ছোটগল্প।। সুক্রন্দসী লুনা আর বিরই ভাতের ঘ্রাণ।। ইভান অনিরুদ্ধ


শাহবাগের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের লবিতে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মত আবছায়া অন্ধকারে আমি আর লুনা বসে আছি মুখোমুখি। কত বছর পর তার সাথে দেখা? গুনে গুনে ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর পর আমাদের দেখা। গত চারমাস আগে যখন তাকে আমি ফেসবুকে খুঁজে পেলাম এবং ভার্চুয়াল বন্ধু হলাম তখন থেকেই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছিল- কবে সে ঢাকায় আসবে? অবশেষে ক্রিসমাসের ছুটিতে পনেরো দিনের জন্য আমেরিকা থেকে সে ঢাকায় এসেছে।
পঁয়ত্রিশ বছর আগে কোথায় ছিলাম তাহলে আমরা? ছিলাম হাতিরপুলের মেহেরুন্নিসা গার্লস হাই স্কুলে। তখন আমরা প্রাইমারি সেকশনের ক্লাস ফাইভে পড়ি। সেই দুরন্ত শৈশবের রঙিন দিনগুলোতে আমি আর সে হাত ধরাধরি করে বেড়ে ওঠেছি, ক্লাসে ঝগড়া করেছি, পাশাপাশি বসে ক্লাসটিচারের অলক্ষ্যে খুনসুটি করেছি। মেয়েদের সেই স্কুলে আমরা কেবল পাঁচজন ছেলে ছিলাম পুরো ক্লাসে। অন্যরা সব মেয়ে। তখন ওই বয়সে কি সবকিছু বুঝতাম? জানি না তবে লুনাকে খুব ভালো লাগতো, তাকে পছন্দ করতাম- এটা বেশ বুঝে গিয়েছিলাম। প্রতিদিন সকালে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে যে হাজির হতাম, তা বুঝি তার জন্যই। তাকে দেখতে পাবো, তার সাথে এক বেঞ্চিতে বসে দুপুর অবধি কাটাবো- এই টানেই!
আমার সেই ভালোলাগার কথা তাকে বলেছিলাম খুব গোপনে, ভয়ে ভয়ে। টিফিন পিরিয়ডে যখন সবাই মাঠে খেলতে চলে যেত তখন আমি আর সে ক্লাসেই বসে থাকতাম। সে বক্স খুলে আমার হাতে টিফিন তুলে দিত। সেই সময়ই তাকে একদিন বলেছিলাম- তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি, তোমার জন্যই প্রতিদিন স্কুলে আসি। আমি যে ক্লাসের ফার্স্ট বয়, ক্লাস ক্যাপ্টেন- এটা ভেবে স্কুলে আসিনা। আরো মনে আছে- তার অংক খাতার ভেতর তিন লাইনের একটা চিঠিও লুকিয়ে দিয়েছিলাম।
তারপর ক্লাস সিক্সে ওঠার পর মেয়েদের স্কুল থেকে আমাদেরকে চলে আসতে হল। ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন দিল সেদিনই ছিল আমাদের শেষ দেখা। তারপর চিরবিচ্ছেদ! মাঝে অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার প্রতি টান বেশ বেড়েছিল। প্রায়ই তার জন্য পেটপুড়তো আমার। তার ভুতের গলির বাসার টেলিফোন নম্বর আমার মুখস্থ ছিল। কয়েক বছর পর একদিন দুরু দুরু বুকে ফোন করেছিলাম। ওপাশ থেকে এক ভদ্রমহিলা ফোন রিসিভ করে বললেন, লুনা এখানে আর থাকে না। ওরা তো চিটাগাং চলে গেছে। ব্যস, এই কষ্টটুকুই সারাজীবনের সঙ্গী করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম!

দুই

ওয়েটার গরম গরম থাই স্যুপ দিয়ে গেছে। লুনা এক বাটি স্যুপ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এইবার বলো কেমন আছ তুমি? আমি হালকা হেসে বললাম, তার আগে তোমার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখি? লুনা কিছুটা অবাক হল। সম্বিত ফিরে বলল, নাও হাত। যতক্ষণ খুশি ধরে রাখো। আই ডোন্ট মাইন্ড! স্যুপের বাটি একপাশে সরিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ লুনার হাতটা ধরে রাখলাম। আহা, এত বছর পর, যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না! তারপর তারদিকে তাকিয়ে বললাম, জানি, আমাদের গেছে যে দিন, তা একেবারেই গেছে! ইট উইল নেভার কাম ব্যাক এগেইন! লুনা গাঢ় হাসি দিয়ে উত্তর দিল, তাতে কী! বরং বেটার লেইট দ্যান নেভার!
হাজার কথার ভিড়ে ডিনারটাইম শেষ হয়ে এল। রাত দশটা বাজে। আমাকে ওঠতে হবে। লুনা পনেরো দিনের জন্য এই হোটেলেই ওঠেছে। ঢাকা থেকে কলেজের পাঠ শেষ করে আমেরিকায় চলে গিয়েছিল উচ্চশিক্ষার জন্য। এখন সে আমেরিকান নেভির একজন সিনিয়র অফিসার। পুরোদস্তুর মিলিটারি লাইফ তার। হাসতে হাসতে বলল, হিমাদ্রী আমি স্রেফ তোমার সাথে আর স্কুল লাইফের আরো কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতেই এসেছি। আমার এই মুহূর্তে ঢাকায় আর কোনো কাজ নেই। আগামি দশদিন তোমাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো ঘুরবো, আড্ডা দিব আর স্কুল ক্যাম্পাসটা দেখতে যাব। আর ইচ্ছে করলে তোমার গ্রামের বাড়িতেও আমাকে নিয়ে যেতে পারো। তোমার ফেসবুকে তো দেখি প্রায়ই তুমি গ্রামে ঘুরতে যাও। আই লাভ ভিলেজ লাইফ। রেন্ট- এ- কার থেকে একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে এইসব ঘোরাঘুরির কাজ করব এন্ড আই উইল পে অল এক্সপেন্সেস। আমি সিগারেটে শেষটান দিয়ে বললাম, নো প্রবলেম। আগে ঢাকার কাজ শেষ হোক। তারপর নেক্সট ফ্রাইডে সকালে ঢাকা থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা করবো।

লুনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি কাঁঠালবাগান আমার বাসায় ফিরে এলাম। কিন্তু সারা দেহমনে লুনার সাথে দেখা হবার এক অপার্থিব আবেশ জড়িয়ে রইল। আহা, এত বছর পর কেন দেখা হল! এরচেয়ে দেখা না হলেই তো ভালো হত!
অথচ জীবনানন্দ বাবু কতটা হাহাকার নিয়ে লিখেছেন-

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

ঢাকায় এবার শীতের তীব্রতা বেশ। খুব সকালে আমি আর লুনা প্রাইভেট কারে গ্রামের বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়লাম। গাজীপুর চৌরাস্তায় জ্যাম না থাকলে বাড়ি পৌঁছতে সাড়ে চার ঘন্টা লাগবে।যদিও গ্রামের বাড়িতে পরিবারের আপনজন কেউ থাকে না। বাড়িটা দেখাশোনা করার জন্য প্রতিবেশী সম্পর্কের এক চাচা আর তার পরিবার থাকে। বছরের দুই ঈদে ঢাকা থেকে আমরা সবাই কেবল কয়েকদিনের জন্য গ্রামে যাই। তবে শীতের এই সময়টায় গ্রামে বেড়াতে খুব ভালো লাগে। লুনাকে বললাম, আমাদের গ্রামের পরিবেশটা খুব কাব্যিক। তোমার বেশ ভালো লাগবে। সে হেসে বলল, কত বছর যে গ্রাম দেখি না! ভালোই হল তোমার সাথে এরকম একটা সুযোগ পেলাম। আমি বললাম, বাড়িতে আমাদের চাচার পরিবারকে বলে রেখেছি আমাদের জন্য রাজহাঁস ভুনা করতে। সাথে থাকবে বিরই চালের লাল ভাত আর মাষকলাইয়ের ডাল। তবে আমরা পৌঁছানোর পর সে রান্নার আয়োজন করবে। তাতে সব গরম গরম পাব, খেতেও ভালো লাগবে। আর তোমাকে একটা স্পেশাল জিনিস খাওয়াবো। লুনা অবাক হয়ে তাকায়- কী সেটা? হেসে বললাম, বিরই চালের ভাত আর ভাতের মাড়। খেয়েছো কখনো ভাতের মাড় এই জীবনে? লুনা হাসে- খাইনি তবে তোমার সৌজন্যে এবার খাব।

তিন

শীতের সাদা চাদরে মোড়া চারপাশের পথঘাট, লোকালয় ছেড়ে সকাল এগারোটার ভেতর গ্রামের বাড়ি চলে আসলাম। ইদ্রিস চাচা আগেভাগেই বাড়িঘর বেশ পরিপাটি করে রেখেছে। হাল্কা চা-নাশতা সেরে আমি লুনাকে নিয়ে গ্রামের আশেপাশে ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। ইদ্রিস চাচাকে বললাম, তাড়াতাড়ি দুপুরের রান্নার আয়োজন করেন, আমরা
আধঘন্টার ভেতর আসছি। ইদ্রিস চাচা হাসিমুখে বলল, তুমরা ঘুইরা আও, রান্দাবাড়ার বেশি সময় লাগতো না। রাজহাঁস জবাই কইরা রেডি রাখছি।
আধঘন্টার ভেতর লুনা আর আমি বাড়ি ফিরে এলাম। সে বেশ উচ্ছসিত গ্রামের পরিবেশ দেখে। সড়কের চারপাশে আদিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সরিষা খেত। শীতের মৃদু হাওয়ায় সরিষা ফুলের ঘ্রাণে মো মো করছে চারপাশ। লাকড়ির চুলায় বিরই চালের লাল ভাত ফুটছে , আরেক চুলায় রাজহাঁসের মাংস কষানো হচ্ছে। সবশেষে রান্না করা হবে টাকি মাছ দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল। চাচীকে বললাম দুইটা গেলাসে গরম লাল মাড় আমাদেরকে দিতে। অনেক বছর বিরই ভাতের মাড় খাইনি। লুনাকে বললাম, এই সেই স্পেশাল আইটেম যেটা তোমাকে খাওয়াতে চেয়েছি। একবার খেয়ে দেখো, অমৃতের মত লাগবে! এটাকেই তো ফুটানি করে শহরের লোকজন বলে- স্যুপ, রাইস স্যুপ। শহরে পরজীবীর মতো জীবন কাটালেও আমরা কৃষক পরিবারের সন্তান, আমাদের শেকড় প্রোথিত আছে বাপ-দাদার ভিটায়, বাড়ির পাশে বিসনাই গাঙের অতলে! আমাদের পূর্বপরুষ লাঙ্গলের ধারালো ফলা দিয়ে জীবনকে রাঙিয়ে গেছে! লুনা খুব আগ্রহ নিয়ে গেলাসভরতি লাল মাড়ে লম্বা করে চুমুক দিয়ে বলে- ওয়াও, ইট’স ইয়াম্মি! দারুণ লাগছে খেতে!
ঘ্রাণটাও চমৎকার। আমি অবশ্য স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে শৈশবে ফিরে গেলাম।
উঠানে মাটির চুলায় শুকনো খড় আর নাড়া দিয়ে ভাত রান্না হচ্ছে। দাও দাও জ্বলছে আগুন, বলক ওঠছে ভাতের পাতিলে। কী সুন্দর লাল ভাত- বিরই চালের লাল ভাত! কী স্বর্গীয় সুঘ্রাণ! কতক্ষণ লাগবে চুলার ওপর থেকে নামতে?
আমার আর তর সয় না। আমি ভাত খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি না, লাল গরম মাড় খাওয়ার জন্য লোভাতুর চোখে বলক ওঠা ভাতের পাতিলের দিকে তাকিয়ে আছি। আনুবুজি আরো এক আঞ্জা খড় ঠেলে দেয় হা করে থাকা চুলার মুখে।
অপেক্ষার পালা শেষ হয়- মাটির সানকিতে আনুবুজি গরম মাড় ঢেলে দেয় গামলা থেকে। জমাট লাল গরম ভাতের মাড়! ইচ্ছে করছে একচুমুকে পুরোটা গিলে ফেলি কিন্তু গরম মাড়ের ভেতর ছোট্ট একখন্ড পাটকাঠি দিয়ে বার বার নাড়ছি।
আনুবুজি তাগাদা দেয়- ছালাইয়া খা, ডাইয়া অইলে বেমজা লাগবো। এক সানকি মাড় খেয়েই বেরিয়ে পড়বো একটা বিশেষ কাজে! এই ভাতের মাড় অন্যরকম- অগ্রহায়ণ মাসের নতুন বিরই চালের মাড়। আনুবুজি অবশ্য আমাকে বলে- বই লইয়া পড়াত ব ছালাইয়া। সারাদিন খালি খৈহরের লাহান ঠ্যাং বাইড়াস।
বেলা বাড়তে থাকে। উঠানের অর্ধেকটা শীতের রোদ তার দখলে নিয়েছে। আমি গরম মাড় খেয়েই রওনা দিব বাড়ির সামনের সড়কের পুব পাশের ক্ষেতে। দুইদিন হল ফসল কাটা হয়ে গেছে। এখন কেবল খেতের কর্তৃক জায়গায় মাথা উঁচু করে আছে ইঁদুরের গর্তের নরোম মাটি। সাথীরা সব এসে গেছে কোদাল, কাচি নিয়ে। গর্তের ধান বের করা হবে। এই গর্তকে আমরা বলি- উন্দুরের গাত। এখনো অবশ্য সিদ্ধান্ত হয়নি উন্দুরের গাতের ধান তুলে আমরা কী করবো। তবে আমি বলেছি- এই ধান জমিয়ে রাখবো কয়েকদিন। তারপর সুযোগ মত বারবাড়ির ঘরে রাখা ধানের টাল থেকে ধান চুরি করে একসাথে সব বেচবো। বেচলেই ম্যালা টাকা! এক টাকা দিয়ে আনুবুজির জন্য একটা তামুক পাতা আর এক টাকা দিয়ে পান। আমার ভাগের বাকি সব টাকা আমার কাছেই জমা থাকবে। এই জমানো টাকাকে সবাই বলে- জুলা ট্যাহা।
ধানের বিশাল টাল থেকে কয়েক খলই ধান সাবধানে সরিয়ে নিলে আনুবুজি টেরই পাবে না।
উন্দুরের একটা গাতের ধান তুলতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায় আমাদের। গর্তের ভেতর থোকায় থোকায় কেটে নেয়া ধান! হেমন্তের সোনালি ধান! এখন কোথায় পাব আমার আনুবুজিকে? সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে শেষমেশ বাইরাগের একপাশে সাড়ে তিনহাত তালুকে আনুবুজিকে পাওয়া যায়। শুয়ে আছে নীরবে, একেলা! আহা, মানবজীবন!

চার

বিকেলের দিকে আমরা ঢাকার দিকে রওনা দিলাম বাড়ি থেকে। লুনাকে নিয়ে একটা দারুণ সময় কাটলো বাড়িতে। সে বারবারই বলছিল- এই অল্প সময়ে কিছুতেই মন ভরে না। আবার যদি আসি তাহলে টানা সাত দিন সময় নিয়ে তোমাদের গ্রামে আসবো ঘুরতে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, জীবন তো একটাই! কী লাভ জীবনে এত জটিলতার সমীকরণ ঢুকিয়ে।
আমেরিকার জীবন ছেড়ে একেবারেই চলে এসো দেশে। লুনা হাসে। শীতের শেষবিকেলের কনেদেখা আলোয় তার হাসিটা আমার বেশ লাগে! গাড়ির জানলা দিয়ে জলভরা চোখে লুনা বাইরে তাকিয়ে বলে- কার কাছে ফিরবো? আমিও হাসি এই কথায়। মনে মনে বলি- সুক্রন্দসী লুনা, বিচ্ছেদের মত চিরসুখী হও! তারপর জীবনানন্দ দাশকে টেনে এনে লুনাকে আওয়াজ করে শোনাই-

প্রেম ধীরে মুছে যায়
নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *