কবিতা।।ফারুক নওয়াজের ।।ফেব্রুয়ারি কবিতা উৎসব সংখ্যা
সত্য শুধু দুঃখটুকু
বিধির নিষেধ ভুলে ভুলফল খেয়ে আহা
পৃথিবীতে নেমে এলো স্বর্গচ্যুত আদম-হাওয়া…
তাদের চোখের জলে সেইদিন ভিজেছিল ঈশ্বরের
আলোর গালিচা; তবু ঈশ্বর পাঠালেন নির্বাসনে
কষ্টসহা পৃথিবীর বুকে।
কী কষ্ট… কী কষ্ট আহা…! কী দুঃখ বুকে নিয়ে…
দু-চোখে অশ্রু ধরে ঘর বাঁধে পৃথিবীর প্রথম দম্পতি।
সেইথেকে দুঃখ হলো আমাদের জীবনের ধারা…
মিথ্যে সুখের পিছে ছুটে মরা, সত্য শুধু দুঃখটুকু
আর সব ধুয়াশা ধূসর…!
ও মেয়ে… দুঃখবতী মেয়ে; মোছো অশ্রু…, দুঃখসহা হও
পুত্রহারা জননী তুমি ক্রন্দন ভুলে গিয়ে শোকসহা হও
বৃক্ষের অশ্রু হয়ে মরা পাতা ঝরে ঝরে পড়ে…
মেঘের অশ্রু হয়ে ঝরে আহা ঝরে বৃষ্টিধারা…
দুঃখ শুধু, দুঃখ চারিধার…
ঝিরিঝিরি ঝরনা সে তো পাহাড়ের অশ্রু অপার;
আমাদের নদীগুলো দুঃখ পোষে, মাটি সহে দুঃখের ভার…।
সব দুঃখ ভেঙে ভেঙে বাঁচি এসো দুঃখজয়ী হয়ে…
এসো হাসি কান্না ভুলে দুঃখ সয়ে সয়ে!
দিনশেষের কবিতা
এতক্ষণ আলো ছিল; ভোর থেকে শেষবিকেলের কাহিনী
আমি কিভাবে বোঝাবো তোমাকে? আমি শুধু উপভোগ করলাম
আমি ঐশ্বরিক আলোতে ভেতরের সব আঁধার ঝেড়েমুছে
তাকালাম আকাশ… আকাশের হৃদয়ে; যেখানে অপার রহস্য
দিবসে ও রাত্রিতে… আ শূন্যতা, আ বিস্ময়…!
আমি কি করে বোঝাবো… অবারিত সবুজ নিরন্তর বাতাস
পাতা-পল্লবে, শাখায় কী আনন্দ বয়ে দিয়েছে…!
কিছু পাখি, এবং দুটি কাঠবিড়ালি এবং একটি বেজি…
আমি আরো কিছু অসাধারণ দৃশ্য দেখেছি;
কি করে বোঝাবো তোমাকে সে-সব দুর্লভ দৃশ্য সম্পর্কে…
আমি শুধু উপভোগ করেছি ওইসব ঐশ্বরিক বিষয়াদি।
আমার চোখে, পকেটে এবং হৃদয়ে অদ্ভুত স্বর্গীয় হাওয়া
বিলি কেটে কী এক নৈসর্গিক খেলায় মেতেছে দিনভর।
এখন শেষবেলার দুঃখ-দুঃখ আবহ, এখন সূর্য যাবে পাটে
এখন কুলায় ফেরা পাখিরা ডানায় ক্লান্তি ছড়াতে ছড়াতে
রেখে যাচ্ছে শেষ সুর-ধ্বনি… যেখানে কিছু বেদনা তো আছেই;
এবং আমি, আমিও রাত্রির জন্য অপেক্ষা করবো…
নির্জনতা প্রার্থনা ও নিদ্রার জন্য উপযুক্ত;
এই রাত্রি সম্পর্কেও আমি তোমাকে কিছুই বোঝাতে পারবো না…
যেহেতু ঐশ্বরিক বিষয়াদি অনুভব করা যায়, বোঝা যায়
কিন্তু বোঝানো যে দুঃসাধ্য খুব!
ডিজিটাল স্টুপিড
মাটি থেকে উৎসারিত আমি…; এবং আমার এ বিশ্বাস
আমার বোধে নাড়া দিতো যখন আমি জনযোদ্ধা ছিলাম
কৃষকের ঘামের গন্ধ আমার ভেতর রোমাঞ্চিত হতো
মহাজনের সুদের বাক্সে লাথি মেরে চেঁচিয়ে উঠেছি…
জয় কৃষকের!
সময় আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পলির মতো
তীরের রোমান্টিক দক্ষিণ হাওয়ায়
দোল খেতে খেতে আমি শিহরিত হয়ে বদলে যেতে থাকি;
কোনো অদৃশ্য নারী পরাবাস্তব হাতছানিতে
ডেকেছে দূরের সবুজ পাহাড়ের চূড়ায়…
ঝরনার শিঞ্জিনী শুনিয়েছে হাওয়া…
সাগরের ফেনানীল উত্তাল ঢেউ দুলিয়েছে
অনির্বচনীয় প্রেমোচ্ছ্বাসে..! .
আমি বদলে বদলে উত্তরাধুনিক ঘূর্ণিতে পাক খেতে খেতে
দাঁড়িয়েছি প্লাস্টিক শহরের ট্রাফিক আইল্যান্ডে.
এখন রোলগোল্ডের চাঁদ ওঠে সোনালি তস্তরির মতো
এখন জোছনা মানে পতঙ্গ ওড়া সোডিয়ামের পথবাতি।
আহা… আমি এখন কবি…
সারশূন্য শব্দ-সর্বস্ব মাজুল বিবৃতি ছাড়া
আর কিইবা লিখতে পারি…!
বদলে বদলে… আমি এখন হয়ে গেছি ডিজিটাল স্টুপিড।
ও নদী ঋজুপালিকা
কবিতারা পাখি হয়ে উড়ে গেছে; কবি থাকে চাতালে ঘুমিয়ে
এখন ধূর্তকাল… এখন চতুর দিন; কৃত্তিবাসী শৃগালসময়;
কবিতার সৃষ্টিঘর হয়ে গেছে দুষ্টদের বৈধকামশালা…!
কবি তো ঋষিই; না হয় হয়েই যাবো নিবস্ত্র ধ্যানপ্রাণসন্ন্যাসী কোনো;
পূর্ণাঙ্গ অহিংস আমি; অসত্যসাধনে রত থাকিনি কখনো…
অচৌর্য, অপরিগ্রহ-স্বভাব তাই বিশ্বাসী চতুর্যামবোধে
হয়ে গেছি যৌনতায় অনাসক্ত বৃহন্নলা ঠিক ; জৈন যেন আমি।
কখনো বা মনে হয় ত্রিশলাপুত্র মহাবীর আমিই…
ইচ্ছে হয় নির্গ্রন্থ হয়ে ছুটে যাই শালবিরিক্ষতলে!
ও নদী ঋজুপালিকা… কাম-দুঃখ আকাঙ্ক্ষা-সুখ
দলেপিষে ভুলেভালে চলে যাই তোমার ভেজাতটে।
আমি কি পাথর? হয়তো পাথরই আমি…
নড়ে উঠি, কখনো গড়াই; পাথরেরও প্রাণ আছে
যেমন পত্র-পুষ্প আর বৃক্ষও প্রাণধারী;
বৃক্ষ নয়, বিরহী হাওয়ায় ঝরেপড়া পাতাও নয়…
পাথরই হতে চাই আমি; পাথরেরা বোঝে না সঙ্গম;
দুঃখ সয়ে সয়ে… তাপ-রৌদ্র সয়ে সয়ে…
হিমাদ্রি ছুঁয়ে আসা হিমহিম মৃত্যু সয়ে সয়ে
বেঁচে থাকে শুধুই পাথর!
রাত্রি যায়… যায় রাত্রি যায়… দিবসও রাত্রি মনে হয়
প্রত্যুষ, দ্বিপ্রহর, প্রদোষও মনে হয় নিকষ অমানিশি
পাথর পাথরই তো… তার আর রাত্রি-দিন কী!
নিরাকার ও ঈশ্বর…! যদি তুমি জিতেন্দ্রিয় করো
তবে আমি হয়ে যাই উলঙ্গ মহাবীর…
ও নদী ঋজুপালিকা… তোমার পললতটে শাল বিরিক্ষতলে
রাখো পেতে ধূসর আসন…!
আরশিনগর চেনো
শহরের শেষবাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমি চলে এলাম মহল্লার মাঝখানে
বাগানবিলাসে সাজানো প্রবেশদ্বার … বাড়িটা কি আমার জন্য বরাদ্দ?
আমি চেয়েছে একটু নির্জনতা, একটু ছায়াময় সবুজ এবং বাতাসে
নুয়েপড়া মাধবীলতার ঝোপ, চৌহদ্দির শেষপ্রান্তে একটা যজ্ঞডুমুর গাছ
হেলে থাকা ডালে পুচ্ছ নাড়িয়ে শিস দেবে একটা পাখি;
পাখিটা অবশ্যই দোয়েল…, তেমন বাড়ি এই শহরে নেই….
পেছন থেকে কেউ বলল, যদিও এই বাড়িটা আরেকজনের,
আপাতত তুমি থাকতে পারো!
হ্যাঁ, এটাই এখন আমার অস্থায়ী বাড়ি…, তোমরা এই বাড়িতেই
ইদানিং আমাকে খুঁজতে পারো; নক করো, দরোজা ভেতর থেকে
কেউ খুলে দেবে, অতিথিদের জন্য আসন পাতাই আছে;
বসে অপেক্ষা করতে থাকো… ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে, এরপরও
কারো সাড়া পাবে না, কেউ বলবে না আমি আছি নাকি নেই!
আমাকে খুঁজবে দেয়ালে? না আমার কোনো ছবি নেই, বুকসেলফে
অনেক বইয়ের মধ্যে আমি নেই, একসময় কর্নার-সেলফে
অনেক পদক-সম্মাননা দেখতে পেতে কিন্তু সেখানে এখন
সটান দাঁড়িয়ে লালন একা একা বাজিয়ে চলেছেন একতারা…
আরশিনগর কোথায়?… আমি থাকি আরশিনগরে;
এই বাড়িটা আপাতত আমার; তবে আমার আত্মা
ঘুমিয়ে থাকে আরশিনগরে…, তোমরা আরশিনগর চেনো?