উপন্যাস

উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব তিন



মারিয়াকে অনুসরণ করে ছোট্ট একটা রুমে এসে প্রবেশ করি। শুরুতেই কাউন্টার। তার পাশেই ট্রেতে সাজানো কয়েক রকম খাবার। পাঁচ ছয়টা টেবিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখে প্রথমে মনে হলো- এলোমেলো হয়ে আছে। পরে বুঝা গেল এভাবেই সাজানো। জানালার পাশে একটা টেবিলের দিকে ইশারা করে মারিয়া সেখানে গিয়ে বসল। আমিও একটা চেয়ার টেনে কাঁধের ব্যাগটা রেখে বসি। এই প্রথম মারিয়া আমার দিকে ভালো করে তাকাল।
জানতে চাইল, ‘নাস্তা খেয়েছ?’
‘না।’ সত্যটাই বলি।
‘খাওনি কেন! এত বেলা হয়ে গেছে।’ বলেই মারিয়া কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। সামনে দাঁড়ানো একটা মেয়ের সাথে কথা বলে আবার এসে বসল।
বলল, ‘আমার অনেক কাজ আজ। একটু পরেই আমরা কুতুপালং ক্যাম্পে যাব। ফিরতে বিকেল শেষ হয়ে আসবে। তোমার প্ল্যান কী আজকের?’
‘আমার কোনো প্ল্যান নেই।’
‘প্ল্যান নেই মানে কী!’ মারিয়া অবাক হয়।
‘প্ল্যান নেই মানে প্ল্যান নেই। আমি অফিসের কাজে আসিনি।’
মারিয়া এবার ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়, ‘তবে কেন এসেছ?’
আমি মারিয়ার হাতের ওপর হাত রাখি। মুহূর্তেই মারিয়া হাতটি সরিয়ে নিজের কোলের ওপর রাখে।
আমার চোখে চোখ রেখে বলে, ‘দেখো এটা আমার অফিস কম্পাউন্ড। এখানে এসে কোনোরকম ঝামেলা করার চেষ্টা করবে না। এটা আমার প্রথম এবং নতুন চাকরি। আমি চাই না, এখানকার কেউ আমাকে নিয়ে কোনো রকম সন্দেহ বা কিছু ভাবার সুযোগ পাক।’
আমি মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মারিয়া কথা শেষ করেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। মারিয়ার চোখ অনুসরণ করে আমিও বাইরে চোখ রাখি। আটতলার ওপর থেকে দূরের সমুদ্রকে কেমন শূন্য মনে হয়। দূরে কালো মতোন একটা নৌকা নজরে আসে। মাছ ধরার ট্রলার হতে পারে। তীর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে নাকি তীরে আসছে বোঝা মুশকিল। আমি মারিয়ার দিকে আবার তাকাই। মরিয়া হয়ে আরেকবার ওর নাম ধরে ডাকি।
‘মারিয়া, আমার ভুল হয়েছে।’
মারিয়া নিরুত্তর।
‘তুমি যেভাবে বলবে, সেভাবেই হবে।’
মারিয়ার মুখে কোনো কথা নেই তবুও।
‘মারিয়া, আমি এখন কী করব, তুমি বলো?
থমথমে মেঘের পরে যেভাবে বৃষ্টি আসে মারিয়া সেভাবে মুখ খুলল। বলল, ‘তুমি যখন যা চাইবে তা-ই হবে, এটা কেন ভাবো? তোমার ভাবনা নিয়ে তুমি থাকো। আমাকে আর বিরক্ত কোরো না। আমি এখন নিজের মতো গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করছি। প্লিজ আমাকে আর কোনো রিকোয়েস্ট কোরো না। কথা শেষ করেই মারিয়া আবার জানালায় চোখ রাখল। ব্যাগে হাত দিয়ে টিস্যু বের করল। আমি উঠে চলে এলাম।
তারপরে মারিয়ার সাথে আর দেখা হয়নি। কথা হয়েছিল কয়েকবার।

এতদিন পরে আবার মারিয়ার মুখোমুখি। হসপিটালের ওয়েটিং রুমে। মারিয়া ফোনে কথা বলছিল। ওর চোখেমুখে ভ্রমণজনিত ক্লান্তি স্পষ্ট। ওর কথা বলা শেষ হওয়ার জন্য দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। ফোনে কথা বলতে বলতে মারিয়া পাশ ফিরে তাকাতেই চোখ পড়ল। হাত উঁচু করে কাছে ডাকল। পাশে গিয়ে বসলাম। মারিয়া খুব স্বাভাবিকভাবে ওর হাতব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করল। ছোট্ট পার্স খুলে কিছু টাকা বের করল।

টাকা আর কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘আগে টাকাটা জমা দাও তো কাউন্টারে।’
আমার কাঁধের ব্যাগটা মারিয়ার পাশে রেখে কাউন্টারের দিকে যাই। কাউন্টারের তরুণী হাত বাড়িয়ে টাকা ও সিল্পটি নিলেন। রোগীর নাম বয়স জানতে চাইলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রোগী আপনার কী হয়?’ কী উত্তর  দেব। মারিয়া যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল টের পাইনি। ও বলে উঠল, বন্ধু লিখে দেন।

তরুণী কী বুঝল কে জানে, আর কিছু জানতে চাইল না। টাকা জমা হয়ে গেলে আমরা এসে আবার আগের জায়গাতে বসি।

মারিয়াই প্রথমে মুখ খুলল, ‘কয়েকমাস ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। জ্বর কমছে না। আবার সামান্য ঠাণ্ডা লাগলেও তা আর সেরে উঠছে না। ওখানকার ক্যাম্পের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা অল্পকিছু টেস্ট করতে বলেছিল। মাঝে একবার চিটাগং গিয়ে সেগুলো করিয়েছিলাম। ওখানেও সব ব্যবস্থা নেই। তারা কিছু একটা অনুমান করছেন। কিন্তু টেস্টের রেজাল্ট না পেয়ে বলতে চাচ্ছেন না। তাই এখানে আসতে হলো জরুরি। এদিকে কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাসায় কারও সাথে যোগাযোগ নেই। তুমি তো জানোই আব্বার কোনো স্মৃতিই আমার নেই। আর মা গেলেন মাস কয়েক আগে। মা যতদিন ছিলেন তাও ফোনে খোঁজখবর নিতেন। আপা ওর শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ব্যস্ত। মাঝেমাঝে কথা হয়। প্রতিদিনের খবর আর এখন কে নেবে! ডাক্তারের কাছে যাওয়া আসা একা একা… তাই তোমাকে ফোন করতে হলো।’
মারিয়া টানা কথা শেষ করে একবার আমার দিকে তাকাল। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। হাতে থাকা কাগজগুলোতে চোখ রাখি। মারিয়া ব্যাগ থেকে আরেকটি কাগজ বের করে আমার পাশে রাখে। আমি হাতে নিয়ে চোখ রাখি। ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিং! আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমি মারিয়ার দিকে তাকাই। কিন্তু সব কেমন ঘোলাটে হয়ে আছে। মারিয়া আমার কাছ থেকে অস্পষ্ট হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।  

ডাক্তারের চেম্বারটি বেশ বড় এবং খোলামেলা। প্রথমে একটি কাচের দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হলো। দেখে মনে হলো এটা ওয়েটিং রুম। কয়েকটি সোফা রাখা আছে। সাত আটজন নারী-পুরুষ বসে আছেন।

ডাক্তার এখনো চেম্বারে এসে প্রবেশ করেননি। চেম্বারের দেয়ালে বেশ কয়েকটি সতর্কবার্তা টানানো। প্লাস্টিকের তৈরি একধরনের বিলবোর্ডের মতো দেয়ালের সাথে ঝুলে আছে। তাতে এক নারীর অবয়ব আঁকা। নারীটি তার বুকের ওপর এক হাত রেখেছেন। অন্য হাত শরীরের সাথে মেশানো। বিলবোর্ডটির ওপরের দিকে কালো অক্ষরে বড় করে লেখা- স্তন ক্যানসার সময়মতো চিকিৎসায় ভালো হয়। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করতে পারলে চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

নিচের দিকে ছোট অক্ষরে লেখা- স্তন ক্যানসারের উপসর্গগুলো চিনতে পারা ও সেদিকে নজর রাখা অবশ্যই উচিত। আরও ছোট ছোট অক্ষরে লেখা রয়েছে-  স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বয়স্ক নারীদের। তবে অন্যদেরও এই বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। তারও নিচে বেশকিছু উপসর্গ লেখা রয়েছে। দূর থেকে সেসব ভালোভাবে পড়া যাচ্ছে না। আমি এগিয়ে সামনে দাঁড়াই। স্তন ক্যানসারের উপসর্গ হিসেবে লেখা আছে– স্তনের ভেতরে দানা বা পিণ্ড ধরনের কিছু অনুভব না করলেও স্তন ফুলে ওঠা, স্তনের ত্বকের কোনো অংশ কুঁচকে যাওয়া, স্তন কিংবা বৃন্তে ব্যথা হওয়া, বৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে যেতে থাকা, স্তন কিংবা বৃন্তের ত্বক লালচে, শুষ্ক ও মোটা হয়ে যাওয়া, বাহুর নিচের অংশে কিংবা ‘কলারবোন’-এর অংশের কোনো ‘লিম্ফ নোড’ বা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া। এই উপসর্গ থেকে বোঝা যায় যে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এসময়ও মূল ‘টিউমার’ বাইরে থেকে অনুভব করা নাও যেতে পারে।

যথাসময়ে ডাক্তারের কামরায় ডাক আসে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের মাথায় চুল নেই। একেবারে চকচকে টাক। গোঁফখানা একেবারে আইনস্টাইনের মতো।  আমাকে দেখেই বসতে বললেন।

সামনের কাগজের দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘পেশেন্ট কী হয়?’
আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। তাই চুপ করে থাকি।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললেন, ‘রোগীর সাথে আপনার সম্পর্ক কী? কী হয় আপনার?’
আমি সহসা কিছু বলতে পারি না। কী বলব? মারিয়া আমার কে? স্ত্রী তো নয়। প্রেমিকা কি বলা যায়? নাকি বন্ধু? কী বলব?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে ডাক্তার আবার তাড়া দেন :  ‘কথা বলছেন না কেন?’
‘আমার পরিচিত।’ অল্প করে উচ্চারণ করি।
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাসীর মতো আমার দিকে তাকালেন। তারপরে বললেন, ‘একজন অপরিচিতার জন্য এখানে এসেছেন! যাক মশাই জগতে তাহলে মায়া-মহব্বত বলেও কিছু আছে।’ বলেই তিনি আমার দিকে তাকালেন।
তারপরে বললেন, ‘দেখেন নিকটাত্মীয় ছাড়া এইসব বিষয়ে কথা বলা ঠিক না। তবুও আমি আপনাকে বলতে চাই, কারণ সময় কম। পারলে পেশেন্টকে আজই ভর্তি করিয়ে যান। যত দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার চিকিৎসা শুরু করা যাবে। ততই মঙ্গল।’
‘কী হয়েছে? টেস্টের রেজাল্ট কী?’
‘আমরা যেটা আশঙ্কা করেছিলাম। তাই হয়েছে। স্তন ক্যানসার!’
আমি দ্রুত ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে আসি।

Series Navigation<< উপন্যাস ।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুইউপন্যা।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব চার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *