গদ্য

গদ্য ।। সৌজন্যতার পরাকাষ্ঠা।। মীম মিজান

এই একটু হাওয়া খেতে ঢাকা যাওয়া। আপনারা আবার বলবেন ঢাকার হাওয়া যেখানে বিষাক্ত শীশাযুক্ত সেখানে সে হাওয়া খেতে ঢাকায় যাওয়ার কিইবা মহত্ত্ব আছে? ঢাকার ইট পাথরের জঞ্জালের বুকে জেগে থাকা অনেক বাড়িতেই বসবাস করেন শিল্পিত অনেক মানস। তেমনই একজন শিল্প মানস দেশের প্রখ্যাত কবি আসাদ চৌধুরী। কল্যাণপুরের নিজের বাসায় বাস করেন তিনি। রমজানের চতুর্থ রোজা। তাপদাহে সারাদেশের মানুষ হাঁসফাঁস করছে। তবুও রোজা থেকে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভূত হতে দেখা যাচ্ছে।

তরুণ ছড়াকার মাহমুদ রনি। গুলশানের একটি ইংলিশ মাধ্যম ইশকুলের পণ্ডিত। তার বাসায় রাত্রিযাপন আমার। সক্কালবেলা কবি ও সাংবাদিক আবিদ আজমের কাছ থেকে প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরীর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করি। সাড়ে নয়টা নাগাদ ফোন করে তাঁরসাথে আড্ডার একটু ফুরসৎ আকাঙ্ক্ষী হই। ঘুম জড়ানো মোটা গলায় বাসার ঠিকানা বললেন।

নিজ কাজে ঢিলেমি স্বভাবী মাহমুদ রনিকে তাড়া দিয়ে বেড়িয়ে পড়ি বাড্ডা থেকে। রাস্তা যেন আগুনের হল্কা। তপ্ত পিচঢালা পথ থেকে লাভার মরীচিকা বেরুচ্ছিল। শুক্রবারের ঢাকাশহর কোন গ্রাম্য স্বভাবী। মানুষজন পড়ে পড়ে ঘুমোয় বুঝি। না কি রাস্তাঘাটকে একদিনের ক্ষীণ মৌনতা বুঝাতে প্রয়াসী হয়। হাসান ফার্মেসি থেকে খানিকদূর। তারপর কবির নিজস্ব বাড়ির তিনতলায়। দরজা খুললেন প্রৌঢ়া। আমাদের অ্যাপয়ন্টমেন্টের কথা বললাম। কবির ছোট্ট কক্ষে আমাদের নিয়ে গেলেন বেশিরভাগ কেশপাকা এক রমণী। কবি বিছানায় বসে গায়ে শার্ট চড়াচ্ছিলেন। বেশ স্বাস্থ্যবান। বাংলার খাঁটি বাঙালি পোশাক ঢিলেঢালা লুঙ্গি পরনে। তবে আলুথালু।

সালাম দিলাম আমরা। পরিচয় দিলাম। আমার ফারসি জানা দেখে বেশ প্রীত হলেন। রনি পরিচয় দিল। তার পরিচয় শুনে কবি বলে উঠলেন, আপনি রাজশাহীতে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন না? রনির উচ্ছ্বাস, জি। আপনি আমাকে চিনেছেন!

কবির উপর একটি সংকলন বেরুবার কথা। সেখানে আমার একটি লেখা আছে। বিষয়বস্তু, কবির কাব্যে একুশের নানাদিক। আমি সেখান থেকে ক’য়েকলাইন পড়ে শুনালাম। যিনি প্রকাশ করবেন তাকে ফোন করলেন। ফোন করে প্রকাশের বিষয়ে কথা বললেন। আর বললেন, আমার এখানে মীম মিজান সাহেব আর রনি সাহেব এসেছেন। নাও, মীম মিজান সাহেবের সাথে কথা বলো।

আমি কথা বললাম। তারপর তিনি ফোনটি নিয়ে দু’য়েক কথা বলে রেখে দিলেন। বললেন এখানে আরবি, ফারসি, বাংলার আমরা তিনজন আছি। কবি বাংলার ছাত্র। রনি আরবি সাহিত্যের। আর আমি ছিলাম ফারসি সাহিত্যের। বললাম, ফারসি ছোটগল্প নিয়ে কাজ করছি আমি। বাহ, ফারসি জানা লোক বাংলাদেশে খুবই কম। আর প্রকৃত ফারসি জানা লোক নেই বললেই চলে। তিনি ইরানে আন্তর্জাতিক কবি ও কবিতা উৎসবে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ থেকে একমাত্র কবি হিশেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বললেন ইরানিদের আন্তরিক আতিথেয়তার বিষয়ে। ইরানি নামাজ, অজুর কথা। মজার এক স্মৃতিচারণ করলেন তাঁর কবিতার ফারসি অনুবাদের বিষয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগ, ইরানি সংস্কৃতি কেন্দ্র ইত্যাদির অনেক কথা বললেন।

তাঁর হাতের লেখা নাকি খুব একটা সুবিধের ছিল না। ঢাবি বাংলা বিভাগে অধ্যয়নকালে তৎকালীন অধ্যাপক মুনির চৌধুরী তাকে হাতের লেখার বিষয়ে বলেছিলেন। সেখান থেকে উৎসাহিত হয়ে নিজস্ব হস্তলেখা চলনসই করেছিলেন তিনি। বিশ্বের নানা প্রান্ত ঘুরে বেড়ান কবি। কানাডা, জার্মানি ইত্যাদি জায়গার সরস স্মৃতিচারণ আমাদের মোহিত করল।

রাজনীতির উত্থান পতন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিগণের সাথে নানা সময়ে ওঠাবসা ইত্যাদি আমাদেরকে বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ে এক সম্যক ধারণায় উপনিত করল। সাহিত্য অঙ্গনে বলয়বৃত্তির নানাদিক তুলে ধরলেন। বিশেষকরে বললেন, মুসলিম সাহিত্যিকদের আত্নবিস্মৃতির বিষয়ে। নিজের শেকড়কে তারা ভুলে গেছে। উদ্যায়ী হতে চায়। নিজেকে শেকড়হীন পরিচয় দিতে তাদের কী পরমাদ!

শক্তি বাবু যেখানে নিজেকে খাঁটি ব্রাহ্মণ পরিচয় দেন। শেক্সপিয়ার লিখেছেন রোমান ক্যাথলিক নিয়ে। সেখানে নিজেদের ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়ে কেন এত এসব লেখকের হীনমন্যতা! এনারা কি উক্ত দু’জনের থেকেও বড় কবি বা লেখক? এরকমটি আক্ষেপ করলেন। তিনি মূলত ইসলামের সূফীতত্ত্ব বিষয়টি আঁকড়ে ধরতে চান খুউব করে।

বিশ্বসাহিত্যের কত্ত বিষয়ে জ্ঞান তাঁর! বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকের নানা বই তাঁর অধিত। গরম লাগছিল খানিক। তিনি একটু উঠবেন বিছানা ছেড়ে। আমাদের কাছে অনুমতি নিলেন। আমি একটু উঠি? একজন মধ্যবয়সী মানুষকে ডেকে আনলেন। সেই মহোদয় ঘরের এসিটি চালু করলেন। কবাট বন্ধ করে প্রস্থান করলেন মহোদয়। কবি আবার বসে পড়লেন বিছানায়। আমি একটু বিষয় যোগ করে বললাম, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে মাস্টার্স এ বাংলাদেশের কবি ও কবিতা সম্পর্কিত একটা কোর্স আছে। সেই কোর্স রিলেটেড একটি রেফারেন্স গ্রন্থ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। আমার লেখা চারটি প্রবন্ধ থাকবে তাতে।

খুবই উচ্ছ্বসিত দেখলাম কবিকে এই খবর শুনে। সেই গ্রন্থকারের একটি কথা ছিল আমার কাছে যে, আমি যেন বাংলাদেশের দু’য়েকজন এরকম শিল্পমানসগণের কাছথেকে দু’য়েক লাইনের শুভেচ্ছা বাণী সংগ্রহ করি। সেই বিষয়ে কবিকে বললে তিনি একটু ইতস্তত হয়ে বললেন, বইটি না দেখে তো আমি দিতে পারি না। আর এর আগে আমার কাছ থেকে কোন একটি বইয়ের একপৃষ্টা লিখে নিয়ে পরে সেটিকে সাড়ে চারপৃষ্টা করেছিল। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে এ বিষয়ে তিনি সম্মত নন।

ফারসি বিভাগীয় লোকজনকে তিনি খুব ভালোকরে চিনেন। ইরানি রাষ্ট্রদূতের সাথে তাঁর খুউবি ভালো সম্পর্ক জানলাম। ঢাবি’র এক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে ভিসির সাথে যোগাযোগের নানা কথা বললেন। অনুবাদের চরম অভাবের কথা বললেন। বললেন বাংলা সাহিত্যে যে ধরনের কাজ আছে কিন্তু সে পরিমাণে অনুবাদ হচ্ছে না। ফলে বহির্বিশ্ব আমাদের সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদন থেকে বঞ্চিত। আমরাও উন্মোচিত হতে পারছি না বিশ্বসাহিত্য দরবারে। এই প্রসঙ্গে আমি যুগান্তর পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক জুননু রাইন ভায়ের কথা বললাম। তিনিও একই কথা বলেছিলেন।

একটি ফোন আসল বিকেলে ইফতার মাহফিলে যাওয়ার। ফোন শেষে আমাদের হেসে বললেন, দেখুন, আমি মানুষ একজন। ইফতার মাহফিল দু’টো। কয় জায়গায় যাব বলুন? আমি বললাম আমাকে তুমি বলবেন। আমি তাতেই খুশি। কিন্তু তার একাট্টা জওয়াব, আমি যাকে একবার আপনি বলি তাকে তুমি বলাটা প্রায় অসম্ভব। আরবি কবিতার বিষয়ে কথা হল। নবী করিম (সা.) এর সাহাবাদিগের কাব্য, ইমরুল কায়েসের কাব্য, সাব’য়া মু’য়াল্লাকা ইত্যাদিতে কী গভীর দখল কবির!

আমার কোন একক বই নেই। রনির দু’টো ছড়াগ্রন্থ আছে। তবে সেগুলোর কোন কপি অবশিষ্ট নেই। কবিকে পারিনি কোন সৌজন্য দিতে। তাই দাবি করে বললাম, আপনার কোন বই যদি একটু সৌজন্য দিতেন! তিনি উঠবেন বিছানা থেকে। আবারো অনুমতি নিলেন আমাদের থেকে। চারটি পুস্তক হাতে ফিরে এলেন।
‘পদক্ষেপ বাংলাদেশ’ তাকে সংবর্ধনা দিয়ে একটি পুস্তিকা বার করেছিল। সেটির এককপি। আর সদ্য বইমেলাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত কবির ‘তারায় বোনা আকাশ’ নামক ছড়াগ্রন্থের এককপি করে আমাদের উপহার দিলেন। আমারটিতে লিখলেন, পরমপ্রীতিভাজন মীম মিজানকে শুভেচ্ছাসহ, আসাদ চৌধুরী, ১০০৫২০১৯

কবি আক্ষেপ করে বললেন, বাংলাদেশের প্রকাশকেরা বইও দেয় না টাকাও দেয় না। আমার সব কাব্যসমগ্র শেষ হয়ে গেছে। আমার রচনাসমগ্র বেরুলো এবার অনন্যা থেকে।

জুমার দিন। তাই বিদায়ের সুর বাজিয়ে একটা ছুঁই ছুঁই কালে আমরা বেরিয়ে পড়ব কবির বাসা থেকে। বাসার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। দরজা খোলা রেখে মিনিট পাঁচেক আরো কথা হলো। আমি বললাম, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক পদে দরখাস্ত করেছি। তিনি বললেন, কাউকে ফোন করতে হলে জানাবেন প্লীজ! আমি বললাম, সামনে ঢাকা আসলে আবারো আসব আপনার কাছে। তাঁর সৌজন্যতার পরাকাষ্ঠা উত্তর, প্লীজ! অবশ্যই আসবেন। আর আসার আগে ফোন করে আসবেন। আমি মাস তিনেক পরে হয়ত ক্যানাডা চলে যাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *