অদ্বৈত মারুত-এর কবিতা নিয়ে গদ্য।। একজন জলমাতাল কবি অদ্বৈত মারুত।। মাহফুজা অনন্যা

কবি জীবনানন্দ দাশ মনে করতেন  “প্রত্যেক কবিই তার কবিতার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমালোচক’’; যেহেতু প্রত্যেক কবি তার নিজের কবিতা বা সৃষ্টি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন। এছাড়াও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ”কবিতা যে লেখে কবিতাগুলির অন্তরের ইতিহাস তার কাছে সুস্পষ্ট”। যদিও একজন কবির কবিতা সৃষ্টির রহস্য সমালোচকের অজানা, তবুও একজন জলমাতাল কবি অদ্বৈত মারুতের কবিতা পড়ে দু’কথা লেখার প্রয়াসকে দমন করতে পারলাম না। তিনি একজন কবি, ছড়াকার এবং আমাদের সময় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেন  ছড়াসাহিত্যের ছোটকাগজ  ‘পাঁপড়’। আজ কবি অদ্বৈত মারুতের কবিতার শক্তি নিয়ে কিছু কথা লিখতে বসেছি। ঢেউ ছাড়া সমুদ্র যদি খুব অসুন্দর হয় তবে বলতে পারি, কবি অদ্বৈত মারুতের কবিতায় প্রবাহিত ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আর ঢেউ, অর্থাৎ ঢেউরাশির এক বিশাল সমুদ্র বলা যায় অদ্বৈত মারুতের কবিতা।

কবি অদ্বৈত মারুতের প্রতিটি কবিতায়  আছে সুদৃঢ় ভাবনা। আর সেই ভাবনা কত সুগভীর হলে কবি  ‘তাড়া’ কবিতায় বলতে পারেন… “যে জুতো আমার সাথে থাকে আঠারো ঘন্টা, তারও তাড়াহুড়ো স্যার, চলেন তো ভেতরে যাই”!

কবির প্রতিভা বিদ্যাবুদ্ধি কবির নিজস্ব সম্পদ, কবি অদ্বৈত মারুতের কবিতায় তার প্রতিভা ও নিজস্ব বিদ্যা স্পষ্ট প্রতীয়মান। আর সেই প্রতিভার বহিপ্রকাশ আমরা বুঝতে পারি কবি যখন বলেন… “গুমোট হয়ে অন্ধকারে

তোমার কাছাকাছি

সুখ-অসুখে তোমার জন্য রোদ্র হয়ে আছি।

জলমাতালের কবি অদ্বৈত মারুতের কবিতায় আছে চিন্তাজগতের প্রগাঢ়তা যে প্রগাঢ়তা কবিতাকে নিয়ে গেছে উত্তরাধুনিকতার পথে।  চিন্তার গভীরতা কতটা প্রখর হলে কবি  ‘আবাদ’  কবিতায় এভাবে লিখতে পারেন… “ পাট বুনে দেবো নিম্নাঙ্গে

আগাছা পোড়াতে ঔষধ

দৃষ্টিশক্তি বাড়বে প্রেমে”…

কবির কবিতায় আছে নিরঙ্কুশ দেশপ্রেম, সমাজ সচেতনতা, সমসাময়িক বিষয়। সমাজের বিত্তবান, ক্ষমতাবানদের অহেতুক অহংকার ও জাহিরিকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে লিখে চলেছেন কবিতা কিংবা রম্যছড়া। যা পাঠকের নিগূঢ় ভাবনার খোরাক মেটায়। আর তাই কবি “আসুক সে কাণ্ডারি” কবিতায় উচ্চারণ করেন…” ঘুটঘুটে এক আঁধার এসে ঢেকে দিলে ঘর

এমন আঁধার, এমন এ ঘোর আপন হবে পর!

চিনবে না কেউ বাড়ি

কে হবে এ আঁধার কাটার দাপুটে কাণ্ডারি”?

মনে পড়লো কবি জীবনানন্দ দাশের একটি বিখ্যাত কবিতার কথা ‘অদ্ভুত আঁধার এসেছে এক’… কবি অদ্বৈত মারুতের আসুক সে কাণ্ডারি কবিতাটি সেই কবিতার প্রতিনিধিত্বকারী একটি কবিতা বলা যায়।  কবির আপন অনুভূতি, বোধ, ও অভিজ্ঞতার দারুণ সমন্বয় করেছেন এই কবিতায়।

রুপক নির্মাণে অসম্ভব চতুরতার পরিচয় মেলে কবি অদ্বৈত মারুতের কবিতায়। রুপকের নিদারুণ আশ্রয়ে কবি ‘অনাস্থা’ কবিতায় লিখেছেন… “জানালা গলে আসা দুধকুয়াশা – শীতের  পালকে ক্রমে; বন্ধুর পাহাড়- ম্লানমুখে নত হয়ে থাকে দূর নাবিক চাঁদ”।

চিত্রকল্প, উপমা, প্রতীক, রহস্য অর্থাৎ যা কিছু কবিতার জন্য দ্যুতিময় তার সমস্তকে ধারণ করেছেন ‘লিঙ্গপুজো’ কবিতায় যেমন: ”হরিণের মাংসের স্বাদের গল্প শুনতে শুনতে দুর্দান্ত ধবল হাত চায় লেমোনিক সুবাস”…

কবিতা যেমন ভাবের ভাষা তেমনি কবিতাও কবির ভাষা। কবির ভাষায় প্রকাশ পায় দেশভাবনা, চাটুকার ও ঘুণেধরা সমাজের বাস্তবচিত্র। আর তাই কবি ছড়ার ছলে বলে ওঠেন… কী যে মজার দেশ আমাদের, কী যে মজার দেশ

যা খুশি তাই করার আছে দারুণ পরিবেশ”…

অদ্বৈত মারুতের কবিতা পড়তে গিয়ে একসময় মন ভারী হয়ে আসে। কয়েকটি কবিতা মাকে নিয়ে লেখা হৃদয় ছোঁয়া কবিতা যেমন…”চুপটি করে রইছো কবে থেকেই

ভুলেই গেছি তোমার স্পর্শ, চুমো

আর দেবে না একটু আদর করে

বলবে না আর বুকের ভেতর ঘুমো”…

এছাড়া ধর্ষণের বিরুদ্ধে এবং মা জাতিকে বাঁচানোর তাগিদ থেকে তিনি শ্লোগান দেন তরুন সমাজের প্রতি… “ ওঠ জেগে ওঠ ঘুমিয়ে পড়া

ওরে নবীন কাঁচা

অমানুষের হাত থেকে আজ মা জাতিকে বাঁচা”…

এই দুঃসময়ে সবচেয়ে কার্যকরী একটি শ্লোগান হতে পারে কবির আওড়ানো এই লাইনগুলি। একদিন যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুভব করেছিলেন… ‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’…

কবি অদ্বৈত মারুতের কবিতায় আছে এক বিস্ময়কর ঘোর। উনার কবিতা পড়লে এ ঘোর কাটতে বেশ সময় লেগে যায়। তিনি সাধারণ বিষয়গুলি কবিতায় প্রকাশ করেছেন অসাধারণ-সুচারুভাবে… তার ”ঘুম” কবিতা একটি উদাহরণ হতে পারে… “ ঘুম হাঁটতে বের হয়ে পথ ভুলে বসে আছে

কোথাও এতটুকু স্বস্তি নেই চোখ জুড়াবার!

কবি অদ্বৈত মারুতের প্রকাশভঙ্গীর একটি আলাদা  আভিজাত্য আছে, যা সচরাচর  অন্য কবিদের কবিতায় চোখে পড়ে না। “দহন” কবিতায় তার এ আভিজাত্য স্পষ্ট যেমন : “অথচ পোড়ার সকল আয়োজনে রয়েছি পড়ে

লাল হয়ে উঠি কামারশালায় পুড়ে ক্ষণে  ক্ষণে”…

প্রতিটি কবিতায় রয়েছে সাবলীল শোভনতা এবং উত্তরণের অভিনব কৌশল, একজন প্রচারবিমুখ এবং জলমাতাল কবি  “এই যে আমি” কবিতায় সহজ করে নিজেকে বুঝিয়েছেন… “পথ মেপে তাই পা-টা বাড়াই

পথের হিসাব দুই কি আড়াই-

হলেই ভাবি, নাই বাঁচা নাই

আখকলে এই হলাম মাড়াই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *