কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব- এক
- কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব- এক
- কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব- দুই
- কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম-পর্ব তিন
- কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব ছয়
- কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব সাত
- কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব আট
পর পর দু’দুটো মানুষের উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের পাড়ায় বেশ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বলা যায় ভৌতিক আতঙ্ক। এরকম আতঙ্কের কথা মানুষ আগে কখনো শুনেছে বলে মনে হয় না। পত্র-পত্রিকায় বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছে এই উধাও হওয়ার কাহিনি। কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি দু’দুটো তরতাজা যুবকের। বয়স আর কতই বা হবে দুজনের। একুশ কি বাইশ। একজনের নাম ইনজাম, অন্যজন তৌফিক।
গত মাসের দশ তারিখে ইনজাম উধাও হয়। রাত বারোটায় ওদের ঘরের জানালায় একটি চিঠি সুতো দিয়ে ঝোলানো দেখা যায়। ওর বাবা রাতে পানি খেতে উঠে জানালায় তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় জানালার কাছে।
তারপর চিঠিটা খুলে পড়ে অজানা আতঙ্কে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখে। চিঠিটা এরকম– জনাব, আপনার ছেলে ইনজামকে তুলে নিয়ে গেলাম। সে বড্ড জ্বালাতন করছিল। কিছুদিন আমার কাছে রেখে দেখি ওকে ঠিক করা যায় কিনা। আপনি কি জানেন ক’মাস আগে ইনজাম একটা ছিনতাই করেছিল? জানেন না বোধহয়। না জানারই কথা। তো যা হোক দেখি ওকে ভাল করতে পারি কিনা। খোদা হাফেজ।─
ইরকিটি কিরকিটি ভূতং চৌধুরী। অস্থায়ী বাসিন্দা, বটবৃক্ষ।
ইনজামের বাবা সে রাতে একটা কথাও বলেনি ভয়ে। সারারাত কাঁথা মুড়ি দিয়ে জেগেছিল। সকালে ইনজামের মাকে কথাটা জানায় আর চিঠিটা দেয়। চিঠিটা পড়ে মূর্ছা যায় ইনজামের মা। ইনজামের উধাও হওয়ার সাতদিনের মাথায় তৌফিক উধাও হল। ঠিক একই রকম চিঠি তৌফিকের বাবাকে দেওয়া হয়। ইনজামদের বাসার মতো তৌফিকদের বাসায়ও কান্নার রোল পড়ে। থানা-পুলিশ সব মিলিয়ে একটা বড় রকমের ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় দু’বাড়ির মানুষদের। কিন্তু ব্যাপারটার কোনো প্রকার সুরাহা আজ পর্যন্ত হয়নি।
পাড়ার মানুষ এখন বিশেষ করে যুবক, কিশোর বয়সের ছেলেপেলেরা ঘর থেকে বেরোয় না বললেই চলে। দিনের বেলা যদি কেউ আমাদের খেলার মাঠের পাশে যে বড় বটগাছটা আছে, সেখান দিয়ে যায় তবে দোয়াদরূদ পড়তে পড়তে যায়। কারণ ওই বটগাছটা নিয়ে অনেক কাহিনি রয়েছে। এখনো অনেক কাহিনির জন্ম দেয় ওই বটবৃক্ষ।
একাত্তর সালে নাকি ওই বটগাছে ঝুলিয়ে অনেক বাঙালিকে পাকসেনারা মেরেছে। তারপর এই পাড়ার এক গৃহবধূ চার বছর আগে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ওই বটগাছে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। এরকম অনেক কাহিনি রয়েছে। রাতের বেলা ওখান দিয়ে গেলে নাকি কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। একবার গোঙানি শুনে মুন্সী সাহেবের ছোট ছেলে সাতদিন বিছানায় পড়েছিল। ভয়ে একদম নীল হয়ে গিয়েছিল। কত পানি পড়া খাওয়ানো হয়, তবু ছেলেটার নীল রঙের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
পুলিশ সন্ধ্যার পর প্রতিদিন একবার দু’বার করে পুরো পাড়া টহল দেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইনজাম আর তৌফিকের বাবা মা বলা যায় শয্যাশায়ী। শয্যাশায়ী শুধু উধাও হবার ঘটনায় নয়, দু’জনের কৃতকর্ম ফাঁস হবার কারণে। দু’জনেই প্রথম শ্রেণির মাস্তান আর ছিনতাইকারী। মাঝে মাঝে নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্তান আর ক্যাডার হিসেবে ভাড়া খাটতো। একটি ছাত্র সংগঠনের কাছ থেকে অস্ত্রও পেয়েছিল। এসব কথা পুলিশের কাছ থেকে জেনেছে।
তো যাই হোক, ইরকিটি কিরকিটি ভ‚তং চৌধুরীর কোনো প্রকার সন্ধান মেলেনি। সেই বটগাছটাকে কেটে ফেলারও কথাবার্তা চলছে পাড়ায়। গত সপ্তায় এলাকার বিশিষ্ট মুরুব্বি আকরাম সাহেবের বাসায় মিটিং হয়েছে বটবৃক্ষ নিয়ে। সেই মিটিং শেষ হবার পরই আকরাম সাহেবের ঘরের জানালায় একটি চিঠি ঝুলতে দেখা যায়। চিঠিতে লেখা– আকরাম সাহেব সালাম নিবেন। আশা করি খুব ভাল নেই। আমার একটা আস্তানা নষ্ট করার পাঁয়তারা করছেন। কাজটা ভাল হচ্ছে না।
আশা করি কাজটা থেকে বিরত থাকবেন। এই আস্তানায় আমাকে কিছুদিন থাকতে হবে। তারপর একসময় চলে যাব। তখন বটবৃক্ষটাকে কাটার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবেন-ঠিক আছে? নইলে আপনাকে গুম করা হবে। –ইরকিটি কিরকিটি ভূতং চৌধুরী। অস্থায়ী বাসিন্দা বটবৃক্ষ।
সেই মিটিংয়ের পর থেকে পাড়ায় সবার আতঙ্কে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। ব্যাপারটা যে প্রকৃতপক্ষে ভ‚তেরই এ ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত। তবে দু’একজন অন্য মতও পোষণ করেছে। যেমন আমার বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে কাজটা ভূতের। তিনি ভ‚তটূত-এ বিশ্বাসী নন। আমার বড় ভাইও বাবার মতো। কিন্তু আমার মা আর নীনা আপা দুজনেই একশত পারসেন্ট নিশ্চিত যে কাজটা ওই বটবৃক্ষের ভূতের।
ইজনাম আর তৌফিকের উধাও হওয়ার পর থেকে আমরা মাঠে আর যাই না। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। স্কুল বন্ধ। অথচ ক্রিকেট খেলতে পারছি না। মাঠটার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই আমাদের কষ্ট হয়, ক্রিকেট খেলতে পারছি না বলে। বার্ষিক পরীক্ষার আগে কত প্ল্যান করেছি– এবার আমরা টুর্নামেন্ট ছাড়বো। আশেপাশের পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ফাটাফাটি খেলা হবে। চার আর ছক্কা মেরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব। আমাদের সব আশা গুঁড়েবালি হয়ে গেল ওই ইরকিটি কিরকিটি ভূতং চৌধুরীর জন্য। ব্যাটাকে যদি কোনোদিন কাছে পাই তবে একদম ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেব। মাঝে মাঝে আমি, পল্টু, অপু আর খোকা বলাবলি করি চল ওই বটবৃক্ষের নিচে গিয়ে চিৎকার করে বলি যদি সাহস থাকে তবে নেমে আয় ইরকিটি কিরকিটি ভূতং চৌধুরী।
আমরা চারজন ভূতটূত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করি না। ভয়টয়ও পাই না। কিন্তু হলে কি হবে, মায়ের জন্য সন্ধ্যার পর বাইরে যেতে পারি না। আমাদের যে ক্রিকেট টিম-সে টিমে শুধু আমরা চারজনই ওই ভূতটূতে বিশ্বাস করি না, অন্যেরা ভূত কথাটা শুনলেই একদম কুঁকড়ে যায় ভয়ে, তাই তো মাঠে নিজেরা নিজেরা খেলতে পারি না। ভূত বলে কিছু নেই, ভাইয়া আমাদের চারজনকে শিখিয়েছে। তবে যেটা আছে সেটা হল মনের ভয়। যারা একটু দুর্বল চিত্তের অধিকারী তারা ওই বটগাছের নিচ দিয়ে যাবার সময় অবচেতন মনে একটা কিছুর শব্দ শুনেই ভয় পায়। এছাড়া অন্য কিছু না।
তবে আমরা চারজন এখন এক হলে একটা জিনিস আলাপ করি সেটা হল– বটবৃক্ষের নিচে মাঝে মাঝে শুয়ে থাকা সেই পাগলকে নিয়ে। পাগলটা ওখানে দুপুরে শুয়ে থাকে। সন্ধ্যার আগে অবশ্য তাকে দেখা যায় না। মাঝে মাঝে বাজারে ঘোরাফেরা করে। মামুর হোটেল থেকে বাসি ডালপুরি, পরোটা চেয়ে খায়। বেকারির কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে ম্যানেজার তাকে এটা-ওটা দেয়। রঙ ওঠা একটা নীল রঙা ছেঁড়া শার্ট আর কালো মোটা ফুলপ্যান্ট পরা এই পাগলটাকে অনেকেই ইদানীং ভূত বলে ধরে নিয়েছে। মানুষের রূপ ধরে নাকি ভূতটা ঘুরে বেড়ায়। বাজারে ওই পাগলটাকে দেখলে অনেকেই দশ হাত দূর দিয়ে যায়। দোয়াদরূদ পড়ে। পাগলটা তখন তাকিয়ে থাকে হেঁটে যাওয়া পথচারীর দিকে জুলজুল চোখে। এই পাগলটাকে কেউ কখনো কথা বলতে শোনেনি। একবার বাজারে এক পানদোকানে ক্যাশের টাকা চুরি হয়েছিল বলে পাগলটাকে ধরে কজনে মিলে কি মারটাই না মেরেছিল। একটা শব্দও বের হয়নি পাগলটার মুখ দিয়ে। শুধু নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ডান হাতের আঙুল চালিয়ে চুলকাচ্ছিস।