লতিফ জোয়ার্দার এর কবিতা
বই
যদি বই হতাম। সময়ে অসময়ে আমাকে পাঠ করতে তুমি।
বুকসেল্ফের অসংখ্য বইয়ের ভিড়ে বারবার আমাকে খুঁজতে তুমি।
প্রচ্ছদে হাত বোলাতে। আমাকে পাঠ করতে করতে রাত্রি গভীর হতো
অথবা কোনো এক দুপুরবেলায় ভাত ঘুমের মতো তোমার বুকে ঘুমিয়ে পড়তাম।
আমাকে পাঠ করতে করতে বেহায়া হাওয়ার মতো বারবার ছুঁয়ে দিতে।
অনেক যত্নে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টোতে উল্টোতে কত কথা হতো আমার সাথে।
যদি বই হতাম আমায় পাঠ করতে তুমি। তোমার কবি ব্যাগে সঙ্গী
হতাম। যদি বই হতাম তোমার কবিতা হতাম আমি।
প্রত্ন পাথর
নিঃশব্দে বহুগামী পথের সীমানায়
আঁচড় রেখে ফিরে এসে দেখি
অজস্র বকপাখির দাপাদাপি।
নির্ঘুম রাতের মতো বুকের তোলপাড় ভেঙে
আরও একটি সূর্যোদয় উঁকি দিচ্ছে মন পবনের বৈঠায়।
জ্যোৎস্না রাতের প্রস্থান শেষে যেমন
শিশির ভেজা সকালের উঠোন জেগে ওঠে।
অতঃপর আছড়ে পড়া জলরাশি থেকে দূরে,
মনবাঁশির খপ্পরে দিনের সূচনা সঙ্গীত প্রত্নপাথরে লিখে রাখি।
বনমোরগের ঝঁটির মতো।
সম্রাট
এখনও আমার মনখারাপের সকাল পাঠ করো।
একান্তে বসে থাকো সংসার ক্লান্তির মাঝে!
পাখিদের সংসারে মনখারাপের কোনো সজ্ঞা নেই।
বৃত্ত ব্যাসার্ধ কৌণিক কোনো দূরত্ব নেই।
তেত্রিশ বসন্ত শেষে খুঁজে ফিরি নদীর বয়ে চলার প্রশান্তি।
নাব্যতা হারিয়েছে যে নদী তার বুকে বেদনার চর।
বুকের বসন্তে পাখিহাট। যতবার আমাকে তুমি করবে পাঠ।
বুঝবে, আমিই তোমার হৃদয় রাজ্যে মুকুটহীন সম্রাট।
ঘোড়া
কোনো চার্চে নয় এখনও ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে।
ফার্ম হাউসের অফিসে এগার, বার, একটা’র ঘণ্টা বাজে।
সময়কে নিয়ে যে বালকের কোনোই ভাবনা নেই আর।
কোনোই অর্জন নেই আর।
এখনও মাঘের বোরোধান খেতে শীত নামে।
সরিষা খেত, টমেটো খেত,
কোনো এক বালিকার মুখাবয়ের মতো মনে হয়।
আর আমি শেখের বেটার ঘোড়ার গাড়ির অপেক্ষায় বসে থাকি।
নির্জন রাস্তায় যখন কেউ থাকে না।
তখন ঘোড়া হাকিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে।
মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত ঘোড়া ও
একজন শেখের বেটার ঘোরলাগা
রাতকে দেখি অবাক দৃষ্টি মেলে।
শিকল
আনমনা বিকেলের রোদেরও কিছু কিছু উচ্ছ্বাস থাকে।
আমার অবশ্য তাও ছিলো না।
কী এমন হবার ছিলো আমার।
বাবার রেখে যাওয়া দেড়বিঘা জমি।
যার অনেকটাই পতিত হয়ে আছে এখন।
বাঁশবাগান আর গোটা কয়েক রেইনটি গাছের
ছায়া শুধু আমার আছে।
তারপরও মনে হয়,
কোনো এক ভরসায় বেঁচে আছি আমি।
কিছু ক্ষীণ আশা এখনও আমার আছে।
এখনও বইয়ের পাতা উল্টোতে উল্টোতে
একটা পরিবর্তনের কথা ভাবি।
সমাজ সংসারের মানুষগুলোর কথা ভাবি।
মাঝে মাঝে নিজের কথাও ভাবি।
কিছু একটা করার ছিলো আমার ।
কবিতা লেখা অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে
লিফলেট বিতরণের কথা অবশ্য চিন্তা করিনি কখনও।
তবুও অপেক্ষা।
তবুও ভিতরে ভিতরে আন্দোলিত হই।
একটা পরিবর্তনের কথা ভাবি।
শ্যামল রঙের পাগলামির কথা ভাবি।
একদিন অন্তত আমাদের ভাগ্যের শিকলটা
ছিড়ে ফেলবো আমরা।
নিদেনপক্ষে কেউ না কেউ
একদিন আমাদের কথা বলবে।