উপন্যাস।।‘চরের মাস্টার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার’ ।। রাহিতুল ইসলাম।। পর্ব পাঁচ

৫.

পাত্রপক্ষ দেখে গেছে ফারিয়াকে। ছেলেরা বেশ ধনী। আর ছেলেটাকে দেখেও খুব ভদ্র মনে হলো। বড় চাকরি করে, বংশ ভালো। এ জন্যই সব মিলিয়ে ফারিয়ার মা-বাবা পাত্রপক্ষকে প্রথমেই ‘না’ করে দিতে চায়নি; বরং তারা চাইছিল ফারিয়া ওদের সঙ্গে কথা বলুক, কোনোভাবে যদি পছন্দ হয় তবে সামনে এগোনো যাবে। ফারিয়ার মায়ের মনে সূক্ষ্ম একটা আশা ছিল, মেয়ে হয়তো সবকিছু দেখে একটা পজিটিভ মত দিতেও পারে। কিন্তু ফারিয়ার ধনুকভাঙা পণ। সেই পণ কিছুতেই কিছু করা গেল না। আর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েকে ফারিয়ার মা-বাবা জোর করার পক্ষপাতী নন। ফলে ছেলেপক্ষের প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সম্বন্ধটা যে আর এগোবে না, সেটা ফারিয়া জানে। তবে বিশেষত সেমিস্টার ফাইনাল যখন সামনে, সেই অবস্থায় তাকে এভাবে গ্রামের বাড়িতে যেতে হওয়ায় সে বেশ বিরক্ত। আর তার বিরক্তি সে ঢেকে রাখেনি। বাড়ির সবাইকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে এসেছে। সবাইকে সে এ-ও বলেছে যে, পাত্র হিসেবে শফিক কোনোভাবেই খারাপ নয়। তার সাবজেক্ট ভালো এবং সে ভালো ছাত্র। তা ছাড়া একটা অচেনা-অজানা ছেলেকে বিয়ে করার চেয়ে অনেক বছর ধরে চেনা কাউকে বিয়ে করা যে বেশি ভালো, এটা সে তার মাকে বলেছে। বিয়ে করতে আসা ছেলেটার যদি কোনো বদ দোষ থাকে, আর সেটা বিয়ের পর বের হয়, তাহলে ব্যাপারটা যে মোটেই ভালো হবে না, তার সঙ্গে ফারিয়ার মা একমত পোষণ করেছেন। বিকল্প কোনো যুক্তি দেখাতে পারেননি। দুটো ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে ফারিয়া তার বান্ধবী জুঁইয়ের সঙ্গে এসে হাকিম চত্বরে বসে। অনেকটা খোলা জায়গা, প্রচুর কলকাকলিতে মুখর থাকে এই সময়টা। অনেকের সঙ্গেই দেখা হয় এখানে। দুটো শিঙাড়া এক কাপ চা খেতে খেতে একটু গল্পগুজবও করা যায়। ফারিয়ার আজ মুড অফ দেখে জুঁই বলল, ‘কী রে, তোর হয়েছেটা কী? সকাল থেকে চুপচাপ।’

ফারিয়া বলল, ‘আর বলিস না। বাসায় বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।’

‘বাহ, ভালো তো। করে ফেল।’

‘কী করে ফেলব?’

‘কেন? বিয়ে করে ফেলবি। সমস্যা নাই তো।’

‘তোরে বলাই ভুল হইছে। তুই শফিকের কথা জানিস না? তুই করে ফেল এত শখ থাকলে।’

হাতে একটা চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে জুঁই বলল, ‘আমার তো খুব ইচ্ছে করে বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু জুতসই কাউকে পাচ্ছি না। আর কালো বলে ভালো কেউ আসছেও না।’

‘আহারে! তোর জন্য ট্রাই করব?’

‘প্লিজ, এখন থেকেই চেষ্টা কর। আমি তোদের ব্যাপারটায় হেল্প করব।’

‘হেল্প করবি ভালো কথা। যার জন্য করবি তারই তো তেমন গরজ দেখি না।’

জুঁই বলল, ‘এ জন্যই সমবয়সীদের সঙ্গে প্রেম করতে নেই। ও সেটেল হতে হতে তো অনেক সময় চলে যাবে।’

‘ধুর। তুই তো প্রেম করিস না। তুই এসব বুঝবি না। প্রেমে প্রতীক্ষা থাকতে হয়। সহজে পাওয়া গেলে মূল্যটা বোঝা যায় না।’

একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলল জুঁই। বলল, ‘প্রেম তো করতেই চাই। কেউ আসে না রে।’

ফারিয়া বলল, ‘আচ্ছা, তুই আগে ঠিক কর প্রেম করবি নাকি বিয়ে করবি। তাহলে আমার হেল্প করতে সুবিধা হয়।’

‘তুই আর হেল্প করেছিস! শফিকের প্রেমে লাইলি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। তুই করবি হেল্প। নিজের জন্য নিজেকেই করতে হবে। কাউকে না পেলে মাহফুজের গলায়ই ঝুলে পড়ব ভাবছি।’

‘তা পড়তে পারিস। ছেলেটা তোকে পছন্দই করে। তা ছাড়া ওর স্বভাব-চরিত্রও ভালো।’

জুঁই ফারিয়ার সঙ্গে একমত। মাহফুজ কিন্তু ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো। থার্ড ইয়ারে থাকতে জুঁইকে প্রপোজ করে। জুঁইয়ের কেন যেন ভালো লাগে না ছেলেটাকে। তবে সে আবার খারাপ লাগার মতো কিছু খুঁজেও পায় না মাহফুজের ভেতর। ছেলেটাকে সে একবার না বলে দিয়েছে। কিন্তু সে আশা ছাড়েনি বোঝা যায়। ওদেরই ক্লাসমেট মাহফুজ। জুঁইয়ের আশপাশে তাকে প্রায়ই ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। অবশ্য সে ঘোরাঘুরি ডিস্টার্বের মতো নয়; বরং কাঁচুমাচু হয়ে ঘুরে বেড়ানো বলা যায়। জুঁইয়ের সামনে গেলে মাহফুজ কথা খুঁজে পায় না। এই যে এখন যেমন ছেলেটাকে হাকিম চত্বরেই চা খেতে দেখা যাচ্ছে। জুঁইয়ের ইচ্ছে হলো ডেকে এনে আচ্ছামতো বকে দিতে। কিন্তু কেন সে বকবে তার কোনো যুক্তি নেই। সে তো ক্লাসের ফাঁকে চা খেতে আসতেই পারে। তবে ফারিয়া ও জুঁই দুজনই জানে সে এখানে এসেছে কেন। ছেলেটার বেশি বন্ধুবান্ধব নেই। প্রায়ই একা একা ঘুরে বেড়ায়। ফারিয়ার বেশ মায়া লাগে তার জন্য। দেখলে অনেক সময় ডেকে কথা বলে। আজও ডাক দিল। যদিও সে বুঝতে পারছে এতে জুঁই ও মাহফুজ দুজনের কেউই সহজ হতে পারবে না। তবু একটু মজা করার জন্য ডাক দিল।

‘এই যে… মাহফুজ… এদিকে এসো।’

মাহফুজ যেন বুঝতে পারছে না তাকে কেউ ডাকছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দুই বান্ধবীর দিকে। ফারিয়া আবার ডাকল, হাত দিয়ে ইশারা করল। ফারিয়া বলল,
 ‘কী ব্যাপার, ক্লাসমেটরা এখানে বসে আছে আর তুমি পাত্তা না দিয়ে একা একা চা খাচ্ছ!’

মাহফুজ কী বলবে বুঝতে পারছে না। এ রকম বিব্রতদশা দেখে জুঁই মুখ টিপে হাসছে। ফারিয়া বলল, ‘আমাদের জন্য চা অর্ডার করো।’

মাহফুজ ‘আচ্ছা’ বলে চায়ের দোকানের দিকে হাঁটা ধরল। পেছন থেকে ফারিয়া তাকে থামাল। বলল, ‘হনহন করে যে হেঁটে যাচ্ছ, কে কী চা খাবে শুনেছ?’ মাহফুজ এমন মুখ করে তাকিয়ে রইল যে মনে হচ্ছে সে ক্ষমার অযোগ্য কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। তার মুখ দেখে জুঁইয়ের এমন মায়া লাগল! বাড়ি থেকে ফেরার পর শফিকের সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি ফারিয়ার। ছেলেটা মাঝে মাঝে এমন ডুব দেয় যে অনেক চেষ্টা করেও তার নাগাল পাওয়া যায় না। ফোন করলেও দিব্যি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে শর্টকাটে কথা বলে রেখে দেয়। এত ব্যস্ততা দেখায় যে তখন ফারিয়ার আর দেখা করার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এই কয়েক বছরের প্রেমের সম্পর্কে শফিক নিজে থেকে কবার ফারিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে, সেটা হাতে গুনে বলে দিতে পারবে ফারিয়া। প্রতিবারই উদ্যোগটা ফারিয়া নেয়। অথচ বান্ধবীদের প্রেমও তো সে দেখেছে। ছেলেরাই দেখা করার জন্য পাগল হয়ে যায়। একটু পরপর ফোন করে, টেক্সট করে। ফারিয়ার অভিমান হয় খুব। ছেলেটা তো জানত বাড়িতে পাত্রপক্ষ আসবে। তার কি উচিত ছিল না খোঁজ নেওয়া? কিন্তু ফারিয়ার সমস্যা হলো সে খুব বেশিক্ষণ শফিকের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না। কিছু সময় গেলেই তার রাগ গলে যায়। তখন ছেলেটার মুখ খুব মনে পড়ে। তার পাশে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। চা নিয়ে এসেছে মাহফুজ। জুঁই ফারিয়াকে মৃদু ধাক্কা দিল। বলল, ‘কী ভাবিস এত?’

ফারিয়ার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। সে বলে, ‘কিছু না রে। পরীক্ষার নোট করা শেষ হলো?’

জুঁই আর ফারিয়া দুজনে মিলে নোট করে। একই সাবজেক্টের অর্ধেক করে ফারিয়া বাকি অর্ধেক জুঁই। এর ফলে দুজনের কাজই অর্ধেক হয়ে যায়। নিজেদের নোট কারও সঙ্গে শেয়ারও করা লাগে না। অন্যদেরটার খোঁজখবর করে বরং হেল্প নিতে পারে তারা। কিন্তু পরীক্ষার দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ফারিয়ার টেনশন বেড়েই চলছে। সেটা তার নিজেকে নিয়ে যতটা, তার চেয়ে বেশি শফিককে নিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *