Warning: Cannot modify header information - headers already sent by (output started at /home/kabyashi/public_html/wp-config.php:1) in /home/kabyashi/public_html/wp-content/plugins/post-views-counter/includes/class-counter.php on line 479 প্রবন্ধ।। শিশুসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী | কাব্যশীলন Warning: scandir(/home/kabyashi/public_html/wp-content/plugins/file-manager//assets/themes/.htaccess): failed to open dir: Not a directory in /home/kabyashi/public_html/wp-content/plugins/file-manager/backend/app/Providers/PreferenceProvider.php on line 86 Warning: scandir(): (errno 20): Not a directory in /home/kabyashi/public_html/wp-content/plugins/file-manager/backend/app/Providers/PreferenceProvider.php on line 86 Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/kabyashi/public_html/wp-content/plugins/file-manager/backend/app/Providers/PreferenceProvider.php on line 87

প্রবন্ধ।। শিশুসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

ভূমিকা

শিশুসাহিত্য বললে কোন ধরনের সাহিত্য মাথায় আসে? প্রথমেই প্রশ্ন জাগতে পারে শিশু কে বা করা? জাতি সঙ্ঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী শূন্য থেকে আঠার বছর পর্যন্ত সকল মানব সন্তানকেই শিশু বলা হয়। এই সংজ্ঞা থেকে শিশুদের একই অর্থে উল্লিখিত বয়সের মানব সন্তানকেই বুঝানো হয়ে থাকে। তবে শিশুশিক্ষা বা শিশুসাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা ওই বয়সের মধ্যেও বিভাজন করেছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদেরকে প্রারম্ভিক শিশু হিসেবে বিবেচনা করে তাদের জন্য পৃথক পাঠ্যক্রম ও পাঠ্য বই রচিত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে প্রারম্ভিক শিশুশিক্ষা নিয়ে অনেক বছর আগে কাজ শুরু হলেও বাংলাদেশে এই দশক থেকে সরকারি ভাবে কাজ শুরু করা হয়েছে। এজন্য এনজিও ও দাতা গোষ্ঠীর অবশ্যই অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে। প্রারম্ভিক বয়স পেরিয়ে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা ও পরে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। এই ক্ষেত্রে বয়সের বিভাজন থাকলেও শিশুদের পৃথক কোনো বিভাজন করা হয়নি। অর্থাৎ প্রারম্ভিক শিশুর মতো এমন বলা হয় না যে, প্রাথমিক শিশু বা মাধ্যমিক শিশু। তবে শিশুদের বয়স অনুযায়ী যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে পাঠ্য সূচি ও পাঠ্য বই রচনা করা হয়। এসব পাঠ্য বইয়েও সাহিত্যের বিষয়গুলো বিশেষ মানদণ্ডে বিবেচনা করে রচিত হয় কিংবা নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি পাঠ্য বই যদি বিশ্লেষণ করা হয় তখন সহজেই অনুমান করা যায় যে, কোন বয়সের সাহিত্যের স্বরূপ কেমন। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় শিশুসাহিত্য। আমরা পাঠ্য বই থেকে শুরু করেছি, কারণ, পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট থাকেন তারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং এ-বিষয়ে সম্যক ধারণা নিয়েই পাঠ্য বই রচনা করেন। প্রতিটি শ্রেণির বই বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সেসব সাহিত্যে বাক্যের সংখ্যা, শব্দের সংখ্যা, লেখার ধরন ইত্যাদির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এর কারণ, শিশুদের বয়স ও যোগ্যতা বিবেচনা করেই সাহিত্যের এই মান নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।বাংলাদেশে অনেক ছড়াকারকে বলতে শোনা যায় তিনি শিশুসাহিত্যিক। এ-রূপ বলাটা খুব যে সহি তা নয়। ছড়াকার মানেই শিশুসাহিত্যিক হবেন এমন কোনো গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন না। যদি কোনো ছড়াকার বড়দের জন্য ছড়া লিখেন অর্থাৎ শিশুদের উপযোগী ছড়া না লিখেন সেক্ষেত্রে তাকে শিশুসাহিত্যিক বলাটা খুব দুরস্ত হবে বলে মনে হয় না। এখন ফিরে দেখা যাক শিশুসাহিত্যের ধরন কেমন হওয়া উচিত।

প্রথমেই আমরা বয়সের বিষয়টি উল্লেখ করেছি শুধুমাত্র শিশুসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য গুলোকে ভালো ভাবে খতিয়ে দেখার জন্য। ইংরেজি ভাষার শিশুসাহিত্য রচিত হয় বয়স বিবেচনা করে। বিশ্লেষক ও সমালোচকগণ ইংরেজি শিশুসাহিত্যকে পরিষ্কারভাবে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেখিয়েছেন। যেমন, তিন থেকে চার বা পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের টডলার, ছয় থেকে বারো বছর বয়সীদেরকে আর্লি চিলড্রেন এবং বারো থেকে আঠার বছর বয়সীদের এডাল্ট চিলড্রেন বিবেচনা করে শিশুসাহিত্যকে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশে র্শিশু ও কিশোর সাহিত্য বলে অনেকেই সাহিত্যকে বিবেচনা করছেন কিন্তু এখানে পরিষ্কার করে শিশুসাহিত্যের বয়সের বিভাজন করা হয়নি। ফলে অনেক ছড়াকারই নিজেদেরকে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে দাবি করলেও তাদের ছড়া কোন বয়সী শিশুর জন্য নাকি বড়দের জন্য সে বিবেচনা করা হয় খুব জরুরি। এ-কারণেই বাংলা সাহিত্যের শিশুসাহিত্যের গল্প বা ছড়া বা কবিতা গুলো আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে পরিষ্কার ভাবে দেখা যায় দশ থেকে আঠারো বছর বয়সী শিশুদের উপযোগী সাহিত্যকর্মই বেশি। হাতে গোনা কিছু পাওয়া যায় টডলার বা আর্লি চিলড্রেন দলের সদস্যদের জন্য।

বাংলাদেশে শিশুসাহিত্য একটি গণ্ডির মধ্যে দীর্ঘকাল বন্দি থাকলেও সম্প্রতি কয়েক বছরের মধ্যে সে গণ্ডি থেকে বের হয়ে এসেছে। দীর্ঘকাল যে শিশুসাহিত্য রচিত এসেছে সেখানে তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের সাহিত্য তেমন চোখে পড়েনি। ইংরেজি সাহিত্যে এই বয়সী শিশুদের বলা হয় টডলার, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত এই বিষয়টি বা এ-রকম সাহিত্য উপেক্ষিত থাকায় এদেশের মানুষের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে বলেই আমরা অনুমান করতে পারি। এমনটি অনুমান করার পিছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যেমন, বিভিন্ন গবেষণা দেখা গেছে বাংলাদেশের শিশুদের পঠন দক্ষতা ভয়াবহ রকমের খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। এই খারাপ অবস্থার জন্য মূল কারণটি হলো তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের অর্থাৎ টডলাদের হাতে তাদের উপযোগী বই দিতে না পারা। অন্যদিকে টডলার দলের শিশুদের জন্য যে বই হতে পারে তা অনেক শিশুসাহিত্যিকের ধারণাই করেন না। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সে ধরনের আভাসই পাই। তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের বই হওয়া উচিত ছবি ভিত্তিক। পূর্ণ পৃষ্ঠায় মজার ছবি থাকবে, লেখা একটি বা দুটি শব্দ বা সহজ বাক্য থাকবে। শিশুরা ছবি দেখেই বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং পড়ার প্রতি আগ্রহী হবে— এই সত্যটিই পৃথিবীর উন্নত দেশের মানুষেরা অনেক আগেই অবধারণ করলেও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই ধারণাটি এখনও উল্লেখ যোগ্য ভাবে গৃহীত হয়নি। ইংরেজি সাহিত্যে পিকচার বুক বা ছবি ভিত্তিক শিশুতোষ গল্পের বা ছড়ার বই অনেক সমাদৃত এবং আন্তর্জাতিক ভাবে পুরস্কারও প্রদান করা হয়। এসব পিকচার বুক বইয়ের ছবির মান যেমন উন্নত ঠিক তেমনি বইগুলো অনেক ব্যয়বহুল। উন্নত মানের কাগজ, ছাপা, মলাট ইত্যাদি সবই উচ্চ মূল্যের। তবে বইয়ের পাতা উল্টালে পাওয়া যাবে এক পাতায় একটি শব্দ বা একটি বাক্য অথবা বড়জোড় দুটি বাক্য। বাংলাদেশে এধরনের কোনো বই আগে চোখে না পড়লেও গত কয়েক বছর ধরে এমন বই অনেক ছাপা হচ্ছে। Maurice Sendak রচিত Where the Wild Things Are! বইটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত এবং অনেক আলোচিত একটি বই। এই বইয়ের ছবি লেখক নিজেই এঁকেছেন। এই বইটিতে কোনো কোনো পৃষ্ঠায় একটি মাত্র শব্দ রয়েছে। তবে ছবিগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং যেকোনো শিশুকেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম। বইয়ের সাইজও বেশ বড়। শিশুদের জন্য লেখা বই বলে বইয়ের সাইজ কিন্তু শিশুসাইজ নয়। বাংলাদেশে দেখা যায় যে, শিশুদের বইয়ের সাইজ বা আকারও শিশুদের মতো ছোট বানানো হয় যা বিজ্ঞান সম্মত হয় এবং শিশুদেরকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করারই সামিল। উল্লিখিত বইয়ের মতো উন্নত বিশ্বে শত শত বই রয়েছে যেসব বই শিশুদের ছবি দেখানোর মাধ্যমে পড়তে আগ্রহী করার জন্য উৎকৃষ্ট উপকরণ। এই দশকের আগে বাংলাদেশে একটি মাত্র প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিদেশি বইয়ের অনুবাদ করে টডলারদের চাহিদা কিছুটা পূরণ করেছে। এই প্রকাশনার বইগুলো শুনেছি দেশের বাইরের শিল্পীর আঁকা ছবি। বইয়ের অন্যান্য উপকরণ খুব বেশি উন্নত না হলেও ছাপা, হরফের আকার ইত্যাদি বেশ আকর্ষণীয়। আমরা যে বয়সী শিশুদের অবজ্ঞা করে বই প্রকাশ করছি না সেই বয়সী শিশুদের জন্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে বই থাকার প্রয়োজন; আমাদের বিবেচনায় এই প্রত্যয়টি রাখা দরকার।


স্তর ১
বয়স ৩-৫ ছবি প্রধান বই। চেনাজানা মৌলিক শব্দে লেখা।
মাঝে মাঝে শব্দের পুনরাবৃত্তি। লেখার সঙ্গে ছবির মিল।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্য সংখ্যা ১ বা ২। প্রতি বাক্যে শব্দের সংখ্যা ৪-৬।
স্তর ২
বয়স ৫-৬ বছর ছবি প্রধান বই। চেনাজানা মৌলিক শব্দ।
মাঝে মাঝে শব্দের পুনরাবৃত্তি। লেখার সঙ্গে ছবির মিল।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্য সংখ্যা ১-৩। প্রতি বাক্যে শব্দ সংখ্যা ৬-৮।
স্তর ৩
বয়স ৬-৭ বছর সহজ সরল শব্দ। ছোট বাক্য।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্যের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৫।
প্রতি বাক্যে শব্দ সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০।
সাধারণ গল্প। পৃষ্ঠার অধিকাংশেই ছবি।
স্তর ৪
বয়স ৭-৮ বছর সহজ সরল শব্দ।
বাক্য সামান্য দীর্ঘ। বাক্যে শব্দ সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২।
আনন্দদায়ক মজার গল্প। লেখার সঙ্গে ছবির মিল।
স্তর ৫
বয়স ৮-৯ বছর কিছু জটিল ও কঠিন শব্দ।
প্যারাগ্রাফে বিভক্ত। বাক্য দীর্ঘ।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ৮।
সর্বোচ্চ শব্দ সংখ্যা ১৮।
গল্পের সঙ্গে শিশুকে সম্পৃক্ত করার মতো প্লট।
প্যারাগ্রাপের সঙ্গে ছবির মিল।
স্তর ৬
বয়স ৯-১০ বছর অপেক্ষাকৃত বড় প্যারাগ্রাফ।
জটিল ও কঠিন শব্দ। গল্পের প্লটে দ্বন্দ্ব ও সমাধান।
বাক্যে সর্বোচ্চ শব্দ সংখ্যা ২০।
গল্পের সঙ্গে শিশুকে সম্পৃক্ত করার মতো প্লট।
প্যারাগ্রাপের সঙ্গে ছবির মিল।
স্তর ৭
বয়স ১০-১২ বছর চ্যাপ্টার বা অধ্যায় যুক্ত করা।
বিভিন্ন ধরনের শ্রেষ্ঠ গল্প (ক্লাসিক)।
প্রতি অধ্যায়ে এক বা একাধিক ছবি।

শিশুসাহিত্যের সংকট ও উত্তরণের উপায় শিশুসাহিত্য নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করলে বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন সংকট চোখে পড়ে বা অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় যা এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। শিশুসাহিত্যের সংকট আমরা কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি। প্রথমে বলা যেতে পারে বড়দের বা অভিভাবকদের মানসিকতা হলো শিশুদের যত পারা যায় তত শেখাতে হবে। এ কারণেই অভিভাবককেরা শিশুদের ‘পড়তে শেখার’ বই না দিয়ে তারা দিয়ে থাকেন ‘শেখার জন্য পড়ার’ বই। অভিভাবকরাও হয়তো জানেন না কোনটি প্রকৃতপক্ষে শিশুদের উপযোগী বই। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বইমেলায় যেসব বইয়ে লেখা কম ছবি বেশি অভিভাবকগণ সে বইটি কিনতে চান না। এই ধরনের মানসিকতা একটি বড় ধরনের সংকট বলেই আমরা অভিহিত করতে চাই। বড়দের বা অভিভাবকদের বুঝতে হবে তিন বছরের শিশুরা যা পড়তে পছন্দ করবে দশ বছরের শিশুরা সেটা পছন্দ করবে না। পক্ষান্তরে দশ বছরের শিশুরা যে সাহিত্য পড়তে পছন্দ করবে সেটি কোনো ভাবেই তিন বা চার বা পাঁচ বছরের শিশুরা পছন্দ করবে না। তাই বড়দের মানসিক সংকট আগে দূর করা দরকার এবং তাদের বুঝতে হবে শিশুদের হাতে প্রথম যে বইটি দেব সেটি হতে হবে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, চমৎকার ছবি, লেখার ভারে ভারাক্রান্ত নয় এবং শিশু যেন বইটি নিজে নিজে পড়তে পারে। একবার যদি একটি শিশু কোনো একটি বই পড়ে শেষ করতে পারে তাহলে তার মধ্যে দেখা যায় বই পড়ার আনন্দোচ্ছ্বাস। সে নিজেই লাফাবে আর বলবে, আমি একটি বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। এই আনন্দই শিশুকে নিয়ে যাবে পরবর্তী ধাপে। পড়ার জগতে প্রবেশদ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হবে। আর যদি এমন বই দেন যা শিশুদের আকৃষ্ট করে না তাহলে বুঝতে হবে পড়ার জগতে শিশুর একটি দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এখন অভিভাবক হিসেবে চিন্তা করতে হবে কোন ধরনের বই প্রথমে শিশুর হাতে দেবেন। অভিভাবকদের ভাবনা থেকে আমরা লেখকদের ভাবনার জগতেও প্রবেশ করতে চাই। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কম শব্দে লেখার গল্প যা ছবি নির্ভর বই দেখে অনেক নামি দামি শিশুসাহিত্যিক সরাসরি বলে ফেলেন, ফাঁকিবাজি আর কত করবেন? বিষয়টি এতোটা নেতিবাচক হিসেবে দেখার আগে আমাদের দেখা উচিত আমরা কোন বয়সী শিশুদের হাতে প্রথম শিশুসাহিত্যের বই তুলে দিতে চাই। যদি ধরা হয়ে থাকে আট থেকে দশ বছরের বয়সী শিশুদের হাতে প্রথম বই দিতে চাই তাহলে কোনো কথা নেই; নামিদামি লেখকদের কথাই বিচার্য। আর যদি মনে করা হয় তিন বছর বয়সী শিশুদের হাতে প্রথম বই দিতে চাই তাহলে অন্যকথা রয়েই যায়—মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য।

সব শিশুসাহিত্যিকের এই মানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার। অবশ্যই আমাদের হতাশার অন্ধকার অনেকটা কেটে গেছে, বর্তমানে বেশ কয়েকজন লেখক বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য অর্থাৎ শিশুদের বয়স বিবেচনা করেই তারা গল্প নির্মাণ করছেন এবং বই প্রকাশ করার জন্য প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা কারো নাম উল্লেখ করছি না, তবে তাঁদের নাম উল্লেখ করে পরবর্তী সময় বিস্তারিত একটি নিবন্ধ লেখার ইচ্ছে রইল। অভিভাবক ও লেখকের মানসিক সংকটের পরেই আসে প্রকাশকের মানসিক সংকটের কথা। বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ শয়ের মতো প্রকাশক আছেন। তাদের মধ্যে শুধু শিশুসাহিত্যের বই প্রকাশ করছে এমন প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটটি প্রকাশক বর্তমান সময়ে লক্ষ করা যায়। এছাড়া, বড়দের বই প্রকাশ করার প্রকাশকদের অনেকেই এখন শিশুদের বই প্রকাশ করার দিকে এগিয়ে এসেছে। এর ফলে শিশুদের বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি গর্বের বিষয়ও বটে। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রকাশকদের মধ্যে হাতে গোনা চার/পাঁচটি প্রকাশক আছে যারা শিশুদের বয়সের দিকটি মাথায় রেখে বই প্রকাশ করে। এদের মধ্যে পাঞ্জেরি, ওয়ার্ল্ড চিলড্রেনস’ বুক, কালান্তর, ইকড়িমিকড়ি, ছোটদের বই অর্থাৎ তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু বা টডলার গ্রুপের শিশুদের জন্য মানসম্মত ও ব্যয়বহুল বই প্রকাশ করছে যা উল্লেখ করার মতো। কয়েকটি এনিজও এই কাজ করলেও রুম টু রিডই কেবল মানসম্মত বই প্রকাশ করছে যা উল্লেখ করার মতো। অন্যান্য প্রকাশকের মধ্যে এক প্রকার মানসিক সংকট আছে যারা টডলার গ্রুপের শিশুদের জন্য বই প্রকাশ করতে চান না। তারা গল্পই খুঁজে পান না, ফলে বর্তমান সময়ে যারা এই গ্রপের শিশুদের জন্য গল্প লিখছেন বা সাহিত্য রচনা করছেন তাদের জন্য একটি হতাশার কারণও বটে। প্রকাশকদের মধ্যে এই সংকট থাকার কারণ বাজার ব্যবস্থা। তারা ব্যবসা করবেন লোকশানের চিন্তা করে নয়। অভিভাবকদের মানসিকতার ওপর নির্ভর করে তাদের মানসিকতাও তৈরি হয়েছে। যেহেতু, অভিভাবকরা এখনও ছোট শিশুদের বা টডলার গ্রুপের শিশুদের হাতে বই দেওয়ার জন্য বই কিনেন না সেহেতু তারা এই ধরনের ছবি নির্ভর বা পিকচার বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হন না। তবে প্রকাশকদের দায়িত্ব হবে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করে ছোট শিশুদের হাতে ভালো বইটি দেওয়ার জন্য তৈরি করা শিশুসাহিত্যের সবচেয়ে বড় সংকট হলো বাংলাদেশে আঁকিয়ের খুব অভাব। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিশুসাহিত্য মানেই চমৎকার ছবি দিয়ে সাজানো একটি বই যে বইটি হাতে নিয়েই শিশুরা মুগ্ধ হবে। এই ধরনের ছবি আঁকিয়ের সংখ্যা এদেশের প্রকাশক, জনসংখ্যার তুলনায় খুবই কম মানে নগন্য এবং তারা অলঙ্করণের ব্যাপারে অনাগ্রহীও বটে। অবশ্যই আঁকিয়েদের অভিযোগ আছে যে তারা প্রকাশকদের কাছ থেকে টাকা পান না এবং প্রকাশকদের অভিযোগ আছে তারা যথা সময়ে কাজ দেন না। এই সংকট থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে এবং উভয় পক্ষের পেশাদারিত্ব বাড়াতে হবে। একটি উন্নত ও পড়ুয়া জাতি গঠনের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে গোড়া থেকে। তাই প্রত্যেক সচেতন মানুষের নিজে দায়িত্ব বোধের জায়গা থেকে শিশুদের জন্য কাজে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদের পড়ার উপযোগী ও আনন্দদায়ক বই পড়তে দিতে হবে।



শিশুর বই কেমন হওয়া উচিত


পূর্বের আলোচনার সঙ্গে সাজুয্য রেখে বলা যায় যে, শিশুদের উপযোগী বইয়ের কারণেও শিশুরা প্রত্যাশিত পর্যায়ে পঠন দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয় না শিশুদের হাতে প্রথমে এমন বই দেওয়া উচিত যা শিশুদের পড়তে আগ্রহী করে তোলে। শিশুর বয়স তিন বছর হলেই তাদের হাতে ছবির বই দেওয়া উচিত। মজার মজার ও সুন্দর ছবি, পশুপাখি নিয়ে মজার মজার গল্প, রূপকথা ইত্যাদি বই শিশুদের জন্য বেশি উপযোগী। একটি বইয়ে একটি গল্প, বড় হরফ, বাক্যের সংখ্যা কম ইত্যাদি এমনভাবে বই তৈরি করতে হবে যাতে শিশু পড়তে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিশুর তিন বছর বয়স থেকে তাকে পড়ে শোনাতে হবে। বড়রা এই কাজটি যদি করেন তাহলে শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে। মা-বাবা, বড় ভাইবোন বা অন্যান্য কোনো ব্যক্তি শিশুদের নিয়ম করে বই পড়ে শোনালে বই পড়ার প্রতি শিশুরা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আগ্রহী হবে এবং একবার পড়ার দক্ষতা যদি শিশু অর্জন করতে পারে এবং বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয় তাহলে তার লেখাপড়ার পথটিও স্বয়ংক্রিয় ভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়। শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন বইপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বয়সভিত্তিক শিশুদের বই কেমন হবে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। এই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে কালান্তর (প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান) একটি স্তর বিন্যাস করেছে। তবে এই স্তর বিন্যাস যে চিরন্তন তা নয়। এখানে কিঞ্চিৎ হের ফের হতে পারে। শিশুদের বই যে বড়রা পড়ে না তা নয়। তবে সর্বজনীনতা বিবেচনা করে যে স্তর বিন্যাসটি কালান্তর করেছে তা গ্রহণযোগ্য বলেই প্রতীয়মান হয়। এই স্তর বিন্যাসটি আন্তর্জাতিক মান থেকে সামান্য ভিন্ন। তদুপরি শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য এই স্তর বিন্যাসটি উপযোগী ও কার্যকরী বলে আমরা মনে করি। পড়ুয়া জাতি গঠনের জন্য এবং শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলার দায়িত্ববোধ থেকেই কালান্তরের স্তর বিন্যাসটি নিন্মে উল্লেখ করা হলো।

স্তর ১
বয়স ৩-৫ ছবি প্রধান বই। চেনাজানা মৌলিক শব্দে লেখা।
মাঝে মাঝে শব্দের পুনরাবৃত্তি। লেখার সঙ্গে ছবির মিল।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্য সংখ্যা ১ বা ২। প্রতি বাক্যে শব্দের সংখ্যা ৪-৬।
স্তর ২
বয়স ৫-৬ বছর ছবি প্রধান বই। চেনাজানা মৌলিক শব্দ।
মাঝে মাঝে শব্দের পুনরাবৃত্তি। লেখার সঙ্গে ছবির মিল।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্য সংখ্যা ১-৩। প্রতি বাক্যে শব্দ সংখ্যা ৬-৮।
স্তর ৩
বয়স ৬-৭ বছর সহজ সরল শব্দ। ছোট বাক্য।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্যের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৫।
প্রতি বাক্যে শব্দ সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০।
সাধারণ গল্প। পৃষ্ঠার অধিকাংশেই ছবি।
স্তর ৪
বয়স ৭-৮ বছর সহজ সরল শব্দ।
বাক্য সামান্য দীর্ঘ। বাক্যে শব্দ সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২।
আনন্দদায়ক মজার গল্প। লেখার সঙ্গে ছবির মিল।
স্তর ৫
বয়স ৮-৯ বছর কিছু জটিল ও কঠিন শব্দ।
প্যারাগ্রাফে বিভক্ত। বাক্য দীর্ঘ।
প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ৮।
সর্বোচ্চ শব্দ সংখ্যা ১৮।
গল্পের সঙ্গে শিশুকে সম্পৃক্ত করার মতো প্লট।
প্যারাগ্রাপের সঙ্গে ছবির মিল।
স্তর ৬
বয়স ৯-১০ বছর অপেক্ষাকৃত বড় প্যারাগ্রাফ।
জটিল ও কঠিন শব্দ। গল্পের প্লটে দ্বন্দ্ব ও সমাধান।
বাক্যে সর্বোচ্চ শব্দ সংখ্যা ২০।
গল্পের সঙ্গে শিশুকে সম্পৃক্ত করার মতো প্লট।
প্যারাগ্রাপের সঙ্গে ছবির মিল।
স্তর ৭
বয়স ১০-১২ বছর চ্যাপ্টার বা অধ্যায় যুক্ত করা।
বিভিন্ন ধরনের শ্রেষ্ঠ গল্প (ক্লাসিক)।
প্রতি অধ্যায়ে এক বা একাধিক ছবি।


উপসংহার


উপরের স্তর অনুযায়ী গল্প নির্বাচনের জন্য বইয়ের ছবি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছবির সঙ্গে মিল রেখে প্রতি পৃষ্ঠায় বাক্যের সংখ্যা, শব্দ সংখ্যা ও বর্ণের আকার নির্বাচন করতে হবে। অন্যথায় শিশুসাহিত্যের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বাধ্য। লেখক ও প্রকাশককে মনে রাখতে হবে যে, শিশুদের শিখন ক্ষেত্রের জ্ঞান মূলক ও আবেগীয় বিকাশ অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন। আবেগীয় বিকাশের কথা চিন্তা করা হলে অবশ্যই আনন্দ ও বিষাদের বিষয় থাকতে পারে। শিশু নৈতিক ভাবে ভালো হয়ে গড়ে উঠুক। দেশপ্রেমিক হোক। মূলত শিক্ষার উদ্দেশ্যও তাই এবং এ-কারণে শিশুতোষ বইয়ে নেতিবাচক কোনো বিষয় থাকা উচিত নয়। বরং মূল্যবোধ গঠন ও চর্চা করার জন্য ভালো গল্পের বা ছড়ার বই শিশুদের হাতে দেওয়া বর্তমান সময়ের একটি উল্লেখ যোগ্য দাবি।

One thought on “প্রবন্ধ।। শিশুসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

  • জানুয়ারি ২৯, ২০২১ at ৯:৪০ অপরাহ্ণ
    Permalink

    শিক্ষামূলক লেখা। অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার জন্য, এ ধরনের লেখা পড়তে হবে। বয়সভিত্তিক যে পার্থক্য, সে অনুযায়ী পুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। সর্বোপরি, চাপ প্রয়োগ করে নয়, আনন্দের মাঝেই শিশুকে শিখার সুযোগ দিতে হবে।
    চমৎকার এ প্রবন্ধের জন্য প্রিয় লেখক ও কাব্যশীলনকে ধন্যবাদ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *