উপন্যাস

কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব সাত

৭.

রাত এগারটা। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানায় এপাশ—ওপাশ করছি। সন্ধ্যায় ওই পাগলটার উধাও হবার ঘটনার পর থেকেই বুকের ভেতরে যেন একটা টেনিস বল ধীর গতিতে ড্রপ খাচ্ছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে একটা জলজ্যান্ত মানুষের উধাও হয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা।
আমার ঘরের জানালাটা বন্ধ। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কুয়াশা পড়ছে হালকা। জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কেন যেন মনে হচ্ছে ঠিকমতো বোধ হয় লাগানো হয়নি। বারবার চোখ শুধু ওই জানালার দিকে চলে যাচ্ছে। একটু একটু ভয়ও করছে। ভয়টা কিসের বুঝতে পারছিনা। ওই পাগলটার হঠাৎ উধাও হবার সঙ্গে ভয়টার সম্পৃক্ততা বুঝতে পারছি। কখনো ভূতের ভয় হয়নি। কিন্তু আজ কেন জানি অদৃশ্য একটা কিছুকে ভয় ভয় ঠেকছে।
আবুকে আমার ঘরে এনে রাখব? ভাবতে থাকি। এই শীতের রাতে পাকঘরে গিয়ে আবুকে ডেকে আনতেও ইচ্ছে করছে না। লেপের নিচে যে ওম ওম ভাবটা সেটা কেটে যাবে উঠলেই। কিন্তু ভয়টা ক্রমশই যেন বাড়ছে।
না, আবুকে ডাকা দরকার–ভেবে উঠে পড়ি। দরজা খুলতে যাব তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার দৃশ্য─পাগলটা ডান দিকের গলিতে নেমে পড়ল ফুটপাত থেকে। আমরা দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দেখলাম সেই গলিটা শূন্য। কোনো মানুষ নেই। একটা কুকুর ধুলাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
দরজা খোলার সাহস যেন হারিয়ে ফেললাম নিমিষেই। পিঠটা দরজার দিকে রেখে বিছানায় তাকালাম। লেপটা কিরকম এলোমোলোভাবে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন লেপের নিচে দু’হাঁটু উঁচু করে শুয়ে আছে। আমার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে ওঠে। ভাইয়াকে কি ডাক দেব? ভাবতে থাকি। জানালাটা খুলে নিশ্চয়ই দেখব ভাইয়ার ঘরে বাতি জ্বালানো। ভাইয়া পড়ছে। আস্তে ডাক দিলেই শুনতে পাবে।
দরজার কাছ থেকে বিছানায় উঠে জানালাটা খুলে ফেলি সাহস করে। ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করেই জানালাটা লাগিয়ে দেই। ভাইয়ার ঘরের দরজার খোলার শব্দ হল। খানিকবাদেই আমার জানালায় এসে ভাইয়া বলল, লিন্টু কি হয়েছে রে?
আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছি। কিছু বলতে পারছি না। ভাইয়া আবার বলল, লিন্টু কি হয়েছে?
আমি জানালাটা খুলে বলি, ভাইয়া ভেতরে আসবে একটু?
কেন কি হয়েছে?
আসো আগে─বলেই আমি জানালার কাছ থেকে দরজার সামনে চলে যাই। দরজাটা খুলে মাথাটা বের করে বলি, জলদি আস?
ভাইয়া ঘরে ঢোকার পর ঘরের চারদিকটা একবার ভাল করে তাকাল। তারপর বলল, তুই কি ভয়টয় পাচ্ছিস?
আমি কোনো কথা বলি না। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না।
কিরে চুপ করে আছিস কেন?
ভাইয়া ভয় করছে─বলেই ফেললাম আস্তে করে।
ভয়টা কেন?
এমনি─এছাড়া আর কি বলব? আসল কথাটাতো কাউকে বলা যাবে না─কারণ যে কাজটা আমরা চারজন ইদানীং শুরু করছি সেটা কাউকে বলব না সেরকম প্রতিজ্ঞা করেছি।
তুই ভূতটূত ভেবে ভয় পাসনি তো? ভাইয়া আমাকে বলল।
ভাইয়া, একা একা খুব ভয় করছে।
এতদিন তো ভয় পাসনি। নীনাকে আমরা ক’দিন আগেও খেপালাম ভয় পায় বলে আর আজ তুই বলছিস ভয় লাগছে।
ভাইয়া আবুকে আমার ঘরে থাকতে বল না, বললাম।
তা না হয় বললাম. কিন্তু কেন ভয় পাচ্ছিস সেটা আমাকে জানতে হবে না? তুইতো ভূতটূত ভয় পাস না। স্বপ্নটপ্ন দেখিসনিতো আবার?
না ভাইয়া তুমি আবুকে আমার ঘরে নিয়ে এসো এখানে এই মেঝেতে ঘুমাবে আবু।
ভাইয়া আমার দিকে বেশ অনেকক্ষণ রহস্যময় চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খানিকবাদে আবুকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। আবু একটা মোটা কাঁথা গায় পেঁচিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, ছোট মামা ভয় পাইছেন?
হ্যা. তোর ছোট মামা নীনার চেয়ে ভিতুর ডিম আগে বুঝিনি─তুই তোর বিছানাপত্র পাকঘর থেকে নিয়ে আয় আবু। আজ থেকে তুই এখানে ঘুমাবি, বলেই ভাইয়া চলে গেল।
আবু কোনো কথা না বলে চুপচাপ ওর বিছানাপত্র এক এক করে পাকঘর থেকে এনে বলল, দরজা লাগামু?
আমি মুখে কিছু না বলে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম।
আবু দরজাটা লাগিয়ে দিল। আমি আমার বিছানায় লেপ গায়ে দিয়ে বসলাম। আবুও ওর বিছানায় বসে আছে। খানিকক্ষণ পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি কিছু বলছি না দেখে আবুও কিছু বলছে না।
সময় গড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবু বলল, ছোট মামা হেই বুড়া ভূতটা আইছিল?
আমি কি বলব ভেবে পাই না–বুড়া ভূতের কথা আমি কদিন আগে আবুকে দুষ্টুমি করে বলেছিলাম আর আজ আমাকেই সেই বুড়া ভূতের কথা জিজ্ঞেস করছে।

আপনেরে কি ভয় দেখাইছে ? আবুর দ্বিতীয় প্রশ্ন।
না, আমি বললাম।
তাইলে আমারে আপনের ঘরে আইতে কইলেন কেন্?
তোর যদি ভয়─টয় করে সে জন্য—বুদ্ধি করে বললাম।
আমার ভয় করে না─একদিন আইছিল আমি ভয় পাই নাই।
কে এসেছিল। আবুকে জিজ্ঞেস করি।
বুড়া মিয়া─আবুর বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর।
কোন বুড়া মিয়া? বললাম।
আপনে যার কথা কইছিলেন।
তোকে কি বলল এসে?
আবু মিয়া কেমন আছো?
বুঝলাম, আবু ওর গল্পের ঝুলি খুলে বসল সুযোগ পেয়ে─তবে এই রাতেরবেলা খারাপ লাগবে না শুনতে, তাই আমিও এগিয়ে যেতে সাহায্য করি। অন্তত আমার ভয়টা আপাতত দূর হোক─বললাম, তুই কি বললি?
ভালা নাই।
বুড়া মিয়া কি বলল?
আমার কাছে একটু তরকারি চাইল। আমি ইলিশ মাছের তরকারি দিলাম মিটসেফ খুইলা─আবুর গল্পের রেল বেশ দ্রুত গতিতেই ছুটছে।
আবু তোর ঘুম পাচ্ছে? বললাম আমি।
না ছোট মামা ঘুম গেছে গা।
আমারও ঘুম পাচ্ছে না।
তাইলে তো ভালাই, আহেন কেরাম খেলি।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে, এই রাত দুপুরে কেরাম খেলব─তারচে বরং তুই ওই বুড়া মিয়ার গল্প বল─আমি শুনি।
আইচ্ছা─বলেই আবু বসা থেকে শুয়ে পড়ে গল্প শুরু করে…..

Series Navigation<< কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব ছয়কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব আট >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *