উপন্যাস ।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।।এহসান মাহমুদ।।প্রথম পর্ব
- উপন্যাস ।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব তিন
- উপন্যা।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ ।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।।কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। কোকিল অসময়ে ডাকিয়াছিল।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দশ
২
হসপিটালের ভেতরে পা রাখতেই মারিয়াকে দেখা গেল। পায়ের কাছে ছোট্ট একটি হ্যান্ডব্যাগ। মোবাইলে কথা বলছে। মারিয়ার পায়ের কাছে ছোট্ট ব্যাগ দেখেই আমার কেমন ভয় করল। কেবল অনার্স শেষ করেই চাকরিতে ঢুকেছি, মা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। এমন এক সময়ে মারিয়া আমার অফিসে এসে হাজির। সাথে একটা ছোট্ট ব্যাগ। এসে বলল ও আমার বাসায় যাবে। আমাদের বিয়ে করতে হবে। শুনে আমি অবাক হতেও ভুলে গেছি। কেবল নতুন চাকরি। মা মারা গেলেন অল্প কয়েকদিন। এই মুহূর্তে বিয়ে করি কী করে! আর বিয়ে নিয়ে কোনো পরিকল্পনাও ছিল না কখনো। মারিয়াকে নিয়ে রিসিপশনের পাশে গেস্টরুমে বসি। ও বলল, ওর বাসা থেকে বিয়ের জন্য প্রচুর চাপ দিচ্ছে। সন্ধ্যায় এক পাত্রপক্ষ আসবে ওকে দেখতে। পছন্দ হলে আংটি পরিয়ে যাবে। তাই ও বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে। আমি ওকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তারপর এত বছর আর দেখা হয়নি। আমি প্রথমে কয়েকদিন ভয়ে ছিলাম। ভাবলাম মারিয়া কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পেরেছে। তাই নিজে থেকে ফোন দেওয়া থেকে বিরত ছিলাম। এক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরে মনে হলো এখন যোগাযোগ করা দরকার। নইলে বিষয়টা খারাপ দিকে যাবে। আর মারিয়া ছাড়া দিনশেষে কথা বলার মতোও আমার কেউ ছিল না।
এক সপ্তাহ পরে মারিয়াকে ফোন দিয়ে যা জানলাম, রীতিমতো সিনেমার কাহিনীকেও হার মানাবে। সেদিন মারিয়া আমার অফিস থেকে বের হয়ে সোজা চলে গিয়েছিল যাত্রাবাড়ীতে। আমাদের বন্ধু লিজার বাসায়। লিজার বিয়ে হয়েছিল। লিজার স্বামী আরমান ভাই জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এ চাকরি করত। প্রথমে চিন্তা ছিল সে বাসায় দিন কয়েক পালিয়ে থাকবে ফোন বন্ধ করে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরেই ওর পথ বদলে যায়। আরমান ভাই ওকে নাকি হাসতে হাসতে বলেছিল, মারিয়া নিজের বাসায় ফিরতে না চাইলে ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকতে পারে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কাজ করতে হবে, ওখানেই থাকতে হবে- এমন একটা চাকরির ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন। সেই থেকে মারিয়া কক্সবাজারবাসী। ওখানে ইউএন ফিল্ড অফিসে কাজ করে। জার্নালিজম ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়াশোনা হওয়ায় ওকে দেওয়া হয় ডকুমেন্টেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেকশনে। সপ্তাহে দুদিন বন্ধ। বাকি পাঁচদিন অফিস করতে হবে। কোন ক্যাম্পে কতজন রোহিঙ্গা এলো, তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা কত, পুরুষের সংখ্যা কত, শিশুর সংখ্যা কত, গর্ভবতী নারীর সংখ্যা কত, ষাটোর্ধ্ব লোকসংখ্যা কত- এইসব কাজ করতে হবে।
মারিয়ার কণ্ঠ শুনে কেমন অপরিচিত মনে হলো। আবার আমার মধ্যেও একধরনের অপরাধীর মতো ভয় ছিল। তাই ওকে আর কিছু বলতে চাইনি। ভেবেছিলাম কয়েকদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আর ঠিক হলো কই! এরপরে যখনই মারিয়াকে ফোন করতাম বলত, ব্যস্ত আছি কাজ করছি। মিটিং করছি। আর রাতে ফোন দিলে বলত, সারা দিন অনেক কাজ করেছি, এখন প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। রাখি। বলেই লাইন কেটে দিত। এইভাবে প্রায় এক মাস চলে গেল। এরপর আমারও জিদ চাপল। আমিও কল করা বন্ধ করে দিলাম। অফিসে নানামুখী কাজে দিনে প্রায় ভালোভাবেই কেটে যেত কিন্তু ছুটির দিনে বা রাতে বাসায় ফেরার পরে মনে হতো কারও সাথে কথা বলি। গল্প বলি। তখনই মারিয়ার কথা মনে হতো। মাঝেমাঝে ভাবি দুদিনের ছুটি নিয়ে কক্সবাজার চলে যাই। আমাকে দেখে মারিয়া চমকে যাবে নিশ্চয়। মারিয়াকে নিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার কত প্ল্যান করেছিলাম। সব প্ল্যান অবশ্য মারিয়া নিজেই করত। ওয়েবসাইট দেখে দেখে ট্যুর প্ল্যান সাজাতো। কিন্তু আমার তখন অফিসের ছুটি মিলত না। ওর প্ল্যান মাটিতে যেত। ও আমাকে তখন কেরানি বলে ক্ষেপাত।
আমি বলতাম, কাছে পেলে এখন তোমারে মাইর দিতাম। মারিয়া বলত, সাংবাদিক আর কেরানি একই। কখন ছুটি মিলবে কেউ জানে না।
এক রাতে কথা বলতে বলতে বললাম, তুমি আসো। কালই আমরা কক্সবাজার যাব।
মারিয়া বলল, ‘না।’
‘কেন?’
‘তুমি যে বললা, মাইর দিবা!’
‘আদরের মাইর।’
‘মানে!’
‘বুঝো নাই?’
‘না।’
‘সত্যি বুঝো নাই?’
‘বলব না।’
‘তবে শুক্রবার আসবে না?’
‘এখন বলতে পারছি না। শুক্রবার জানাব।’
‘এখনই বলতে হবে। প্ল্যান করতে হবে না!’
‘যাব না আমি।’
‘মানে কী! তুমি কথা দিয়েছ, মারিয়া…’
‘এখন ভয় দেখাচ্ছ, তাই আর যাব না।’
‘হা হা হা…’
‘হাসতেছ কেন?’
‘তুমি কি বাচ্চা?’
‘কেন? বাচ্চা হতে যাব কেন!’
‘তাহলে ভয় পাও কেন?’
‘পাবই ভয়। বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো বজ্রপাতের সময় ভয় পেয়ে তোমার বুকে থাকব।’
‘হইছে আর বাচ্চামি করতে হবে না সোনা।’
‘কেন! বাচ্চামি করলে সমস্যা কী? বুকে রাখতে চাও না? গার্লফ্রেন্ড পুরনো হয়ে গেছে, না?’
‘আরে ধুর! বাদ দাও।’
‘আচ্ছা। বাদ দিলাম।’
‘এবার সিরিয়াসলি ভাবো— শুক্রবার কোথায় যাওয়া যায়?’
‘তুমি ভাবো।
‘আচ্ছা। গাজীপুর কেমন হয়? ওখানে সুন্দর রিসোর্ট আছে। সুইমিংপুল আছে। ট্রাভেল সাইটে দেখলাম। একদিনের জন্য আমরা যেতে পারি।’
‘আমি ছুটি নিয়ে নিলাম দুদিনের।’
‘মাথা খারাপ তোমার! তুমি পাবা ছুটি?’
আমার আর ছুটি পাওয়া হয়নি। মারিয়াকে নিয়ে কক্সবাজার কিংবা গাজীপুরও যাওয়া হয়নি।
তবে মারিয়া কক্সবাজার চলে যাওয়ার পরে যেদিন তিনমাস পূর্ণ হলো, ঠিক করলাম সেই রাতেই কক্সবাজার যাব। অফিস থেকে ছুটি চাইলাম। রাতের বাসের টিকিট কাটলাম। একবার ভাবলাম মারিয়াকে কল করে জানাই। কিন্তু ওকে সারপ্রাইজ দেব ভেবে আর জানালাম না। সকালে যখন কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছলাম তখন প্রায় আটটা। ঢাকা থেকে ফেরার সময়ে আমাদের পত্রিকার কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি ইয়াসিনের নম্বরটা নিয়েছিলাম সাথে করে। ইয়াসিন আমাকে ইউএন কক্সবাজারের অফিসে নিয়ে গেল। আমি যখন মারিয়ার অফিসে গিয়ে পৌঁছলাম তখন সকাল নয়টা। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির হওয়ার পরে এটাই প্রথম কক্সবাজার আসা। কলাতলী বিচের সাথেই একটি চারতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে অফিস করা হয়েছে। কক্সবাজারে এখন জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। ইয়াসিন এখানকার স্থানীয় হওয়ায় ওর কাছে খবর নিয়ে জানলাম এখানে বিভিন্ন এনজিও এবং দাতা সংস্থার অফিস হওয়ায় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম থেকে শুরু করে হোটেল ভাড়াও বেড়েছে। আগে মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে হোটেলের ভাড়া খুবই কম ছিল। এখন মৌসুমে আর সারা বছরে ভাড়ার তারতম্য তেমন একটা হয় না।
মারিয়ার অফিসে গিয়ে ইয়াসিনকে বিদায় জানিয়েছিলাম। চাইনি মারিয়ার সাথে ইয়াসিনের জানাশোনা হোক। মফস্বলের সাংবাদিকদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। সারাক্ষণই ধান্ধায় থাকে। ইউএন অফিসের ফ্রন্টডেস্কে যিনি বসা ছিলেন, সম্ভবত আদিবাসী নারী হবেন। আমাকে দেখেই জানতে চাইলেন কার কাছে এসেছি। মারিয়ার নাম বলতেই সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। চা বা কফি কিছু খাবো কি-না জানতে চাইলেন। প্রায় মিনিট বিশেক বসে থাকার পরে মারিয়া এলো। সাথে এক পুরুষ। সম্ভবত ওর কলিগ। আমি মারিয়াকে দেখে দাঁড়ালাম। মারিয়া ওর কলিগকে বিদায় দিয়ে আমার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে আরেকটি চেয়ারে বসল।
আমার দিকে তাকিয়ে খুব সহজ গলায় বলল :
‘কী তোমার অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট? সাথে আর কারা এসেছে?’
আমি মারিয়ার মুখের দিকে চেয়ে আছি। মারিয়া এই তিনমাসে একটু কালো হয়েছে। না ঠিক কালো না। কেমন বাদামি হয়েছে। না ঠিক বাদামিও নয়। বাদামি ও তামাটের মিশ্রণ হয়েছে। তবে এই সময়ে যেটি সবচেয়ে বেশি চোখে লাগছে মারিয়াকে কেমন আর পরিচিত মনে হচ্ছে না। মনে করতে পারছি না, এই মারিয়া আমার কতটা জুড়ে ছিল একসময়। কত কথা গুছিয়ে এনেছিলাম। সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কোথায় গেল সব কথারা! কী বলব আমি? গুছিয়ে উঠতে পারছি না। মারিয়া কী জানতে চাইল আমার কাছে? আমি কেমন আছি এটা কি জানতে চেয়েছে? আমার ভাবনায় যখন এইসব ঘুরপাক খাচ্ছে, মারিয়া আবারও মুখ খুলল তখন :
‘কীসের অ্যাসাইনমেন্ট? কতদিন থাকবে?’
এইবার কিছু একটা জবাব দিতে হয়। আমি বলি : ‘থাকব কয়েকদিন। দেখি, এখনো ঠিক হয়নি।’
মারিয়া কিছু একটা বলে বিড়বিড় করে। আমি বুঝতে পাারি না।
আমি বলি, ‘তুমি কেমন আছো মারিয়া?’
মারিয়া আমার কথার জবাব দেওয়ার আগে ফ্রন্টডেস্কের দিকে একবার দেখল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চলো ওদিকে গিয়ে বসি। বলেই উঠে দাঁড়াল। আমি মারিয়াকে অনুসরণ করি। মারিয়া বের হয়ে লিফটের সামনে দাঁড়ায়। লিফট আসতেই আমার দিকে ইশারা করে ভেতরে প্রবেশ করে। আমিও মারিয়ার পিছু পিছু যাই। সেভেন বাটনে চাপ দিয়ে মারিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। কথা শুরু করার আগে মুহূর্তেই লিফটের দরজা খুলে যায়। মারিয়া বের হয়ে পড়ে। আমিও। মারিয়ার সাথে প্রথম লিফটে ওঠার কথা মনে পড়ে। আমরা তখন ফাইনাল ইয়ারে সম্ভবত। একদিন কারওয়ান বাজারে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে একটি ওয়ার্কশপে যোগ দিয়েছিলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে নয় তলায় আসতে প্রায় দুই মিনিটের মতো লেগে গেল। সাত তলায় আসতেই লিফট খালি হয়ে গেল। আমি আর মারিয়া ছাড়া কেউ নেই। মারিয়া হঠাৎ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। কাছে এসেই হঠাৎ চুমু খেল। আমি ভড়কে গেলাম। মারিয়া হাসল। বলল, এমন সুযোগ আর আসবে না। বলে চোখ টিপে দিয়ে হাহা হিহি করল খানিক। হায়! এসব কথা কেন আমার আজ মনে পড়ছে!