কিশোর উপন্যাস

কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। তেরো

১৩.

আজ সন্ধ্যা হবার আগেই কুয়াশা পড়েছে বেশ। দূরে কেবল নিয়ন বাতির আলো ছাড়া কিছুই ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। তাও পরিষ্কার না, ঝাপসা ঝাপসা আলো। আমরা চারজনই বেরিয়েছি সন্ধ্যার আগে। আমি ভেবেছিলাম আমাকে বোধহয় ঘর থেকে বেরুতেই দেবে না মা। কিন্তু যখন খুব নিচু স্বরে বললাম, অপুদের বাসার সব ওর মামার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছে, অপু বাসায় একা থাকবে। আমি পল্টু আর খোকা আজ ওর বাসায় থাকবো রাতে, মা তুমি অমত করতে পারবে না। মা তেমন কোনো কথা বললেন না। শুধু বললেন, রাতে আবার ঘর থেকে বের হোস না যেন। এমনিতেই দিনকাল খুব একটা ভাল না। আমি তখন একদম বোকার মতো বললাম না না মা অমন কথা ভেবোই না, আমরা একেবারে দরজা জানালা লাগিয়ে টেলিভিশন দেখব।
আমাদের আড্ডাখানায় বসে আছি চারজন। মাথায় ক্যাপ পরেছি কুয়াশার জন্য। নইলে মাথা ভিজে যাবে। জিন্স প্যান্ট আর কালোর ভেতর লাল নীল উলের কাজ করা সোয়েটার গায়ে চাপিয়েছি। প্রচণ্ড শীত। মাঠের কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কুয়াশার কারণে। বটগাছ তো দূরের কথা। নিশ্চয়ই কোনো অঘটন আজ ঘটবেই– পল্টু বলল।
কেমন? অপু বলল।
এই যে দেখছিস না কেমন কুয়াশা পড়েছে আজ ।
তাতে কি? আমি টর্চ লাইট এনেছি– বলেই পকেট থেকে ছোট টর্চ বের করল অপু।
আমরা রাত আটটার সময় বটগাছের সামনে গিয়ে কি দেখব? কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে ?
শোন টয়োটার বাতি নিশ্চয়ই জ্বালানো থাকবে– অপু বলল।
টয়োটার কথা মনে হতেই আমার সব লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। লাল রঙা টয়োটায় করে সে আসবে। নিজেই ড্রাইভ করবে। কে সে? মনের ভেতর কেউ একজন প্রশ্ন করে। সে কী মানুষের মতো দেখতে? আর ভাবতে পারি না, ভয় এসে কাঁটা দেয় শরীরে।
আচ্ছা আমরা আজ কোথায় ঘুমাবো? পল্টু বলল।
কেন সেই ভূতং চৌধুরীর সঙ্গে যেখানে যাব সেখানে, অপু বলল।
তার কি বাড়িঘর আছে?
নিশ্চয়ই আছে। অপু বলল।
রাত সাড়ে সাতটা বাজে, ঘড়ি দেখলাম আমি। কখন যে আটটা বাজবে। বটগাছের নিচে যাব। দেখব সেই লাল গাড়ি। ভয়ও করছে আবার কৌতূহলও বাড়ছে।
কেন যেন বাজারে যেতে ইচ্ছে করছে। এই শীতের ভেতর কালুর দোকানের ঝাল ফুচকা খেতে বেশ লাগত। জিভে পানি এসে গেল। সঙ্গে একশ’ টাকার একটা নোট আছে।
অপু চল না ফুচকা খেয়ে আসি। খুব খেতে ইচ্ছে করছে। বললাম।
তোর বুদ্ধি দেখে আমার খুব অবাক লাগছে। যদি আমাদের চারজনকে বাসার কোনো একজন সদস্য দেখে ফেলে তবে মেরে একদম তক্তা বানিয়ে ফেলবে মিথ্যে কথা বলার জন্য। অপু বলল।
পল্টু বলল, আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে যাব।
ওসব বাদদে তো, শেষে দেখবি সব ভেস্তে যাবে।
খোকা বলল, অপু রাতে ক্ষুধা পেলে ?
আজ না হয় না খেয়েই থাকলাম।
না খেয়ে থাকতে হবে শুনে আমার খুব খিদে পেল। দুপুরে বাসায় খেয়েছি মুরগি ভুনা আর ভাত। আর রাতে না খেয়ে থাকতে হবে– ইশ!
চুপ। অপু বলে উঠল।
আমরা তিনজন অপুর দিকে তাকালাম। অপুর দুচোখ মাঠের ওদিকে। আমরা তিনজনই মাঠের দিকে তাকালাম। কুয়াশ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ ঝাপসা একটা আলো চোখে পড়ল। আলোটা স্থির নয়। চলছে ধীরে ধীরে। বটগাছটার কাছাকাছি এসে আলো থেমে গেল।
এই প্রচণ্ড শীতের ভেতর আমার মনে হল পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। এরকম একটা মুহূর্ত আসবে, কখনো ভাবিনি। কে জানে কপালে কি আছে। রহস্যময় কিছু একটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। এখন থেকে এক ঘন্টা পরে আমরা কোন অবস্থায় থাকব আমরা জানি না। আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে জানি না। আমাদের বাবা মায়েরা যদি যাদের বাসায় গিয়ে রাতে থাকব বলে এসেছি তাদের বাসায় গিয়ে খোঁজ করে তা হলে? একদিকে ঘরের চিন্তা আরেকদিকে সেই লাল গাড়ির রহস্যময়তা, সব মিলিয়ে কেমন জানি একটা চাপা উত্তেজনা বুকের ভেতর।
আলোটা নিভে গেল এইমাত্র। আমাদের চারজনের আটখানা চোখ এখন কুয়াশা আর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখছে না। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাতটা পঞ্চান্ন বাজে। হঠাৎ আমরা চারজনই শুনতে পেলাম বটগাছের ওইদিক থেকে ভেসে এল- অলিখোপ। এই কণ্ঠটাই গতকাল শুনেছিলাম। পল্টু বলল, আমার হিশি চেপেছে– বলেই স্কুলের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল।
আমারও পল্টুর মত অবস্থা। আমিও ওর পাশেই দাঁড়িয়ে গেলাম। টেনশনে বাকি দুজনও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। প্যান্টের জিপার লাগাতে লাগাতে অপু বলল, চল যাই।
পল্টু বলল, যাবি?
দেরি করিস না চল চল।
আমরা চারজন কুয়াশার ভেতর হাঁটা শুরু করলাম। মাঠের ঘাস ভিজে গেছে। পায়ে সেন্ডেল তাই শিশির পায়ে লাগতেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। বটগাছের কাছে যেতেই দেখি অপু টর্চ জ্বালাল। দেখি হাত পাঁচেক সামনে একজন লোক ‘এসো’ বলেই হাঁটা শুরু করল। তার পরণে কালো প্যান্ট, কালো জ্যাকেট, মাথায় কান ঢাকা টুপি। কোনো কথা না বলে আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। তার মুখটা দেখতে পারিনি। সে যখন এসো বলে হাঁটতে শুরু করেছে তখন তার মুখ ঘোরানো ছিল।
একটা টকটকে লাল গাড়ির সামনে আমরা থেমে গেলাম। সেই রহস্যময় লোকটা ড্রাইভিং সিটে বসে সামনের এবং পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বলল– এসো।
অপুর টর্চের আলোয় দেখি শিশিরে ভিজে গাড়িটা একেবারে ঝকঝক করছে যেন। গাড়িটা অসম্ভব লাল দেখাচ্ছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখে লোকটা বলল, কই এসো।
আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে এক এক করে চারজনই গাড়িতে উঠলাম। অপু বসল লোকটার পাশে। আমরা তিনজন পেছনে।
দরজা লাগিয়ে দাও-লোকটা স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে সামনে তাকিয়ে বলল।
আমরা দরজা লাগিয়ে দিলাম। লোকটার মুখ আমরা দেখতে পারিনি এখনো। গাড়ি ছুটে চলল ধীর গতিতে। পাড়ার ভেতরে বলেই হয়তো এভাবে সাবধানে ধীরে চালাচ্ছে। নাকি কুয়াশার কারণে!
তোমাদের বাসায় চিন্তা করবে না? লোকটা বলল।
না, আমরা সে ব্যবস্থা করে এসেছি– অপু বলল।
কি ব্যবস্থা জানতে পারি?
আমরা একজন আরেকজনের বাসায় আজ রাতে থাকব– একথা বলেছি।
তোমরা তো খুব বুদ্ধিমান দেখছি। ইনজাম ফিরেছে জানো তো?
হ্যাঁ, অপু বলল।
কেমন দেখলে?
খুব একটা কথা বলে না– অপু বলল।
আস্তে আস্তে বলবে। আগের চেয়ে নিশ্চয়ই কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছো ওর ভেতরে?
হ্যাঁ, একটু ফর্সা হয়েছে। সুন্দরও হয়েছে।
ও আশা করি এখন থেকে একেবারে ভাল ছেলে হয়ে যাবে। কোনো প্রকার মাস্তানী-সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকবে না– কারণ ও জেনে গেছে আসলে ওসবে কোনো প্রকার সম্মান নেই।
ওকি এতদিন আপনার কাছেই ছিল? পল্টু এই প্রথম মুখ খুলল।
হ্যাঁ।
আমরাও কি আপনার কাছে থাকব এখন?
না না, তোমরা থাকবে কেন? তোমরা তো খুব ভাল ছেলে। যারা বখে যায়, যারা সন্ত্রাসের পথে যায়, আমি তাদেরকে নিয়ে আমার কাছে রাখি। তারা যখন বোঝে তারা যে কাজ করছে সেটা ভাল না তখন তাদের ছেড়ে দেই।
তৌফিক কি আপনার কাছে এখন?
হ্যাঁ।
ইনজাম আর তৌফিক কি একই জায়গায় ছিল এতদিন?
না। দু’জন দু’জায়গায়। কখনোই দু’জনকে একসঙ্গে রাখি না। আলাদা রাখি। একসঙ্গে রাখলে সমস্যা হতে পারে।
আপনি ভ‚তের ভয় দেখান কেন?
যারা দুর্বল মনের মানুষ তারা আমার কথাকে ভয় পায়। যারা এখনো অন্ধকারে পড়ে আছে তারাই ভ‚তকে ভয় পায়। তাই ভূতের কথা বলে এ সমাজের মানুষকে বিচার করি।
বিচার করে কি পেলেন? অপু বলল।
আমাদের সমাজের মানুষ বিংশ শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে এসেও এখনো ভ‚তকে ভয় পায়, বটগাছকে ভয় পায়। তাবিজ কবজ, পীর ফকিরে বিশ্বাস করে। মনে করে বটগাছে কোনো না কোনো প্রেতাত্মা বাস করে। আরেকটা দিক হচ্ছে অন্যের দাস হওয়া। বর্বর যুগের মতো দাস সেজে অন্যের হয়ে কাজ করা।
ভূতকে ভয় পায় বুঝলাম, কিন্তু দাস হওয়াটা মাথায় ঢুকল না। অপু বলল।
একটু ভেঙে বলি– মনে কর তোমাদের পাড়ায় একজন প্রভাবশালী লোক আছে। যার প্রচুর ধন সম্পত্তি রয়েছে। সে রাজনীতি করতে চায়। এলাকার কমিশনার হতে চায়, চেয়ারম্যান হতে চায়। তার লোকবল নেই। তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই। তার কোনো ভালো গুণ নেই। সে করে কি কিছু লোককে টাকা দিয়ে নিজের ঢাক ঢোল পিটায়। টাকা পেয়ে কিছু লোক নিজের অস্তিত্ব ভুলে ওই প্রভাবশালীর প্রভুত্বকে স্বীকার করে নেয়। তার পক্ষে কথা বলে। অন্যের বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে কোনো প্রকার চিন্তা ভাবনা করে না। অর্থাৎ টাকা পেয়ে মনুষত্ব জ্ঞান ভুলে বসে। বোঝাতে পারলাম?
আমরা সমস্বরে বললাম– হ্যাঁ।
তোমাদের পাড়ার ইনজাম আর তৌফিকও ওই পথে চলে যাচ্ছিল। আমি তাই ওদের হাওয়া করে দিয়েছিলাম। যথেষ্ট বুঝিয়েছি। ওরা বুঝতে পেরেছে ওদেরকে যিনি চালাচ্ছেন আসলে তিনি ওদের ভাল চান না। নিজের বিপদ কেটে গেলে কিংবা স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে টিসু পেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
আমাদেরকে আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? অপু বলল।
কেন লং ড্রাইভে যাচ্ছি আমরা। তোমাদের ভাল লাগছে না?
লাগছে– অপু আস্তে করে বলল।
তোমাদের খিদে পেয়েছে?
আমরা কোনো কথা বলছি না। এখনো লোকটার চেহারা দেখতে পাইনি। ভেতরে চাপা উত্তেজনা।
কথা বলছো না কেন?
হ্যাঁ খিদে তো পেয়েছে। অপু বলল।
সামনে একটা ফাস্টফুডের দোকান আছে। সেখান থেকে চিকেন বার্গার নিয়ে নেব- খাবে তো?
হ্যাঁ, অপু বলল।
লোকটা একটা ফাস্ট ফুডের দোকানের সামনে গাড়ি থামাল। নিজে নেমে পাঁচটা চিকেন বার্গার এনে সামনে বসা অপুর হাতে দিল। আবার গাড়ি চলছে।
আশ্চর্য লোকটা তার চেহারা যাতে আমরা দেখতে না পারি ঠিক সেই ভাবে গাড়িতে উঠেছে এবং নেমেছে। অপুর হাতে বার্গারের প্যাকেটটা দিয়েছে স্টিয়ারিং-এ ডান হাত রেখে, সামনে তাকিয়ে। লোকটার এই চেহারা না দেখানোর ব্যাপারটা রহস্যময়তাকে আরো গাঢ় করে তুলল।
কি ব্যাপার তোমরা খাচ্ছো না? লোকটা বলল।
অপু আমাদের তিনজনকে বার্গার দিয়ে নিজে নিল। আর বাকি একটা গাড়ির সামনে রেখে দিয়ে বলল, আপনি খাবেন না?
হ্যাঁ, দাও বলে বাঁ-হাতটা এগিয়ে দিল।
অপু প্যাকেট থেকে বার্গারটা বের করে তার হাতে দিল। লোকটা ডান হাত দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে আর বা হাত দিয়ে বার্গার খাচ্ছে। আমরাও খেতে থাকি।
গাড়ি চলছে কুয়াশা কেটে। মাঝে মাঝে দু’একটা ট্রাক, নাইট কোচ আমাদের রেখে চলে যাচ্ছে সামনে। সামনে থেকে দু’একটা গাড়ি আবার পেছনে যাচ্ছে সাঁই সাঁই করে।
বাসার কথা ভেবে আমার ভয় করছে– যদি জেনে যায় তবে আর রক্ষা নেই। পানির পিপাসা পেয়েছে খুব। কিন্তু পানির কথা লোকটাকে বলার মতো সাহস আমার নেই। তাই সামনে বসা অপুকে খোঁচা মেরে পানি খাব বলে ইশারা করলাম।
পানি খাব– অপু বলল।
পেছনে মিনারেল ওয়াটারের বোতল আছে। খুলে খেয়ে নাও। লোকটা বলল।
আমি দেখলাম পেছনে দুটা বোতল। একটা নিয়ে খুলে ঢক ঢক করে পানি খেলাম। আমার দেখাদেখি খোকা আর পল্টুও খেল। অপুর তখনও বার্গার শেষ হয়নি।
আচ্ছা তোমরা ভূতটূত তো বিশ্বাস কর না, তাই না? লোকটা আচমকা প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, করি না। অপু বলল।
তোমাদের পাড়ার মানুষ ভূতে বিশ্বাস করে?
সবাই বোধহয় করে না।
তবে নাইনটি পারসেন্ট লোক করে।
হ্যাঁ তা করে। অপু বলল।
তোমরা আমার কাছে কিছু জানতে চাইলে প্রশ্ন করতে পার।
আমাদের ভেতর বেশ থ্রিলিং থ্রিলিং ভাব বিরাজ করছে। কুয়াশা রাতে লাল গাড়িতে চেপে আমরা অপরিচিত একজনের সঙ্গে লং ড্রাইভে বেরিয়েছি। যে লোকটা আমাদের পাড়ার সবাইকে ভ‚তের ভয় দেখিয়েছে তার পাশে বসে আছি। বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছি। আমরা তার প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় দ্বিতীয়বার বলল, তোমাদের কিছুই জানার নেই?
আছে, খোকা বলল।
কি প্রশ্ন?
আচ্ছা আপনার সঙ্গে ওই পাগলটার কি সম্পর্ক? পল্টু বলল।
আমরা আস্তে আস্তে তার সঙ্গে সহজ হয়ে আসছি টের পেলাম। আমার ভেতর আর কোনো প্রকার ভয়টয় জাতীয় কিছু নেই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে লোকটা বলল, ওই পাগলটার সঙ্গে আমার আসলে কোনো সম্পর্ক নেই।
আপনি তাহলে পাগলকে চেনেন কিভাবে? বললাম আমি।
বারে একটা পাড়ায় একজন পাগল থাকে। তাকে দেখেছি, এর জন্য আবার চেনার প্রয়োজন হয় নাকি?
তাহলে আপনি কিভাবে জানলেন আমরা ওই পাগলের পিছু নিয়েছিলাম?
আমি দেখেছি।
কেথায় দেখলেন? অপু বলল।
তোমাদের পাড়ায় আমি ছিলাম।
আমরা তো আপনাকে দেখিনি?
তোমরা আমাকে দেখেছো।
আমরা চুপ হয়ে গেলাম। বলে কি!
আচ্ছা আমরা এখনো কিন্তু আপনার চেহারা দেখতে পাইনি। আপনিও খুব কৌশলে মুখটা আড়াল করে রাখছেন। অপু বলল।
তাই না! লোকটা রহস্যময় কণ্ঠে বলল।
আপনি ইনজামের মতো তৌফিকের মতো কতজনকে উধাও করেছেন? আমি বললাম।
অনেককেই।
তারা কোথায় এখন?
আমার আস্তানায়।
সেটা আবার কোথায়?
অনেক দূরে। তোমরা কি যেতে চাও সেখানে?
না না, পল্টু বলল একটু ভয়ে ভয়ে।
অবশ্য তোমরা ভাল ছেলে তোমাদের ওখানে যাবার প্রয়োজন নেই।
কাদের প্রয়োজন আছে সেখানে যাবার? অপু বলল।
যারা সবেমাত্র বখে যাচ্ছে কারো আঙুলের ইশারায়।
এদেরকে ভাল করে আপনার কি লাভ? অপু বলল।
আমি এদেশকে ভালোবাসি।
এদেশকে অনেকেই ভালোবাসে।
অনেকে ওপর দিয়েই দেশের কথা বলে, দেশকে ভালোবাসার কথা বলে, আসলে তারা তাদের স্বার্থের জন্য কথাগুলো বলে। মন থেকে বলে না। আমার কথাগুলো ভারি ভারি ঠেকছে, তাই না?
তা ঠেকলেও আমরা মূল ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। অপু বলল।
হ্যাঁ দেখো, আমাদের দেশটা– মানে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশটাকে পাবার জন্য কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। কত মানুষ তাদের মা বাবা ভাইবোনকে হারিয়েছে একাত্তরে। কেন দিয়েছিল প্রাণ? কেন হারিয়েছিল স্বজনদের? সুন্দর একটা দেশ হবে সে জন্যইতো নাকি। পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর অমানষিক নির্যাতন করেছে– তারা চায়নি আমরা মিলেমিশে সুখে শান্তিতে থাকি– আর আজকে আমাদের দেশে কি হচ্ছে ?
অপু বলল, আপনি একাত্তরে যুদ্ধ করেছিলেন?
হ্যাঁ। তখন আমি তোমাদের চেয়ে দু’তিন বছরের বড় হব। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম। হাতে অস্ত্র নিয়েছিলাম।
আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল লোকটার কথা শুনে। আমি মুক্তিযোদ্ধা দেখিনি। তাদের কথা পড়েছি শুধু বইয়ের ভেতর। আজ স্বচক্ষে মুক্তিযোদ্ধা দেখছি। কিন্তু তার মুখটা এখনো দেখতে পাইনি।
লোকটা আবার কথা শুরু করল– দেখো আজকে সারা বাংলাদেশে সন্ত্রাস, রাহাজানি, খুন, নির্যাতন চলছে, কারা এগুলো করছে? এরা নিশ্চয়ই পাকিস্তানিরা নয়। এরা এদেশেরই সন্তান। এদেশের মানুষ। এরা নিজেদের স্বার্থের জন্য তরুণদের হাতে তুলে দিচ্ছে অস্ত্র। এই যে তোমরা তোমাদের মতো অনেক ছেলেরা আজ বই ফেলে পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানী করে।
আমরা কিন্তু ওসবে নেই– অপু কথার মাঝখানে বলল।
না আমি তোমাদের বলছি না। কিন্তু তোমরা যখন আরেকটু বড় হবে, কলেজে উঠবে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিবে তখন দেখবে স্বার্থান্বেষী মহল তোমাদের ব্যবহার করার জন্য পাঁয়তারা করবে। তাহলে এই স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে পাকিস্তানিদের ভেতর পার্থক্য কোথায়? বল আমাকে?
খোকা বলল, হ্যাঁ এরা বোধহয় রাজাকার, তাই না?
না, এটা ভুল কথা। আমরা মঞ্চে ওঠে বলি ওমুকে রাজাকার তমুকে রাজাকার। হ্যাঁ, কথা ঠিক, এদেশে নামকরা এবং সত্যিকার অর্থে রাজাকার রয়েছে কিন্তু একাত্তরে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজাকারি কেউ কেউ করলেও এদেশে স্বাধীনতার পর অনেক রাজাকারের চেয়েও ভয়াবহ মানুষ তৈরি হয়েছে। যারা অনেক ক্ষমতাশালী। যারা ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া ফ্যাসাদ, বন্ধু বন্ধুদের ভেতর মারামারি, একসঙ্গে পড়ুয়াদের ভেতর কলহ তৈরি করে রাখার জন্য অস্ত্র তুলে দেয়। এরা আসলে পাকিস্তানিদের চেয়েও খুব বাজে মানুষ।
আপনি এত কথা বলছেন, গাড়ি আবার এক্সিডেন্ট করবেন না যেন– অপু বলল ।
না না সে হুশ আমার আছে। কথাগুলো বলতে বলতে যদিও আমার মাথা গরম হয়ে গেছে। আসলে কি জানো এ সমাজের প্রতি আমার একেবারে ঘেন্না ধরে গেছে। এখানে মানুষ সামান্য কথা কাটাকাটি হলে মারমুখি হয়ে যায়। দল পাকায়, মাস্তান ভাড়া করে। রক্তারক্তি করার জন্য তৈরি হয়।
আপনি কবে থেকে এরকম উধাও করার কাজে নেমেছেন? খোকা বলল।
লোকটা কোনো কথা বলছে না। একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি কেউ জানি না। রাত এগারোটা বাজে।
বললেন না যে? খোকা আবার বলল।
আমার একটা ছেলে ছিল। তোমাদের মতো বয়স। ক্লাস লাইনে পড়ত। একদিন ওর এক বন্ধুর সঙ্গে সামান্য কথা নিয়ে ঝগড়া হলে আমি আমার ছেলেকে বলেছিলাম তুমি ওর সঙ্গে মিশবে না। খেলাধুলাও করবে না। তো আমার কথামতো আমার ছেলে ওর সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। ওর সেই বন্ধু এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। সেই থেকে শুরু হয় শত্রুতা। একদিন শুনি আমার ছেলের লাশ পাওয়া গেছে পুকুরপাড়ে। তখন দুপুরবেলা। আমি জানতে পারি কে বা কারা তাকে পুকুরপাড়ে নিয়ে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে। যাদের হাতে আমার ছেলে মারা গেছে পাড়ায় তাদেরকে নাকি কেউ দেখেনি। এই হলো আমাদের সমাজ। মানুষ ভয়ে একটা কথাও বলেনি সেদিন। মুখ খোলেনি কে বা কারা মেরেছে। থানা-পুলিশ করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। ছেলের সেই বন্ধুকে থানায় নিয়ে যাবার পর কদিন হাজতে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সাক্ষীর অভাবে সেই মৃত্যুর কোনো বিচার হয়নি। সেই থেকে আমি আমার জীবনকে পরিবর্তন করেছি।
আমরা কেউ কোনো কথা বলি না। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। লোকটার জন্যে খুব মায়া হচ্ছে। একজন পিতা তার ছেলের দুঃখে কতটা পরিবর্তন করেছে নিজের জীবনকে, ভাবতেই মন কেমন করে ওঠে।
আপনি কতজনকে এযাবৎ সুন্দর জীবনের দিকে এনেছেন? অপু বলল।
তা প্রায় তিনশজনের মতো হবে।
তারা এখন কি অবস্থায় আছে তা জানেন?
হ্যাঁ। তারা আমার সঙ্গে দেখা করে। আমিও দেখা করি। তবে এই দেখাদেখি হবার ব্যাপারটা কোনোদিন কাউকে বলবে না এরকম প্রতিশ্রুতি করা আছে।
আশ্চর্য ঠেকে ব্যাপারটা– আচ্ছা আমরাও কি কাউকে একথা বলবো না? বলেই ফেললাম।
না বলবে না– এই অনুরোধ আমি তোমাদের কাছে রাখলাম– যদি কোনোদিন এমন হয় যে আমাদের দেশে আর একজনও বখাটে না থাকে সেদিন বলবে।
সেদিন যদি আপনি বেঁচে না থাকেন? অপু বলল।
আমার লোকেরা থাকবে।
মানে? অপু আশ্চর্য হয়ে বলল।
তোমরা কি ভেবেছো আমি একাই একাজ করি। সারা দেশে আমার দলে নব্বইজন সদস্য আছে। ক্রমান্বয়ে এই দলে আরো লোক আসবে।
আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। বলে কি!
তোমরাও বড় হয়ে আমার দলে আসতে পারো। তবে আশা করি তোমরা যখন বড় হবে সেদিন যেন এই সোনার বাংলায় একজনও খারাপ মানুষ না থাকে। একজন সন্ত্রাসী, মাস্তান, নরপশুও যেন না থাকে।
আমাদেরকে আপনার বাসায় নিয়ে যাবেন না? অপু বলল।
না।
কেন?
তোমাদের ভেতরে এক ধরনের ডিটেকটিভ মানসিকতা আছে সেটা আমার ভালো লেগেছে– সেজন্য তোমাদের সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছি। কিন্তু এর বেশি কিছু তোমরা জানো সেটা চাই না। এখনো তোমরা ছোট। পড়াশুনা করো। মানুষের মতো মানুষ হও। বাবা মার মুখ উজ্জ্বল করো। যদি কখনো মনে করো আমার এই লাইনে তোমরা আসবে তবে আমাকে জানাবে। কিংবা আমার লোকদের জানাবে।
আপনাকে বা আপনার লোকদের কোথায় পাবো? অপু বলল।
আমি এবং আমার লোকেরা তোমাদের চারজনকেই চিনি। অসুবিধা হবে না। এই শহরের কোথাও না কোথাও হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে। কাল থেকে অবশ্য আমি আর তোমাদের পাড়ায় থাকব না। অন্য কোথাও চলে যাব। তোমাদের পাড়ার ইনজাম আর তৌফিক দুজনই ভালো হয়ে গেছে। কালই তৌফিক বাসায় ফিরবে।

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। শেষ পর্ব<< কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব বারোকিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব চোদ্দ >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *