উপন্যাস।। নিখোঁজ মানুষের গান।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই
- ধারাবাহিক উপন্যাস//নিখোঁজ মানুষের গান// এহসান মাহমুদ// এক
- উপন্যাস।। নিখোঁজ মানুষের গান।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। নিখোঁজ মানুষের গান।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব তিন
পর্ব-২
প্রেসক্লাবে অনেক প্রোগাম কাভার করেছি। এর আগে কোনো অনুষ্ঠান কাভার করতে গিয়ে এমন হয়নি। বারবার মনে হচ্ছে- শুক্রবার দিনটাই মাটি হয়ে যাবে। দিনের শুরুতেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে। আজকে সাংবাদিক না হলে এমন ছুটির দিনের সকালে এখানে বসে থাকতে হতো না। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। সবার ঠোঁট নড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে এখনই কথার বাজার বসে যাবে। কিন্তু কারও মুখ থেকেই কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। এমন দম বন্ধ করা পরিস্থিতি প্রেসক্লাবে এর আগে কখনও দেখিনি। হলরুমের দরজার বাইরে সবুজের সাথে দেখা। সবুজ প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে কাজ করে। আমাদের দেখলেই মামা ডেকে সামনে এগিয়ে আসে। মাঝেমাঝে সিনিয়রদের আড়ালে আমাদের হাতে সিগারেটের প্যাকেট পৌঁছে দেয়। সবুজের ব্যক্তিত্ব আমার পছন্দ। ক্যান্টিনে কাজ করলেও টিপস নিতে ওর আপত্তি। চা নাস্তা খাওয়ার পরে ওকে দশ-বিশ টাকা টিপস দিতে চাইলে সহজে নিতে চায় না। আমার সাথে সবুজের অন্য রকম একটা সম্পর্ক আছে। প্রেসক্লাবে সবুজ আমার সোর্স। আমাকে যে খবরের সূত্র ও জানায় অন্য কাউকে তা জানায় না। মাঝেমাঝে ফোন করে দুর্দান্ত সব তথ্য দেয়। এই কাজের জন্য সবুজকে মাঝেমাঝে কিছু টাকা দিই। প্রথমে সবুজ টাকা নিতে রাজি হতো না। বলতো, ইমতু মামা, আমিও আপনার লগে সাংবাদিকতা করুম। শুনে আমার হাসি চলে আসতো। আমার ইমতিয়াজ নামটাকে সবুজ সংক্ষেপ করে নিয়েছে নিজের মতো করে। ওর মুখে ইমতু মামা শুনলেই আমার হাসি পায়। আবার আমি হাসলেই সবুজের মুখ মলিন হয়ে যায়।
আজকে হলরুমের বাইরে সবুজের সাথে দেখা হতেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
ইমতু মামা, নিচে ক্যান্টিনে গেলেন না। জটিল খবর আছে। বলেই সবুজ আশেপাশে তাকায়। আমাকে ইশারা করে ওয়াশরুমের দিকে যায়। আমি ওর পেছন পেছনে ওয়াশরুমে যাই। সবুজ বলে চলে- মামা, আজকা বড় হলরুমে যে প্রোগ্রামটা অইবো, এইটা নিয়ে তো ঝামেলা আছে। সকালে আটটার দিকে যখন আমরা ক্যান্টিন পরিস্কার করতেছিলাম তখন দুইজন লোক আসছিল। চোখে সানগ্লাস লাগানো। দুইজনের হাতে পুলিশের মতো ওকিটকি ছিল। আবার পুলিশ কিনা, তাও বুঝতে পালাম না। ক্যান্টিনের ম্যানেজার রফিক মামারে যেন কী বলে গেল। তারপরে হলরুমের কেয়ারটেকার নাসির ভাইরে নিয়ে হলরুমে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবিটবি তুলল। যাওয়ার সময়ে বল গেল, যেন হলরুমে কোনো মাইক ব্যবহার করা না হয়।
নিজের কথা শেষ করে সবুজ আমার কাছে জানতে চাইলো- মামা, কীসের অনুষ্ঠান অইবো? কুনো ঝামেলা নাই তো?
না ঝামেলার কিছু নাই। তুই নিচে যা। আমি নাস্তা করে আসি নাই। একটা ডিম পরোটা দিয়ে রোল বানিয়ে রাখ। আমি আসতেছি।
আমার কথা শেষ হতেই সবুজ মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে যায়।
পকেটে মোবাইলের ভাইব্র্যান্ট টের পেয়ে বের করে দেখি শারমিনের কল। কী বলবো সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ফোনের কাঁপাকাঁপি শেষ হয়। শারমিন কি হল থেকে রওনা দিল কিনা, বুঝতে পারছি না। আমি শুক্রবারেও প্রেসক্লাবে এসেছি শুনলে ক্ষেপে যাবে নিশ্চিত। এরইমাঝে দ্বিতীয়বারের মতো ফোন কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে। শারমিন যে সপ্তাহের একটি দিন আমার সাথে কাটায় এটা শুরু হওয়ার প্রথমদিকের কথা মনে পড়ছে। একবার আমরা ঠিক করলাম দুজনে নিরিবিলি সময় কাটাবো। ঢাকার আশেপাশে কোথায় যাওয়া যায় তা ঠিক করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল। সেদিনও শুক্রবার সামনে রেখেই কথা হয়েছিল আমাদের।
আমি বলেছিলাম, তুমি আসো শুক্রবার।
না।
কেন?
তুমি যে বললা, মাইর দিবা!
আদরের মাইর।
মানে!
বুঝো নাই?
না।
সত্যি বুঝো নাই?
বলবো না।
তবে শুক্রবার আসবে না?
এখন বলতে পারছি না। শুক্রবার জানাবো।
এখনই বলতে হবে। প্ল্যান করতে হবে না!
যাব না আমি।
মানে কী! তুমি কথা দিয়েছ, শারমিন…
এখন ভয় দেখাচ্ছো, তাই আর যাব না।
হা হা হা।
হাসতেছো কেন?
তুমি কি বাচ্চা?
কেন? বাচ্চা হতে যাব কেন!
তাহলে ভয় পাও কেন?
পাবোই ভয়। বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো বজ্রপাতের সময় ভয় পেয়ে তোমার বুকে থাকবো।
হইছে আর বাচ্চামি করতে হবে না সোনা।
কেন! বাচ্চামি করলে সমস্যা কী? বুকে রাখতে চাও না? গার্লফ্রেন্ড পুরোনো হয়ে গেছে, না?
আরে ধুর! বাদ দাও।
আচ্ছা। বাদ দিলাম।
এবার সিরিয়াসলি ভাবো- শুক্রবার কোথায় যাওয়া যায়?
তুমি ভাবো।
আচ্ছা। গাজিপুর কেমন হয়? ওখানে সুন্দর রিসোর্ট আছে। সুইমিংপুল আছে। ট্রাভেল সাইটে দেখলাম। একদিনের জন্য আমরা যেতে পারি।
আমি ছুটি নিয়ে নিলাম দুই দিনের।
মাথা খারাপ তোমার! তুমি পাবা ছুটি?
এইভাবে সব আলোচনা আমার ছুটি হবে না-এখানে এসে শেষ হয়। শারমিনের সাথে গাজিপুরেও যাওয়া হয় না।
মনে মনে ঠিক করি, শারমিনের ফোন রিসিভ করবো না। এখানে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কাজ শেষ হলে বের হয়ে তারপরে ওকে কল করবো। অথবা হলের গেটের সামনে গিয়ে ফোন দিয়ে ওকে চমকে দিব। এইসব ভাবতে ভাবতে হলরুমের দিকে এগিয়ে যাই। বেশ কিছু লোকজন হয়েছে। হলরুম প্রায় ভরে এসেছে। মঞ্চের সামনে বাম পাশে কয়েকটা টিভি ক্যামেরাও দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে ট্রাইপডের উপর টিভি ক্যামেরার মাথা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে আমার ভালো লাগে। মঞ্চে যারা বসে থাকেন তারা বেশ ভারিক্কি মুখ করে ক্যামেরার সামনে চোখ দিয়ে রাখেন। আজকের মঞ্চটি খালি। কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে নাই। মঞ্চের পেছনে কেবল একটি ব্যানার। একপাশে ডায়াস।
এক তরুণ সামনে এগিয়ে এলো। চোখে চশমা, মাথার চুলগুলো পেছনের দিকে রাবার দিয়ে ঝুটি করা। বয়সটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না। তরুণটি হাত দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করল। তারপরে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে বলল- আমরা খুবই আনন্দিত, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আপনারা আমাদের আহ্বানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এখানে কোনো সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা করতে পারিনি। এ থেকেই আজকের বিরাজমান পরিস্থিতি আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন বলে আমরা আশাকরি। আমি আর বেশি কথা বলতে চাই না। আমাদের আজকের এই আয়োজনের নাম ‘মায়ের ডাক’ হলেও আসলে তা সন্তান, স্ত্রী, ভাই কিংবা বোনের ডাক হতে পরতো। মা কথাটির মধ্যে যে ভালোলাগা ও অধিকারের কথা আছে- তার আবেদন কখনও পুরোনো হবে না। তাই আমাদের এই আয়োজনের নাম মায়ের ডাক দেওয়া হয়েছে। নিচু গলায় কথা বলে তরুণটি নেমে যেতেই মনে হল, ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আবৃত্তি বা উচ্চারণ কর্মশালায় যেন ক্লাশ নিচ্ছে। এখনকার অল্প বয়েসী তরুণদের এমন সঠিক উচ্চারণে কথা বলতে খুব একটা দেখা যায় না।
প্রথমে একজন মধ্যবয়স্ক নারী দর্শক সারি থেকে সামনে চলে এলেন। কালো বোরকার সাথে আকাশি রঙের ছাপা ওড়না। হাতে একটি বাঁধাই করা ছবি। তিনি ডায়াসের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আর সামনে আগাতে পারলেন না। কথা শুরুর আগে একবার ওড়নাটা ঠিক করে নিলেন গলার কাছ দিয়ে। ছবির ফ্রেমটা বুকের কাছে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখলেন। তারপরে বলতে শুরু করলেন- আমার স্বামীর খোঁজ নাই আজকা চাইর মাস। তিনি খুবই নিরীহ লোক ছিলেন। কারও সাতে পাঁচে যাইতেন না। মিরপুরের পল্লবীর মুসলিম বাজারে বিরিয়ানির দোকান ছিল। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। শাশুড়িকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। বিরিয়ানির দোকানের আয়ে আমাদের সংসারে কুনো অভাব ছিল না। চাইর মাস আগে একবার এক মাদ্রাসা থেকে একটা বড় অর্ডার পাইছিল আমার স্বামী। এক হাজার মানুষের জন্য বিরিয়ানি সাপ্লাই দিতে অইবো। অর্ডারটা পাইয়া সে খুব খুশী অইছিল। কিন্তু এই খুশী আর তার কপালে বেশিদিন টিকল না। বিরিয়ানি অর্ডারের দশ দিনের মাথায় একদিন রাইতে দোকান বন্ধ কইরা বাসায় ফিরার আগে তারে একটা মাইক্রোবাসে করে কারা জানি তুইল্লা নিয়া গেল। সেই যে লোকটারে নিয়া গেল আর কুনো খবর কেউ দিতে পারলো না। মানুষের মুখে শুনছি, যে মাদ্রাসা বিরিয়ানি অর্ডার দিছিল, সেই মাদ্রাসার বড় হুজুররে নাকি গ্রেফতার কইরা নিছে। অহন আমি আমার স্বামীরে খুঁইজা পাইতে চাই। লোকটারে কই নিয়া গেল, কারা নিয়া গেল-কিছুই জানতে পারলাম না। আমার পোলাটা আগে স্কুলে যাইতো, অহন স্কুল ছাইড়া দিয়া বিরিয়ানির দোকানে বইছে কামাই করনের জন্যি। কামাই বন্ধ হইলে মুখে খাওন জুটবো কেমনে? বাসা ভাড়া দিমু কোনখান থিকা? ছোট মাইয়াটা বাপেরে দেখতে চায়। বাসা থেকে দোকানে যায়, আবার দোকান থেকে বাসায় আসে। বাপেরে কুনহানে খুঁজে পায় না। লোকটা বাঁইচা আছে না মইরা গেছে তা জবাব দিতে পারি না। আইজকা সকালে বাসা থিকা আহোনের সুম শাশুড়ি কয় বউ আমার পোলারে না দেইখা কি আমার মরণ অইবো? এই কথার কী উত্তর দিমু আমি? বলতে বলতে ওড়নায় মুখ চেপে ধরে সেখানেই বসে পড়েন। তরুণ চশমাওয়ালা ছেলেটি তাকে ধরে নিয়ে আবার দর্শক সাড়িতে বসিয়ে দেন।
এরপরে একজন অল্পবয়সী তরুণী উঠে এল। তার হাতেও একটি ছবি। তরুণীটি বলতে শুরু করে- আমার আব্বু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। তার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আব্বু খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। গত বছর পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা আয়োজন নিয়ে কয়েকজন ছাত্রের সংগে তার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা করলে ধর্ম অবমাননা করা হবে এমন যুক্তির বিরোধীতা করেছিলেন আব্বু। সেদিন বিকেলে মতিহার এলাকা থেকে আব্বুকে কারা যেন একটি কালো রঙের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেল। তারপরে গত একবছরেও আব্বুর আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। আমি এবছর অনার্স শেষ করেছি। আব্বু বলেছিলেন, আমাকে মাস্টার্স পড়াতে দেশের বাইরে পাঠাবেন। এখন আমার আম্মু আর ছোট ভাইকে রেখে আমি কীভাবে দেশের বাইরে যাব? আব্বু নিখোঁজ হওয়ার পরে আমরা আব্বুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। তারা বলল, চেষ্টা করছেন। এই এক বছরেও আমরা তাদের চেষ্টার রেজাল্ট পেলাম না। আমরা থানায় গেলাম। প্রথমে একটা সাধারণ ডায়েরি তারা নিতে চায়নি। পরে পুলিশ কমিশনারের কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে একটা সাধারণ ডায়রি হয়েছে। প্রথম তিন চার মাস থানা থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হত। ভরসা দিত, খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করতো। এখন আর থানা-পুলিশ কেউ কোনো খোঁজ রাখে না আমাদের।
আমার আব্বু বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়াতেন। একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী জি সি দেব ছিলেন আব্বুর প্রিয় শিক্ষক। আমাদের সাথে কথায় কথায় তার প্রিয় শিক্ষকের কথা বলতেন। এখন স্বাধীনতার এতোবছর পরেও আমরা আব্বুকে এভাবে হারাবো- এটা মেনে নিতেই কষ্ট হয়। একাত্তরে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিবারের তবুও একটা সান্তনা আছে। আমরা কী নিয়ে বাঁচবো। আমাদের সামনে কীসের আশা আছে? কথা শেষ করেই তরুণীটি সামনের দর্শক সাড়িতে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে এসে বসে। তার পাশের একজন পিঠে হাত রাখতেই কান্নার আওয়াজে হলরুম ভারী হয়ে ওঠে।
এরপরে এক শিশু উঠে এলো। ডায়াসের সামনে দিয়ে দাঁড়াল। শিশুটির গলায় এক নারীর ছবি ঝুলানো। শিশুটি বলতে শুরু করল-প্রতিদিন আম্মু ব্যাংকে যাওয়ার আগে আমাকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিয়ে যেত। বিকেলে ডে কেয়ার সেন্টার থেকে আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরতো। গত ছয় মাস আমি আমার আম্মুকে ছাড়াই স্কুলে যাই। আমার একা একা ড্রাইভার আংকেলের সঙ্গে স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। আমি আমার আম্মুর সাথে স্কুলে যেতে চাই। প্লিজ, আপনারা আমার আম্মুকে খুঁজে এনে দিন।
(চলবে….)