঙ্কার এমন এক উপন্যাস, যা প্রথা ভাঙতে শুরু করে প্রথম বাক্য থেকে। এবং প্রথা ভাঙার এ নিয়ম অব্যাহত থেকেছে পুরো সময়। ক্ষুদ্র পরিসরের এই বইয়ে লেখক যখন যেখানে যেভাবে মন চেয়েছে, শিল্পিত চর্চায় কাহিনির মোড় ঘুরিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় পাঠককে উদ্বেলিত করেছেন। তাঁর অপরাপর উপন্যাসমূহও স্ব স্ব মহিমায় ভাস্বর। 

একবিংশ শতাব্দীতে আরও যাঁরা বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে সৃষ্টিশীল কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে জাকির তালুকদার, পাপড়ি রহমান ও ইমতিয়ার শামিম উল্লেখযোগ্য।

ইমতিয়ার শামীম ভিন্ন রীতির গদ্যশৈলীসমৃদ্ধ উপন্যাস রচনা করে সাহিত্য বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর রচনা জনপ্রিয়ও বটে। তার রচনা পাঠান্তে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আখ্যান বয়ান, বাক্যবিন্যাস ও শব্দশৈলী নির্মাণে তিনি যেন এক জাদুকর। ইতিহাসের কালপর্ব ভিত্তিক উপন্যাস রচনায় তিনি সত্যাশ্রয়ী, আখ্যান বয়ানে সততা ও ভাষাশৈলীর মিশেল-সমৃদ্ধ তাঁর রচনা শিল্পোর্ত্তীণ, একই সাথে জনপ্রিয়ও বটে। তাঁর ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ এমনই এক উপন্যাস। 

আবুবকর সিদ্দিক অন্যতম কবি, গীতিকার হিসেবে সাধারন্যে পরিচিত হলেও কথাসাহিত্যে তিনি ভিন্ন রীতির দাবিদার। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গদ্যসমূহ বাংলা গদ্য কত শক্তিশালী, সাবলীল, ব্যঞ্জনাদীপ্ত ও বহুমাত্রিক হতে পারে তা প্রমাণ করে । উপন্যাসে বর্ণনাধর্মিতাকে প্রাধান্য দান তাঁর রচনাকে ভিন্নতা দান করেছে। ‘খরদাহ’, ‘জলরাক্ষস’, ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’ তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

জাকির তালুকদার লেখালেখি করছেন আশির দশক থেকে। ছাত্রজীবনে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী এই লেখক তাঁর লেখায়ও রাজনীতি-সচেতনতা সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর রচনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি প্রতিটি রচনাতেই সমাজবাস্তবতার সাথে ইতিহাস ও রাজনৈতিক কার্যকারণ সম্পৃক্ত করেই আখ্যান নির্মাণ করেছেন। বাংলাদেশের উপন্যাসের যাত্রাপথ, বিশেষত স্বাধীনতার পরে অনেকটাই সমাজ-কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ধর্মকে যেন পরিত্যাগ করেছে। বেশিরভাগ সাহিত্যে ধর্ম বিষয়টিই সম্পূর্ণ নেতিবাচকরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ, উপমহাদেশীয় সমাজকাঠামো ধর্মীয় বাতাবরণে আবদ্ধ। এমনকি ধর্মীয় পুরাণ ও সাহিত্যে ‘বিষাদ সিন্ধু’র পরে আর পরিদৃশ্যমান নহে। প্রতিটি ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আরবীয় ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাসের অনুবাদ সাধারণ পাঠকের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জাকির তালুকদার তাঁর রচনায় ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মিথ বা পুরাণের সংমিশ্র্রণে ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ‘কুরসিনামা’, ‘মুসলমানমঙ্গল’-এ এর স্বরূপ জাজ্বল্যমান। মুসলমানমঙ্গলে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এই দুই প্রপঞ্চ সংমিশ্রণের সাথে সাথে ধর্মীয় পুরাণের বিষয়সমূহ এখানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসের মাধ্যমে ভিন্নধর্মী বিশেষ আখ্যানের অবতারণা করেছেন। ইতিহাসের উপকরণ নিয়ে সার্থক ও জনপ্রিয় দুই ধরনের উপন্যাসই বাংলাদেশের উপন্যাসের ঝুলিতে আছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস রচনা করেছেন, যার বেশিরভাগই শিল্পোত্তীর্ণ। ইলিয়াস এক্ষেত্রে মাত্র দুটি উপন্যাসের মাধ্যমে যে সৃষ্টি আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন, তা শত বছরের খোরাক। কিন্তু জাকির তালুকদার তাঁর ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসের মাধ্যমে হাজার বছরের বাঙালির স্বাধীনতার চেতনা যেভাবে বিবৃত করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পর্যায়ক্রমিক বিশ্লেষণের জোর দাবি রাখে। তিনি ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন, বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম চলমান হাজার বছর ধরে। ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসে পরাক্রমশালী রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী এই জনপদের ভূমিপুত্র কৈবর্ত্যদের লড়াই ও জয়লাভের ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার চেতনার স্বরূপ সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। একটি উপন্যাসে কোনো এক জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা বয়ান সম্ভব না। তবে একটি ঘটনাই যদি সার্থকভাবে রূপায়িত হয় তাহলে ঐ একটি ঘটনাই পরবর্তী ঘটনার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ শাসনামলেও আমরা বারবার বাঙালিদের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করি। মাস্টার দা সূর্যসেন, সুভাষ বসু, তিতুমীর সহ আরও অনেকের সশস্ত্র আন্দোলন, ফরায়জী আন্দোলন, ফকির-সন্নাসী বিদ্রোহ– এসবই বাঙালির স্বাধীনতার চেতনার প্রত্যক্ষ অবদান।

জাকির তালুকদারের ‘মুসলমান মঙ্গল’ ও ‘পিতৃগণ’ উপন্যাস দুটি আমাদের সাহিত্য-সম্ভারে নিঃসন্দেহে দীর্ঘকাল আলোচিত হবে।

পাপড়ি রহমান তাঁর সব কটি উপন্যাসে সার্থকভাবে যে কাজটি করেছেন, তা হচ্ছে গভীর নিমগ্নতায় উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক অনুসন্ধান করা; তিনি মানবজীবনের নিগূঢ় দর্শন, মনস্তত্ত্ব, মানবীয় সম্পর্ক, মানবজীবনের নানাবিধ সংকট বাস্তব অথচ শিল্প-নান্দনিকতায় উপস্থাপন করেছেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে,  নানাবিধ কার্যাবলিতেও রয়েছে প্রকৃতির বিস্তর প্রভাব এবং মানব ও প্রকৃতির মাঝে যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ঘটে, সেসব তিনি সুনিপুণ দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন। এবং এই উপস্থাপনায় আধ্যাত্মিকতা ও বৈরাগ্য, প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির নান্দনিক ব্যাপ্তিতে দীপ্যমান। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উৎপাদন-পদ্ধতি যে তাদের নিজস্ব এক সংস্কৃতি তৈরি করে,  তার সার্থক রূপায়ণ পাপড়ি রহমানের উপন্যাস ‘বয়নে’ প্রস্ফুটিত। অন্যদিকে ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ উপন্যাসে বুড়িগঙ্গা নিজেই প্রধান-চরিত্র। অন্যান্য চরিত্ররাও বিকশিত হয়েছে এই নদীকে কেন্দ্রে রেখেই। এ-এক অনন্য সৃষ্টি।

বুড়িগঙ্গা নদীতীরবর্তী মানুষের যাপিত জীবনের বাস্তবচিত্র নিয়ে রচিত এ উপন্যাস। সাধারণভাবে গদ্যে কাব্য-প্রয়োগ প্রায়শই দেখা যায়। অনেকেই তা করে থাকেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আরোপিত হিসেবে প্রতীয়মান হয়। পাপড়ি রহমানের গদ্যে কাব্যের বিস্তর প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এসব প্রয়োগে যে মুনসিয়ানা তিনি প্রদর্শন করেছেন, তা অনুকরণীয়। কোনো কোনো রচনায় তিনি স্থানীয় ভাষায় সংলাপ ব্যবহার করেছেন, শুধু তা-ই নয়; অনেক আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে পাঠককে সেসব শব্দের সাথে পরিচিত করে তুলেছেন। এক অর্থে তিনি সার্থকভাবে পশ্চিমবঙ্গের গদ্য থেকে স্বতন্ত্র গদ্যধারা সৃষ্টি করেছেন। স্বতন্ত্র গদ্যরীতি নির্মাণে তিনি ছোটগল্পে যেভাবে যাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা ও রূপক চরিত্র গল্পে ব্যবহার করেছেন, তার উপন্যাসগুলিতেও তা দেখা গিয়েছে। বয়নের ‘মুল্লুকচান’ ও নদীধারা আবাসিক এলাকার ‘রেফুল’ চরিত্র তার উদাহরণ ।

পাপড়ি রহমান এক স্বতন্ত্র গদ্যরীতি নির্মাণে সিদ্ধহস্ত, একথা বলতে এখন আর দ্বিধা করা যায় না। কিন্তু একথা বলতে ক্লেশ বোধ হলেও বলতে হচ্ছে, এমন একজন ঔপন্যাসিক বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকমহলে যেন অনেকটাই অনালোচিত। অবশ্য বাংলাদেশের সাহিত্যে শিল্পসম্মত রচনার প্রসারও খুব যে বেশি বা আদরণীয়, তা-ও বলা যাচ্ছে না। তবে পাপড়ি রহমানের সৃষ্টি-সমূহ বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে এবং তা স্রোতস্বিনীর মতোই প্রবহমান থাকবে, এমনটা আশা করা আজ আর দুরাশা নয়।

একবিংশ শতাব্দির কথা সাহিত্যে হরিশংকর জলদাস চমক নিয়েই নিজেকে উপস্থাপন অনেকটাই ‘এলাম, জয় করলাম’ ঢং-এ। বাংলা সাহিত্যের এই অধ্যাপক পঞ্চান্ন বছর বয়সে নিজের জীবন ও সমাজের বর্ণবাদী কদর্য চিত্র বিশুদ্ধ ছন্দময় বয়ানরীতিতে প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ রচনা করেন। এই উপন্যাসে জেলেদের প্রাপ্তি-হাহাকার, আনন্দ-বিলাপ, মৃত্যু আর জাগরণের প্রতিচিত্র ফুটে উঠেছে নিখুঁত বর্ণনায়। ‘জলপুত্র’ এর সাফল্যের পর জেলে জীবনের উপাখ্যান উঠে আসে তার ‘দহনকাল’ উপন্যাসে, যে আখ্যানে জেলে সমাজে শ্রেণীচেতনার প্রকাশের পাশাপাশি গুরুত্ব পায় মুক্তিযুদ্ধে জেলেদের অংশগ্রহণ। শুধু জেলেদের জীবনের গল্প রচনাতেই থেমে থাকেনি হরিশংকর জলদাসের কলম। তিনি ‘রামগোলাম’ উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন হরিজন সম্প্রদায়ের জীবনগাথা। মহাভারতের নিন্দিত চরিত্র শকুনির প্রচলিত বৈশিষ্ট্যের বিপরীত দিক তুলে ধরে পৌরাণিক সময় ও বর্তমান সময়কে সমান্তরাল ধারায় উপস্থাপন করেছেন সাফল্যের সাথে সাজিয়ে লিখেছেন ‘সেই আমি নই আমি’ উপন্যাসে। হরিশংকর জলদাস নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে তাঁর আসন পোক্ত করে নিয়েছেন, যা অবিনশ্বর।

শাহাদুজ্জুমান জনপ্রিয় বথাসাহিত্যি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর লেখা কবি জীবননান্দের জীবন কেন্দ্রিক একজন কমলালেবু পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর ক্রাচের কর্নেলও অনুরূপ আলোচিত উপন্যাস। তবে এই উপন্যাসে ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতির অভিযোগ অনেকেই করেছেন। শাহাদুজ্জামান ছোটগল্পেও জনপ্র্রিয়। তাঁর লেখার সাবলীলতা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে।

সাম্প্রতিককালে বহুসংখ্যক তরুণ লেখক উপন্যাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন। এঁদের অনেকেই হুমায়নীয় প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম না। তবুও কিছু প্রতিশ্রুতিশীল লেখক বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে সমৃদ্ধি আনবে বলে মনে দৃঢ বিশ্বাস আমার।

One thought on “গদ্য।। বাংলাদেশের উপন্যাস: একটি সহজিয়া পর্যালোচনা।। মো. রেজাউল করিম

  • শারমিন আহমেদ

    সমগ্র রচনাটি প্রচুর পড়াশোনা করে লেখা হয়েছে। নাসরিন জাহান আমার পছন্দের লেখিকা কিন্তু তাঁকে নিয়ে তেমন আলোচনা দেখিনি। কিছু ক্ষেত্রে আমিও সহমত লেখকের সাথে। এই পরিশ্রমসাধ্য পর্যালোচনার জন্য ধন্যবাদ সুহৃদ লেখককে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *