ধারাবাহিক উপন্যাস//নিখোঁজ মানুষের গান// এহসান মাহমুদ// এক

ভেবেছিলাম বাসা থেকে বের হব না। শুক্রবার সপ্তাহের একটা দিন ছুটি। সকালে পেপারওয়ালা যখন কলিংবেল বাজিয়ে ঘুম ভাঙালো, তখনই মেজাজটা খারাপ হয়েছিল। দরজার নিচ দিয়েই সবসময় পেপার রেখে যায় রেজাউল। ওর সাথে আমার দেখা হয় না। কিন্তু মাসে একদিন ওর সাথে দেখা করতে হয়। পেপার বিল নেওয়ার জন্য পাঁচ সাত তারিখের দিকে একবার ও দরজার বেল বাজায়। সেদিন শুক্রবার হোক আর সোমবার হোক- আমাকে বিছানা থেকে নামতে হয়।
আজকে রেজাউলকে বিলের টাকাটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে আবার বিছানায় আসতেই নিউজ এডিটরের মেসেজ- ‘মিট দ্য প্রেস অ্যাট ১০:৩০, প্রেসক্লাব’। এখন বাজে সাড়ে আটটা। নাহ! শালার চাকরি করে আর শান্তি নাই। শুক্রবারের দিনেও একটু শান্তিমতো ঘুমানো যাবে না। 
সকাল সকাল বন্ধের দিনেও বাসা থেকে বের হতে হবে। এদিকে দুপুরে শারমিনের আসার কথা। শারমিন গতকাল রাতেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পত্রিকার সেকেন্ড এডিশনের কাজ শেষ করে আমার বাসায় ফিরতে প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল। তাই শারমিনকে আসতে মানা করেছিলাম। শারমিন একবার বলছিল, আমার অফিসে চলে আসবে। সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত অফিসের রিসিপশনে ওকে বসে থাকতে হবে ভেবে আমি রাজি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো এখন যেন কেমন! রাত নয়টার পরে ছাত্রীদের প্রবেশ করা ও বের হওয়া বারণ। শারমিন সপ্তাহে একটা দিন ক্যাম্পাসের হল ছেড়ে পান্থপথে আমার বাসায় আসে। অবশ্য শারমিন বলে, আমাদের বাসা। 
দুই রুম আর ছোট একটা বারান্দার এই বাসা। শারমিন দোয়েল চত্বর থেকে একটা পাটের দোলনা কিনে এনেছে। বারান্দার রেলিঙের সঙ্গে সেটি ঝুলানো। আমি আর শারমিন মাঝরাতে ওখানে গিয়ে বসি। ওখানে বসলেই ওর চোখে মুখে স্বপ্ন খেলা করে। ওর মাস্টার্স শেষ হলে আমাদের বিয়ে হবে। ও একটা চাকরি করবে। ওর ডে অফের দিন সংসারের সব কাজ আমাকে করতে হবে, ও সেদিন আরাম করে ঘুমাবে-এমনসব শর্ত বানাতে থাকে। সাধারণত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে বা শুক্রবার সকালেই চলে আসে শারমিন। গত প্রায় দুই বছর ধরে এটা অলিখিত নিয়ম। 
তবে আমার সাথে ঝগড়া হলে তখন আসা বন্ধ থাকে কিছুদিন। আবার এক সপ্তাহ পরে ঠিকই এসে হাজির হয়। অবশ্য এর মাঝে আমাকে ওর হলের গেটে গিয়ে দুই তিন সন্ধ্যা বসে থাকতে হয় ফুটপাতে। ওর রাগ কমাতে একদিন দুইদিন কেটে যায়। ওই সময়টাতে হলের সামনের ফুটপাতে গাছের আড়ালে যেখানে ল্যাম্বপোস্টের আলো কম সেখানে আমি ওর হাত ধরে বসে থাকি। শারমিন কোনো কথা বলে না। মাঝেমাঝে আমার মুঠো থেকে হাত সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। নির্দিষ্ট বিরতিতে আমার পিঠের মধ্যে কিল-ঘুষি পড়তে থাকে। যেদিন ওর রাগ কমে আসবে সেদিন আমার কাধের সাথে নিজের মাথা আস্তে করে রাখবে। আমার মুখ ওর কপাল ছুঁয়ে গভীর ঘন চুলের মধ্যে ডুবে গেলে সোজা হয়ে বসবে। ওর চোখ ছোট হয়ে আসবে। নিঃশ্বাস বেড়ে যাবে। হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলবে- একটা রিকশা ঠিক করো। আমি আসতেছি। যাব আর আসবো। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে দাঁড়াবে। ঘড়ি ধরে ঠিক আট মিনিটের মাথায় এসে হাজির হবে। তখন ওর কাঁধে থাকবে ছোট নকশী কাপড়ের ব্যাগ। যেটা আমরা বাণিজ্যমেলা থেকে কিনেছিলাম। এর মধ্যে পরনের কামিজটাও বদলে যাবে। প্রথমদিকে ভেবে অবাক হতাম, এই আট মিনিটে হলের সিড়ি বেয়ে দোতলায় যাওয়া এবং ড্রেস পাল্টে নিচে আসা কীভাবে সম্ভব! শারমিন এলেই আমাদের রিকশা নিয়ে পান্থপথের দিকে রওনা হয়। ভিসি চত্বর, নীলক্ষেত, কাঁটাবন মার্কেট পেড়িয়ে দ্রুত রিকশা চলতে থাকে।
হাতিরপুল বাজারের দিকে জ্যামে রিকশা আটকে গেলেই শারমিন রাগে গজগজ করতে থাকে। ওর পাশে বসে তখন আমি একটা সিগারেট জ্বালাই। শারমিন চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। শারমিনের পাশে বসে সিগারেট ধরাবার এই একটি সুযোগ আমি কখনো হারাতে চাই না। অন্য সময় ওর সামনে সিগারেট ধরানোই যায় না। রিকশায় বসে বসে শারমিন ট্রাফিক পুলিশের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কাঁটাবন সিগনালে বসেই একদিন আমাকে বলল, শোনো একটা ভালো আইডিয়া পাইছি। আমি সিগনালের ওই পুলিশটার দিকে তাকিয়েই থাকবো, তাকিয়েই থাকবো। যদি একবার চোখাচোখি হয়ে যায় চোখ মেরে দিব। ইশারায় বলব, সিগন্যাল তুলে দিতে। সেদিন ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হওয়ার যোগার আমার।
এইভাবে কাঁঠালবাগানের ভাঙাচোড়া রাস্তা পেরিয়ে বাসায় ঢুকেই শারমিন প্রথমে ওয়াসরুমে যাবে। ওর ব্যাগ পরে থাকবে দরজার পাশে। আমার অফিসের শার্ট-প্যান্ট খোলার আগেই বেরিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। ওর ভেজা হাত মুখ আমার বুকে পিঠে ঘসতে ঘসতে আমার শার্টের বোতাম খোলা হয়ে যায়। যখন আমাদের দুজনের জড়াজড়ি ধরাধরি শেষ হয় তখন শারমিন চোখ বন্ধ হয়ে বাকা হয়ে শুয়ে থাকবে। শারমিনের এই শুয়ে থাকাটা আমার খুব পছন্দ। ওর গমের মতো ফর্সা পিঠের ওপর কোকড়ানো চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে নড়তে থাকবে। বাকা হয়ে থাকায় বুকের অংশটা নতুন চাঁদের মতো উঁকি দিয়ে থাকবে। শারমিনের পাশে শুয়ে আমি প্রায়দিনই ভাবি- আমি কি শারমিনের যোগ্য! শারমিনের কথা পরেও বলা যাবে। 
আজকে শুক্রবারের দিনেও আমাকে আসতে হল প্রেসক্লাবে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই কেন যে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম আজকাল সেটা আর ভেবে পাই না। বন্ধের দিন বলতে আর কিছু রইলো না। এক সরকারি হাসপাতালের কেনাকাটায় অনিয়ম নিয়ে একটা নিউজ করেছিলাম। সেই নিউজের পরে মোটামুটি একটা পরিচিতি পেয়েছিলাম। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস এবং রেল মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট করায় অল্পবিস্তর নামডাকও হয়েছে।
সাংবাদিকতা করে এইটুকু ছাড়া আর কোনো লাভ হয় নাই। পত্রিকায় কাজ করি বলে, লোকজন তেমন করে মুখ চিনে না। এই ভিডিও ব্লগের যুগে পত্রিকার সাংবাদিকতা করে কী হবে- বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের এমন কথায় আমি কোনো জবাব দিই না। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা, বিশেষকরে আম্মা যখন বলেন, একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে বিসিএসটাও হয়ে যেতে পারে। এতো অনিশ্চিত চাকরি কেন করি, এসব প্রশ্নের আসলে আমার কাছে কোনো উত্তর নেই। এখনও বয়স আছে সরকারি চাকরির- ছোট মামা প্রায়ই এটা মনে করিয়ে দেন। আমি তেমন উৎসাহ পাই না। 
নিউজ এডিটর রায়হান আরিফ ভাই আজকে সকালে যখন মেসেজ পাঠানোর পরে আবার ফোন করেছিলেন তখন থেকেই মেজাজ খারাপ। নাহ! শালার সাংবাদিকতা করে বন্ধের দিনেও একটু শান্তিতে থাকা যাবে না। প্রেসক্লাবের দোতলায় হলরুম ভর্তি বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। বেশ কয়েকজন শিশু রয়েছে। এই চার বছরের সাংবাদিকতায় অসংখ্য ‘মিট দ্য প্রেস’ কাভার করেছি। তাই অনুষ্ঠানের ধরণ দেখেই একটা ধারণা করতে পারি এখন। কতো যে সংগঠন রয়েছে দেশে! মানবাধিকার সংগঠনও আছে অন্তত হাজারটা। কোনটা আসল কোনটা ভেজাল, প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম না। দেখা যায় এনজিও, ছোট ছোট রাজনৈতিক দল নানা রকমের তথ্য উপস্থাপন করে। এসব অনুষ্ঠানে প্রায় একই রকম অভিযোগ থাকে সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, দেশটা নিয়ে কেবল তারাই ভাবেন। 
এখনও অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। শুরু হওয়ার আগে একবার ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরাবো চিন্তা করতে করতে হলরুম থেকে বাইরে বের হতেই রিনি আপার সঙ্গে দেখা। রিনি আপা আজকের খবরের চীফ রিপোর্টার। অসম্ভব সুন্দরী। এখনও বিয়ে করেননি। এমন সুন্দরী নারীর দেখা আমি জীবনে কম পেয়েছি। তাঁকে দেখে কখনও আমার উত্তেজনা হয়নি, কেমন সহজ ও সুন্দর তিনি। যতোবার দেখেছি, মনে হয়েছে সৌন্দর্য তাঁর সহজাত। বয়স অনুমাণ করতে পারি কেবল, চল্লিশ পেরিয়েছে হয়তো। সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার পনের বছরের মতো। এমন সুন্দরী নারীর বিয়ে না হওয়াটা নিয়ে প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে নানা মুখরোচক কথা শুনেছি শুরুর দিকে। আমিও আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম নতুন কিছু জানার আশায়। 
একবার আমরা একসঙ্গে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে অনেক সাংবাদিক গিয়েছিল সেইবার। আমাদের টিমে রিনি আপাও ছিলেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওই কক্সবাজার ট্রিপে গিয়েই আমি রিনি আপাকে কাছাকাছি জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। রিনি আপা এমনিতে খুব হাসিখুশী। বাইরে থেকে দেখে একদম বোঝা যায় না ভেতরে কতোটা কঠিন তিনি। 
একদিন বিকেলে হোটেলের রুম থেকে বের হচ্ছি, লিফটে রিনি আপার সঙ্গে দেখা। আপা হেসে জানতে চাইলেন, কোথায় যাচ্ছি?
সিগারেট শেষ হয়েছে, এটা বলা ঠিক হবে না ভেবে অবলীলায় মিথ্যা বলে দিলাম- ইনানী বিচে।
রিনি আপা চোখ বড়বড় করে তাকালেন, সত্যি! ইনানী?
এইবার আমি যেন সত্যিই ইনানী বিচে যাচ্ছিলাম তার পক্ষে যুক্তি বললাম, কলাতলী বিচে খুব লোকজন। ইনানীর দিকে লোকজন কম। নিরিবিলি। সন্ধ্যার সমুদ্রটা ওখান থেকে দেখতে চাই।
আমিও হোটেলে বোর হচ্ছিলাম। আমিও যাই তবে, কী বলো? রিনি আপা বললেন।
আমার জবাবের আগেই আবার বললেন, কী আমি সাথে থাকলে সমস্যা? বিশেষ কেউ আছে নাকি ওদিকে? হুম?
আমি দেখলাম রিনি আপার চোখে দুষ্টুমি। বললাম, না। এইখানে কই পাব?
বাহ! ভালো তো। এইখানে কই পাবো। রিনি আপা অমার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। তারমানে ঢাকায় আছে? আপার চোখে প্রশ্ন?
আমি মাথা ঝুলাই।
লিফট নিচে আসতেই আপা বললেন, চলো ইজিবাইকে করে যাই। 
হোটেলের সামনের রাস্তা থেকে দামাদামি করে একটা ইজিবাইক পাওয়া গেল। কলাতলী থেকে ইনানী সতের কিলোমিটারের দূরত্ব। হিমছড়িতে আমরা ডাব খেয়েছিলাম। সেখান থেকে আরো প্রায় পাঁচ কিলোমিটার গেলেই ইনানী বীচ। ইনানী বীচে প্রবাল পাথরের ছড়াছড়ি। অনেকটা সেন্টমার্টিনের মতই। রিনি আপা দেখেই বললেন, বাহ! ভালো করেছো কক্সবাজারে এসে তুমি সেন্টমার্টিনের ফিল দিয়েছ। 
ইনানী বিচটা আমার কাছে ভালো লাগে। কক্সবাজারের বিচের মত এখানে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে না সৈকতের বেলাভূমিতে। অনেকটাই শান্ত। জোয়ারের সময় এলে প্রবাল পাথরের দেখা পাওয়া যাবে না। ভাটার সময়েই কেবল বিশাল এলাকা জুড়ে ভেসে উঠে এই পাথর। পাথরে লেগে থাকে শামুক-ঝিনুক। ইনানী সৈকতের প্রধান আকর্ষণ প্রবাল পাথর। তাই ভাটার সময়ে এখানে আসা উচিৎ। 
আমার টানা কথা শুনে রিনি আপা বললেন- বাবা! খুব ভালো অবজারবেশন।
আমি বললাম, জি আপা সাংবাদিক বলে কথা।
সেদিন আমরা ইনানী থেকে ফিরেছিলাম সন্ধ্যার বেশ পরে। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময়। কথায় কথায় রিনি আপা বললেন, আমার বিষয়ে অনেক কৌতুহল তোমার, না?
আমি বললাম,  অনেকের কাছে নানা কিছু শুনেছি তো। তাই।
আমাকে যে বুঝতে পারে এমন মানুষ এখন আর আমার আশেপাশে কেউ নাই। গেল বছর মা মারা যাওয়ার পরে নিজের কথা বলার লোকও হারিয়ে গেছে আমার। রিনি আপা তাঁর কথা শুরু করলেন। রিনি আপার সব কথা শেষ হলে আমরা যখন হোটেলে ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম, তখন মনে হয়েছিল আমি আমার বড় বুবুর সাথে বিকেল বেলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। কোনো সন্দেহ নেই। অবিশ্বাস নেই। ভয় নেই। সেই থেকে রিনি আপাকে শুধু আপা ডাকি।     
অন্য সময়ে প্রেসক্লাবে এলে রিনি আপাকে ফোন করি। একসাথে চা সিঙ্গারা খাই। মাঝেমাঝে আপা বাসা থেকে নুডুলস, খিচুরি নিয়ে আসেন। আমরা ক্যান্টিনে বসে খাই।
শুক্রবার আমাকে প্রেসক্লাবে দেখেই রিনি আপা চোখ টিপে হাসলেন। আহারে ভাইটি, শুক্রবারও সাংবাদিকতা করতে হচ্ছে। কোনো ছুটি নাই। আমি রিনি আপার কাছে যেতেই আপা আমাকে ইশারা করে পাশে ডাকলেন। আপার এই ইশারার মানে আমি বুঝি। আমাকে সাবধানে থাকতে বলছেন। আমি আপাকে নিয়ে ছাদের দিকে যাই। ছাদের আরেক পাশে দৈনিক বার্তার মিঠু ভাই, সমকালের রাজীব ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। তারাও ফিসফাস করে কিছু আলাপ করছেন। 
রিনি আপা বললেন, শোন, পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। আয়োজকরা পুরো অনুষ্ঠানটা চালিয়ে নিতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। এরমাঝে খবর এসেছে আয়োজকদের একজনকে পল্টন মোড় থেকে মাইক্রোবাসে করে কারা যেন তুলে নিয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে। তারপর থেকে তার ফোনও বন্ধ। গতকাল অ্যামেনিস্টি ইন্টারন্যাশনাল আমাদের দেশের সম্প্রতি দুই ছাত্র নেতার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে যে বিবৃতি পত্রিকাগুলো ছেপেছে এসব নিয়েও ঝামেলা হচ্ছে। কেন অ্যামেনিস্টির উদ্বেগের খবর প্রকাশ হয়েছে-এটা জানতে চাওয়া হচ্ছে। অফিস থেকে ফোন এসেছিল, এডিটর আমান ভাই বলেছেন, আজকের অনুষ্ঠানটি ঠা-াভাবে কাভার করতে। আয়োজকদের কাছে কোনো প্রশ্ন করতে নিষেধ করছেন। চারিদিকে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটু সাবধানে চোখ-কান খোলা রাখিস। কথা শেষ করেই রিনি আপা হলরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। 
প্রেসক্লাবে এসে আগে কখনো এমন চাপা উত্তেজনা দেখি নাই। চারিদিকে কেমন দমবন্ধ অবস্থা। এর আগে একবার বিরোধীদলের হরতালের সময়ে প্রেসক্লাবের মধ্যে আটকা পড়েছিলাম প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। পল্টন মোড়ে দুটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল হরতাল সমর্থকেরা। পরে সাজোয়া গাড়ি, অগ্নিনির্বাপক গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনে পুরো এলাকা রণক্ষেত্র হয়েছিল। হরতাল সমর্থকদের একটি দল পুলিশের ধাওয়া খেয়ে প্রেসক্লাবে ঢুকে পড়েছিল। পুলিশও লাঠি টিয়ারশেল নিয়ে প্রেসক্লাবে ঢুকে পড়েছিল। পুরো ক্লাব অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আজকে কোনো লাঠিচার্জ নাই। টিয়ারশেল নাই। তবুও একটা ভয়ে চারিদিক চুপ হয়ে আছে।

সিগারেট না ধরিয়েই আবার ছাদ থেকে বের হয়ে আসি। হলরুমের দিকে এগিয়ে যাই। ভেতরে ঢুকেই সামনে ডায়াসের দিকে চোখ রাখি। একটা সাদা ব্যানার। তার মাঝে কালো রঙে বড় করে লেখা- মায়ের ডাক। আর কিছু না।  মুহূর্তেই পুরো ব্যানারটা জেগে উঠল। অজস্র মায়ের মুখ সেখানে আঁকা হয়ে গেছে। সব মা তাঁর সন্তানকে ডাকছে। 

(চলবে)

Series Navigationউপন্যাস।। নিখোঁজ মানুষের গান।। এহসান মাহমুদ।। পর্ব দুই >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *