ঈদসংখ্যার কবিতা।। মিলু শামস

১.ভালোবাসি ভালোবাসি

মেঘলা বাতাস যেভাবে ছুঁয়ে যায়
জাহাজের মাস্তুল খালাসীর শ্রম ক্লান্ত
আঙুলের গাঁট বেয়ে
যেভাবে চাঁদ জেগে রয় মেঘের পলকা শরীরে ধুসর
ঘাস বনে লেগে থাকে দূর শৈশবের ঘ্রান
ঝড়ের রাতে বিজলী বহ্নি ঝলসে ওঠে
পৃথিবীর আদিম বাতাসে, পথঘাট পিচ্ছিল
নিকটে অপেক্ষমান পোস্ট অফিসের
লাল ঘর, হরকরার অগ্নিলণ্ঠন
স্তব্ধ দিনের আলোয়, নব নব বার্তা
এই সব, এই পৃথিবীর গান
যাপনের বিবর্তিত কৌশলে হেঁটে আসা বহুদুর
পথের ধারে জ্বলে ওঠা জীবনের নতুন সাইনবোর্ড-
তোমাকে কি বাজায় জীবন এসব উপাচারে?
সাজায় অনাবিল প্রানরস
কাম প্রেম ভালবাসা মাতাল করে কি আজও?
তবে এসো, দাঁড়াই এ বিহ্বল ভোরে
নত শিরে জানাই প্রণতি পৃথিবীকে এক সুরে
বলি গলা ছেড়ে, ভালবাসি ভালবাসি।

২. প্রকৃত স্বত্ব

কতবার আমি একরোখা লেঠেলের মতো
চেঁচিয়ে বলেছি, এ জমি আমার
আমারই এর স্বাধীন স্বত্বাধিকার—
পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে প্রতিবার
নিজেরই কাছে ফিরে এলে সে কথা বার বার
বুঝেছি, এ জমির স্বাধীন স্বত্বের দলিল—
কখনও ছিল না আমার, পিতার কিংবা পিতামহের
রয়েছে অন্যত্র,এক গোপন সিন্দুকে;
সংকেত ধরে ধরে চক্রাকার ঘুরে
স্যান্ন্যালদের পোড়ো দিঘীর পাড়—
তার পশ্চিমে বিস্তৃত প্রান্তরে হলুদ ও শটি ঝোপের
যেখানে ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে
গ্রীবা তোলা সাদা বক আর
শ্বেতপদ্ম ফোটে বার মাস
লোকে বলে, সেখানে কিছু তঞ্চক
অতন্দ্র প্রহরায় রেখেছে সেই গোপন সিন্দুক;
বংশ পরম্পরায় আমাদের ভোগ
কেবল দখলী স্বত্বে।

৩. এক জোড়া চোখ

এক জোড়া চোখ
সাত ভাই চম্পা, জেগে থাকে
বিমর্ষ শিউলী ডালে,
শিশিরের শব্দে ভাঙে
রূপকথা ঘুম—
বৈঠক ছেড়ে টুপটাপ খসে পড়া
সপ্তর্ষীর সাতটি তারায় চাপে
সাতজন লক্ষ্মীছাড়া চিল।

এক জোড়া চোখ
যেন নিঃসঙ্গ ডুমুর, ফুটে থাকে
প্রেতছায়া রাতে—
বাদামের খোসার মতো
ভেঙে যাওয়া স্বপ্নকে
পাঁজাকোলা করে।

৪.বেগুনী বেগুনী খেলা

প্রত্যুষে লাল চাদর বিছিয়ে
উপত্যকায় নেমেছিল তারা

পাহাড়ের খাড়ায় পদরেখা এঁকে
মেপেছিল সূর্যের উত্তাপ
দৃষ্টি ছিল উত্থিত আকাশে।

বরফ যুগের স্মৃতিধোয়া পথে
ডাইনোসর ম্যামথের
ভাঙা সংসারের হাড়,
তাকেও অতিক্রম করা
সবল মাতৃবাহু থেকে বয়ে আসা
স্পর্ধার ধারা—
স্নাত হয়েছিল তাতে তারা
কিছু দুর্লভ শস্য বীজ ছিল পরম্পরায়
তারই দেখভাল চাষাবাদে দিন যায় ব্যস্ততায়;
বাণিজ্য তরীর আগমন ঘটে অগোচরে
মেঘলা দিনে বাজে তার ভেঁপু
পালে লাগে হাওয়া
সমুদ্র কাঁপিয়ে ছোটে দিগি¦দিক
আকাশ ভরা বেগুনী আভা।

লাল চাদর বিছানো ভোরে এসেছিল যারা
বহুরূপী বাণিজ্যের তোড়ে
ভেসে যায় তাদের
চাষবাষ জমি জমা।

আকাশে এখন শুধুই বেগুনী বেগুনী খেলা।

৫.নৈঃসঙ্গ

প্রাচীন প্রেমের সমৃদ্ধ
একটি মেঘলা ভোর
হাওয়ায় উড়লেও
আজও আমরা দু’শহরে ওড়াই
জীবনের ভিন্ন রঙা পতাকা;

বৃষ্টির জলে যতটা ভিজলে
দাঁড় কাককে মনে হয়
ইলেকট্রিক তারে দাঁড়িয়ে রয়েছে
নো ম্যান্স ল্যান্ডের নিঃসঙ্গ শববাহী
তারচেয়ে অধিক সিক্ততা ও নৈঃসঙ্গ
বাজে আমাদের নিজ নিজ ভূ-খণ্ডে
বৃষ্টি ও হাওয়ার যৌথ প্রপাতে ॥

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *