দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন জীবনের আকিবুকি।। ফখরুল হাসান

কবিতার শব্দচয়ন এবং বাক্য গঠন, ভাষায় তিনি জীবনের গভীরতর উপলব্ধি গুলো অনায়স দক্ষতায় তুলে আনেন। তাই কবি মিলু শামসের নিজস্ব ভঙ্গির সাথে পাঠক সহজে একাত্মবোধ করবে বলে আমার ধারণা। তা থেকে যে উত্থিতউচ্ছ্বাস, ভিন্নভিন্নরূপ-উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্পের বন্ধনে, নানা আঙ্গিকে করেছেন। যেখানে তার মন জাগতিক উপলব্ধির যে দিকতা- ভাল লাগার ভালবাসার, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষার, স্বপ্নের, ভয় ও আতঙ্কের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক দেহ তাত্ত্বিক,স্বাদেশীকতা ছাড়াও অসংগতির বিরুদ্ধতা তাঁর উপস্থাপনায় উপস্থাপিত হয়েছে। শুধুতা-ই না, মাটির জন্যে, মানুষের জন্যে প্রতিটি মুহূর্ত কথা বলবার যে অদম্য স্পৃহা, তা ঘুরে ফিরে এসে তাঁকে ও তাঁরকাব্য সৃষ্টিকে স্বাতন্ত্র্যতা দিয়েছে বলে বিশ্বাস, লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠে। পেশায় সাংবাদিক হলেও লিখে যাচ্ছেন তিনি সেই শৈশব থেকেই। যার ফলশ্রুতিতে নিজেকে তৈরী করে।দেশের একজন সামনের কাতারের কবি হিসাবে জাতির সামনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন শ্রমসাধ্য কাব্যশক্তি বলে। তিনি হচ্ছেন কবি মিলু শামস। যার সাথে আমার সরাসরি সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়নি।
তাঁর কবিতায় স্বাধীনতার কথা বলেছেন। বলেছেন গণতন্ত্রের কথা, স্বপ্নের কথা। মৃত্যুর কথাও এসেছে কবিতায়। ভালোবাসার কথা তো আছেই। কবি ও কবিতার বন্দনা গেয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে তারুণ্যের জয়গান গাইতেও ভোলেননি। আমার কাছে মনে হয়, কবিতা সার্থক হয়ে ওঠে তখনই, যখন এটি জীবনের অদেখা অংশকে আমাদের সামনে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে। সেদিক থেকে আমার দৃষ্টিতে কবি মিলু শামস ও তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই সফল ও সার্থক। পাঠক প্রতিটি কবিতায় নতুনত্বের স্বাদ খোঁজে পাবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে নিজস্বতা একজন সফল কবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মিলু শামসের কবিতাপাঠ শেষে মনে হয়েছে তাঁর নিজস্বতা আছে। পরিশেষে বলা যায়, সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে কবিতায় যে খড়া চলছে। তার মাঝে দাঁড়িয়ে এই কাব্যগ্রন্থটি কাব্যের জয়গান ইউচ্চারণ করবে।

হলুদ জোনাকি কবিতায় কবি স্মৃতিচারণ করেছেন, তাঁর কৈশোরের কোন এক বন্ধুকে নিয়ে। সেই বন্ধু আজও কবির মনের অলিন্দে ভেসে বেড়ায়। কবিতার লাইন গুলো যে কোন মানুষকে নিয়ে যাবে শৈশবে মনে করিয়ে দিবে শত ব্যস্ততার মাঝেও সেই প্রিয় বন্ধুর মুখ।

“ইচ্ছে হয় তোমায় নিয়ে হেঁটে যাই
কৈশোরের শিমুল তলা দিয়ে,
ঝাঁ-ঝাঁ রোদে
হাতে রেখে হাত
পেরিয়ে যাই আমাদের
ক্ষীণ স্রোতা নদী”

দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো কবিতায় কবি এঁকেছেন অসংখ্য মানুষের জীবনের জলছবি। যেখানে গ্রাম ও প্রকৃতির রূপ অপূর্ব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। সেই সাথে কবি খুঁজেছেন। সেইসব মানুষের গ্রামকে। যারা জীবনের প্রয়োজনে নিজের গ্রামকে ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আছেন। কিন্তু তারা এক মুহূর্তের জন্য ও গ্রাম কে ভুলতে পারছে না। এই কবিতার পঙক্তি গুলো পড়লে নিজের গ্রাম থেকে চলে আসা মানুষের মনে ভীড় করবে তার অতীত স্মৃতি।

“বহুদূর থেকে ভেসে আসে
বর্ষণ ক্লান্ত উঠোনের ডাক,
বাড়িটি আঁচল বিছিয়ে দিলে
সবুজ গাছেরা সাজতো”

কংক্রিটের শহরে বসবাস করলেও কবির অবচেতন মন এখনো পড়ে আছে রূপসী সেই গ্রামেই। কবিতার চয়ন গুলো পাঠ করলেই যে কেউ সহজে বুঝতে পারবে। এটাই মনে হয় কবির কাব্যের মুন্সিয়ানা।

নিজস্ব মুখ কবিতা পড়ে পাঠক খুঁজে পাবে কবির দেশ প্রেমকতটা গভীর। সমসাময়িক বিষয় গুলোও যে কবির ভাবনার জগৎকে এড়িয়ে যায়না তার প্রমাণ রেখেছেন এই কবিতায়। দেশ প্রেমের অভিনয় করা মুখোশ পড়া মানুষের চরিত্র গুলো চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কয়েকটি লাইনে। সেই সাথে কবি আশাবাদী কেউ একজন আসবেন হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো। তাই কবি তাঁর কবিতায় অসভ্য এস বমানুষকে ইঁদুরের সাথে তুলনা করে একজন বাঁশিওয়ালার অপেক্ষায় আছেন। তাইতো কবি লিখেছেন।

“নীল পাহাড় থেকে একদিন
সেই বাঁশিওয়ালা
নেমে আসবে নিশ্চিত;
শহর দাপানো ইঁদুরের রিলেরেসে
রেফারি হয়ে”

কবি মিলু সামসের প্রতিটি কবিতায় ফুটে ওঠে ভালোবাসা অপার লীলাভূমি।সীমানা প্রাচীর কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন জীবনের আকিবুকি-

‘মানুষ আর ছায়া মানবের
সীমানা প্রাচীর থেকে
মৃত্তিকার অতলে…
কবিতায় এভাবেই তিনি দেখিয়েছেন জীবনের নানা মূখি দিক প্রবাহ। কবিতার চরণে চরণে ফুটে তুলেছেন পাঠককে তৃপ্ত করার নানান উপমা সমৃদ্ধ কল্পনা। ঝিঙে ফুল বিকেল কবিতায় তাঁর প্রেমসিক্ত পুস্পবতীতপ্ত মোমের মতো ফোঁটা ফোঁটা স্নিগ্ধতা ছড়ানোর গল্প পাঠককে খুব দ্রুতই কবিতা স্বাদ গ্রহণে তৃপ্ত করবে।
দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো কাব্যগ্রন্থের সব কটিকবি তাই দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। অনেকেই হয়তো মিলু সামসের সে সব কবিতা আগেই পড়ে ফেলেছেন। কিন্তু পাঠক মাত্রই বইটি হাতে নিলে সেই পুরোনো স্বাদ নতুন পেয়ালায় পান করার তৃপ্তি পাবেন। কবির কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের আসনে স্থায়ীভাবে আসন পাবে বলে আশা করি।

বইয়ের নামঃ দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো
ধরণঃ কাব্যগ্রন্থ
প্রচ্ছদঃ মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশকঃ উৎস
মূল্যঃ ১৫০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *