উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস /আমাদের আগুনবিহীন কাল /জাকির তালুকদার /চতুর্থ পর্ব

আউটডোরে যথারীতি প্রচণ্ড ভিড়। সকাল ঠিক ঠিক ৯টায় রোগী দেখতে শুরু করেছে ইমরুল। বারোটা বেজে গেলেও ভিড় তেমন কমেনি। সকাল এগারোটায় টিএইচও-র রুমে হালকা রিফ্রেশমেন্টের সিস্টেম আছে। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট, ডালপুরি কিংবা শিঙাড়া। এই সময়টাতে সারাদিনের কর্মপন্থাও ঠিক করে নেওয়া হয়। বিভিন্ন মিটিংয়ে যোগ দিতে হয় খলিল সাহেবকে। তাই তিনি এই সময়টাতেই সবাইকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে বেরিয়ে যান। আজ তেমনভাবে বসতে পারেনি ইমরুল। একটা বিস্কুট মুখে গুঁজে চায়ের কাপে দুই চুমুক দিয়েই উঠে পড়েছে। সেলিম ভাই এবং গাইনির ঝরনা আপা হাসে মুখ টিপে। রোগীর জন্য ইমরুলের ঝটপটপনি দেখে হাসে। কয়েকদিন পরে দেখা যাবে তাদের মতো ইমরুলও রোগীদের সংখ্যা দেখে বিরক্তি প্রকাশ করছে, চেম্বার খুলে বসছে বিকেলে, ফরদু মিয়াকে দিয়ে রোগীদের বলাচ্ছে যে এখানে কী ভালো করে রোগী দেখা যায়? ভালো চিকিৎসা পেতে হলে তারা বিকেলে আসুক তার প্রাইভেট চেম্বারে। সেখানে ভালোভাবে রোগী দেখা হয়, ভালো ব্যবহার করা হয়, ভালো ওষুধ লেখা হয়।

সেলিম ভাই অবশ্যি বলে- আমি যতদূর জানি ইমরুল অসম্ভব ধনী পরিবারের সন্তান। টাকার জন্য কোনো চাপ নাই ওর।

ঝরনা আপা বলে- আরে রাখেন তো সেলিম ভাই! আমরা কি ভিখারি পরিবারের সন্তান? কিন্তু পেশা হচ্ছে পেশা। পেশাদার হয়ে গেলে তখন আর অন্য কোনো পথ থাকে না। টাকার দরকার থাকুক আর না থাকুক, তখন জীবন সেইভাবেই সাইজ হয়ে যায়। ইমরুলও সাইজ হয়ে যাবে।

এসব কথা শোনার সময় নেই ইমরুলের। সে রোগী সামলাতে ব্যস্ত। সেই সময় পর্দা ঠেলে ঢোকে তিন যুবক। তাদের দেখে একটু তটস্থ হয়ে ওঠে ফরদু মিয়া। তাড়াতাড়ি করে ইমরুলের সামনের চেয়ারগুলো মুছতে থাকে। মুখে বলে আসেন বাবারা আসেন!

তিনজনের মধ্যে একজনের পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। বাকি দু’জনের পরনে জিনস এবং চক্রাবক্রা গেঞ্জি। একনজর দেখেই আঁচ করে নেয় ইমরুল। এরা এই উপজেলার কেষ্টুবিষ্টু যুবক। মনের মধ্যে কাঠিন্য তৈরি হয়ে যায় আপনাতেই।

জিনস পরা একজন মুখ খোলে- ভাই কলো নতুন ডাক্তার আইছে, চল তার সাথে একটু আলাপ পরিচয় করে আসি।

খুব ভালো করিছেন। ফরদু মিয়া তড়বড় করে বলে নতুন ডাক্তার ছার নিজেই যাবেন বলিছিল, কিন্তু এত রুগী! ছার তো টাইমই পায় না।

পরিচয় পর্বে জানা যায় পাজামা-পাঞ্জাবি হচ্ছে সরকারি দলের যুব সংগঠনের উপজেলা প্রেসিডেন্ট। সে বেশ বিনয়ের সাথে ইমরুলকে জিজ্ঞেস করে এখানে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না।

নাহ। তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
যুব-সভাপতি জানায়- তার আরও আগে আসা উচিত ছিল। এলাকায় কোনো সম্মানিত ব্যক্তি বা কর্মকর্তা এলে তার তো দায়িত্ব হয়ে পড়ে তার সুবিধা-অসুবিধা দেখা। কিন্তু এত চাপ! এমপি সায়েব এলাকায় আসেন কম। তার হয়ে প্রায় সবকিছুই দেখাশোনা করতে হয় যুবনেতাকে।

ইমরুল উসখুস করছিল। বাইরে রোগীরা অপেক্ষা করছে। সে চায় নেতারা তাড়াতাড়ি চলে যাক। সেই কারণে ফরদু মিয়াকে চা জোগাড়ের কথাও বলেনি সে। কিন্তু নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে পুরো সবক না দিয়ে উঠবে না যুবনেতা।

অবশেষে আসল কথাটা আসে- বুঝেনই তো ডাক্তার সায়েব, সারাদিন পাবলিকের কাম করে বেড়াই, আমার সংসার কীভাবে চলে? চান্দাবাজি তো করতে পারি না। তেমন বংশের ছাওয়াল আমি না। তাছাড়া এই যে এত এত লোকের কাম করে দি, কেউ কুনোদিন বলতে পারবে না যে একটাকা ঘুষ দিতে হইছে আমাক। কিন্তু আমার সংসার তো চালাতে হবি। তাই একখান ছোটোমোটা প্যাথলজি দিছি। ডায়াগনস্টিক সেন্টার আরকি। সেইডা তো আর আপনাদের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। তা খলিল ভাই প্রতিদিন দশখান রোগী পাঠায়। অন্য ডাক্তাররাও পাঁচ-দশখান করে কেস পাঠায়। আমি শুনলাম এখন হাসপাতালে আপনেই সবচায়ে বেশি রোগী দ্যাখেন। তা ভাই আমাক যে খানিক হেল্প করা লাগে।

এইসব লোক যে বিনা উদ্দেশ্যে এক ধাপও নড়ে না ইমরুল তা জানে। তার কাছে আসার পেছনের ধান্ধাটা জানা হয়ে গেলে বলে- ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব। আসলে রোগীকে পরীক্ষা করতে পাঠাব কী, এরা এতই গরিব যে, বাইরে থেকে ওষুধ কেনার দরকার হলে সেটাই কিনতে পারে না।

হেসে ওঠে যুবনেতা। বলে- আপনে তো গাঁয়ের মানুষেক চিনেন না! এরা হচ্ছে সদকা খাওয়ার যম। যদি বুঝতে পারে যে আপনে নরম মানুষ, আপনের সামনে খালি নাকে কাঁদবি। আপনে যদি কন যে পরীক্ষা করাই লাগবি, তখন দেখবেন যে সুড় সুড় করে প্যাথলজির দিক হাঁটতিছে।

এখনকার মতো ঝামেলা দূর করার জন্য ইমরুল বলে- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখব।

তা তো দেখবেনই। আমিও আপনেক দেখব। দেখব যাতে আপনের কুনো অসুবিধা না হয়।

ওরা বেরিয়ে গেলে ইমরুল বলে ফরদু মিয়াকে- তাড়াতাড়ি রোগী পাঠান!

ফরদু মিয়া যেন কিছু বলতে চায়। তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় ইমরুল।

ফরদু আমতা আমতা করে বলে- না মানে ছার, এরা সব মানুষেক বিপদে ফেলা মানুষ। একটু বোঝ-বুঝ দিয়া চলতে হয়। আপনে তাদেক ঠিকমতো সনমান করলেন না, চা-ও দিলেন না, এই নিয়া ঝামেলা হতে পারে ছার।

মাথাটা গরম হয়ে ওঠে ইমরুলের- সেটা আপনার ভাবনার বিষয় না। আপনি রোগী পাঠান।

ভেবেছিল গরম মাথা নিয়ে রোগী দেখা কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু রোগী সামনে এসে বসতেই একটু আগের তিতকুটে স্মৃতি মুহূর্তেই উবে যায় ইমরুলের মন থেকে।

Series Navigation<< ধারাবাহিক উপন্যাস / আমাদের আগুনবিহীন কাল / জাকির তালুকদার / তৃতীয় পর্বধারাবাহিক উপন্যাস // আমাদের আগুনবিহীন কাল // জাকির তালুকদার // পঞ্চম পর্ব >>

One thought on “ধারাবাহিক উপন্যাস /আমাদের আগুনবিহীন কাল /জাকির তালুকদার /চতুর্থ পর্ব

  • আনোয়ার রশীদ সাগর

    সহজ-সরল ভাষায় ঝরঝর করে বলে যাওয়া বাক্যগুলো পড়তে ভালোই লাগছে।অপেক্ষায় থাকছি।ধন্যবাদ জাকির ভাই।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *